Home   |   About   |   Terms   |   Library   |   Contact    
A platform for writers

যে দিন গেছে চলে

Bengali Story

All Bengali Stories    81    82    83    84    85    86    87    88    89    (90)     91    92   

-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ আমাদের এই ওয়েবসাইট ( RiyaButu.com )-এ প্রকাশিত গল্পগুলির মধ্যে থেকে কিছু গল্প নিয়ে এবছরই প্রকাশিত হবে আমাদের 'রিয়াবুটু'র গল্প'।
--------------------------



যে দিন গেছে চলে ( পর্ব ৩)

লেখিকা - শ্রীপর্ণা দে, দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০৬
( লেখিকা পরিচিতি: প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে একটি কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। লেখিকার বিভিন্ন লেখা দেশ, উনিশ কুড়ি, গৃহশোভা, কথাসাহিত্য, প্রসাদ, নন্দন, উদিতা এবং আরও অনেক লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। )

অন্য পর্বঃ পর্ব ১    পর্ব ২   

◕ পর্ব ৩

সুজিতবাবু কলেজ থেকে ফিরে চায়ের কাপে সবে চুমুক দিয়েছেন। সমাদৃতা বাবার কাছে গিয়ে বলল, "বাবা, এই মেসেজগুলো তুমি দেখেছো?"

সুজিতবাবু মেসেজগুলো দেখে অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, "এটা তো আমার পুরনো ফোন। কোথায় পেলি?"

অজন্তা কড়া গলায় বললেন, "তোমার চুপ করে থাকার কোনও কারণ নেই। মেসেজগুলো তোমাকে কে পাঠিয়েছে সেটা পরিষ্কার। সে তোমাকে ‘তুমি’ সম্বোধনে লেখে কোন সাহসে!"

সুজিতবাবু ঠাণ্ডা গলায় বললেন, "দেখো আমি ফোনের ব্যাপারে কম বুঝি। চার মাস হয়ে গেছে আমি এই ফোনটা ব্যবহার করছি না। আমি নিজে এখনো ম্যাসেজ পাঠাতে পারি না।"

সুজিতবাবুকে সমাদৃতা বলল, "বাবা, তোমার ফোনে কেউ একজন মেসেজ পাঠিয়েছে, সেগুলো ইনবক্সে রয়ে গেছে অথচ তুমি সেই ব্যাপারে কিছু জানো না! অথচ দিনরাত আমাদের বলো ফোনে আজকাল সবকিছু ডকুমেন্ট থাকে। এখন ফোন চেক করে অপরাধী ধরা সহজ হয়েছে। সচেতনভাবে ফোন ব্যবহার করা উচিত।"

সুজিতবাবু বললেন, "তোদের যদি মেসেজ নিয়ে জিজ্ঞাসার কিছু থাকে তাহলে আমি ইরাকে জিজ্ঞাসা করব এগুলোর ব্যাপারে।"

নীল বলল, "আমার তো একটাই প্রশ্ন যে, কোন ছাত্রী স্যারকে এই ধরনের মেসেজ পাঠায়! আর তাছাড়া ইরা প্রতিদিন আমাদের বাড়ি আসেই বা কেন! আমি তো তোমাকে তিন বছর আগেই ইরাকে বিয়ে করব না বলে দিয়েছি। এখনও ওকে এত প্রশ্রয় দেবার কি আছে!"

সুজিতবাবু নিরুত্তর থাকলেন। অজন্তা বললেন, "তোর বাবা তো প্রশ্রয় দেয় বটেই। নাহলে ওই বাইরের মেয়ে আমার আলমারিতে জামা রেখে যায় কি করে! আমি থাকা সত্ত্বেও ওই মেয়েকে নিয়ে জিনিসপত্র কিনতে বিগ বাজার গিয়েছিল। আমি পাগল কিনা, আমাকে নিয়ে এখন তোর বাবার পথ চলতে অপমান বোধ হয়। সারাদিন ফোনে স্যারকে কি পাখি-পড়া পড়ায় কে জানে! আমাদের থেকে এখন তোর বাবার কাছে ওই মেয়ে আপন হলো।" অজন্তা কথাগুলো বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন। সমাদৃতা বুঝতে পারল কোথাও একটা বাবার প্রতি চাপা অভিমান থেকে মা আজ এই কথাগুলো বলছে।

সমাদৃতা বরাবর ছোট থেকেই রাগী, জেদি। তার ঠাকুমা প্রায়ই সুজিতবাবুকে বলতেন, "তোর মেয়ের রাগ পুরো তোর বাবার মতো। সমাদৃতা তোর বাবার মতোই রাগী আর জেদি হয়েছে।" নিজে মেয়ে হয়ে মায়ের চোখের জল দেখে সমাদৃতা রুক্ষ গলায় বলল, "তুমি মেয়েটাকে কি জবাব দিয়েছো? ভাই তো ওকে বিয়ে করবে না। এই জেদ আমাদের রক্তের দোষ বাবা। তোমার এই জেদের ফলে কতটা সংসারের ক্ষতি হচ্ছে ভেবে দেখেছো একবারও, অথবা ভাববার প্রয়োজন মনে করেছো! আমাদের সম্পর্কগুলো কোথায় দাঁড়িয়েছে আজ! তুমি মেয়েটাকে বাড়িতে আসতে এন্টারটেইন করছো। তাই ও আসছে। এতে কার ভালো হচ্ছে? মা এতে অসন্তুষ্ট হচ্ছে তাতে তোমার কিছু মনে হচ্ছে না! আর প্রশ্রয় দিও না। প্রত্যেক মানুষেরই ভুল হয়। মানুষই তা সংশোধন করে। কেউ জোর করে দাবি করতে পারে না তার জীবনে কোনও ভুল নেই। তোমার একটা ভুল হয়েছে কারো সঙ্গে কোনও পরামর্শ না করে মেয়েটাকে কথা দেওয়া। সবার কথা বাদই দিলাম। মাকে তো একবার জানাতে পারতে সিদ্ধান্ত নেবার আগে। ছেলেটা তো শুধু তোমার একার নয়, মায়েরও।"

সমাদৃতার মুখ থেকে এসব কথা শুনে সুজিতবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কোথায় গেলেন তিনি কিছু বলে গেলেন না। প্রায় ঘণ্টা-খানেক পরে ফিরে এসে তিনি অজন্তাকে বললেন, "এমন শিক্ষাই আমি দিয়েছি যে আমার মেয়ে আমাকে অপমান করে। চরিত্রে কলঙ্ক লেপে দেয় আমার সন্তান! আমি মেয়েটাকে এন্টারটেইন করেছি! আজ আমার আর এই বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করে না। মেয়েটা সন্তানসম্ভবা বলে ফিরে এলাম।"

সমাদৃতা উচ্চৈঃস্বরে বলল, "বাবা, তোমার ভালো চেয়ে কথাগুলো বলেছি। আজ যদি তুমি জানতে পারো তোমার ছেলেমেয়ের জীবনে কোনও বিপদ আসতে চলেছে তাহলে তুমি তা আটকানোর চেষ্টা করবে না অথবা সাবধান করবে না। আর তুমি ভালো করে জানো ‘এন্টারটেইন’ কথাটা কোনও কলঙ্ক লেপন করতে বলিনি। তুমি যদি জোর গলায় বলো তাহলে আমার কিছু করার নেই। ঈশ্বর জানেন, চিরকাল তোমাকে কোন চোখে আমি দেখি।" সে কথা শেষ করে কাঁদতে-কাঁদতে অন্য ঘরে চলে এলো। নীল দিদিকে বলল, "দিদি, কাঁদিস না। তোর বাচ্চার ক্ষতি হবে। এই সময় হাসিখুশি থাকতে হয়।" সমাদৃতা অভিমানী গলায় বলল, "যাদের আমাকে নিয়ে ভাবার কথা তারা কি একবারও ভেবেছে! শুধু যে যার নিজের মতো পরের মেয়েকে নিয়ে ঘরে অশান্তি সৃষ্টি করছে। খাওয়া পড়ার অভাব নেই তো, তাই কোনও কিছুকে কেন্দ্র করে ঝামেলা করতে হবে। সুখ কপালে না থাকলে সুখ ভোগ করা যায় নাকি!"

বাবার বাড়িতে ছ'দিন সমাদৃতার অশান্তির মধ্যেই কেটে গেল। সুজিতবাবু সেদিনের পর সমাদৃতার সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ করলেন। সমাদৃতাও নিশ্চিতভাবে কোনও অন্যায় করেনি জেনে বাবার কাছে মাথা নত করল না। বিনা বাক্যালাপেই কেটে গেল বিষণ্ণ দিনগুলো। সমাদৃতার মানসিক অবস্থা স্থিতিশীল নয় জেনেও অজন্তা তাকে বলল, "বাবার খাচ্ছিস,পড়ছিস। বাবার বাড়িতেই বসে আছিস। আবার সেই বাবার সঙ্গেই কথা বন্ধ করেছিস। এই তো শিক্ষার পরিচয়? এই নাহলে উচ্চশিক্ষিত মেয়ে?" মায়ের কথা শুনে সমাদৃতার চোখে জল এলো। সে কোনও প্রতিবাদ না করে তার স্বামীকে ফোন করে বলল যে আর এখানে থাকতে ভালো লাগছে না, সে এসে কাল যেন তাকে নিয়ে যায়।

পরের দিন দুপুরে সমাদৃতার যাওয়ার সময় হলো। সুজিতবাবু কলেজ যাবার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন। পাঁচ মিনিট পরে ফিরে এসে সমাদৃতাকে ডেকে বললেন, "আজ চলে যাবি নাকি?"

সমাদৃতা সংক্ষেপে উত্তর দিলো, "হ্যাঁ।"

সুজিতবাবু একটা পাঁচশো টাকার নোট পকেট থেকে বের করে বললেন, "রাখ এটা।"

সমাদৃতা বলল, "আমার লাগবে না। তোমার কাছে রাখো। দরকার হলে তুমিই তো দেবে।"

সমাদৃতার কথায় সুজিতবাবুর মুখটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। সমাদৃতা হঠাৎ বাবকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে-কাঁদতে বলল, "বাবা, তোমার সত্যিই মনে হয় তোমার মেয়ে তোমাকে ছোট করতে পারে? নিজের বাবাকে অপমান করতে পারে? আমি ‘এন্টারটেইন’ কথাটা বলেছি ঠিকই। কিন্তু কোনও কিছু খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে বলিনি।"

সুজিতবাবুর চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। মেয়ের কাছে বিদায় নিয়ে বলল, "আসছি আমি। দেরি হয়ে যাচ্ছে।"

সমাদৃতাও স্বামীর সঙ্গে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে এলো। নীলও চাকরি নিয়ে সাউথ আফ্রিকা চলে গেছে। দেখতে-দেখতে কয়েক মাস কেটে গেল। সমাদৃতাও সন্তানের জন্ম দিলো। সে সদ্যজাত সন্তানকে নিয়ে ছ'টা মাস বাবার বাড়িতে ভালো -মন্দে কাটাচ্ছিল। তার শরীর অল্পেই কাহিল হয়ে পড়ত সন্তানের দেখভাল করতে গিয়ে। অপারেশনের পর তার শরীর যেন আরও কমজোরি লাগে। সন্তানকে বড় করার কঠিন লড়াইয়ে সে নেমেছে। সুজিতবাবু কাজের অবসরে সমাদৃতাকে সাহায্য করছিলেন। সমাদৃতার স্বামী সপ্তাহ শেষে দেখা করে যাচ্ছিল। প্রথমদিকে এক সপ্তাহ কাজের ছুটি নিয়ে স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে সময় কাটিয়েছে। এই অবস্থায় সমাদৃতার মা থেকেও নেই। যেই সময়ে একটা মেয়ের মাকে প্রয়োজন সবথেকে বেশি সেই সময়ে অজন্তা নিজের সঙ্গে সমাদৃতার তুলনা দিয়ে বলেছেন, "আমার কাছে কটা লোক ছিল! আমি তো দুটো ছেলেমেয়েকে একাই মানুষ করেছি। তুইও করবি। আমি সাহায্য করতে পারব না। আমি ওই বাচ্চা দেখাশোনা করার জন্য লোক রাখতে পারব না। আমাকে আবার জামাই বোঝাতে এলো তার বউয়ের কষ্ট হচ্ছে; আমি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছি কাজের লোক রাখতে হয় তার বাড়িতে গিয়ে রাখুক। আমার বংশের ছেলে নাকি যে আমি সবটা করব। আমি আমার বাড়িতে কোনও লোক রাখতে দেব না।" সমাদৃতাও মায়ের মুখে এসব কথা শুনে মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। সেও মায়ের কথার প্রত্যুতরে বলল, "ঠিক আছে মা। আমি কোনও লোক চাই না। আমি যেমন করে পারব মেয়েকে বড় করব। আমাদের মতো অভাবের সংসার যেন কারোর না হয়। আমার মতো মা যেন শত্রুর না হয়।"

সমাদৃতার সন্তানকে কেন্দ্র করে প্রায় দিনই অজন্তার কথা কাটাকাটি, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। অজন্তার কথা রাগ, অভিমান, জেদ তৈরি করেছে সমাদৃতার মনে। কখনো-কখনো অজন্তার নির্মম কথায় সমাদৃতা ভেঙে পরেছে। কতদিন সমাদৃতা আড়ালে কেঁদেছে আর ঈশ্বরের কাছে বলেছে, "আমার মা কি আর পাঁচটা মায়ের মতো মানসিক দিক থেকে সুস্থ হবে না। তুমি বুঝবে না ভগবান, আমার মায়ের মতো মায়ের সন্তানদের যে কি যন্ত্রণা! আমার মাকে আগের মতো করে দাও যেন মা তার সন্তানের জন্য সাধ্যমত সবকিছু করতে পারে।" এরই মধ্যে ইরাকে নিয়ে অজন্তার নানা মানসিক সমস্যা, প্রশ্ন দানা বাধল যার আঁচ এসে পড়ল সমাদৃতার উপর। ঈশ্বর পুতুলের মতো থেকে গেলেন। অজন্তার ভালো হয়ে ওঠা হয়তো আর হবে না।

এভাবেই মাসগুলো এক এক করে কেটে গেল নিজের ছন্দে। সমাদৃতার সন্তানের অন্নপ্রাশন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলো। সুজিতবাবু ভাবলেন যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নীলের সিদ্ধান্ত পাল্টাবে। তাই সুজিতবাবুর বাড়িতে ইরার আসা-যাওয়া বাড়ল। বাড়িতে আসা-যাওয়া থেকে শুরু করে সুজিতবাবুর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, তাদের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া কোনোকিছুই বাদ রইল না। সমাদৃতাও একসময় ভাবল যে নীলের সঙ্গে ইরার বিয়ে হলে ভালোই হবে। সমাদৃতার সন্তানের অন্নপ্রাশনে সমাদৃতার শ্বশুরবাড়িতে এলো ইরা। ছেলের বউ হওয়ার আগেই ইরার সঙ্গে সুজিতবাবুর ঘনিষ্ঠতা সমাদৃতার শ্বশুরবাড়ির অনেকেরই চোখে লাগল। কানাঘুষো সমাদৃতার কানেও এলো সেকথা। কিন্তু সে সেসব উড়ো কথা এড়িয়ে গেল। যেটা সে উপেক্ষা করতে পারল না সেটা সুজিতবাবুর মতো মানুষের অকারণ মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া। সমাদৃতা অন্নপ্রাশনের গোটা দিনটা বাবাকে থাকার জন্য অনুরোধ করল। সে চেয়েছিল পরের দিন সকালে সুজিতবাবু যেন তার শ্বশুরবাড়ি থেকে যান। কিন্তু সুজিতবাবু ব্যস্ততা দেখিয়ে রুক্ষ স্বরে বললেন, "আমার থাকলে হবে না। কলেজে আগামীকাল ক্লাস আছে।" পরে সমাদৃতার মা তাকে বললেন, "ক্লাস নেই। ইরাকে নিয়ে তোর বাবা এখানে থাকবে না। ওকে নিয়ে এখানে থাকা যাবে না। ওরা আমাদের বীরভূমের বাড়িতে থাকবে। কাল বিকেলের আগে শ্রীরামপুর যাবে না।"

সমাদৃতা ভাবল যে, সে তো অবুঝ নয়। সুজিতবাবু একবার তাকে আড়ালে ডেকে সত্যিটা বললেই পারত। হয়তো ইরার অপরিচিত জায়গায় থাকতে অসুবিধা হবে। যে সুজিতবাবু সমাদৃতাকে একদিন এত ভালোবাসতেন সেই মানুষেরই আজ সঙ্কোচ হয় মনের কথা খুলে বলতে! মেয়ের বিয়ের পর বাবাদের দায়িত্ব কিছুটা হলেও শেষ হয় সমাদৃতা জানে। কিন্তু সময় পরিস্থিতি মানুষকে এতখানি বদলে দেয় তা তার জানা ছিল না। নীলকে সুজিতবাবু ল্যাপটপ, ফোন কিনে দিলেও নিজের এইসব বিষয়ে কোনও আগ্রহ ছিল না। যেহেতু ছেলেমেয়েরা দূরে থাকে তাই কতবার বলেছে সুজিতবাবুকে ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ করার জন্য। তিনি বরাবর অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন। অথচ সেই সুজিতবাবু নির্দ্বিধায় ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ করেন সকলের অজান্তেই। নিজের বাবাকে সমাদৃতার অচেনা মানুষ লাগে। সে যেন চিনতে পারে না বাবাকে। সে অন্তর থেকে বিশ্বাস করে, মানুষের অন্তরের সত্তার অপমৃত্যু ঘটলে বাইরের কাঠামোটায় আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। সমাদৃতার ভাবতে অবাক লাগে, যে সুজিতবাবু একসময় মিথ্যাকে ঘৃণা করতেন, তিনিই আজ কারণে-অকারণে মিথ্যার আশ্রয় নেন। সুজিতবাবু নিজের ছেলেমেয়ের জন্মদিন কখনো ঘটা করে পালন করেননি। অথচ ষাট বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কেক কেটে ছাত্রছাত্রী তাঁর জন্মদিন পালন করলে তিনি তা সাদরে প্রশ্রয় দেন। একসময় সুজিতবাবু ছেলেমেয়েকে বলতেন, "তোমরা এমন কিছু সেলিব্রেটি হয়ে যাওনি যে লোক জানিয়ে ঘটা করে অনুষ্ঠান করতে হবে। মা পায়েস রান্না করবে, খেয়ো। আমি এসব ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করি না। আমরা সাধারণ মানুষ। সাধারণের মতোই থাকতে চাই।" যাইহোক সময়ের সঙ্গে প্রত্যেক মানুষের কম বেশি পরিবর্তন হয়, সেটা ভালো কি খারাপ তা বিচার্য নয়। সুজিতবাবুরও আমূল পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনটা অনেকটা ঠিক আটপৌরে শাড়িতে ফ্যাশেনেবেল গহনা পড়ার মতো।

সমাদৃতার খবরাখবর নিতে বিয়ের পর সুজিতবাবু নিজে থেকে ফোন করে খোঁজ নিয়েছেন হাতে গোণা কয়েকবার। সমাদৃতা প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় নিয়ম করে ফোন করত খবরাখবর নেওয়ার জন্য। সুজিতবাবু ব্যস্ত মানুষ। তাঁর মেয়ের খবর নেওয়ার সময় কোথায়! সুজিতবাবু সমাদৃতাকে উল্টে ফোন করেন যখন তিনি বাড়ির কারোর মুখ থেকে শোনেন যে, সমাদৃতা বাবার বাড়িতে এসে বাবার বিরুদ্ধে কথা বলে গেছে। একথা শুনে সমাদৃতার স্বামী তাকে বলে, "আমি তোমাকে ওই বাড়ির কোনও ব্যাপারে জড়াতে দিতে চাই না। তোমার কি চৈতন্য হবে না কোনোদিন? কারো ভালো করতে হবে না তোমায়। বোবার মতো থাকতে পারলে ওই বাড়ি যেও।" সমাদৃতা বলে, "বিশ্বাস করো, আমি যা বলিনি তার দায় নেব কেন! আমি বাবার বিরুদ্ধে কেন বলব? আমি কিছু বলিনি ওই বাড়ি গিয়ে।"

সমাদৃতা তার স্বামীকে কথা দিলো সে আর বাবার বাড়ির কোনও ভালো-মন্দে নিজেকে জড়াবে না; সেটা ইরার ব্যাপারেই হোক বা অন্য কোনও সাংসারিক বিষয়েই হোক। সমাদৃতার সেই কথা দেওয়ায় বাধ সাধল সুজিতবাবুর অনুরোধ। নীলকে ইরার সঙ্গে বিয়েতে রাজি করানোর ভার পড়ল সমাদৃতার উপর। সে বাবার অনুরোধ রাখতে নীলকে জানালো সেকথা। নীল পরিষ্কার ফোনে জানিয়ে দিলো যে সে ইরাকে বিয়ে করতে পারবে না। সুজিতবাবু মেয়ের কথার উপর ভরসা না করতে পেরে ছেলের বাইরে থেকে ফেরার অপেক্ষা করলেন। দেড় বছর কাটিয়ে বিদেশ থেকে নীল ফিরে এলে তিনি তার কাছেও একই অনুরোধ করলেন। কিন্তু সুজিতবাবু নিরাশ হলেন। নীল একদম মুখ ফিরিয়ে নিলো বাবার প্রস্তাবে।

বেশ কিছুদিন পর সমাদৃতাকে আর্দ্র গলায় সুজিতবাবু বললেন, "আমি ছেলে মানুষ করতে পারিনি। তুই দেখিস, আমি ওর কোনও ব্যাপারে থাকব না। তোর মাকেও বলেছি, নীলের সঙ্গে আমি কোনও সম্পর্ক রাখব না। টাকাপয়সা যা দরকার আমি দেবো। আমি বাবা। ওকে পৃথিবীতে যখন এনেছি ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তো আমার।" বাবার বিষণ্ণ মুখ দেখে সমাদৃতা বলল, "চিন্তা করো না বাবা। নীল যদি বিয়ে না করে তাহলে তুমি কি করবে! তোমরা তো চিরকাল বাঁচবে না। তুমি বাবা হিসাবে ছেলের ভালো করতে চেয়েছিলে। তোমার কথা নীল শুনবে না। তুমি আর ছোট হয়ো না। ইরাকে নীলের মতামত জানিও।"

সুজিতবাবু বললেন, "আমি কার জন্য উপার্জন করব? সবকিছু থেকে ভাবছি নিজেকে সরিয়ে নেবো।"

সমাদৃতা ভালো করেই জানে তার বাবা সন্তানের উপর অভিমান করে থাকতে পারবেন না। নীলের অবাধ্যতা তাঁকে সাময়িক কষ্ট দিয়েছে বলে আজ তিনি একথা বলছেন। সময় অতীত স্মৃতির উপর এমনভাবে প্রলেপ দেয় যা মানুষকে বিস্মিত হতে সাহায্য করে। সুজিতবাবুর মন থেকেও একদিন সব বিস্মিত হবে।

জীবন সবসময় একইভাবে চলে না। গতি এবং গতিপথ- দুই বদলায়। সমাদৃতা সন্ধ্যায় শহরের জনাকীর্ণ রাজপথে চার বছরের মেয়ের হাত ধরে হাঁটতে-হাঁটতে ভাবে সেও একদিন হয়তো নিজের অজান্তেই বদলাবে। এই পথেই সুজিতবাবু একদিন ঊনিশ বছরের মেয়ে সমাদৃতার হাত ধরে হাঁটতে-হাঁটতে বলেছিলেন, "বিয়ে করে সংসার করতে হবে। এতে ভয় কি! আমি তো চিরকাল বাঁচব না। বাবার আশীর্বাদ সবসময় তোর সঙ্গে থাকবে। বাবা যতদিন বেঁচে আছে ততদিন এই দু'হাত দিয়ে সব প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করবে মেয়ের জন্য। তোর কোনও চিন্তা নেই। এই বাবাটার উপর একটু ভরসা রাখিস।"

সমাদৃতাকে একটা অজানা ভয় গ্রাস করে। তার ভয় হয় এই প্রাণহীন শহরের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে তো হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোকে, বাহ্যিক আবরণের অন্দরে থাকা নিজের সত্তাকে! ব্যস্ততার ভিড়ে সে কখনো হারিয়ে যাবে না তো প্রিয়জনের থেকে! তার প্রিয়জনের কাছে সে হয়ে যাবে না তো একজন অচেনা মানুষ! বাড়ি ঢোকার মুখে জনশূন্য গলিতে ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে সমাদৃতা রিক্ত দু'হাতে তার ছোট মেয়ে অজানাশ্রীকে বুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলে ওঠে, "গুণ-দোষ সব মিলিয়ে তুই আমার সন্তান। আমার হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি। আমার রক্ত। শুধু আমার। একান্তই আমার।’
( সমাপ্ত )
◕ এই লেখিকার আরেকটি গল্প 'আর একটি নতুন ভোর' পড়তে এখানে ক্লিক করুন আর একটি নতুন ভোর

Next Bengali Story

অন্য পর্বঃ পর্ব ১    পর্ব ২   


All Bengali Stories    81    82    83    84    85    86    87    88    89    (90)     91    92   


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717