Home   |   About   |   Terms   |   Library   |   Contact    
A platform for writers

শ্রীরাধিকা

( 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার'- ২০২২-এর একটি নির্বাচিত গল্প)

-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ আমাদের এই ওয়েবসাইট ( RiyaButu.com )-এ প্রকাশিত গল্পগুলির মধ্যে থেকে কিছু গল্প নিয়ে এবছরই প্রকাশিত হবে আমাদের 'রিয়াবুটু'র গল্প'।
--------------------------



All Bengali Stories    169    170    171    (172)     173   

শ্রীরাধিকা
Writer - Dr. Bhargavi Chatterjea Bhattacharyya
( 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার'- ২০২২-এর একটি নির্বাচিত গল্প)


## শ্রীরাধিকা

Writer - Dr. Bhargavi Chatterjea Bhattacharyya

থমথমে মুখে বসে আছেন মিস্টার আগরওয়াল। টেবিলে জোরে একটা ঘুষি মারলেন, মেরে ব্যথায় নিজেই 'উ উ' করে উঠলেন। দু- তিনটে কাগজ মুঠো করে ছুড়লেন ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে, ভারী পেপারওয়েট ছুড়ে ফেললেন মাটিতে। ওই ঝনঝন আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেলেন তিনি। খেয়াল হল সামনে দাঁড়িয়ে আছে রামশরণ।

"ঠিক আছে রামশরণ তুমি যাও এখন।"

"আচ্ছা," বলে চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে এল রামশরণ।

রামশরণ মিঃ আগরওয়ালের বাড়িতে আছে চল্লিশ বছর। যখন প্রথম এসেছিল তখন তার বয়স বারো আর মহেশের পাঁচ। দেশে খাওয়া জুটছিল না। বাবা-জ্যাঠারা মিলে বাড়িতে বারো জন সদস্য। এতগুলো পেট চালানো মুশকিল। এই বাড়িতে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন জ্যাঠা। মাইনের টাকাটা মাসের শুরুতে নিয়ে যেতেন তিনি। পরে যখন একটু বড় হল রামশরণ, তখন তার হাত খরচ দরকার পড়ল। কাজেই জ্যাঠাকে 'আজ বলতো: মাইনে হয়নি, কদিন বাদে দেবে', 'কাল বলতো: এ মাসে কটা টাকা কম দিয়েছে।' জ্যাঠা মারা যাবার পর পুরো টাকাটা আসে তার হাতে; অবশ্য বাড়িতে টাকা পাঠায় সে নিয়মিত। বউ বাচ্চা হবার পরে তো বটেই।

এতদিন সে আছে মহেশ আগরওয়ালদের পরিবারের সঙ্গে যে, রামশরণ এখন তাদের ঘরের লোক। প্রথমে টুকটাক ফাইফরমাশ খাটত। আস্তে-আস্তে সংসারের সব কাজ শিখে নিলো। আঠারো বছর বয়স হতে আগরওয়াল সাহেব ড্রাইভিং শিখিয়ে দিলেন। এখন সে মহেশের গাড়ি চালায়, বাড়িতেও টুকটাক কাজ করে। তবে তার শ্যেন দৃষ্টি; ঘরে-বাইরে সব নজর রাখে। মিঃ আগরওয়াল রামশরণকে বিশ্বাস করেন ভরসাও করেন। উনার রাগের কথা সবাই জানে। যে কথাটা তাকে রামশরণ বলল, তা বলার মত সাহস পৃথিবীতে আর কারো নেই। অফিসের স্টাফ তো দূরস্ত, বাড়িতেও কেউ এত বড় কথা বলতে সাহস পাবে না।

মহেশ আগরওয়াল একজন সফল ব্যবসায়ী। কলকাতায় তার বসতবাটি। অনেক প্রজন্ম ধরে তাদের এখানে বাস। কিন্তু তার ব্যবসা সারা ভারতে ছড়ানো। দিল্লী, বোম্বে, চেন্নাই সব জায়গায় অফিস আছে তার। পরিবার বলতে তার স্ত্রী আর একমাত্র মেয়ে রাধিকা। রাধিকা তার চোখের মনি। শুধু একটা সন্তান, তায় আবার মেয়ে; বাড়িতে অনেকে দত্তক নেওয়ার কথা বলেছিল। বিশেষতঃ তার ভাইয়ের যেখানে দুই ছেলে। মেয়ে তো শ্বশুরাল চলে যাবে। কে তোমার এত বড় ব্যবসা সম্পত্তি সব দেখভাল করবে? খুব দোটানায় পড়েছিলেন মহেশ। তখন রাধিকা খুব ছোট। সবে হাঁটতে শিখেছে। "পাপা, পাপা" বলে কোলে আসত তিনি বাড়ি ফিরলেই। বড়-বড় দুচোখ মেলে বাবার দিকে তাকাতো। মহেশের মনে হতো মেয়ে বলতে চাইছে, "তুমি ছেলে দত্তক নেবে বাবা? আমায় আর। ভালোবাসবে না? আমি কি এতই পর? " মন শক্ত করেছিলেন মহেশ আগরওয়াল। সবার ওজর-আপত্তি অগ্রাহ্য করে দত্তক নিলেন না তিনি।

তবে ভাইপো সুরেশ, রমেশ দুজনেই তাঁর বিশেষ স্নেহভাজন। রমেশ মুম্বাইয়ে থাকে আর সুরেশ থাকে কলকাতায়। বয়স কম হলে কি হবে, সুরেশের বুদ্ধি প্রখর। দরকারে অদরকারে তার শলা নেন তিনি। আজকালকার ছেলে, কম্পিউটারে খুব চৌকস। মহেশ দেখেছেন বাড়ির ব্যাপারেই হোক আর কারবারের ব্যাপারেই হোক, খুব ভালো পরামর্শ দেয় সুরেশ।

রাধিকার এখন বয়স উনিশ। মেয়ের কোন সাধ অপূর্ণ রাখেন নি মহেশ। সে যখন যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। আঠারো বছরের জন্মদিনে গাড়ি চেয়েছিল মেয়ে। গাড়িটা কি হবে সেটা ছিল সারপ্রাইজ। সুন্দর একটা হোন্ডা সিটি কিনেছিলেন মিঃ আগরওয়াল। মেয়ের সে কি অভিমান সে বিএমডব্লিউ ভেবেছিল। সকাল থেকে কান্নাকাটি, মান অভিমান, ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকা, খাবার না খাওয়া এইসব চললো। প্রমাদ গুনলেন বাড়ির সবাই। মেয়ের জন্মদিন পন্ড হয়ে যাবে! গাড়ি ফেরত দিয়ে তৎক্ষণাৎ বিএমডব্লিউ বুক করলেন তিনি। অপরাধের ফাইন স্বরূপ একটা সুন্দর সোনার সেট কিনে দিলেন। তবে মেয়ের মুখে হাসি ফুটল। উনিশ বছরের জন্মদিনে তাই আর রিস্ক নেন নি মিঃ আগারওয়াল। এবারের উপহার ইউরোপ ট্যুর। ব্রোসার ফেলে দিয়েছেন মেয়ের সামনে। সে পছন্দমত বেছে নিতে পারবে।

তবে মেয়ে যখন, তাকে তো শ্বশুরাল পাঠাতেই হবে। সে ব্যাপারেও পরিকল্পনা করা আছে মহেশের। তার বন্ধু বিনোদ বাজাজের একমাত্র ছেলে বিনায়ক। বিনোদের বড় ব্যবসা আর বিনায়ক হীরের টুকরো ছেলে। দুই পরিবারের সখ্যতা তিন প্রজন্মের। বিনোদের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে মহেশের। বিনোদ আপ্লুত। "তোমার ঘর থেকে আমি লছমি আনবো, এত সৌভাগ্য হবে আমার!! রূপে-গুণে কুলে শীলে রাধিকার জুড়ি মেলা ভার।"

কিন্তু মুশকিল হল রাধিকার একদম পছন্দ নয় বিনায়ককে। সে ব্যবসার কাজে যতই চৌকস হোক না কেন, তাকে দেখতে মোটেও ভালো নয়। মোটাসোটা গোলগাল চেহারা; ঘি মাখন খেয়ে। ব্যবসাই তার ধ্যান-জ্ঞান। সে জানে রাধিকা তার ভাবী স্ত্রী, কিন্তু তার ব্যবহারে সেটা প্রকাশ পায় না। একটু রোমান্টিক না হলে রাধিকার মনে ধরবে কেন? মহেশ জানে ব্যাপারটা কিন্তু এ ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করে না। বিয়ের আগে সাজগোজ গয়না-গাঁটি এগুলোতে মেয়ের চোখ ধাঁধিয়ে গেলে চুপিসারে পছন্দমত পাত্রের হাতে তিনি রাধিকাকে তুলে দেবেন। আরে চেহারা তো দুদিনের। ওতে মজলে চলে? কিন্তু রাধিকার যে মন মজেছে। রাধিকা বরাবরই ডাকাবুকো ধরনের। একবার কে খবর দিল, মোড়ের মাথায় যে ট্রাফিক পুলিশ ডিউটি করছে তাকে দারুন দেখতে। বন্ধুরা মিলে বাজি ধরল তাকে গিয়ে বলতে হবে যে সে খুব হ্যান্ডসাম। গাড়িশুদ্ধ চলল রাধিকা আর তার বান্ধবীরা সেই ট্রাফিক পুলিশের খোঁজে। কিন্তু গিয়ে বান্ধবীদের মুখ চুন। এ ওকে ঠেলছে, ও তাকে ঠেলছে। রাধিকা সটান এসে ট্রাফিক পুলিশকে বলল, "হাই হ্যান্ডসাম।" ছেলেটি সপ্রতিভ। জবাব দিল, "থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাম।" দুদিন বাদে আবার সেই মোড়ে গেছিল রাধিকা। এবার একা। কিন্তু সেই ছেলেটি অন্য কোথাও ট্রান্সফার হয়ে গেছে। বলা বাহুল্য দুদিনই গাড়ির ড্রাইভার রামশরণ।

আরেকদিন বিপাকে পড়েছিল রামশরণ। রোজকার মতো কলেজে গেছে রাধিকা। বাইরে গাড়ী নিয়ে অপেক্ষা করছে রামশরণ। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেল, কিন্তু রাধিকা বেরোয় না। পনের মিনিট, আধ ঘন্টা, এক ঘন্টা। পাগলের মত খুঁজছে রামশরণ। উল্টোদিকের গেটের দারোয়ান বলল, এক দঙ্গল মেয়েরা উবার নিয়ে বেরিয়ে গেছে। মোবাইলে ফোন করলে ধরছে না। কেটে দিচ্ছে বারবার। তাও মহেশজীকে ফোন করতে সাহস হয়নি রামশরণের। সুরেশকে ফোন করেছিল। সুরেশও সহজে খোঁজ পায়নি রাধিকার। বহুকষ্টে জানা যায় যে সাউথ সিটি মলে আছে রাধিকা। সেখানে গিয়ে তাকে খুঁজে পেতে বাড়ি নিয়ে আসে রামশরণ। তবু মনে-মনে রাধিকার তারিফ না করে পারে না সে। অন্য যে কোন মেয়ের গাড়ি করে যদি রাধিকা যেত, তাহলে খবর পেতে পাঁচ মিনিটও সময় লাগত না রামশরণের। ড্রাইভারদের নেটওয়ার্ক এতই ভালো। সেটা এড়াতেই উবার নিয়ে যাওয়া। তবে বারবার ভুল করবার লোক নয় রামশরণ। অন্য গেটে লোক ফিট করে রেখেছে সে, এখন যাতে রাধিকা বেরোলেই সে খবর পায়।

রাধিকার অংক বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে, সে তার জন্য একটি ছেলের কাছে টিউশন নেবে। ছেলেটি ব্যাচে পড়ায়, অনেক ছেলে-মেয়ে পড়ে তার কাছে। মহেশ বললেন, "কোনো ব্যাপার নয়, বাড়িতে ব্যাচ বসিয়ে দিচ্ছি। না হলে ও এ-বাড়ি এসে একা পড়াক রাধিকাকে। কত আর খরচ হবে? "

রাধিকা খুশি হয়ে বলল, "একা পড়াবে বাড়িতে? বাবা তুমি রাজি হবে? "

মহেশজী যতই তুখোড় বুদ্ধিমান হোন না কেন মেয়ের ব্যাপারে একদম অন্ধ; তিনি উল্টো বুঝলেন। বললেন, "ডরো মত বেটী, তোমার মা সামনে বসে থাকবেন তোমার ক্লাসের সময়৷"

রাধিকা বুঝল কেস জন্ডিস। সে বলল, "না বাবা, সবাই মিলে পড়লে ভালো হয় পড়াটা। গ্রুপ ডিসকাশন করা যায়। আর ওনার বাড়ির সামনে একজন ফুচকাওয়ালা বসে, সে দারুন গোলগাপ্পা বানায়।"

মহেশজির আপত্তি আর ধোপে টেকেনি। আসল কথাটা অন্য। রাধিকার বন্ধু পূজা খবর দিয়েছে যে ওদের এই অংকের টিউটর দারুণ হ্যান্ডসাম। ব্যাস আর রাধিকাকে আটকায় কে?

তরুণকে দেখতে সত্যি খুব সুন্দর। পেটানো চেহারা, বড়-বড় দুটো চোখ, তাতে বুদ্ধির দীপ্তি। সে গরীব ঘরের মেধাবী ছাত্র, বাপ মায়ের একমাত্র ছেলে। অল্প বয়সে তার শখ ছিল ফুটবলার হবে; ময়দানে খেলতে যেত সে। কর্মকর্তাদের নজরে পড়ল তার খেলা। সে ভর্তি হল ক্লাবে। মাঠ তো তাকে টানতই, আরো একটা জিনিস তাকে টানত। ওরা টিফিনটা খুব ভালো দিত। চিকেনটা খাসা রাঁধত। গরীব না হলেও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা সাধারণ কাজ করতেন, মা গৃহবধূ। তার মধ্যে তাঁরা চেষ্টা করতেন ছেলের শখ পূর্ণ করার। ছেলের তো শখ ওই দুটোই; এক পড়াশুনা আর দুই ফুটবল।

পড়াশোনার জন্য সাধ্যমত মাস্টার রেখেছিলেন বাবা, দামি মাস্টার আর কোথা থেকে দেবেন? তাতেই দুর্দান্ত রেজাল্ট করত তরুণ। বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবে। বাবা কোনদিন টাকার অভাব বুঝতে দেন নি। আজ সে কথা মনে পড়লে আফসোস হয় তরুণের। একটা লেদারের ভালো ফুটবল চেয়েছিল। বাবা কষ্টেসৃষ্টে সেটা কিনে দিয়েছিলেন। আরেকবার ল্যাপটপ চেয়েছিল। উঁচু ক্লাস হচ্ছে, পড়াশোনার সুবিধে হয়।

বাবার আর ল্যাপটপ কেনা হয়ে ওঠেনি। টাকা জমাচ্ছিলেন উনি। কিন্তু তরুণ ক্লাস এইটে পড়ার সময় বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ে। ছ মাসের মধ্যে সব শেষ। বাবাও, টাকাও। জমানো টাকা তো গেলোই বরং মাথার উপর ধার। রাতারাতি নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে তারা নিম্নবিত্ত হয়ে পড়ল। ফুটবল খেলা মাথায় উঠল। নিজের পড়া ছেড়ে নিজে পড়াতে শুরু করল ছোট বাচ্চাদের। মা দুটো বাড়িতে রান্নার কাজ নিলেন। না হলে সংসার আর চলছিল না। একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছিল তরুণদের পরিবার, এখন আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। টিউশনি করে নাম হয়েছে তরুণের। মা এখন আর বাড়ি-বাড়ি রান্নার কাজ করেন না। তরুণ একটা কোচিং সেন্টার খোলার কথা ভাবছে। দুই বন্ধুর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা চলছে। মা আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন — তরুণকে বলছেন এবার বউ আনতে হবে। তরুণ অবশ্য হু হাঁ করে কাটিয়ে দিচ্ছে, তার এখনো অনেক পথ চলা বাকি। এইসময় তরুণের কোচিংএ ভর্তি হল রাধিকা। অত বড় গাড়ি এসে দাঁড়াতে গলির মুখে, পাড়ার সবাই তাজ্জব হয়ে গেল। পাড়ার কাকা জ্যাঠাদের গর্বে বুক ফুলে উঠলো। তারা সকলেই বুঝতে পেরেছিল তরুণের যা প্রতিভা তাতে ও অনেক দূর যাবে। পাড়ার ছেলেছোকরারা 'আমাদের তরুণ' বা 'আমাদের তরুণদা' বলে কলার উঁচু করে বেড়াতে লাগলো। শুধু তরুণের হেলদোল হলো না। সে মাটিতে পা রেখে চলে। বাবার মৃত্যুর পর সে বুঝেছে মানুষ স্বার্থ বোঝে শুধু নিজের। একটা দুস্থ পরিবার তলিয়ে যাচ্ছে দেখে কেউ সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। পুরো ঝড়টা গেছে তার আর তার মায়ের মাথার ওপর দিয়ে। দামী গাড়ির চাকচিক্যে সে ভুলছে না। তার কাছে রাধিকা একজন ছাত্রী মাত্র। দামী গাড়ির জন্য সে তো আর বেশি পয়সা নিতে পারে না। তরুণ অন্য ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে সমান চোখে দেখত রাধিকাকে।

রাধিকার অংক বুঝতে অসুবিধে হতে থাকলো। নানান অছিলায় ক্লাস শেষ হবার পরে পড়া বোঝার নাম করে বেশিক্ষণ থাকত সে। প্রথম-প্রথম বুঝতে পারেনি তরুণ। কিন্তু ক্রমশ জিনিসটা দৃষ্টিকটু হয়ে দাঁড়ালো। তরুণ হতভম্ব হয়ে গেল। কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। তখন বীরুদার সঙ্গে কথা বললে সে।

বীরুদা তরুণের চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়ো, দুজনে খুব ভাব। বিপদে-আপদে একে অপরের পাশে থাকে। বীরুদা তরুণকে দেখে হাসতে হাসতে বলল, "কি ব্যাপার তরুণ? তুমি তো ডুমুরের ফুল হয়ে গেছো দেখছি। হবে নাই বা কেন? তোমার এখন হাইফাই ব্যাপার- স্যাপার। বাড়ির সামনে রাজকীয় গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে।"

তরুণ তার প্রবলেমটা খুলে বলল। তরুণের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বীরুদা বলল, " ব্রাভো! কংগ্রাচুলেশনস! এগিয়ে যা।" তরুণ বীরুদার দিকে তাকিয়ে বলল, "তুমি ঠাট্টা করছো? " গম্ভীর হয়ে গেলেন বীরুদা। বললেন, "সমস্যা গুরুতর। ও মেয়ে সহজে ছাড়বে না। চট করে মাথায় কিছু আসছে না। দাঁড়া দু-তিন দিন সময় দে। আমি একটু ভেবে দেখি। তোর বৌদির সঙ্গেও কথা বলি। মেয়েমানুষ তো, ওর দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। অনেক সময় আমরা যেটা মিস করি, সেটা ও ধরে ফেলে।"

আরো একজন ভাবনা চিন্তা করছিলেন। তিনি মহেশ আগরওয়াল। রাগে তার মুখ চোখ লাল হয়ে গেছিল। প্রথমে ভাবলেন নিজেই বেরোবেন রিভলবার নিয়ে। ছেলেটার মাথাটা উড়িয়ে দেবেন। তারপর ভাবলেন ওস্তাদকে খবর দেবেন। তারপর একটু মাথা ঠিক হলে ভাবলেন যে সুরেশের সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার। ডেকে পাঠালেন সুরেশকে। বাড়িতে অথবা অফিসে নয়, দুজনে দেখা করলেন টলি ক্লাবে। ভিড় ছিল না বেশি। একটা ছাতার তলায় বসলেন দুজনে। সামনে খোলা সবুজ মাঠ। আগে প্রায়ই আসতেন মহেশ গল্ফ খেলতে। এখন সময় করে উঠতে পারেন না। সুরেশ নিয়মিত আসে। গল্ফ খেলে, সাঁতার কাটে, ঘোড়ায় চড়ে।

সব শুনে সুরেশের তো মাথায় হাত, "কি বলছেন কাকাবাবু!! খুন করবেন ছেলেটাকে!!" তখনো রাগ কমেনি মহেশের, "আমার মেয়ের সঙ্গে ফস্টি-নস্টি করতে গেছে, কত বড় সাহস!! বামন হয়ে চাঁদে হাত!!"

সুরেশ বললে, "তবু তাকে রাগের মাথায় খুন করলে বা ওস্তাদকে দিয়ে খুন করালে বিপদ আসতে পারে..."

"কিসের বিপদ? বিপদকে ভয় পায় এই শর্মা? " নিজের বুক চাপড়ে বললেন মহেশ।

"তা বলছি না," বলল সুরেশ। "রাধিকার মনের ওপর চাপ পড়তে পারে..."

একটু থমকালেন মহেশ। রাগের মাথায় এ কথাটা মনে হয়নি তার। "ঠিক আছে এমন ব্যবস্থা করো যাতে মনে হয় ও সুইসাইড করেছে।"

"তাতেও লাভ নেই," বলল সুরেশ। "রাধিকা নিজেও সুইসাইডের কথা ভাবতে পারে। আজকালকার মেয়ে। কত কি ঘটছে চারদিকে।"

"তাহলে আমাকে কি করতে বল? " জিজ্ঞেস করলেন মহেশ। তখনো তার উত্তেজনা কমেনি।

"আমাকে সাতদিন সময় দিন কাকাবাবু, ছেলেটার খোঁজ খবর নিয়ে দেখি," বলল সুরেশ।

"সাত দিন যে অনেক সময়। আমি অত দিন অপেক্ষা করতে পারব না। টেনশনে মরে যাব। একদিনের বেশি নয়।"

অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল সুরেশ। এসব অত্যন্ত ডেলিকেট ব্যাপার। সাবধানে পা ফেলতে হবে। তাড়াহুড়ো করলে পুরো জিনিসটা কেঁচে যেতে পারে। এ তো আর ব্যবসায়ের ডিসিশন নয় যে সঙ্গে-সঙ্গে অ্যাকশন নিতে হবে। কিন্তু কে কার কথা শোনে। ঠিক হলো দুদিন বাদে মানে ঠিক আটচল্লিশ ঘণ্টা বাদে তাঁরা দেখা করবেন আরেকবার। এই একই জায়গায়। দুদিন বাদে সুরেশ আর মহেশ আবার দেখা করলেন। সুরেশ বললেন, " আমি সব খোঁজখবর এনেছি কাকাবাবু। ছেলেটি ভালো। প্রেমটা এক-তরফা; রাধিকার তরফ থেকে। ছেলেটি গরীব বটে, কিন্তু মেধাবী। টিউশন পড়ায়। বাবা নেই। মা কদিন আগে বাড়ি-বাড়ি কাজ করতো।"

ঘৃণায় নাক কুঁচকে গেল মহেশের। সুরেশের কথাটা পুরোপুরি মানতে পারলেন না তিনি, "রাধিকাকে পছন্দ নয় মানে? তার টাকা দেখে বস্তির ওই কুত্তার মুখে লালা ঝরবে না? "

"রাধিকাকে টিউশন ছাড়িয়ে দিন কাকা আর বিনায়ককে বলুন কয়েকদিন রাধিকাকে নিয়ে ঘুরতে। সিনেমা দেখুক, রেস্টুরেন্টে যাক, শপিংমলে যাক।"

ছেলেটাকে একটু কড়কে দিতে পারলে শান্তি পেতেন মহেশ। তবু সুরেশের কথা মত চলতে রাজি হলেন তিনি। কিন্তু ফল মোটেও সুবিধার হলো না। বাড়িতে তাণ্ডব চালালো রাধিকা। বসবার ঘরে সাজানো ছিল দামি পেইন্টিং, ক্রিস্টালের সুন্দর ফুলদানি, মার্বেলের মূর্তি। সব ভেঙেচুরে শেষ করল রাধিকা। মা'র দামি বেনারসি ছিড়ে, পর্দা ফালাফালা করে কেটে, নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করলো সে। দরকারি মিটিং মুলতবি রেখে হন্তদন্ত হয়ে অফিস থেকে বাড়ি ফিরলেন মিঃ আগরওয়াল। মেয়ের রাগ কমাতে নিজের অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হলেন তিনি। আবার তরুণের কোচিং ক্লাসে যেতে শুরু করল রাধিকা।

রাগে প্রায় উন্মাদ হয়ে গেলেন মহেশ। পুরো রাগটা গিয়ে পড়ল তরুণের উপর। নিশ্চয়ই সে তলে-তলে কলকাঠি নাড়ছে, না হলে রাধিকা তো তেমন মেয়ে নয়। ঠিক আছে, তরুণকে কি করে ঢিট করতে হয় সেটা উনি ভালোই জানেন। বড্ড ফালতু কথা বলে সুরেশ; তরুণ আবার চায় না রাধিকাকে। অর্ধেক রাজত্ব আর সঙ্গে রাজকন্যা, এমন দাঁও কেউ ছাড়ে? রাধিকাকে ভালো মানুষ পেয়ে, দুটো মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলে তার মন ভুলিয়ে কাজ হাসিল করার চেষ্টা করছে। ঠিক আছে, আমিও শ্রী শ্রী মহেশ আগরওয়াল। ক্ষমতা থাকে তো এসো, আমার সঙ্গে লড়ো।

#
খবরটা রাধিকা জানতে পারে পূজার কাছে। সব নিউজ চ্যানেলে বলছে। ছবিও দেখাচ্ছে। তরুণ এক জন ছাত্রীকে রেপ করেছে। মেয়েটা রাজি হচ্ছিল না বলে তাকে ইনজেকশন দিয়ে তারপর রেপ করেছে। ছাত্রীর নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না, ছবিও দেখাচ্ছে না। কিন্তু তার বাবা-মা সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন টিভিতে। তাড়াতাড়ি টিভি চালালো রাধিকা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চ্যানেল থেকে ফোন, "আপনি একটু বাইট দেবেন প্লিজ? আপনার সঙ্গে তো যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা ছিল।" আরেকটা চ্যানেল থেকে ফোন করে বলল, "ম্যাম আপনি তো দেখেছেন খবরটা। আপনার কি প্রতিক্রিয়া? " তিন নম্বর চ্যানেল থেকে বলল, "আমাদের সমাজে এই ঘটনা ঘটে চলেছে...পাশবিক নক্কারজনক ঘটনা। আপনি কিছু বলুন। আমরা এই সব লোকদের মুখোশ খুলে দিতে চাই। আপনাকে পাশে চাই।" ফোন সাইলেন্ট করে রাখলে রাধিকা। তাতেও থামছে না। ক্রমাগত মেসেজ ঝলসে উঠছে স্ক্রিনে। অগত্যা সুইচ অফ করে দিলো সে। উঃ সত্যি আর পারা যাচ্ছে না।

তরুণও আর পারছিল না। বাবা চলে যাবার পর তিল-তিল করে গড়ে তুলেছে টিউশন। আরো বড়ো হবার স্বপ্ন দেখছিল সে। এক নিমেষে তার সমস্ত স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। একা বসে ছিল সে থানার লকআপে। দারোগাবাবু ঢুকলেন। এবার সে কেঁদে ফেলল, "বিশ্বাস করুন স্যার, আমি নির্দোষ।"

"জানি," বললেন দারোগাবাবু। মুখ তুলে তাকাল তরুণ। সত্যি উনি জানেন। ঘন অন্ধকারে একটু হলেও আলোর রেখা দেখতে পেল সে।

পরদিন সকালে ফোন গেল মিঃ আগরওয়াল এর কাছে —

দারোগা — থানা থেকে বলছি। প্রবলেমে পড়েছি স্যার।

মহেশ — কেন? কি হল?

দারোগা — পাবলিক এসে হুজ্জোতি করছে। বলছি মিথ্যে মিথ্যে ফাঁসানো হয়েছে তরুণকে।

মহেশ — সে কথা আদালতে গিয়ে বলুক।

দারোগা — সামনে ইলেকশন, বাজার গরম। ঝান্ডা নিয়ে চলে এসেছে পার্টির লোক। লোকাল এমএলএ আসছেন একটু পরে। উনি ফোন করেছিলেন।

মহেশ — আর টিভির লোকেরা?

দারোগা — সবকটা চ্যানেল এসে গেছে। কিন্তু তারা সবাই পাল্টি খেয়েছে। পাবলিক চেঁচাচ্ছে। সবার মুখে এক বুলি — ফাঁসানো হয়েছে, ফাঁসানো হয়েছে। চ্যানেল গুলো বলছে, 'আমরা প্রকৃত ঘটনা জানাতে চাই। এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ধোঁয়াশা রয়েছে।' পাড়ার ছেলেরা মহা আনন্দে বাইট দিচ্ছে। টিভিতে তাদের মুখ দেখানো হচ্ছে বলে তারা খুব খুশি। ঘটনাটাকে গরিব-বড়লোক টুইস্ট দিয়ে ইলেকশনের জন্য কাজে লাগাবেন এমএলএ।

মহেশ — আচ্ছা আমি দশ মিনিটের মধ্যে ফোন করছি।

প্রমাদ গুনলেন মিঃ মহেশ আগরওয়াল। ছেলেটাকে শেষ করা ওনার বাঁয়ে হাত কা খেল। কিন্তু এমএলএ মাঠে নেমেছেন, জনতা, টিভি চ্যানেল সবাই পাল্টি খেয়েছে। এই ঘটনাটা ইস্যু হয়ে দাঁড়ালে তার বিশাল প্রবলেম হবে ঘরে এবং বাইরে। সাত-পাঁচ ভাবছেন মহেশ; এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো। সাত সকালে কে এল? ধক করে উঠলো বুকটা। টিভির লোকরা খোঁজখবর নিয়ে বাড়ি অবধি ধাওয়া করে নি তো? দরজা খুলে দেবদূতের মত দুই ভাই ঢুকলো — সুরেশ আর রমেশ। ভোরের ফ্লাইট ধরে রমেশ মুম্বাই থেকে চলে এসেছে। দুজনকে দেখে বুকে বল পেলেন তিনি। সুরেশ আর রমেশ সোজাসুজি ড্যামেজ কন্ট্রোল মোডে চলে গেল। অনেকগুলো ফোন করলো। কাকে কি দিতে হবে তার চটপট হিসেব করে ফেলল দুজনে। ঠিক হলো এমএলএ এসে দশটার সময় তরুণকে বের করে আনবেন। গরীব মেধাবী তরুণের পাশে দাঁড়িয়ে এলাকার উন্নয়নের কথা বলবেন, চাকরির প্রতিশ্রুতি দেবেন। কয়েকটা চাকরি সত্যি দিতে হবে, সেটা দিন সাতেকের মধ্যে ফাইনাল করা হবে। "কিন্তু," এবার সোজাসুজি বলে ফেলল রমেশ, "রাধিকাকে আর ওই কোচিং-এ পাঠাবেন না। এবারে ও পাড়ায় গেলে মারমুখী জনতা গাড়ি ভাঙবে, রাধিকারও ক্ষতি করে দিতে পারে।"

মুক্তি পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল তরুণ। মা তো কেঁদে কেটে একসা। বললেন, "তোকে আর টিউশনি করতে হবে না খোকা। আমি দুটো কাজ ধরে নিচ্ছি। দুটো পেট আমি ঠিক চালিয়ে নিতে পারব।" পাড়ার সবাই এমএলএর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তিনি বাড়িতে এসেছেন, তরুণের সঙ্গে কথা বলেছেন, তরুণের মার সঙ্গে কথা বলেছেন, সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন। সবাই বলেছে, "তুই কাল থেকে আবার টিউশন চালু কর — দেখি কে কি করে!"

আবার পুরনো ছন্দে ফিরেছে জীবন। টিউশনি চালু করেছে তরুণ, কোচিং সেন্টারের কথা ভাবছে। ভাবনা ফলপ্রসূ হবার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে কিছুটা। পাড়ার দোকানে চা খাওয়া, আড্ডা দেওয়া চলছে আগের মতই। এমএলএ এসে হাত ধরে নিয়ে এসেছেন তাই। পাড়ার সবার চোখে সে এখন হিরো। বীরুদা সেদিন পাকড়াও করেছিল চায়ের দোকানে —

বীরুদা — তুই তো পাড়ার হিরো রে। ইলেকশনে দাঁড়াচ্ছিস কবে?

তরুণ — আঃ বীরুদা, তুমিও শুরু করলে...

বীরুদা — না রে সত্যি-সত্যি বিপদে পড়েছিলি। মায়ের আশীর্বাদে তোর কিছু হয়নি।

তরুণ — একদিন লকআপে থাকতে হলো। সেটা বুঝি কিছু না?

উত্তর না দিয়ে বীরুদা বলল, "আমার দিদি খুব সুন্দরী ছিল বলে মা-বাবা চিন্তা করতেন... গরীবের ঘরে সুন্দরী মেয়ে বড় বালাই। এখন তো দেখছি গরীবের ঘরে সুন্দর ছেলেও বালাই।"

তরুণ — আচ্ছা শুধু-শুধু এত হেনস্থা হতে হল আমাকে। ভগবান এর কোন শাস্তি বিধান করবেন না?

বীরুদা — বড় লোকের শাস্তি অত সহজে হয় না রে... সময় লাগে। বাপকে যথেষ্ট গুনাগার দিতে হয়েছে। মেয়েকেও হবে; এই স্বভাব না শুধরালে। বাপ কদিন আগলাবে? শ্বশুরবাড়ি আছে, সমাজ আছে। যাক সে কথা। ওসব নিয়ে আর ভাবিস না।

বীরুদার কথা ফলে গেছিল অক্ষরে-অক্ষরে। কিন্তু, সে গল্প অন্য গল্প।
( সমাপ্ত )


Next Story

All Bengali Stories    169    170    171    (172)     173   


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717