Home   |   About   |   Terms   |   Library   |   Contact    
A platform for writers

যেদিন ভেসে গেছে

Bengali Story

All Bengali Stories    70    71    72    73    74    75    76    77    (78)     79   

-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ আমাদের এই ওয়েবসাইট ( RiyaButu.com )-এ প্রকাশিত গল্পগুলির মধ্যে থেকে কিছু গল্প নিয়ে এবছরই প্রকাশিত হবে আমাদের 'রিয়াবুটু'র গল্প'।
--------------------------



◕ যেদিন ভেসে গেছে

লেখক - শান্তনু চ্যাটার্জী, ন্যাশানাল পার্ক, নৈহাটি, উত্তর ২৪ পরগণা

✿ ১

সন্ধেবেলায় তুমুল বৃষ্টি। বাসটা যেখানে থামল সেখানে ছাউনি একটা আছে বটে, কিন্তু সেটা বহু পুরনো। শেডটা সম্পূর্ণরূপে আস্ত নেই। এখানে ফুটো, ওখানে ফাঁকা। আর দু'পাশে তো একেবারে ভেঙেই পড়েছে। এর তলায় আশ্রয় নিলে যে কেউ ভিজে যাবে। আমার কাছে ছাতা ছিল। তাই ঠিক করলাম, এরকম অস্থায়ী আশ্রয়ে দাঁড়াবার চেয়ে হাঁটা লাগানোই ভালো। মেন-রোড দিয়ে মিনিট দুয়েকের হাঁটা, তারপর ডানদিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেদিকেই আমার গন্তব্য।

সরু পাকা রাস্তা আর দু'ধারে বড়-বড় বৃক্ষ শ্রেণীর গাছ লাগানো। এই অঞ্চলে আমি নতুন এসেছি। কিন্তু এই রাস্তাটা আমার খুব ভালো লাগে। দিনের চড়া রোদে হোক কিংবা পড়ন্ত বিকেল, এই ছায়া-ঘেরা রাস্তাটা দিয়ে হাঁটবার মজাই আলাদা। মেন-রোড থেকে রাস্তায় সবে ঢুকেছি, মনে হল আমার পিছন-পিছন কেউ দ্রুত আসছে। আমি কিছু বুঝে ওঠবার আগেই হুট করে সে আমার ছাতার তলায় চলে এলো। তারপর হাসি মুখে বলে উঠলো, "ওফ্ খুব বৃষ্টি। আমি বেশি দূর যাবো না। সামনেই আমাকে ছেড়ে দেবেন?" এই বলে সে আমার মুখের দিকে তাকাল। আমিও তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। আমার বুকের কাছটা ধক্ করে উঠলো। এতোটাই অবাক হয়ে গেলাম যে মুখ ফসকে বেরিয়েই গেল, "সুলগ্না তুমি?"

রাস্তাটায় স্ট্রীট-লাইটগুলো সেদিন সবক'টা জ্বলছিল না। আধো-আলো, আধো অন্ধকার। জায়গাটাও একেবারে নির্জন। এমনিতেই আমাদের এখানে লোকবসতি খুবই নগণ্য। তার ওপরে এখন এই বৃষ্টিতে কেউই বেরোয়নি। এমন একটা জায়গায় সুলগ্নার সাথে দেখা হয়ে গেল!! আমার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি বৃষ্টির শব্দ ভেদ করে যেন আমার কানে আসতে লাগলো। ওর অবস্থা আমার থেকেও খারাপ। সে যে শুধু অবাক হয়েছে তাই নয়। আমার সাথে এভাবে এক সাথে এসে পড়ায় সে চূড়ান্ত লজ্জিত এবং বোধহয় মনে-মনে অনুশোচনাও করছে। বোধ করি, অন্য কাউকে ভেবে ও আমার ছাতার তলায় চলে এসেছে। সুলগ্না হয়তো চলেই যেতো, কিন্তু আমিই নিজের প্রাথমিক বিহ্বলতাটাকে কিছুটা কাটিয়ে জোর করে বলে উঠলাম, "কোথা থেকে আসছো?"

সে কোনো উত্তর করলো না। বুঝতেই পারলাম, আমার পাশে এভাবে হাঁটতে সে খুব অস্বস্তি বোধ করছে। আমাদের দুজনের দেখা না হওয়াটাই উচিত ছিল। কিন্তু দেখা যখন হয়েই গেছে, তখন বৃষ্টির মধ্যে ওকে ছেড়ে দেওয়াটা মোটেই শোভনীয় হবে না। এই মনে করে আমি ওর সাথে আরেকটু আলাপ জমাতে চেষ্টা করলাম। আবারও জিগ্যেস করলাম, "কোথায় গেছিলে তুমি?"

"দোকানে।" মৃদু গলায় খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর এলো।

আমিও একটু উৎসাহিত হয়ে বললাম, "কি দুর্যোগের দিন বল দেখি!"

আমার এইভাবে আলাপ জমানোর চেষ্টায় ও খুব একটা খুশী হল কিনা জানি না। তবে আমাকে হঠাৎ ও বলে উঠলো, "আপনার দিকে ছাতাটা নিন। আমার লাগবে না। আপনি ভিজে যাচ্ছেন।"

আমি বললাম, "ঠিক আছে। তোমার বাড়ি কোথায়?"

ও উত্তর দিলো, "আমি চলে যাবো। আপনি ছাতা নিয়ে আপনার মতো চলে যান।" কিন্তু ওর সংকোচটা না ভাঙিয়ে ওকে ছাড়বার ইচ্ছে আমার ছিল না। মিনিট-খানেক হাঁটতেই ওর বাড়ি এসে পড়লো। একতলা ছোট বাড়ি। আর বাড়ির সামনে কিছুটা জায়গা। উঠোনটা আগাছায় ভর্তি। মনে হয় অনেকদিন এর পরিচর্যা করা হয় নি। ওর বাড়ির সামনে এসে ওকে ছাড়তে যাবো, এমন সময় প্রচণ্ড একটা আলো এসে আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিলো। আর সাথে-সাথে কান ফাটানো শব্দে বাজ পড়লো সামনের নারকেল গাছটার মাথায়। জীবনে এতো কাছ থেকে আমি কখনো বাজ পড়তে দেখিনি। সুলগ্না ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। আমি ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। খানিক বাদে সে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বলল, "কি সাঙ্ঘাতিক।" এই বলে এক দৌড়ে সে তার বাড়ির বারান্দায় ঢুকে গেলো। আমিও চলে যাচ্ছি। এমন সময় ও আমাকে আলতো স্বরে ডাকল, "আপনার কি খুব তাড়া? মানে বলছিলাম যে, বাজ পড়বার সময় এভাবে গাছের তলা দিয়ে না যাওয়াই ভালো। আপনি চাইলে এখানে বসতে পারেন।"

আমি হাসি মুখে ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, "সেকথা ঠিক। বাজের সময় না বেরোনোই ভালো।" এই বলে আমি ওর ঘরের বারান্দায় ঢুকে পড়লাম। বারান্দাটা কিঞ্চিৎ অন্ধকার। এর একপাশে একটা মোড়া রয়েছে। ও আমার দিকে একবার তাকাল। "আপনি ঐ মোড়াটা টেনে নিয়ে বসুন না।" কথাটা বলে ধীর পায়ে ও ঘরে চলে গেলো।

মোড়াটা টেনে বসতে বসতে কেবলই মনে হচ্ছিলো, এ আমি কার বাড়ি এসে পড়লাম? কেনই বা এলাম এখানে? মনে হচ্ছিলো, তখনই বৃষ্টির মধ্যে উঠে চলে যাই, কিন্তু যেতে গিয়েও কেমন একটা আড়ষ্টভাব এলো দুটো পা জুড়ে। একটানা বৃষ্টির শব্দ শুনতে-শুনতে চলে যাচ্ছিলাম স্মৃতি পাতা উল্টে আজ থেকে বেশ কয়েকবছর আগে।

✿ ২

তখন সবে চাকরি পেয়েছি। বাবা-মা দুজনেই বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করতে শুরু করে দিল। প্রথমে তো আমার ইচ্ছেই ছিল না। বিয়ের কথা উঠলেই "এখন করবো না", "দূর ছাই ,যাও তো এখান থেকে", "তোমাদের শুধু এক কথা," ইত্যাদি বলে-বলে একবছর কাটিয়ে দিলাম। কিন্তু তারপর তো আর কাটে না। আর আমাদের পরিবারের রীতিই হল ছেলেদের বিয়ের বয়স ২৫-২৬এর বেশি এগোবে না। কিন্তু আমি নিমরাজি। সবে তখন আমি চাকরি পেয়েছি। হাতে দুটো পয়সা এসেছে। এসময়ে ঘুরে বেড়ানো, নাটক দেখা, সিনেমা দেখা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারা এসব করবো না কি বিয়ে করে সংসারের ঠেলা সামলাবো? কিন্তু বাবা-মাও ছাড়ে না। তারাও তাদের ঘ্যানঘ্যানানি চালিয়ে যায়। তারপর সেই ঘ্যানঘ্যানানি বাবা-মা থেকে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়লো কাকা, পিসে, মেসো, মামা সর্বত্র। তখন আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে দেখা হলেই সেই একই বচন – "এবার চাকরি পেয়েছ, হাতে দুটো পয়সা এসেছে। আর তবে দেরী কেন?" শুধু আমাকেই বোঝানো নয়, বাবা-মায়ের সাথেও দিনরাত চলতো তাদের গুজুর-গুজুর ফুসুর-ফুসুর। তার ফলটা হত এই যে, বাবা-মা দুজনেই আগের থেকে আরো দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তো সংসারের ফাঁস আমার গলায় পড়ানোর জন্য।

অগত্যা দেড়-দুবছর বাদে মত দিতে বাধ্য হলাম। বাড়িতে, আত্মীয় বাড়িতে খুশীর জয়ডঙ্কা বেজে উঠলো। পরিবারের লোকদের একেবারে যেন উদ্ধার করে দিয়েছি। সুলগ্নার পরিবারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগটা হয়েছিলো বাবার এক বন্ধুর সূত্রে। দিনক্ষণ ঠিক করে, একদিন ধূসর দুপুরে প্রথম দেখা হয়েছিলো আমাদের। সুলগ্নার মা নেই। বাবাও বেশ অসুস্থ, অবসরপ্রাপ্ত। পেনশনের টাকায় ওদের সংসার চলে। প্রথমদিন ওকে দেখে আমার যে বিশেষ পছন্দ হয়েছিলো তা নয়। গায়ের রং যথেষ্ট চাপা, বেঁটে-খাটো চেহারা। আকর্ষণ করবার মতো বিশেষ ক্ষমতাও ওর ছিল না; আর ইচ্ছেটাও যেন ছিল না। সাধারণ একটা নীল রঙের চুড়িদার পরে আমাদের সামনে এসে বসলো। চুলটা একটা খোঁপা করে বাঁধা। প্রাথমিকভাবে কিছুক্ষণ কথা বলা হল। আমার বাবা ওকে বেশ কিছু প্রশ্ন জিগ্যেস করলো। তাতে জানলাম, সুলগ্না বি.এ পাশ করেছে বাংলা নিয়ে। গল্পের বই পড়ার শখ। ওর বাবা বলল, "মেয়ে সারাদিন বিভিন্ন বই নিয়েই বসে থাকে। বই পেলে আর কিছু চায় না। টিউশানির টাকায় বই কেনে আর পড়ে।" তারপর কিছুক্ষণ থেমে আবার বলল, "আমার যা হার্টের রোগ, তাতে কখন যে কি হয়ে যায়…।" মেয়ে বাবার কথার প্রতিবাদ করে বলে, "তুমি থামবে বাবা?"

খানিকক্ষণ কথাবার্তার পর একান্তে আলাপ করার জন্য আমাদের অন্য একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। সুলগ্নাকে ভালো লাগাটা আমার ওখান থেকেই শুরু। বাড়িতে গিয়ে এই বিয়েতে আমার সম্মতি জানানোর সময় ওর কিছু-কিছু কথা আমার মনে পড়ছিল। হয়তো তাই এতো সহজে আমি সম্মতি জানিয়েছিলাম। সুলগ্নাও বিয়েতে রাজী হয়েছিলো। পাঠক হয়তো এখানে জানতে চাইবেন, সুলগ্না আমাকে কী এমন বলেছিল যে, ওর প্রতি আমার হঠাৎ এতো অনুরাগ জন্মে গেলো। কিন্তু সেকথা আমি কাউকে বলবো না। সে যে আমার অন্তরের সম্পদ, আমার একান্ত নিজস্ব।

যাক, বিয়েতে আমার মত আছে শুনে সকলেই খুব খুশী। যত শীঘ্র সম্ভব দিন ঠিক করা হয়ে গেলো। বিয়ের দিন নয়। মেয়ের বাড়ি থেকে এ বাড়িতে আসার দিন। জানা গেলো, ঐ দিন পরিবারের অন্যান্য লোকদের সাথে সুলগ্না নিজেও আমাদের বাড়িতে আসছে। আমার বাবা – মা যদিও ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখল না। তাদের বক্তব্য ছিল, মেয়ের এখনই আসার কি হয়েছে? বিয়ের তো এখনও কিছু ঠিকই হল না। কিন্তু আমার এতে খুব ভালো লাগলো। আমি যদি তাকে দেখতে যেতে পারি, তবে ও কেন আমাকে দেখতে আসতে পারে না?

ওদের বাড়ি থেকে দেখতে আসার কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়। প্রথম প্রথম ফোনে আলাপ, তারপর সেখান থেকে সম্পর্কটা গাঢ় হতে লাগলো। অফিসের যত কাজ, যত খুঁটিনাটি, সব গল্প করে বলতাম সুলগ্নাকে। ও মন দিয়ে শুনত, কখনো-কখনো মন্তব্য করতো, প্রশ্ন করতো। ওকে বলতাম, "তোমাকে কথাগুলো না-বললে না, আমার ঠিক ফ্রেশ লাগে না।" ও বলতো, "তোমার কাছ থেকে এগুলো না শুনলেও আমার ভালো লাগে না। যেন কত বুঝছি।" এই বলে ও হেসে উঠত।

এক ছুটির সকালে জন্মভূমি পত্রিকার পাতা ওলটাতে গিয়ে দেখি, সুলগ্নার নাম। ওর লেখা কবিতা এই পত্রিকায় বেরিয়েছে? যতদূর জানি, জন্মভূমি পত্রিকাটা প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখা ছাড়া সাধারণত ছাপে না। আমি কবিতাটা পড়তে লাগলাম। একজন মাঝি, নদীর বুকে নৌকা চালাচ্ছে। তাকে জীবন-নদীতে ভাসমান মানুষের যাপন হিসেবে দেখানো হয়েছে। পড়তে-পড়তে যখন শেষ লাইনটা চলে এল, অনুভব করলাম, আমার দু'চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। তখনই ওকে ফোন করলাম। বললাম, "কি, ব্যাপার কি? জন্মভূমি পত্রিকায় লেখা বেরিয়েছে, আর আমাকে জানাও নি?

ও বলল, "বেরিয়েছে বুঝি? আসলে আমি তো নিজেই জানতাম না। আমার ফোনটা দোকানে, তাই হয়ত ওরাও জানাতে পারেনি। আর ইমেল-টিমেল আমি খুলিই না।" ওর কথার উত্তর না দিয়ে আমি বললাম, "তুমি এই পত্রিকায় লেখো, সুলগ্না?"

ও বলল, "হ্যাঁ, লিখি তো। গতবারের শারদীয়াতেও আমার একটা ছোটগল্প আছে। তুমি পড়ো।"

আমি বললাম, "জানো, এই জন্মভূমি পত্রিকাটা আমি কেন রাখি?"

ও বলল, "কেন?"

আমি বললাম, "ভালো মানের লেখা কিভাবে লিখতে হয়, সেটা শেখার জন্যে।"

ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। শুধু দ্রুত নিঃশ্বাস পড়ার আওয়াজ ভেসে এলো।
Next Part


All Bengali Stories    70    71    72    73    74    75    76    77    (78)     79   


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717