Home   |   About   |   Terms   |   Library   |   Contact    
A platform for writers

আংটি

Bengali Story

All Bengali Stories    78    79    80    81    82    83    84    85    (86)     87   

-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ আমাদের এই ওয়েবসাইট ( RiyaButu.com )-এ প্রকাশিত গল্পগুলির মধ্যে থেকে কিছু গল্প নিয়ে এবছরই প্রকাশিত হবে আমাদের 'রিয়াবুটু'র গল্প'।
--------------------------



আংটি

ড. মোহাম্মদ আলী খান ( PhD), লেখক ও গবেষক, ঢাকা, বাংলাদেশ
( Retired Additional Secretary, Government of Bangladesh)

বাইরে ঝকঝকে রোদ। শীতের রোদের মিষ্টি আবেশ চারিদিকে। শফি বসে আছে তার অফিস কক্ষে। বিসিএস অফিসার হিসাবে কৃতকার্য হবার পর এই প্রথম পদায়ন। টাংগাইল কালেক্টরেট। এক রুমে কয়েকজন বসলেও এখন সে একা, বেশ বিষণ্ণ। এখানে প্রথমেই দায়িত্ব পেয়েছে জুডিশিয়াল মুন্সিখানা সেকশনের। শাখার নিম্নমান সহকারী ফাইল নিয়ে এল, "স্যার, কাল জজকোর্টে মামলা আছে। জিপি সাহেব বলেছেন, তাড়াতাড়ি কাগজপত্র তৈরি করে দিতে।"

"কই আনেন দেখি।"

"এই যে স্যার।"

শফি সই করে দিল, কিন্তু অন্যদিন সে এটা-ওটা জিজ্ঞাসা করে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে, আজ চুপচাপ। এই সেদিন সেটেলমেন্ট ট্রেনিং শেষ করে এসেছে। কিছু হলেই পি-৭০ সিট নিয়ে কথা বলে।

সহকারী খুশি হয়ে চলে গেল। সহকারী চলে যেতেই সুলতানা ঢুকল। সে এবং তার স্বামী এই অফিসে শফির সহকর্মী, "কী শফি ভাই, কালকের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কেমন লাগলো?"

"সাদা শাড়ি পড়ে যে মেয়েটি নেচেছিল, চমৎকার।"

ও মনে ধরেছে? কিন্তু ও যে বিবাহিতা!"

"তা জানি।"

"বুঝেছি এই জন্য বিষণ্ণ বদনে বসে আছেন? তা চোখের কোণে কালি কেন, অনিদ্রা না কি অন্য কিছু?" সুলতানা জিজ্ঞাসা করলো, "কী হল শফি ভাই, সারারাত কি মশা কামড়িয়েছে?"

"রাতভর যন্ত্রণা।"

"কেন মশারি টানান নি?"

"মশারি...!"

"তা একটা নতুন মশারি কিনে ফেলুন না, থাকা খাওয়া তো প্রায় ফ্রি। বেতনের টাকাগুলোতে একটু হাত দিন। মানকচু কোনদিন খেতে পারবেন না জানি, কিন্তু মশার কামড় থেকে যে বাঁচতে হবে।"

শফি কিছু বলে না, সুলতানা মনে-মনে বলতে-বলতে চলে যায়, "কী যে হাড়কৃপণ, মশার কামড় খাবে কিন্তু মশারি কিনবে না।"

শফি ছাত্র জীবনে হাড়কিপ্টা ছিল, চাকুরী জীবনে এসেও কোন পরিবর্তন হয়নি। সহকর্মীর বাসায় গিয়ে অযাচিতভাবে বিনা নিমন্ত্রণে খেতে তার কোন অলসতা নেই। দুপুরে পিছু-পিছু গিয়ে বলে, "সুলতানা আপা, এই দুই নলা ভাত খাব, আর কিছু লাগবে না।" একদিন অনেক রাতে গিয়েছে, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ ঘরে নক করে গিয়ে বলেছে, "আপা ভাত খাব।" সহকর্মী বলে কথা, রাগ চেপে আবার টেবিল সাজাতে হয়েছে সুলতানার।

সুলতানা সুন্দরী, মুখে হাসি সব সময় লেগে আছে। সহজে কাকেও কিছু বলে না। কাজে অত্যন্ত চটপটে। এমন সুন্দর পরিপাটি করে শাড়ি পড়ে যে, শফির ভালো লেগে যায়; ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বিডিআর অডিটোরিয়ামে 'হারানো সুর’ দেখার সময় সুচিত্রা সেনকে যেমন লেগেছিল, তেমন। সারাক্ষণ সুলতানার পাশে ঘুর-ঘুর করে। অন্য সহকর্মী ও স্টাফরা ফিসফিস করে। কিন্তু সুলতানা এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। স্বামী-সংসার আর অফিস নিয়ে দ্রুত কাটে তার সময়। শফি যখন কাছে আসে, তখন তাকে একটু সময় দেয় বৈ কি।

◕ ঘটনা সামান্য। স্থানীয় একজন ডাক্তার, জেলা সদরে চাকুরী করেন, অবসর নেবার সময় হয়েছে। একটি মেয়ের বিয়ে বাকি আছে, কলেজে পড়ে। মিষ্টি চেহারা, হাসিটা আরো সুন্দর। গায়ের রং ফর্সা, চোখ দুটি ডাগর-ডাগর, পাতলা ঠোটে কী এক মাদকতা। হালকা নীল রঙের সালোয়ার কামিজ পড়ে এসেছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাবার সাথে। বাবার পাশে বসেছিল শফি । বাবা ও মেয়ের সাথে সালাম বিনিময় হয়েছে, কথা হয়নি।

সুলতানাকে শফি মুখ ফুটে বলে, "ঐ মেয়েটিকে এনে দিন। ভালো লাগে না অন্য কিছু।"

সুলতানা দুষ্টুমি ভরা চোখে বলল, "ও এইজন্য অনিদ্রা?"

সুলতানা আর তার স্বামী একদিন হাজির ডাক্তার সাহেবের বাসায়। রোগী হিসেবে নয়, পাত্রীর খোঁজে। ডাক্তার সাহেবের চাকুরী শেষ প্রান্তে, একজন বিসিএস অফিসারের নিকট মেয়েকে পাত্রস্থ করতে পারছেন ভেবে আনন্দিত; কবুল করলেন। শফিকে সুলতানা বলল, "কী ভাই, মিষ্টি খাওয়ান।"

মুখচোরা কৃপণ শফি সুলতানার বাসায় বসেই মিষ্টি খেল আর কিছুক্ষণ পর আর জানালা গলে আকাশের দিকে চেয়ে পৌষের মেঘমালার আসা-যাওয়া দেখতে লাগলো। সুলতানা সংসারের কাজে মন দেয়। শফিও ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে ধীরে লয়ে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি নিয়ে ডাকবাংলোয় ফিরল। ঘরের বারান্দায় যে ফুলের টবটি পেয়েছিল উওরাধিকার সূত্রে, তাতে অনেকদিন পর প্রায় মাঝরাতে পানি ঢালল। হঠাৎ পানি পেয়ে বাসি ফুলের পাপড়িগুলো ঝরে যায়। শফিকে সে রাতে আর মশা কামড়ায় নি।

কিন্তু রেবেকা বেঁকে বসলো। ডাক্তার বাবাকে বলল, "আমার পড়া শেষ হয়নি, এখন বিয়ে করবো না।"

বাবার আকুতি, "আমার চাকুরী তো প্রায় শেষ, এই ভালো পাত্র হাতছাড়া করা যাবে না।"

রেবেকার আপত্তি টিকে না, মা-ও বাবার পক্ষে। রেবেকার ফর্সা মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। কোনও ছেলের সাথে তার বন্ধুত্ব নেই। তবু শফিকে দেখে পছন্দ হয়নি। আগেই তাকে দেখেছে, কেমন যেন ভর্তা-মার্কা চেহারা, ঘাস-ফুল রঙা হাসি নেয়। কথা শুনলে বুঝা যায় কোন জেলায় বাড়ি। রেবেকার অপছন্দ সারাটা দেহ মন জুড়ে।

শফির ফুলের টবে গোলাপ ফুটেছে। স্বপ্ন দেখে, 'কে যেন গাঁথে ফুলমালা আনমনে।' কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা 'অমীমাংসিত রমণী’ বইটি পড়ে খুব ভালো লাগে।

ডাক্তার সাহেব মেয়ের বেঁকে বসা নিয়ে চিন্তিত। আত্মীয়-স্বজনকে বলেন, মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, "মা , আমার দিন তো শেষ, তোর পড়ালেখা শেষ হতে অনেক বাকি। তুই রাজি হয়ে যা।"

রেবেকা বাবার কথায় নরম হয় না। তবে চুপচাপ, তার সব কিছু যেন এলোমেলো। বাসার সামনে যে মাধবীলতা লাগিয়েছিল, বেশ বড় হয়েছে। সরু লালচে ফুল ফোটে, ঝোপে মৌটুসি ছুটাছুটি করে। ভালোলাগা মিষ্টি অনুভূতি খেলা করে যায় সারা ঘরময়। কিন্তু বাড়ির ভিতরে অস্থির পরিবেশ। একটু মুক্তির খোঁজে ঢাকায় আসে খালার বাসায়। খালাত ভাই তার চেয়ে বড়, উদ্ভিদবিদ্যার ছাত্র, তার সাথে বেড়াতে যায় বলধা গার্ডেনে। কী চমৎকার সে আয়োজন। একজন জমিদার মনের-মাধুরী মিশিয়ে এই বাগান তৈরি করেছে। পুকুরের পাড়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে, একটি ক্যাকটাস ৭৫ বছর বয়সের, মেক্সিকো থেকে এসেছিল একদিন এখানে। পাশে বিখ্যাত ক্যামেলিয়া। কবিগুরু নোবেল পুরস্কার পাবার পর একবার এসেছিলেন এখানে, মুগ্ধ ক্যামেলিয়া কবিকে কী আনন্দই দিয়েছে, তা তার ক্যামেলিয়া কবিতা পড়লেই বুঝা যায়। রেবেকার ইচ্ছা করে কেউ তার খোপায় ক্যামেলিয়া গুঁজে দিক। কিন্তু কে, সে তা জানে না; তবে সে শফি নয়।

বাসায় ফিরে শোনে, খবর এসেছে বাবা স্ট্রোক করেছেন। সে বাবার খুব সেবা করে। যমে মানুষের লড়াইয়ে বাবার জয় হয়। রেবেকা কথা দেয়, "রোগ যন্ত্রণায় কাতর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে, যেখানে বিবাহ ঠিক করেছ আমি সেখানেই রাজি।"

বাবা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করেন, "মা, তোর কল্যাণ হোক।"

◕ সুলতানা দম্পতি সব আয়োজন করে। মেয়ের পিত্রালয়ে পানিচুনি হয়ে যায় বেশ আড়ম্বরের সাথে। জেলা পর্যায়ের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সকল কর্মকর্তা উপস্থিত থেকে প্রাক-বিবাহ এ অনুষ্ঠানকে জমজমাট করে তোলেন। এর আগে শফি কয়েকবার হবু শ্বশুরালয়ে গিয়েছে, মিঠা-মণ্ডাই খেয়েছে। কিন্তু রেবেকা সামনে আসেনি কখনো।

এতকিছুর পর শফি নিঃশ্চুপ, তার যেন কোন কাজ নেই। ডাক্তার দম্পতি চাপ দেন বিবাহের তারিখের জন্য, কিন্তু শফি যেমন ভাবলেশহীন, তেমনি উদাস। ছোট্ট শহরে এ ধরণের অনুষ্ঠানের পর মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ের এ অপেক্ষা সমাজ মেনে নেয় না। এর ভিতর ডাক্তার সাহেব বদলি হয়ে চলে যান অন্য জেলায়। শফিও অন্য নারী খোজে, অদ্ভুত মানুষের চরিত্র।

সুলতানা এবার খেপে যায়। বলে, "কী শফি ভাই, মেয়েদের কী খেলার পুতুল ভেবেছেন? আমি সব লণ্ডভণ্ড করে দেব, সবাই জানবে আপনি নেমকহারাম।"

শফি নির্লজ্জের মত অফিসে ও বাসায় সুলতানার আহারে ভাগ বসিয়ে যায়। সুলতানা তার স্বামীকে বলে, "একটা কিছু কর।"

উত্তরে তার স্বামী-প্রবর বলে, "কমল মধু পিবিনি বোকই না ভোমরা।"

"মানে কি?"

"কমল-মধু পান করিতে ভুল করে না ভোমরা।"

◕ রেবেকার ডাক্তার বাবা বিপদে পড়ে যান, এখন কী করা যায়, ডাক্তার নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। রেবেকার মা বলেন, "একবার যোগাযোগ কর, দিনক্ষণ পাওয়া যায় কিনা?"

মেয়ে-পক্ষ এ দেশে দুর্বল পক্ষ। উত্তরে বাবা বলেন, "চেষ্টা তো করতেই হবে।"

সুলতানার মাধ্যমে খবর পৌছায় শফির কাছে। শফি যেন অন্যকিছু ভাবে। এই ভাবনার মাঝে সুলতানাকে না জানিয়ে একদিন সহসা হাজির হয় রেবেকার বাসায়। মনে হয় এতদিন কিছুই হয়নি। হবু শ্বশুর-শাশুড়ি বেশ যত্ন করেন। এবার শফি বলে, "আমি সব ঠিক করে রেখেছি। নির্দিষ্ট দিনে গ্রামের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবেন মায়ের কাছে, আমি থাকবো সেখানে।"

শুনে রেবেকা কিছু বলে না। আয়নায় নিজের চেহারা দেখে, শাওয়ারের নিচে নিজেকে পরখ করার চেষ্টা করে। শুনেছে প্রেমিক নাকি এখানেই খোজে অতলান্তিক মহাসাগরের গভীরতা। রেবেকার এক চাচা ও এক পড়শি মুরুব্বী বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান শফির মায়ের কাছে। কিন্তু শফি বাড়ি আসেনি, তবু বিশ্বাসে ভর করে বিয়ের প্রস্তাব পারেন দুই মুরুব্বী। শফির মা পারলে ঝেটিয়ে বিদায় করেন। বলেন, "আমার ছেলে কত বড় চাকুরী করে, সোনার টুকরো, তাকে তোমরা মেয়ে লেলিয়ে দিয়েছ। কিসের এ প্রস্তাব, আমার ছেলের জন্য জগৎসেরা বৌ আনবো।"

এবার ডাক্তার সাহেবের অসুস্থতাকে আর ভালো করা যায়নি। রেবেকার কোন দোষ নেই, তবু সব দায় যেন তার। সে শুধু ঝরে যাবে; বাসার পাশে সকালে শিউলি গাছটির নিচে দাড়িয়ে সে তুলনা করে ঝরা শিউলির সাথে; সবুজ ঘাসের বুকে আলো হয়ে শুধু ফুটে থাকে, কেউ নেই তাকে তুলে নেবার।

সুলতানা শুনে অবাক হয়। ইতোমধ্যে বদলির কারণে একে-একে সবাই শেওলার মত ভেসে গেছে। কিন্তু রেবেকার নিষ্পাপ মুখখানি বারে-বারে ভেসে ওঠে তার মনে। তবে খবর চাপা থাকে না। শফি এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর মেয়েকে বিয়ের জন্য ঠিক করেছে। নিশ্চয় ভালোবেসে নয়, বৈষয়িক প্রয়োজনে; যেখানে শিউলি ফুলের সুবাস নেই। ঝরা ফুলের মত রেবেকা দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যায়।

সুলতানা ও তার স্বামী পাশাপাশি দুই উপজেলায়। আর শফি যথারীতি উপকূলীয় এলাকার একটি উপজেলার ইউএনও। এখনো বিয়ে হয়নি শুনেছে। সুলতানা তার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করে, "শফির মত একজন অসভ্য লোক কীভাবে চাকরি করছে?"

সুলতানার স্বামী রসিক আছেন। বলেন, "সে কৃপণ হলে কি হবে, দিতে হাড়কৃপণ আর নিতে অকৃপণ। খোঁজ নিয়ে দেখ, এখনো মেয়ে খুঁজছে?"

সুলতানা রাগ করে বলে, "এই নেমকহারামির বিচার হবার দরকার।"

ওর স্বামী বলল, "এদেশে মেয়েরা দুর্বল পক্ষ, তুমি না হয় নারীনেত্রী, সবাই কি তাই?"

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। সারাদিন এই নিয়ে নানা ব্যস্ততা, কিন্তু রাতে শফি বড় একা, ভালো লাগে না। দেনাপাওনার আলাপের মাঝে এলেন উপজেলার পিআইও হুমায়ুন সাহেব, ইউএনও সাহেবের মনের দুঃখটা ধরে ফেলেন সহজে। বলেন, "চিন্তা করবেন না, একটা কিছু হয়ে যাবে, আমার স্ত্রী এ বিষয়ে খুবই করিতকর্মা।"

"তাই নাকি!" শফি’র মুখে বিস্ময়।

"স্যার, রাতে খাবারের সময় রাহেলার সাথে আলাপ করিয়ে দেব।"

শফি আজ পাঞ্জাবি পড়েছে, জমিনে ফুল আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। নিজের বেতনের পয়সায় কিনে নি, একজন ইউপি চেয়ারম্যান উপহার দিয়েছেন। এমন উপহার না-করা যায় না। তবু বললেন, "চেয়ারম্যান সাহেব, এসবের দরকার ছিল কি?"

"এটা কিছু না স্যার, ঢাকায় গিয়েছিলাম, সুন্দর পাঞ্জাবি দেখে পছন্দ হয়েছে, তাই আপনার জন্য নিয়ে এসেছি। গরীবের এই সামান্য উপহার দূরে ঠেলে দিবেন না স্যার।"

বাইরে ঝির ঝির বৃষ্টি। আকাশ মেঘলা, বাসার সামনে ঘাসগুলো এমনভাবে ভিজেছে যে পা দিলে ডেবে যাবে। তাই কয়েকটি ইট সাজিয়ে রাখা আছে। দোতালায় ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন হুমায়ুন সাহেব। ইউএনও স্যার আসবেন। গিন্নি রান্নাঘরে, ভালো কিছু রান্নার আয়োজন করছে।

বসের সাথে হুমায়ূন সাহেবের হৃদ্যতার কথা সহকর্মীরা সবাই জানেন। এসিআর লেখার ভয়ের কারণে নয়, বিষয়টা মূলত বৈষয়িক। বড় কর্তার সাথে লেনদেনের সম্পর্ক শুরু থেকে। তবে এসব মামুলি, প্রধান আকর্ষণ বস এখনো অবিবাহিত।

এই মেঘলা বেলায় ছুটির অপরাহ্নে আজকের আয়োজন-নবসৃষ্টির আনন্দে। বস স্মার্ট, হালকা পাতলা গড়ন, গোঁফের সরু রেখা যত্ন করে কাটা, মাথার সামনের অংশ হালকা হতে চলেছে। মফস্বলের জল নাকি এজন্য দায়ী। তাই বসের তাড়া আছে কিছু একটা করার। তবে মনের সব কথা বলতে পারেন না, কবিতা লেখারও অভ্যেস নেই, সব কথা জমা থাকে। বড় সমস্যা কথায় উপকূলীয় টান। এতসব অসুবিধা দূর করে হুমায়ুন দম্পতি নৌকা তীরে ভেড়ানোর সব কাজ প্রায় সমাধা করে এনেছেন।

শফি বলে, "জানেন ভাবী, একটা বড় জেলায় চাকরি শুরু করেছিলাম, কিন্তু সময় তো অনেক গড়িয়ে গেল," হুমায়ূন গিন্নী রাহেলার কাছে সে তার রোমান্টিকতার কথা বলে; কখনো রঙ লাগিয়ে, কখনো হতাশার সুরে। ঘনকালো চুল পিঠে এলিয়ে ডাগর চোখে মায়াবী আবেদন রেখে রাহেলা কথা বলে। রাহেলার সাথে সন্ধ্যার পর অনেকটা সময় কাটিয়ে দেয়। রাহেলা বলে, "আজ বৃষ্টির দিন খিচুরি বেঁধেছি, খেয়ে যাবেন।"

রাতের খাবারের জন্য অনুরোধ করতেই, কর্তার বস সানন্দে রাজী হয়ে যান। রাহেলাও এ ব্যাপারে উদার, বাসায় কাজের লোক আছে, উপরি পাওয়া থেকে বাজারে ঘাটতি নেই। আর অফিসের কর্তাব্যক্তিকে নিজের মত করে আপ্যায়ন করতে রাহেলার জুড়ি নেই। যখন আঞ্চলিক টানে 'ভাবী' বলে সালাম জানান, তখন রাহেলার মনটা একটি অতৃপ্ত সুখে ভরে যায়।

দুদিনের পরের ঘটনা, বৃষ্টি নেই, পূর্ণিমার চাঁদ হাসছে, চারিদিকে জ্যোৎস্না। আজকের আয়োজন একটু অন্যরকম। বস এসেছেন একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে। বর্ষাকালেও কেমন যেন বসন্তের হাওয়া লেগে গেছে।

হুমায়ূন সাহেবকে বসের বিবাহের সব আয়োজন করতে হচ্ছে; কেনাকাটা সহ বহু কিছু। রাহেলারও অনেক কাজ। হুমায়ূন দম্পতিকে এখন শফির দারুণ প্রয়োজন। কোন এক অখ্যাত গ্রাম থেকে উঠে এসে শফি যেন সুউচ্চ পাহাড়ের শীর্ষে বসে পূর্ণিমার চাঁদ দেখে। কিন্তু পূর্ণিমার আলো তাকে আলোকিত করে না। রাতের খাবারের জন্য হুমায়ূন সাহেবের বাসায় পা বাড়ায়।

"আসেন ভাইসাব," রাহেলার স্বাগত সম্ভাষণ। রাহেলা নীল রঙের লাল পাড়ের শাড়ি পড়েছে। অপূর্ব লাগছে। কৌতুক করে বলছেন, "নতুন বৌ এর জন্য কি-কি কিনলেন ভাই?"

শফি কাঁচুমাচু করে বলে, "সবই তো আপনি সাজিয়েছেন।"

হুমায়ূন সাহেব বললেন, "স্যার , কেনাকাটা প্রায় শেষ। তবে বিয়ের সময় একটি আংটি দিতে হবে, সারা জীবন ভাবী-সাহেবা তার স্মৃতি বয়ে বেড়াবেন।"

হঠাৎ করে শফির চোখ পড়ে রাহেলার উপর। তার সুন্দর মুখচ্ছবি বা উন্নত বক্ষ নয়, অন্যদিন যা ছিল শফির অব্যক্ত খোরাক। আজ খপ করে রাহেলার হাত ধরে ফেলে। শুভ্র সুন্দর সরু আঙ্গুলের ফাঁকে শোভা পাচ্ছে রুবি বসানো অনুপম আংটি। এই আংটি যেন তৈরি হয়েছে রাহেলার অনামিকার জন্য। একটানে শফি আংটিটা খুলে নেয়। বলে, "এই তো সুন্দর আংটি, আমার হবু বউকে মানাবে ভাল।"

হুমায়ূন সাহেব অগত্যা বলে ওঠে, "স্যার এ তো আমাদের বিয়ের আংটি!"

শফি উত্তর দেয়, "এ আংটি আমার বিয়েতে কাজে লাগবে।"

রাহেলা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে শফির চলে যাবার দিকে, এক অকস্মাৎ সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে যেন ভাসিয়ে নিয়ে যায় তার স্বপ্নের নীড়।

হুমায়ুন রাহেলার মাথা বুকে নিয়ে বলে, "এই আংটি যার আঙ্গুলে শোভা পাবে তার ভাগীদার আমিও। এবং অবশ্যই।"

কোন পূর্বাভাস না দিয়েই এই রাতে জোৎস্নাকে হঠাৎ ঢেকে ফেললো কালচে মেঘমালা। বাইরে জোরে বৃষ্টি নেমেছে, মেঝের গর্জন শোনা যাচ্ছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে...
( সমাপ্ত )
Next Bengali Story


All Bengali Stories    78    79    80    81    82    83    84    85    (86)     87   


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717