Home   |   About   |   Terms   |   Library   |   Contact    
A platform for writers

দৌড়বাজ হাউসকীপার

Bengali Story

All Bengali Stories    80    81    82    83    84    85    86    (87)     88   

-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ আমাদের এই ওয়েবসাইট ( RiyaButu.com )-এ প্রকাশিত গল্পগুলির মধ্যে থেকে কিছু গল্প নিয়ে এবছরই প্রকাশিত হবে আমাদের 'রিয়াবুটু'র গল্প'।
--------------------------



দৌড়বাজ হাউসকীপার

লেখক - সমরেশ মুখোপাধ্যায়, মনিপাল, কর্ণাটক

সলিলের পড়াশোনায় মাথা ছিল না। তাই মাধ্যমিকের পর ওর কাকা ওকে একটা বিলেতি ফ‍্যাক্টরিতে হেল্পার হিসাবে ঢুকিয়ে দেয়। ভালো সুপারিশ ছাড়া ওখানে ঢোকা মুশকিল। কাকা বলেছিলেন, "পড়ায় যখন তোর ইচ্ছা নেই, মন দিয়ে হাতের কাজ‌টা অন্তত শেখ।"

সেটা মন দিয়েই শিখেছিল সলিল। ফলে ক্রমশ হেল্পার থেকে মেকানিকে পদোন্নতি হল। মাইনে, ওভারটাইম মিলিয়ে রোজগার মন্দ নয়। তিনকুলে ঐ কাকাই সলিলের একমাত্র আপনজন। কাকার বাড়ীতেই ছোট থেকে মানুষ। কাকার অবস্থা ভালো, মনটাও দরাজ। তাই চাকরি পাওয়ার পরেও সলিলের থেকে এক পয়সাও নিতেন না তিনি। বলতেন, "আমি আর ক'দিন? পয়সা জমা, তোর একটা নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই দরকার।"

কাকার উদ্যোগেই সলিল একটা ছোট্ট দু-কামরার ফ্ল্যাট কেনে। সিংহভাগ অর্থ সাহায্যও কাকাই করেন। অকালে বাপ-মা হারানো এই নির্বিরোধী ভাইপোটির ওপর তাঁর অপত্য স্নেহ ছিল। তাঁর নিজের দু-ছেলেই দাঁড়িয়ে গেছে। কাকা সলিলকে বলেন, "দ্যাখ ঘর যখন হয়েছে, তাহলে এবার একটি সুশীল ঘরণীও দরকার। ক'দ্দিন আর কাকিমার হাতের রান্না খাবি। এবার নিজের বাড়িতে নিজের মতো সংসার কর।"

সলিলের বিয়েটাও কাকা-কাকিমার উদ্যোগেই হল। এসবের সাথেই বজায় ছিল ছোটবেলা থেকে সলিলের একমাত্র বিনি-পয়সার স্পোর্টসের শখ - দৌড়। ১৫০০ মিটার দৌড়ে সলিল ছিল সাবলীল। বছরে কয়েকবার হাফ ম‍্যারাথনও দৌড়োতো। তাই রোজ সকালে অভ্যাস করতো। একবার রাজ্য প্রতিযোগিতায় প্রথমও হয়েছিল।

কিছুদিন বাদে ওদের একটি মেয়ে হল। সরল আনন্দে তিনজনের ছোট্ট সংসার চলছিল ভালোই। কিন্তু সহজ সুখও জীবনে কখনো সয় না। একদা চালু কোম্পানি ক্রমশ রুগ্ন হয়ে এল। বাজারের কঠিন প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে গিয়ে কোম্পানিতে লোকসান শুরু হল। বিলেতি মালিকানাধীন কোম্পানি‌তে শ্রমিকদের মাইনে ছিল ভালো। তখন কোম্পানির আয়ের এক চতুর্থাংশই ব্যয় হত কর্মী‌দের বেতনে। তাই কর্তৃপক্ষ ইউনিয়নের সাথে আলোচনা করে কোম্পানি বাঁচাতে সবার মাইনে কিছুটা কমানোর প্রস্তাব রাখলেন। গাছ বাঁচলেই যে সবাই ফল খেতে পারে এই সহজ যুক্তি অপরিণামদর্শী ইউনিয়ন নেতারা মানলো না। ফলে লোকসানের বোঝা‌য় একসময় কোম্পানি‌ বন্ধ হয়ে গেল। বিয়ের কুড়ি বছর বাদে সবার সাথে পথে নামলো সলিল। উগ্ৰ ইউনিয়ন‌বাজীর অভিশাপে‌র এ এক অতি পরিচিত সত‍্যকাহিনী।

কাগুজে যোগ‍্যতা না থাকায় সলিল আর কোথাও কাজ পেলো না। শুরু হল জীবনধারণের নিমিত্তে নানা উঞ্ছবৃত্তি। একমাত্র মেয়ে শিখা‌র পড়াশুনোয় মাথা আছে। সরকারি কলেজে ইংরেজীতে অনার্স পড়ছে। তবু শিখা‌র ইচ্ছে বি.এ পাশ করে যে কোনো একটা চাকরি জুটিয়ে সংসারে সাহায‍্য করে। সলিল রাজি নয়। বলে, "দ্যাখ মা, আমার তো পড়াশুনোয় মাথা, মন কিছুই ছিল না বলে জীবনে তেমন কিছু করতে পারলাম না। তোর যখন দুটোই আছে তুই অন্তত: এম.এ অবধি পড়। আমি যেভাবে হোক চালাবো। সে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই ট‍্যূইশানি করে সময় নষ্ট করার কথা ভাববি না।"

শিখা‌ গভীর দোলাচলে ভোগে। একদিকে বাবার কষ্ট দেখে সংসারে সাহায্য করার তাগিদ, অন‍্যদিকে বাবার ইচ্ছাপূরণের বাসনা। তবু খারাপ লাগলেও মন দিয়ে পড়াশুনা করে ভালো ফল করার সংকল্প নেয় শিখা।

সলিলের এখন বয়স সাতান্ন। অনেক ঘাটের জল খেয়ে এখন ও একটা বড় পরিকল্পিত উপনগরী‌তে হাউসকিপিং বিভাগে কাজ পেয়েছে। হপ্তায় ছ'দিন সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটে ডিউটি। আট হাজার টাকা মাইনে। রবিবার ছাড়া আর কোনো ছুটি নেই। কাজ বলতে ওর জন‍্য নির্দিষ্ট চারটি এগারো-তলা ব্লকের প্রতি তলার প‍্যাসেজে ঝাড়ু, পোঁছা মারা ও প্রতি‌টা ফ্ল্যাট থেকে গারবেজ সংগ্ৰহ করে চাকা লাগানো ভ্যানে করে সীমানা‌র প্রান্তে সেন্ট্রাল ডাম্পে গিয়ে ফেলা। সপ্তাহে তিনদিন ওর জন‍্য বরাদ্দ রাস্তা, পার্কের অংশে ঝাড়ু দেওয়া। ওদের‌ মধ‍্যে কেউ কোনোদিন দরকারে ছুটি নিলে সেদিন তার কাজটাও বাকিদের ভাগাভাগি করে করতে হয়। কারণ অতিরিক্ত লোক নেই।

আমেদাবাদ থেকে সৌমেনের বাড়ীর জিনিসপত্র এসেছে 'গতি' ক‍্যুরিয়ারে। চুক্তি অনুযায়ী ওরা মাল বাড়ীর তলায় নামিয়ে দেবে। সৌমেনকে ওর আট-তলার ফ্ল‍্যাটে সেসব নিজের ব‍্যবস্থাপনায় তুলতে হবে। সৌমেন তাই মাল পাঠানো‌র আগেই ওর ব্লকের সিকিউরিটি‌ গার্ডের কাছ থেকে সলিলের খোঁজ পেয়ে কথা বলে রেখেছি‌ল। সেইমত চারটেয় ছুটির পর সলিল আর একজনকে এনে দু'জনে মিলে ওর সব মাল ফ্ল‍্যাটে তুলে দিল। লিফট থাকলেও বড় কয়েকটা মাল লিফটে ঢুকলো না বলে সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে যেতে হল। জুনের কলকাতায় ভ‍্যাপসা গরমে দুজনেই গলদঘর্ম অবস্থা। সৌমেন বলে, "কত দিতে হবে?"

সলিল কুণ্ঠিত ভাবে হাজার টাকা চায়। ভেবেছিল সৌমেন দরাদরি করবে। তবে যারা কায়িক পরিশ্রম করে ন‍্যায‍্য পয়সা চায় তাদের সাথে সৌমেন কখনো দরাদরি করে না। তাই ও সানন্দেই সলিলকে হাজার টাকা দেয়। খুব খুশি হয় সলিলও। সৌমেন জানতে চায়, "আপনারা কী ভাবে এটা নিজেদের মধ‍্যে ভাগ করবেন?"

সলিল বলে, "যেহেতু আমি এই কাজটা ধরেছি তাই আমি রাখবো ছ'শো, ওকে দেবো চারশো। যদি ও কখনো কাজ ধরে আমায় ডাকে তাহলে সেবার ও একটু বেশি রাখবে। এটাই আমাদের দস্তুর।"

সৌমেন ওর সমবয়সী সলিল‌কে বলে, "যদি কিছু মনে না করেন,একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো?"

"বলুন না।"

"দেখুন, একসময় আপনি নামকরা ফ‍্যাক্টরিতে মেকানিক ছিলেন, রাজ‍্যস্তরে দৌড়ে প্রথম হয়েছেন, এখন ভাগ‍্যে‌র ফেরে হাউস কিপিংয়ের কাজ করতে কি মনোকষ্ট হয়?"

সলিল বলে, "ও এই কথা, তা কী করবো স‍্যার, আমি তো বেশি পড়াশুনো করি নি। চাকরির বাজার তো খুব খারাপ। শিক্ষিত ছেলেরাই বেকার তো আমাকে এই বয়েসে কে কাজ দেবে বলুন। তাই বাড়ির কাছে এই কাজটা পেয়ে বর্তে গেছি। বছরে দু'সেট ড্রেস, এক জোড়া জুতো আর তিন বছরে একটা রেনপ্রুফ জ‍্যাকেট দেয়। আমার বাড়ি এখান থেকে তিন কিমি। একসময় প্র‍্যাকটিসে দেড় কিমি চার মিনিটে কভার করতাম।এখন বয়স হয়ে গেছে। রাস্তায় গর্ত, গাড়ি। তাই সকালে আমি টিফিন হাতে হালকা চালে দৌড়ে‌‌ আসি। শেয়ার অটোর জন‍্য অপেক্ষা‌ করতে হয় না। মিনিট পনেরো লাগে। যাতায়াতে ডেলি ষোলো টাকা অটোভাড়া বাঁচে। সারাদিন কাজের পর ক্লান্ত লাগে। তাই ছুটির পর হেঁটে যাই। তখন আধ ঘণ্টা লাগে।"

সৌমেন মুগ্ধ হয়ে বলে, "বাঃ, এই বয়সেও আপনি রোজ দু'বেলা ছ'কিমি পথ দৌড়ে, হেঁটেই চলে যান!"

সলিল বলে, "বহুদিনের দৌড়োনোর অভ‍্যাস‌ স‍্যার, তাই আমার কাছে এটা জলভাত লাগে। মাসে চারশোটা টাকাও বাঁচে। বউ বাড়ীতে চুক্তিতে সেলাইয়ের কাজ করেও কিছু আয় করে। আরাম, মান সম্মান এসব নিয়ে ভাবলে আমাদের চলে না। তাছাড়া কোনো কাজ‌ই তো ছোট হয় না স‍্যার। নীচু হয় মানুষের মন, দেখা‌র নজর। চুরি বা ভিক্ষে না করে সৎপথে পরিশ্রম করে সংসার চালাচ্ছি। সারাদিন খাটুনির পর রাতে শুলেই মড়া। দৌড়টা বজায় রেখে শরীর‌টাও ছিপছিপে আছে। ঈশ্বরের কৃপায় প্রেশার, সুগারের মতো বড়লোকী রোগেও ধরে নি। আপনাদের সবার আশীর্বাদে মাসে এমন এক আধটা ঠাওকা কাজ পেয়েও কিছু উপরি আয়‌‌ হয়। এভাবেই বেশ চলে যাচ্ছে। আমাদের চাহিদাও তো কম। কাকার দৌলতে নিজের বাড়িতে থাকি বলে ভাড়া লাগে না। খরচ বলে তাই খাওয়া পড়া আর মেয়েটার পড়াশোনা। একসময় হন্নে হয়ে ঘুরেছি স‍্যার, এখন ভালো‌ আছি। জানেন স‍্যার, যেদিন এই কাজটা পেয়েছি সেদিন আমরা তিনজনে মন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়ে‌ছি। অবশেষে ঠাকুর মুখ তুলে চেয়েছেন।"

স্কুলে‌র পরীক্ষায় সৌমেন বই পড়া বিদ‍্যায় Dignity of Labour রচনা লিখে ভালো নম্বর পেয়েছিল। আজ এক স্বল্প-শিক্ষিত পিতা তাঁর জীবনাচরণের মাধ্যমে সৌমেনকে তার‌ লেখা রচনার মর্মার্থ বুঝিয়ে দেয়। সলিলের হাত দুটো ধরে সৌমেন আন্তরিক ভাবে বলে, "ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি আপনাদের মেয়ে যেন ভালোভাবে পাশ করে আপনাদের স্বপ্ন সার্থক করে।" সৌমেনের মুঠোহাত কপালে ছুঁই‌য়ে প্রতিনমস্কার করে সলিল।

সারাদিনের ডিউটির পর আট তলায় ভারী-ভারী মাল তুলে তথাকথিত অন্ত‍্যজশ্রেণীর পেশায় নিযুক্ত এক বয়স্ক দায়িত্ব‌বান পিতা ক্লান্ত শরীরে কিন্তু প্রত‍্যয়ী পদক্ষেপে ঝকঝকে টাইলস মোড়া উজ্জ্বল প‍্যাসেজ ধরে ধীরে-ধীরে চলে যায়। সপ্রশংস নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে এক সচ্ছল প্রযুক্তি‌বিদ।
(সমাপ্ত)
Next Bengali Story


All Bengali Stories    80    81    82    83    84    85    86    (87)     88   


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717