Home   |   About   |   Terms   |   Contact    
RiyaButu
A platform for writers

ওখানেই ঝরেছিল মানুষের ঘাম


বাংলা স্বরচিত গল্প প্রতিযোগিতা - ২০২০, একটি নির্বাচিত গল্প


All Bengali Stories    61    62    63    (64)     65    66    67    68   

লেখক - সুপ্রিয় ঘোষাল, যোধপুর পার্ক , গড়িয়াহাট, কলকাতা

ওখানেই ঝরেছিল মানুষের ঘাম
নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার ২০২০
একটি নির্বাচিত গল্প
লেখক - সুপ্রিয় ঘোষাল, যোধপুর পার্ক , গড়িয়াহাট, কলকাতা

২৮-জুলাই, ২০২০ ইং

-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ আমাদের এই ওয়েবসাইট ( RiyaButu.com )-এ প্রকাশিত গল্পগুলির মধ্যে থেকে কিছু গল্প নিয়ে এবছরই প্রকাশিত হবে আমাদের 'রিয়াবুটু'র গল্প'।
--------------------------



ওখানেই ঝরেছিল মানুষের ঘাম

লেখক - সুপ্রিয় ঘোষাল, যোধপুর পার্ক , গড়িয়াহাট, কলকাতা

এক

এ আখ্যান ঘোর বর্ষার স্রোতস্বিনী নয়। জীবনের কামনা আর আকাঙ্ক্ষার কাছে কখনো হেরে যাওয়া, কখনো বা অমীমাংসিত হার-জিতের বাঁকে প্রোথিত—ব্যর্থ, দীর্ঘশ্বাস বহন করা - অথবা হার জিত মেলাতে না পারা, সময়ের রুদ্ধদ্বারে আটক এক প্রান্তিকের। যার কথা কেউ মনে রাখে, কেউ ভুলে যায়| স্মৃতি ভেসে যায় সময়ের অলকানন্দা জলে| কখনো-সখনো কোনও নিকটাত্মীয়ের স্মরণে সে মানুষ আবার ভেসে ওঠে, বুদবুদের মত, বর্তমান হয়। বর্তমান হয়? আসলে সত্যি কি সে লোক বর্তমান হয়? হয় না গো| যে অতীত সে চিরটা কালই অতীত হয়ে হারিয়ে যায় ভবিষ্যতের গর্ভে। আজ যে বর্তমান কালই তো সে অতীত। আগামীতে যে ভবিষ্যৎ, কালের স্পর্শে সেও অতীত হয় একদিন। যেন নদীর জল, স্থির নয়; সদাই চঞ্চল। কথায় বলে, এক নদী জল কেউ দু,বার দেখে না।

নদী? হ্যাঁ নদীই তো ৷ নদী প্রকৃতির এক বিচিত্র খেলা। খেলা না খেলাঘর? আজ এ পাড় ভাঙে তো কাল ও-পাড়। কখনো সে দাঁড়িয়ে থাকে স্থির জলরাশি বুকে নিয়ে। আবার কখনো বা সে বেগবান প্রাণোচ্ছল যুবকের মত। কখনো বা লোহার কারখানার শ্রমিকের মত সে পেশীবহুল, বলবান। কখনো বা মন ক্ষুণ্ণ বালিকার মত সে দুঃখিনী হয়ে ফুলে ফুলে কাঁদে। কখনো চঞ্চলা, কখনো স্থির। সে প্রকৃতির লীলাবতী কন্যা। সে প্রকৃতির বেগবতী কন্যা। কিন্তু এ গাঁয়ে তো নদী নেই। গাঁ শুধু নয়, তল্লাটেই নদী নেই কোথাও। সবটাই ডাঙা, নামটাও তাই সেই রকম -ঘোলাডাঙ্গা| তবে নদী যে একেবারেই নেই সেটা ঠিক নয়। আছে একটা মজে-হেজে যাওয়া নদী| নাম তার সুবর্ণবতী। লোকের মুখে মুখে তা এখন পুঁটি। পুঁটি নদী আর তার খাত এখন হেজে মজে গিয়ে খালের রূপ নিয়েছে| কোথাও বা সেটুকুও অবশিষ্ট নেই। সেটেলমেন্টের বাবুদের কেরামতিতে ক্ষমতাশালী লোকদের নামে রেকর্ড হয়ে গেছে ডাঙা জমি হিসেবে। সে এক গভীর চক্কর। এ আখ্যানের চরিত্রও তাই বদলে যেতে থাকে।

নদীর পাড় দেখেছে বিজন। গঙ্গা আর ফুলহরের মাঝের চরে বাড়ি ছিল তাদের। সে বাড়ির কথা আবছা মনে আছে তার। উঁচু দাওয়া-ওলা মাটির বাড়ি। টালির চাল| তার সাথে উঠোন, রান্নাঘর আর বাড়ির সামনে এক চিলতে জমিতে সবজির বাগান| বাড়ির ঠিক সামনেটার পূর্ব দক্ষিণ কোণে একটা ক্ষীরশাপাত আমের গাছ। একটা ঘরে ঠাকুরদাদা মতি মণ্ডল আর অন্যটাতে বিজন আর তার বাপ| বাড়িতে কোনও মেয়েছেলে নেই। বাড়ির সব কাজ তার বাপই করত। শুধু রান্নাবাড়া করে দিত বুড়ি অন্নদা দিদি। বলত, "তোদের মাগ-খেগোর বংশ| তোর মা যেমন চলে গেল এয়োতি, তোকে ফেলে রেখে, তেমনি তোর ঠাকুমাও চলে গেছল তোর বাপেরে এটুনি রেখে।"

খেলো হুঁকোয় তামুক টানতে টানতে আর কাশতে কাশতে ঠাকুরদাদা মতি মোড়াল শুনত সব কথা আর গাল পাড়ত অন্নদা দিদিকে – ‘চুপ কর, চুপ কর আবাগি বুড়ি, আমার একটাই মা-মরা পোতা| আমার বংশের পুঁজি| তারে এসব কথা বলতি লজ্জা করে না।"

তা সে কথা অন্নদা দিদি কানে তুলে বলত, "একশো বার বলব। তোমরা সব মাগ-খেগো। মাগ-খেগোর গুষ্টি তোমাদের।"

বাপ তারে নিয়ে যেত ফুলহরের চরে আর দূরে নদীর মাঝখানে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলত ওখানে নাকি তাদের আগের বাড়ি ছিল। তিনটে ঘর, গোয়াল, বাগান সব। সে সব নাকি ফুলহরের ভাঙনে কবে তলিয়ে গেছে। বাপের দুঃখ সবটা বুঝত না বিজন। বাপ তাকে মাঝে মাঝে মাঠেও নিয়ে যেত। তখন সে নওগাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কেলাস থিরি। সবুজ ধানের ক্ষেত। যেদিকে তাকাও চোখ যায় জুড়িয়ে৷ তারপর কার্তিকে সোনালি রঙ ধরত তাতে। আহা পাকা ধানের গন্ধ। কি যে মধুর সে বাস৷ সেই ফুলহরের চরে। সে গন্ধ এখনও পায় বিজন মোড়াল। এই করতে করতে সে আরেকটু বড় হল। আফতাব মাস্টার| তাহেরপুর হাইস্কুলের অক্ষের মাস্টার গো| বাপকে ডেকে বলল, "তোর ছেলের যা মাথা, তাতে ওর স্টার পাওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।"

বাপ বলত, "চাষার ব্যাটা, মাঠের কাজ না শিখলি চলবে ক্যামনে?" তারপর আষাঢ় মাসে ঠাকুরদা গেল মরে| বুকে ব্যাধি ধরেছিল গো, ক্ষয়কাশ তাতেই তার এন্তেকাল। আর তার দুমাস কাটতে না কাটতেই তাদের ভিটে সমেত দু'বিঘে জমি জলের তলায়। সেই থেকে বাপ-ব্যাটা জন মজুর| অন্যের জমিতে কাজ। ঝুপড়িতে বাস৷ আবার কখনও বা মাটি কাটার কাজ। সরকারি লেবার। সে-ও তখন সপিন্দির সরকারের ইটভাটাতে কাজে জুটে গেল। লেখাপড়া বন্ধ। আফতাব মাস্টার দুঃখ করে বলত নদীর ভাঙন তোর জীবনটাই তছনছ করে দিল রে বিজন। তোর মত অক্ষের মাথা আমি খুব বেশি পাইনি জীবনে। বাপ জনমজুর, ছেলে ইটভাটার শ্রমিক। দিনের শেষে সে-ই দুমুঠো ফুটিয়ে নিত দুজনের জন্যে। কিন্তু সে সবও বেশিদিন সইলে তো?

দুই

শুনশান দুপুর। কার্তিক মাসের শেষ। মাঠের কাজ এখন অনেকটা কম। বলতে গেলে নিড়েন দেওয়া ছাড়া আর কোনও কাজ নেই। আমনের ক্ষেতে সোনালি আভা। আহা দেখলে বুক জুড়ায়ে যায় গো। মাঠ থেকে নিড়েন দিয়ে ফিরেছে। বিজন মণ্ডল। খানিক আগে। তারপর চাট্টি ডাল-ভাত খেয়ে, দাওয়ার খুঁটিতে পিঠ ঠেকিয়ে খেলো হুঁকোয় তামুক টানছিল সে| একটু ঝিমুনি মত এসেছিল যেন। ঠিক সেই সময় নইমুদ্দিনের ভটভটির আওয়াজটা তার দাওয়ার সামনে এসে দাঁড়াল। ভটভটির আওয়াজে মেয়ে সন্ধ্যাও ঘর থেকে বেরিয়ে দাওয়ায় এসে দাঁড়িয়েছে।

-"তোমারে ডেকেছে কাকা অঞ্চল আপিসে৷ কাল দুপুর নাগাদ একবার আসতি বলেছে।" আড়চোখে সন্ধ্যাকে দেখতে দেখতে হড়বড় করে কথাগুলি বলে নইমুদ্দিন। নইমুদ্দিন অঞ্চল আপিসের পিওন। বেশিদিন চাকরি নয়। ইদানীং মোটরবাইক কিনেছে। তার মানে হাতে বেশ টু-পাইস আসছে এখন। তার দৃষ্টিটা ভালো লাগে না সন্ধ্যার। সে তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতর ঢুকে যায়।

-"কেন রে? আমারে আবার অঞ্চল আপিসে কেন?" থতমত খেয়ে কথাগুলি বলে ফেলে বিজন।

- "তা জানি নি। প্রধান সাহেব তোমারে খপরটা দিতি বলল," বলে সে দেখার চেষ্টা করে সন্ধ্যা কোথায় গেল। তারপর খানিকটা নিরাশ হয়েই বাইকে স্টার্ট দিতে দিতে আবার বলল, "কাকা কাল দুপুরবেলা, মনে থাকে যেন।" কথা প্রায় শেষ না করেই হুশ করে বাইক নিয়ে বেরিয়ে যায় সে। বিজনের মনে একটা খটকা যেন আশঙ্কার মেঘের মত জমা হতে থাকে, হতেই থাকে।

শুধু এ গাঁয়ে কেন, গোটা ঘোলাডাঙ্গা থানা এলাকাতেই কোনও নদী নেই। আছে একটা মরা নদীর সোঁতা। সেটা কোথাও খাল কোথাও বা ডাঙা। ক্ষেতের ফসল ফলে সেখানে কোথাও কোথাও। এক বাবুদের কায়দায় অন্য বাবুদের নামে রেকর্ড হয়ে যায়। নদী থাকলে মন উদাস হয়। নদীর কূল বড় সাংঘাতিক জায়গা হে। সেখানে বসলেই ভেসে যেতে ইচ্ছে হয়। দূর দিয়ে যখন ভেসে যায় পালতোলা নৌকা। মনটা তখন ব্যাকুল হয়ে যায়৷ ভেসে পড়তে ইচ্ছে করে। সংসারের বাঁধন ভুলে মন প্রজাপতি হয়ে যায়।

ফিডার রোডের ধারে ঝুপড়ি থেকে ঘোলাডাঙ্গা থানার আড়খালি গ্রাম অনেকখানি পথ। সে পথ পেরিয়ে আসার কথাও বিস্তর| সব কথা জমে ভারি হয়ে আছে বিজনের ফাঁপা বুকে। নদীর পাড় ভাঙার শব্দ সে যেন এখনো শুনতে পায়। সে ঘটনাও তো প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর হতে চলল। সে তখন গভীর ঘুমে অচেতন। বাবার ঝাঁকুনি আর মানুষজনের চীৎকারে ধড়মড় বিছানায় উঠে বসল। তারপর বাপ-ব্যাটায় এক দৌড়ে ভিটের বাইরে। তারপর শুধু ঘুম-চোখে তাকিয়ে দেখা, তাদের ভিটেমাটি, তুলসী মঞ্চ, সবজির বাগান, গোয়াল ঘর, গাই-বলদ সব সমেত ধীরে ধীরে তলিয়ে গেল ফুলহরের জলে। আহা সে কি বুক ফাটা আর্তনাদ মানুষের। শুধু কি তাদের ঘর? আরও অন্তত পনেরোটা গেরস্তর ঘর, গরু-বাছুর, হাল-বলদ সমেত ফুলহরের গ্রাসে তলিয়ে গেল| সবাই তারা উঠে এল শ্রীপুর স্টেশনে যাবার রাস্তার ধারে রেলের জমিতে। সার-সার ঝুপড়ির একটাতে তাদের ঠিকানা। মাঝে মাঝে মাঠ থেকে ফিরে বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠত, "আমি মলে তোরে কে দেখবে রে বিজু ? কী হবে তোর?" মাঝে মাঝে নেশাও করত বাবা। তার নাকে গন্ধ আসত। এ গন্ধ তার চেনা। সপিন্দির সরকারের ইটভাটার ম্যানেজার বলাই নাথের মুখেও এই গন্ধ সে পেয়েছিল। সেদিন নাথ চড়াও হয়েছিল তার ওপর। ঘেটি ধরে তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ইটভাটার পেছনের দিকে একটা ঘুপচি ঘরে। সে যেন একটা গুম-ঘর। দম বন্ধ হয়ে আসছিল বিজনের। তার ওপর বলাই-এর মুখের ওই দুর্গন্ধ। প্রায় আধ-ঘন্টাটাক বাদে সে যখন হাফপ্যান্টটা পায়ের নীচ থেকে ওপরে ওঠাতে পেরেছিল তখন তার শরীর, মন দুটোই ক্লেদাক্ত৷। ঘোরের মধ্যে সে শুধু শুনতে পেয়েছিল বলাই-এর গলা- "যদি কাউরে বলিস, তবে তোর লাশ তোর বাপেও আর খুঁজে পাবে না। এখন যা ভাগ!"

সেদিন ইটভাটা থেকে বেরিয়ে আসে সে। তারপর সোজা ফুলহরের চরে| মরে যেতেই ইচ্ছে করছিল তার| কিন্তু বাধ সাধল সেই আফতাব মাস্টার| সন্ধের মুখে সাইকেল নিয়ে ফিরছিল পাশের গ্রাম ধরমপুর থেকে দূর থেকে তাকে ঠাহর করে হাঁক পাড়ল -"কে? কে ওখানে? বিজন নাকি? সাঁঝের বেলা এখানে কী করছিস?"

কাছে এসে তার চোখে জল দেখেছিল মাস্টারমশাই। তারপর জিগ্যেস করেছিল, "কিরে কাঁদিস কেন?"

তাকে কিছু বলেনি বিজন। তার শরীর আর মনের অসহ্য যন্ত্রণা কেমন করে যেন টের পেয়েছিল মাস্টারমশাই। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল তার। তারপর তাকে সঙ্গে করে ঝুপড়িতে পৌঁছে দিয়ে বাবাকে বলেছিল, "এখানে আর থাকিস না| এখানে কী-ই বা আর আছে তোর ? কাল সকালে আমার কাছে আসিস| ঘোলাডাঙ্গায় চলে যাবার বন্দোবস্ত করে দেবো| আমার কলেজের বন্ধু ভবেশ মুখুয্যেকে চিঠি লিখে দিচ্ছি কিছু একটা হিল্লে হয়ে যাবে তোদের বাপ-ব্যাটার| ওদের অনেক জমিজমা, দেখভালের লোকজন তেমন নেই। তোদের পেলে বর্তে যাবে। আর হ্যাঁ, পারলে ছেলেটাকে লেখাপড়া শেখাস।"

-"বাবা!" সন্ধ্যার ডাকে চমক ভাঙে বিজন মোড়ালের। অন্যমনস্ক ভাবে সাড়া দেয়, "কী মা?"

-"কী বলে গেল লোকটা?"

-"পঞ্চায়েতে ডেকেছে আমারে কাল দুপুর বেলায়।"

-"কেন?"

-"তা তো বলল না!"

-"একা যেও না যেন। ভাইকেও সঙ্গে নিয়ে যেও।"

-"তোর ভাই তো কলেজে থাকবে তখন।"

-"যাবে না। আমি বারণ করে দেব। তোমার সাথে যেতে বলব।"

মা-মরা দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বিজনের সংসার। অন্নদাদিদির কথা তার বেলাতেও হুবহু ফলেছে৷ 'মাগ খেগোর গুষ্টি'। ছেলে হবার সময় তার বউ সারদাও গেল মরে। মেয়ে সন্ধ্যা তখন পাঁচ বছর। এখন চব্বিশ৷ তা সেই সন্ধ্যাই এখন তাদের বাপ-ব্যাটার অভিভাবক। বিয়ের কথা বললে সে ফুসে ওঠে৷ আর বিজনেরও কেমন জানি হু হু করে ওঠে বুকটা।

তিন

অঞ্চল আপিসের একতলায় বেশ ভিড়৷ দোতলায় উঠতে গিয়ে একটু হাঁপ ধরে গেল বিজনের। বয়েস সবসময় জানান দেয় শরীরকে। বয়েস? তা প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই হতে চলল। চাষের কাজে কিন্তু তার ক্লান্তি নেই। শুধু ধান রোয়ার কাজটা তার ভালো আসে না কোনও কালে। রোয়ার কাজে তাই সে ডেকে নেয় মধু ওঁরাও আর তার বউকে। হত দরিদ্র মধুর। মুখে কিন্তু অনাবিল হাসিটি প্রতীক চিহ্নের মত লেগে থাকে সর্বদা|

-"কোত্থেকে তোর এত হাসি আসে মধু?"

-"আকাশ ঠেয়ে গো বিজনদা৷, না হাসলি বাপ পিতামো কষ্ট পাবেনি," বলে মধু আবার হাসতে থাকে তাঁর বিড়ি খাওয়া, কালো ছোপ লাগা দাঁতগুলি বার করে।

দোতলার ঘরে প্রধান দিলীপ বোস বসে আছেন চেয়ারে। তার আশেপাশে আরও দু'চারজন ভদ্রলোক। তার মধ্যে জমির আপিসের আমিন আইনুদ্দিকে চিনতে পারল বিজন। বাকি লোকদের একজনকে খুব চেনা-চেনা লাগল। দিলীপ বোস স্থানীয় কোদলা হাই ইস্কুলের মাস্টার। এখন পাটির নির্দেশে ছুটি নিয়ে প্রধানগিরি করছেন। বিজন মোড়ালকে ঢুকতে দেখে বোস বলে উঠলেন, "এস বিজন এস। সঙ্গে কে? তোমার ছেলে?"

-"হ্যাঁ দিলীপদা৷ আমার ছেলে"

-"ও কী করে? লেখাপড়া?"

-"এই তো কলেজে ভর্তি হয়েছে এই বছর।"

-"বা বেশ৷ কই হে সমর তোমার যেন কী বলার ছিল বিজনকে? বলে ফেল।"

সমর? এতক্ষণ পরে চেনা চেনা লাগা লোকটার পরিচয় বুঝতে পারে বিজন। ভবেশ মুখুয্যের নাতি৷ এ তল্লাটে বেশি দেখা যায় না| বেশির ভাগ সময়েই জেলা শহরে থাকে। পাটির উঠতি নেতা৷ তাই বোধ হয় প্রধান সাহেবও অতিরিক্ত খাতির দেখাচ্ছেন ওকে।

-"হ্যাঁ," বলে খানিক গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে শুরু করে সমর, "আচ্ছা বিজনকা, তুমি যে আমাদের চার বিঘে জমি লিজে চাষ কর, সেটা দাদু কবে লিজ দিয়েছিল তোমাদের?

--"লিজ!" মাথায় প্রায় বাজ পড়ে বিজনের, "লিজ তো নয়, ভবেশ জ্যাঠা তো আমার বাপের নামে বর্গা করে দিয়েছিল ওই জমি।"

-"লিজ নয়? জমির রেকর্ড কি বলছে হে আইনুদ্দি?" সমর এবার প্রশ্নটা করে আমিন আইনুদ্দিকে।

-" পরচা তো বলছে ভবেশ মুখুয্যের নামে রায়তি জমি৷ বর্গাদার তো কেউ নেই। বিজনের বাপের নাম কোথাও রেকর্ডে নেই।" আমিনুদ্দিন কী একটা কাগজে চোখ বুলাতে বুলাতে বলে কথাগুলি।

-"রেকর্ডে না থাকাটা তো আপিস বাবুদের কারসাজি। আর নতুন আইন বলে যে রেকর্ড না করলেও বর্গাদারের সত্ত্ব বিলোপ হয় না।" এইবার কথাগুলি বলে ওঠে মানব, বিজনের ছেলে।

-"আচ্ছা!" কপট বিস্ময়ের ভঙ্গি সমরের গলায়, "তোমার ছেলে তো বেশ আইন-বাজ হয়েছে দেখছি৷ তা কলেজে রাজনীতি টাজনীতি করছে নাকি আজকাল? তা ভালো, চাষার ছেলে সবসময় যে চাষবাসই করবে তারই বা কী মানে আছে?"

ছেলে মানব কিছু একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে বিজন বলে, “তুই চুপ কর," বলে ছেলেকে কর্কশ ধমক লাগায়। তারপর গলাটা খানিক নামিয়ে মোলায়েম করে বলে, "আসলে আমি তো জানি ওটা বর্গা জমি?"

-"মানুষ চলে যায় বিজনকা। রেকর্ড থেকে যায়। তোমার কাছে যদি কোনও কাগজ থাকে দেখাও। না থাকলে আইনুদ্দি যা বলছে সে তো শুনলেই -"

-"আসলে কী হয়েছে জানো বিজন, ওই চার বিঘের মধ্যে দু'বিঘে পুঁটি নদীর খাত। আর বাকিটা সমরের দাদুর নামে। এখন সমরই তার ওয়ারিশ।" এবার কথাগুলি বলেন প্রধান সাহেব, "সরকার প্রকল্প নিয়েছে পুঁটি খাল আবার নতুন করে কাটবে, তাতে করে ওই জমি তো গেলই -"

-"আর বাকি দু'বিঘে আমি আর রাখতে চাই না। আমাদের পাটির সরকার। কম্পেনসেশন যাই পাই না কেন সরকারকেই দিয়ে দেব। মানুষের কাজে লাগবে। আর তা ছাড়া তোমাদের ভিটেটাও তো আমাদেরই জমি। সেটাও তো আমি ফেরত চাইছি এখনি।" সবটা এক লপ্তে বলে দম নেয় সমর।

-"তার মানে? আমি খাবো কী? আমার খোরাক তো ওই জমি থেকে।" অসহায়ের মত কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বিজন। কেউ কোনও উত্তর দেয় না তার কথার৷ ধীরে ধীরে বিজন আর মানব বেরিয়ে আসে অঞ্চল আপিস থেকে।

নদী না থাকলেও ভাঙ্গন থেকে যায়। তার কোনও সাক্ষী থাক বা না থাক।

চার

ফিকিরচাঁদ ফকির বলে খেদে, দিন থাকিতে, আপনার হিসেব নে রে দেখে;
যদিরে থাকে বেঠিক; কর তা ঠিক; তবেই নিকাশ দিবি সুখে।

আজ গাঁয়ে নবান্ন উৎসব। বারো মাসের তেরো পার্বণ। শুধু বিজনের ঘরেই টিমটিম করে একটা হলুদ লাইট জ্বলছে। সেই প্রায়ান্ধকার ছুঁড়ে শোনা যায় মানবের গলা, "বাবা আর ফিরবে নারে দিদি? আজ ন’দিন হয়ে গেল মানুষটার দেখা নেই।" যেন কিছু একটা আশ্বাস সে চায় সন্ধ্যার কাছে।

-"অলক্ষুণে কথা থামাবি?" সন্ধ্যার মনটা খাঁ খাঁ করতে থাকে। ভাইকে থামিয়ে দিলেও চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে তার। ন’দিন আগে শেষ বিকেলে মধু ছুটতে ছুটতে এসে তাদের উঠনের কাছে হাঁপাতে থাকে।

-"কি হয়েছে রে মধু?" বিজন জিগ্যেস করে।

-"তোমার জমিতে কারা নেমেছে বিজনদা| ধান সব কেটে নিল মনে হচ্ছে!"

-"সে কী রে! দাঁড়া আসছি!" বলে গামছাটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে যায় বিজন। সত্যিই জনা পাঁচেক লোক হেঁসো হাতে তার জমিতে। সূর্য ততক্ষণে অস্তে গেছে। অঘ্রানের সন্ধ্যা ঝুপ করে নেমে এসেছে তখন।

-"কে তোমরা?"

বিজনের কথা শেষ হওয়ার আগেই পেছন থেকে একটা ভারি কিছুর আঘাত তার মাথার ওপর নেমে আসে। পড়ে যেতে যেতে বিজন দেখতে পায় কাকে? ঠিক ঠাহর হয় না। বলাই কি? কিন্তু বলাই নাথ তো তো মরে গেছে বলে সে শুনেছিল। তাহলে এরা কারা৷ এরা কি সবাই বলাই। এদের মধ্যে কি একটাও আফতাব মাস্টার নেই? নাকি আফতাব মাস্টার এখনি এসে পড়বে। দূর থেকে তার সাইকেলের ক্রিং শুনতে পাবে বিজন। মাটিয়ে লুটিয়ে পড়তে পড়তে সে শুনতে পাবে আফতাব মাস্টারের গলা, "কিরে বিজন কী করছিস এখানে?"

বিজন আর বাড়ি ফেরেনি। পুলিশের খাতায় সে নিখোঁজ। ভাই-বোনে বেশ কবার গিয়েছিল ঘোলাডাঙ্গা থানায়। প্রতি বারই শুনে এসেছে তদন্ত চলছে। আসলে সেই তো রেকর্ড কথা বলে মানুষ নয়। মানুষের মুখ বন্ধ হয়। কখনও খোলেও আবার। কে যেন জীবনানন্দের কবিতা শোনায়, মানবের কানের কাছে মুখ এনে –
তুমি সেই নিস্তব্ধতা চেনোনাকো;
অথবা রক্তের পথে পৃথিবীর ধূলির ভিতরে জানোনাকো আজো কাঞ্চী বিদিশার মুখশ্রী মাছির মত ঝরে;
সৌন্দর্য রাখিছে হাত অন্ধকার ক্ষুধার বিবরে;
গভীর নীলাভতম ইচ্ছা চেষ্টা মানুষের — ইন্দ্রধনু পরিবার ক্লান্ত আয়োজন হেমন্তের কুয়াশায় ফুরাইতেছে অল্পপ্রাণ দিনের মতন।

ফুলহরের বুকে একটা সাদা পালতোলা নৌকা দেখা যায় আজকাল। আর তাতে ভেসে যেতে দেখা যায় সন্ধ্যা আর মানবকে। ধীরে ধীরে অঘ্রানের কুয়াশায় তাঁরা ক্রমশ মিলিয়ে যায়।

অন্যান্য গোয়েন্দা গল্প ও উপন্যাস:
নয়নবুধী   
কান্না ভেজা ডাকবাংলোর রাত    
মাণিক্য   
সর্দার বাড়ির গুপ্তধন রহস্য   
প্রেমিকার অন্তর্ধান রহস্য   
লুকানো চিঠির রহস্য   
সে তবে কে?   



All Bengali Stories    61    62    63    (64)     65    66    67    68   


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717