-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার - মে, ২০২৪' স্বরচিত গল্প লেখার প্রতিযোগিতা, ( প্রতি বছর মে মাসে )
Result
--------------------------
All Bengali Stories
150
151
152
153
(154)
155
156
◕
জুলুটি
লেখক - দীপ্তেশ মাজী, চেতলা রোড, কলকাতা
##
জুলুটি
লেখক - দীপ্তেশ মাজী, চেতলা রোড, কলকাতা
#
কাছারির সামনে বাংলোয় বসে-বসে দূরে ঢালু জমির পিঠে একের পর এক চা বাগানের শোভা উপভোগ করছে মেরি। সে সদ্য লন্ডন থেকে এখানে এসে মুগ্ধ হয়েছে বলা যায়। বিদেশে এসেও মন এমন একটা আচরণ কিভাবে করে, তাতেই ষোড়শী মেরি উইন চেস্টার আশ্চর্য বোধ করে। ইন্ডিয়া তো কালো চামড়ার লোকেদের থাকার জায়গা, অথচ থাকার জায়গা তো নয়, যেন ভূস্বর্গ!
সাল ১৮৯০, এ দেশ তখনও স্বাধীন হয় নি। দেশীয় রাজারা বলতে গেলে সবাই ইংরেজদের বশ্যতা মেনে নিচ্ছে। পাহাড় অধ্যুষিত আসামে তখন বাগিচা ফসলকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। শর্করা জাতীয় খাদ্যের চারিপাশে যেভাবে পিপীলিকার দল ভারি হয়ে ওঠে তেমনই পাহাড়ের গায়ে সারি-সারি কুটীর গড়ে ওঠে। ঝুম চাষ প্রতিহত করে আদিবাসীদের চা বাগানে বেগার শ্রমে বাধ্য করা হয়। অচিরেই চা রপ্তানিকে কেন্দ্র করে একাধিক ফ্যাক্টরি গড়ে ওঠে। স্কটল্যান্ড এবং লন্ডন থেকে দক্ষ কারিগর এবং বাণিজ্যে সহায়ক বা ডিরেক্টরের পদ এবং প্রশাসনিক কাঠামো উন্নত করতে সাহেবদের আগমন ঘটল। এমনই এক কোম্পানি হল, 'ইষ্ট জুভেনাইল টি প্রোডিউসার কোম্পানি'। যার ডিরেক্টর হলেন মি. জর্জ কাস্টার্ড। জর্জ এবং তার কয়েকজন সঙ্গী সাথীর দীর্ঘ মেয়াদি পরিশ্রমের ফসল এই জুভেনাইল কোম্পানি। নিজেরাই মাস-বছর এক করে স্বল্প পুঁজি দিয়ে গড়ে তুলেছে এই কোম্পানিকে। বর্তমানে প্রায় দেড়শো জন কর্মচারী। লুসাই, মার, লাই, চাকমা, মারা প্রমুখ উপজাতির লোক এখানে কর্মরত। তবে অধিকাংশই বেগার শ্রমের ভাগীদার। অনেক সময় দেখা গেছে, এদের জমিই বল পূর্বক আদায় করে সেখানে চা, কফি, রবার চাষ করা হচ্ছে। লাভের গুড় বিদেশে স্থানান্তরিত হচ্ছে।
জর্জ কাস্টার্ড কিন্তু যথেষ্ট সহানুভূতি প্রদর্শন করেন। খুব অল্প বয়সে বাণিজ্যের ওপর নিজের জীবন অর্পণ করলেও পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ এতটুকু কমে নি। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে বিবাহ করেন। অবশ্য এর কয়েক দিনের মধ্যেই ঘটে পত্নী বিয়োগ। তারপর, পাকাপাকি ভাবে নিজেকে কাজের সাথে জড়িয়ে নেন। সাফল্যও আসে তড়িঘড়ি। অন্যদের থেকে অনেকটাই আলাদা জর্জ। সময় করে লুসাইদের সাথে গল্প- গুজব করেন। য়্যুরোপীয়দের আড়ালে এই মানুষগুলোকে শীতবস্ত্র, খাবার-দাবার দেন। ফলে, এই বন্য মানুষগুলো অনেক সময়ই বিপদে পড়লে কোম্পানির বর্তমান ডিরেক্টর জর্জ কাস্টার্ড -এর কাছে ছুটে যায়।
সকালে হাতে করা গরম রুটি আর মধু সহযোগে আহার করলেন জর্জ। ন'টার ঘণ্টা এখনো পড়ে নি। এর মাঝেই দেখলেন মেরিকে। মেরির গাল দুটো ওর বাবার মত লালচে আর পাতলা আঁশের মত হলেও চোখ দুটো ঠিক ওর মায়ের মতন। উত্তরের পাহাড় দিয়ে ভেসে আসা দুটি শীতল মুক্তধারা যার আদরে চা বাগানের শোভা আর গন্ধে ম-ম করে। মেরি শুনে বলল, "বাবা, তুমি কি আবার কোনও পাহাড়ি মেয়ের পাল্লায় পড়লে?"
জর্জ নিজের টাই ঠিক করে বলল, "তার কি সুযোগ আছে মেরি! এত কাজ, চা বাগানের দেখাশোনা, তারপর তোমার মত একটা মিষ্টি ফুলকে সযত্নে লালন করা — এর পর প্রেম জানলা দিয়ে বেরিয়ে মেঘের সাথে মিশে অন্যত্র পলায়ন করবে।"
#
আজ সারাদিন বৃষ্টি। মেরি জানলায় বসে সারাটা দিন কাটিয়ে দিয়েছে। বিকেলে যখন প্রায় কাক ভেজা হয়ে জর্জ আসল, তখন মেরি বলল, "বাবা, আমি আজ ঐ মহিলাকে আবার দেখেছি! উনি চা বাগানে সারাটা দুপুর ছিলেন। অনেক বার মনে হয়েছে যাই, তাকে জিজ্ঞেস করি, 'আপনি কে? কেন এভাবে আমাদের ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকেন?' কিন্তু যেতে পারি নি। শুধু তুমি বারণ করেছিলে বলে। আর ফাদার তো তোমারই মতন! একই কথা বলেন।"
জর্জ কিছুটা শান্ত হয়েই বলল, "তুমি এখনো ছোটো আছো মেরি। ছোটদের, বড়দের কথা শুনতে হয়। এসো, আমরা কিছু খেয়ে নি..."
সামনের ঢালু জমি নিচে অনেকটা নেমে গেছে। তারপরই শুরু হয়েছে লুসাই পাহাড়। বাংলো থেকে পাহাড়ের মাঝের অংশ পরিষ্কার বোঝা যায়। এমনিতে দুপুরে, বিকেলে বা রাতে বাগানে কারুর প্রবেশ নিষিদ্ধ। বেশ কিছুদিন ধরেই মেরি লক্ষ্য করেছে, একজন অল্প বয়সী মেয়ে সামনে ঝুড়ি নিয়ে চা-পাতা সংগ্রহ করছে। সেদিন রাতে আচমকাই মেরির ঘুম ভেঙে যায়। জানলায় চোখ যেতেই সে আঁতকে ওঠে। ও কার মুখ!! ভীষণ মিশমিশে গায়ের রং। নীরবতায় ঢাকা চোখ দুটো যেন কেমন ঈশারা করছে ! তারপর মেরি বুঝল কেবল চোখ নয় বরং সেই নারী হাত নেড়ে তাকে ডাকছে! চাদরের একটা অংশ খামছে ধরেছে মেরি।
চা বাগানে ইদানীং মাঝে মধ্যেই হানাদারদের প্রকোপ পড়ে। ম্লেচ্ছ বা বিদেশিরা এভাবে তাদের জমি কেড়ে নিতে পারে না, ফলে স্থানীয় কিছু মানুষ ডাকাত, হানাদারদের দলে নাম লিখিয়েছে। রাত-বিরেতেই এরা আক্রমণ হানে বিদেশি সাহেবদের ওপর। তাই তারা লন্ডন থেকে এখানে নিজেদের পরিবার বয়ে আনতে ভয় পায়।
সেদিন ছিল উৎসবের দিন। চা বাগানের কর্মীরা এক -এক করে এসে নিজ-নিজ পাত্রে রান্না করা মাংস আর পাউরুটি নিয়ে যাচ্ছে। ডিসেম্বর মাস। ঠাণ্ডা যেন জানান দিয়ে যাচ্ছে। একটা কাঠের চেয়ারে বসে ছিলেন জর্জ। আজ বোধ হয় আর মেরির সামনে দাঁড়াতে পারবেন না। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ওয়াইন বেশিই খেয়ে ফেলেছেন। খুব বাজে জিনিস এই ওয়াইন। কম খেলে আশা মেটে না, আবার বেশি খেলে ঠিক থাকতে পারেন না। এই যেমন দূরে টেবিলের পাশে বসে থাকা এক পাহাড়ি মেয়ের খাওয়া দেখে তিনি কত কি ভাবছেন। জীবনে অনেক ধাক্কাই পেয়েছেন। সর্বাপেক্ষা ধাক্কা দিয়েছে মেরির মা। সেও এমন সুন্দরী ছিল। জর্জ একবেলা না দেখে থাকতে পারতেন না। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতেন।
মেরি অনেকক্ষণ নিজের পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকার পর জানলায় চোখ রাখল। সেদিনের পর আর ঐ মায়া ভরা ছবি ভেসে ওঠেনি। একটা মোটা সোয়েটার গায়ে চাপিয়ে মেরি বাইরে আসে। দূর দিয়ে ইংরেজদের নাচ-গানের শব্দ ভেসে আসছে। বাংলোর সামনে দিয়ে রাস্তাটা একেবারে ডান দিকে এবং আরেকটা বাম দিকে চলে গেছে। কৌতূহলী মেরি বাম দিকের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করে। তার দৃষ্টি জঙ্গলের ভিতর একটা ক্ষীণ আলোকে কেন্দ্র করে। কিন্তু হাঁটতে-হাঁটতে মেরি বুঝতে পারল, সে আর একা নেই!
অন্যদিকে, জর্জ কি একটা অশনি সংকেতের কথা চিন্তা করে বাংলো অভিমুখে প্রাণ পণে ছুটতে শুরু করেছে। আর দেরি করা যাবে না। কোম্পানিতে হুলস্থূল পড়ে গেছে। যে মেয়েকে তিনি স্বপ্নে দেখছিলেন সে আর কেউ নয় বরং আসামের দুর্দান্ত হানাদারদের গুপ্তচর। আসার সময় দেখলেন কাছারির এক অংশে কারা যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
"হায়! আমার মেরি—ক্ষমা কর আমায়! আমি এখুনি আসছি। জেসাস, আপনি আমার হয়ে দয়া করে মেরিকে বাঁচান —" ইত্যাদি কথা ভাবতে-ভাবতে জর্জ আসছিলেন। বাংলোয় এসে দেখলেন সেখানে কেউ নেই। চতুর্দিক খাঁ-খাঁ করছে। এবং শেষ পর্যন্ত জর্জও দূরের সেই আলোর সম্মুখীন হল। সারা শরীর কেমন হিম হয়ে এল। কেমন যেন গানের গলা ভেসে আসছে। ভেজা খসখসে মাটির পথ পেরিয়ে জর্জ এগিয়ে বিস্মিত হয়ে গেলেন। একজন অপরূপা মেয়ে কোমর দুলিয়ে অগ্নিকে সাক্ষী রেখে নাচছে। হানাদাররা, যারা আকস্মিক আক্রমণ হানার জন্যে এসেছিল তারা যেন এই নৈশ লীলায় মেতে উঠেছে। তারাও এই পাহাড়ি কন্যা বা জোলুটির আদব-কায়দায় বাঁধা পড়েছে।
জর্জ আর স্থির থাকতে না পেরে ঝোপ সরিয়ে নিজের প্রাণের তোয়াক্কা না করেই ডান হাত ধরে মেরিকে সজোরে একটা চড় কষালেন। ছত্রভঙ্গ উপজাতিরা সচেতন হয়ে যে-যার অস্ত্র তুলে নিল। এতক্ষণ যে-যার ঘোরে ছিল। মাটিতে আছড়ে পড়া মেরি এবার জর্জের দিকে তাকাল। জর্জের মেরুদণ্ড বেয়ে একটা কনকনে প্রবাহ খেলে গেল। মেরির মুখটা ঠিক যেন ওর মতন নয়। মুখের চারপাশে কালো ছোপ। নাকটা কেমন ভোঁতা! তাছাড়া মেরির শরীরে প্রচুর বল এসছে বলে মনে হল। মেরি যেন ঝিমিয়ে পড়ার মন্ত্রে বলল, "বাবু, তুই চামেলিকে মারলি? হেই তোর ভালোবাসা!"
জর্জ মাথা নিচু করে নিয়েছে ততক্ষণে। বহু বছরের কৃতকর্ম যখন ফিরে আসে তখন বর্তমানের সব কিছুই অদৃশ্য মনে হয়। কিন্তু জর্জের আশে-পাশের নেকড়ের দল খুব চালাক। ওরা জর্জকে ঘিরে ফেলল। স্বয়ং সর্দার জর্জের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বলল, "সাহেব, তোমার খেল-খতম! এখুনি আমাদের ইলাকা ছেড়ে যাবি নাকি বল! নয়তো তোর মেয়েকে আমরা অপহরণ করব।"
জর্জের মুখে আর কোনও ভাষা নেই। এর আগে নিজের প্রণয়ী তথা চা-বাগানের কর্মী চামেলিকে হারিয়েছেন। আজ হারাবেন দুজনের অবৈধ সম্পর্কের ভাগীদার, তাদের মেয়ে মেরিকে; যাকে ওর মাই প্রায় দেখা দিত। জর্জ কিছু করা বা ভাবার আগে রাইফেলের শব্দে আকাশ বিদীর্ণ হয়ে গেল। সর্দারের নেতিয়ে পড়া মুণ্ডু জর্জের হাঁটুর কাছে এসে পড়ল। জর্জ দেখল মেরি সজ্ঞানে গুলি ছুঁড়েছে। এই শিক্ষা ওর বাবার কাছেই শেখা। মেরি দৌড়ে এসে বলল, "বাবা, তুমি ঠিক আছো? আমার না শরীরটা কেমন ভারি লাগছিল। চল, আমরা বাংলোয় ফিরে যাই।"
জর্জ এতক্ষণ এর অপেক্ষায় ছিল। আর এক মুহূর্ত এখানে থাকলে বোধ-বুদ্ধি সব লোপ পাবে। কিন্তু ওঠার সময় জর্জের বুকে কি একটা বিধে গেল। মাটিতে আবার লুটিয়ে পড়ল কাছারির ডিরেক্টর জর্জ কাস্টার্ড উইন চেস্টার। মেরি দেখল, ওর বাবার বুকের মাঝ বরাবর একটা সরু তীরের মত জিনিস ফুঁড়ে এপার-ওপার হয়ে গেছে। খানিক বাদে রক্তে ভেসে গেল জামা আর পদ্ম ফুলের মত মেরির হাত। জর্জ নেভা-নেভা চোখ দেখল, দূরে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে চামেলি। চামেলির সাথে বিবাহ না হলেও সে তখন অন্তঃসত্ত্বা। এদিকে, লন্ডনে এলিজাবেথ নামে এক সুন্দরী মেম-সাহেবের সাথে জর্জের বিবাহ সম্পন্ন হয়, যদিও তাদের কোনও সন্তান হয়নি এবং অল্প দিনের মাথায় এলিজাবেথ মারা যান। থেকে যায় একমাত্র আশা-ভরসা মেরি। আর চিরকালীন ভ্রাম্যমাণ চামেলির মুক্তি না পাওয়া সত্তা। আজ, জর্জের মৃত্যুর সাথেই চামেলির অস্তিত্বের বিনাশ ঘটল। মেরি ফিরে গেল হানাদারদের কবলে।
ভাগ্যদেবী কিছুটা কারণ বশতই এই কার্যসিদ্ধি করে ছিলেন। প্রায় এক বছর পর ব্রিটিশ সেনারা অনুসন্ধান আর হত্যা-লীলা চালিয়ে মেরিকে উদ্ধার করে। তখন তাকে চেনার উপায় খুব কম। ভাষা প্রায় ভুলে গেছে। তবে, হানাদাররা ওকে নিজের মেয়ের চোখেই দেখেছিল। লন্ডন ফেরার পথে মেরি বা জুলুটি, একবার বাংলোর দিকে তাকায়। কি নিয়ে এসে ছিল, আর কি ফেরত নিয়ে যাচ্ছে? একবার, লুসাই পাহাড়ের দিকে চেয়ে দেখল। মনে হল, মেঘের আড়ালে পাহাড়ি গান ভেসে আসছে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে দুই ভ্রাম্যমাণ পথিক, যারা আজ মুক্ত।
( সমাপ্ত )
Next Bangla Story
All Bengali Stories
150
151
152
153
(154)
155
156
## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers.
The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation.
Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##
◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717