Home   |   About   |   Terms   |   Library   |   Contact    
A platform for writers

হালদারদের হানা বাড়ি

বাংলা গল্প

-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ আমাদের এই ওয়েবসাইট ( RiyaButu.com )-এ প্রকাশিত গল্পগুলির মধ্যে থেকে কিছু গল্প নিয়ে এবছরই প্রকাশিত হবে আমাদের 'রিয়াবুটু'র গল্প'।
--------------------------



All Bengali Stories    153    154    155    156    (157)     158   

হালদারদের হানা বাড়ি
লেখক- চন্দন চ্যাটার্জি


## হালদারদের হানা বাড়ি

লেখক- চন্দন চ্যাটার্জি

#
পশ্চিমবঙ্গে মুর্শিদাবাদ জেলার একদম শেষ প্রান্তে রেলস্টেশন আছে, যার নাম ধুলিয়ান-গঙ্গা। এখানে উত্তরবঙ্গ-গামী কোন এক্সপ্রেস ট্রেন খুব একটা থামে না, তবে সাহেবগঞ্জ-গামী এবং মালদা-গামী লোকাল ট্রেন কিছু থামে। 'ধুলিয়ান' মূলত বিড়ি- শিল্পে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে। বিড়ি শিল্পের বাদশাহ যে কোম্পানি, 'পতাকা-বিড়ি' তার অনেক কারখানা এখানে আছে। তাছাড়া ছোট-বড় অনেক বিড়ি কোম্পানির কারখানা এখানে আছে। এলাকাটি মূলত মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম। এই গ্রামের এক পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ভাগীরথী নদী এবং তার ওপারে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ন্যাশনাল হাইওয়ে, NH-12.

ধুলিয়ান বাস স্ট্যান্ড এই হাইওয়ের উপরে। ধর্মতলা থেকে উত্তরবঙ্গ যাবার সমস্ত বাস এখানে থামে। এছাড়া অটো, টোটো ও আর একটা যান এখানে খুব বিখ্যাত, সেটা হল ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়ার গাড়িতে ভাড়া কম, তবে ঝাঁকুনি বেশি। আমি একবার লালগোলা থেকে গিয়ে ছিলাম, সেই অভিজ্ঞতার কথাই বলব।

আমি কলকাতার একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে আভ্যন্তরীণ হিসাব পরীক্ষক হিসাবে কাজ করতাম। এই কোম্পানির কলকাতার বাইরে অনেক জায়গায় শাখা অফিস ছিল। এই শাখা অফিসে আমাকে মাঝে মধ্যে ফিজিক্যাল স্টক ভেরিফিকেশনে যেতে হত। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এটা সঠিকভাবে না করতে পারলে কোম্পানির অনেক ক্ষতি হতে পারে, বিশেষ করে এফ,এম,সি,জি কোম্পানিগুলোতে।

যাইহোক, মঙ্গলবার ২৫শে জুলাই অফিসের পর শিয়ালদা স্টেশন থেকে লালগোলা প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে লালগোলার উদ্দেশ্যে রওনা হই। বিকাল ৩.৪৫ মিনিটের গাড়ি ছাড়লো পাঁচটায়। শিয়ালদা থেকে লালগোলার দূরত্ব প্রায় ২৩৪ কিলোমিটার, সময় লাগে ৫ ঘণ্টা ৫০ মিনিট। প্রায় এগারোটা কুড়ি মিনিটে ট্রেনটি লালগোলায় পৌঁছাল। এইটি একটি সীমান্ত স্টেশন এরপর রেললাইন নেই। এখান থেকে ধুলিয়ান যেতে হলে বাই রোড যেতে হবে, কোনও ট্রেন নেই। আমার লালগোলাতে আসবার কারণ হল ধুলিয়ানের অফিসের ম্যানেজারের বাড়ি লালগোলায়, আমি তার সঙ্গে মোটর সাইকেলে করে চলে যেতে পারবো।

৫/৬ ঘণ্টা ট্রেন যাত্রা করে আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম। হোটেল প্রিয়াঙ্কা আগে থেকেই বুকিং ছিল তাই চেক ইন করে একবারে খাবারের অর্ডার দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পরে স্নান করে এসে দেখলাম রুম বয় খাবার দিয়ে গেছে। খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম। পরেরদিন, ধুলিয়ানের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার বিশ্বনাথ দাস সকালবেলায় হোটেলে এল, এবং আমি তার মোটর সাইকেলে চড়ে ধুলিয়ানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। লালগোলা থেকে ধুলিয়ান প্রায় ৫৫ কিলো মিটার রাস্তা, যেটা জঙ্গিপুর রঘুনাথগঞ্জ হয়ে NH-12 এর সঙ্গে মেশে। কিন্তু একটা শর্টকাট রাস্তা আছে গ্রামের মধ্যে দিয়ে যেটা জঙ্গিপুর হয়ে অরঙ্গবাদ, সুতি, আয়রন ব্রিজে উঠবে। তারপর মালদার দিকে কিছুক্ষণ গেলে ধুলিয়ান বাস স্টেশন পড়বে। এটা মূলত গ্রামের রাস্তা। আমরা এই গ্রামের রাস্তাটা ধরেছিলাম। প্রথমত দূরত্ব কিছুটা কম হবে এবং গ্রামের রাস্তা বলে ট্রাফিক অনেক কম হবে। আমরা সকাল আটটায় বের হয়ে প্রায় ১০টা৩০মিনিটে ধুলিয়ান অফিসে পৌঁছলাম। সারাদিন অফিসের কাজ করে দুপুরবেলা একটা হোটেলে লাঞ্চ করলাম এবং গঙ্গার ধারে একবার ঘুরেও আসলাম। বিশাল বড় গঙ্গা, এপার-অপার দেখা যায় না। তারপর আবার বিশ্বনাথের মোটর সাইকেলে চেপে বিকেল পাঁচটা নাগাদ ধুলিয়ান থেকে লালগোলার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। জুলাই মাস, বেলা বড়, তাই কোন অসুবিধা নাই। ধুলিয়ান থেকে অরঙ্গাবাদ, নিমতিতা পার হয়ে যখন সাজিনাপাড়ায় ঢুকলাম এমন সময় প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হল। যদিও আমরা গ্রামের রাস্তা ধরেছিলাম তথাপি এই এলাকায় লোকবসতি খুবই কম। কারণ এখানে খুব বেশি আফিং চাষ হয়। যদিও আফিং চাষ করা বেআইনি তথাপি লুকিয়ে চুরিয়ে অনেক জায়গাতে এখনও তার চাষ হয়। এই আফিং গাছে যে ফল হয় তার ওপরের আবরণটা আফিং বা লোকাল ভাষায় ডেড়ি ফল এবং তার বীজ থেকে তৈরি হয় পোস্ত। যাইহোক, আমরা যে গ্রাম্য রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম তার আসে-পাশে কোন দাঁড়াবার জায়গা ছিল না, তাই মোটর সাইকেলে চেপে ভিজতে-ভিজতে যাচ্ছিলাম। বৃষ্টিতে আমার চশমা ঝাপসা হয়ে গেল তাই সেটা খুলে পকেটে পুরলাম। খানিক বাদে বিশ্বনাথ বলল,"দূরে একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে, ওখানে গিয়ে একটু দাঁড়াব; বৃষ্টিতে আর মোটর সাইকেল চালান যাচ্ছে না।"

আমি বললাম, "ঠিক আছে চল ওখানে একটু দাঁড়ানো যাক, তারপর আবার যাওয়া যাবে।"

সেই মতো বিশ্বনাথ মোটর সাইকেলটাকে আস্তে-আস্তে বাড়ির কাছে নিয়ে এসে থামাল। আমরা মোটর সাইকেল থেকে নেবে বাড়ির কাছে এসে দেখলাম এটা আসলে একটা ভাঙ্গা বাড়ি। বাড়ির সামনে একটা দরজা আছে। সেটা অল্প চাপ দিতেই খুলে গেল। আমরা আস্তে-আস্তে ভিতরে ঢুকলাম। দোতলা বাড়ি, গেটের পর একটু বাগান, নানান গাছ আছে বটে, কিন্তু তা আগাছায় ভরে গেছে, যত্নের অভাব। পথ চলার রাস্তাটাও ঘাসে ভর্তি। নিচে সম্ভবত দুটি ঘর আছে। সামনে একটা বড় দালান আছে, উপরে দুটো ঘর আছে, একটা ঝুল বারান্দা আছে বাইরের দিকে। আমরা আস্তে-আস্তে সিঁড়ি দিয়ে দালানে উঠে দাঁড়ালাম। আমি চশমাটা পকেট থেকে বার করে মুছে সেটা আবার পরলাম। বিশ্বনাথ রুমাল বার করে মাথা, মুখ মুছতে লাগল। এমন সময় ভেতর থেকে একটা বয়স্ক লোকের আওয়াজ এল,"কে?"

আমি বললাম, "আজ্ঞে আমরা ধুলিয়ান থেকে আসছি, যাবো লালগোলা। রাস্তায় বৃষ্টি এসেছে তাই এখানে এসেছি। একটু বৃষ্টি কমলে আমরা চলে যাব।"

ভেতর থেকে আবার উত্তর আসলো, "ঠিক আছে, ভেতরে আসুন, কোনও অসুবিধে নেই।"

আমি বললাম, "না ঠিক আছে, এখানে দাঁড়াই।"

আবার উত্তর আসলো, "আসুন না, এখানে একটু বসতে পারবেন। বাইরে ঝাপটা দিচ্ছে ভিজে যাবেন।"

আমি বিশ্বনাথকে বললাম, "কথাটা ঠিক, একে আধ-ভেজা হয়েছি, এখানে দাঁড়ালে পুরো ভিজে যাব। চল ভিতরে গিয়ে বসি।"

কোন উপায়ন্তর না দেখে বিশ্বনাথ আমার পিছু-পিছু এল। ভেতরে ঢুকে দেখলাম ঘরটি প্রায় অন্ধকার, কোন আলো নেই। পিছন দিকে একটা জানলা খোলা আছে সেটা দিয়ে অল্প আলো ভেতরে আসছে। তাতে দেখা যাচ্ছে ঘরের কোনে একটা চৌকিতে একজন শুয়ে আছে, মনে হয় তিনি অসুস্থ। আপাদ মস্তক কালো কম্বলে ঢাকা। আর একজন ভদ্রলোক একটা চিয়ারে বসে আছেন। সামনে একটা ভাঙা টেবিল, তাতে কিছু প্লেট গ্লাস। একদিকে একটা ফটো ফ্রেম, তাতে একজন ভদ্রমহিলার ছবি বাঁধানো আছে। খুব সম্ভবত বিয়ের সময়কার ফটো, আবছা ধুলোয় ভর্তি আর একটা পুরানো আমলের পেন্ডুলাম ঘড়ি বন্ধ হয়ে আছে। ঘরের ভেতরে কিছু আসবাবপত্র আছে এদিক-ওদিক। ভদ্রলোক আমাদের দুটো মোড়া দিয়ে বসতে বললেন। আমরা সেখানে বসলাম। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "আপনি এখানে একাই থাকেন? আশে পাশে তো কোন বাড়ি দেখছি না.."

ভদ্রলোক একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে খানিকটা আক্ষেপের সুরে বললেন, তার নাম সৌমেন হালদার। পূর্ববঙ্গে তাদের বাড়ি ছিল। দেশভাগের পর তারা এখানে চলে আসেন। চৌকিতে যিনি শুয়ে আছেন, তিনি তার স্ত্রী। তার দুটো ছেলে আছে, তারা বহরমপুরে থাকে। আমি বললাম,"তাহলে তো আপনাদের বহরমপুরে থাকলে ভালো, কারণ এখানে এইভাবে সমস্ত কাজ তো নিজেকেই করতে হয়। ছেলেদের কাছে থাকলে সুবিধে।"

ভদ্রলোক বললেন, "এখানে কিছু জমি আছে, তা একজন ভাগে চাষ করে। সেখান থেকে যা আয় হয় তাতেই আমাদের চলে যায়। নিজের হাতের গড়া বাড়ি তাই ছেড়ে যেতে পারছি না। ছেলেরা অনেক বার আমাদের নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিল, আমরা যায় নি। এ ছাড়াও তিনি আরও কিছু নিজের কথা বলতে লাগলেন। আমরা আন-মনে শুনছিলাম, কিন্তু মনটা পড়েছিল বাইরে বৃষ্টির দিকে। কখন বৃষ্টি থামবে, তারপর আমরা বের হতে পারব। কারণ ঘরের আবহাওয়াটা এত গুমট লাগছিল যে এখানে কিভাবে দুজন জীবন্ত প্রাণী বসবাস করে সেইটা আমার একটু আশ্চর্য লাগছিল। এমন সময় বিশ্বনাথ বলল, "স্যার একটু চা হলে ভালো হতো..."

পাছে ভদ্রলোক শুনতে পেয়ে আমাদের জন্য চা বানাতে বসেন তাই আমি বললাম, "চুপ করো, এখানে চা কোথায় পাবে? বাহিরে দোকানে থেকে চা খাব।"

ভদ্রলোক কিন্তু আমাদের কথা শুনতে পেয়েছেন। তিনি বললেন, "চা তো আমি দিতে পারবো না, তবে লেবুর সরবত খেতে চান তো দিতে পারি। আমাদের উঠানে যে লেবুর গাছ আছে সেটা আমি বাংলাদেশ থেকে এনে বসিয়ে ছিলাম, এখনো ফল দিচ্ছে।"

আমি বললাম, "না না, তার দরকার নেই। আপনি ব্যস্ত হবেন না।"

উনি বললেন, "ঠিক আছে কোন অসুবিধে নেই। আপনারা বসুন, আমি লেবু তুলে আনছি।"

আমি দেখলাম ভদ্রলোক আমাদের সামনে দিয়ে আস্তে-আস্তে উঠে বারান্দা দিয়ে বাইরের দিকে গেলেন লেবু আনতে। এখানে একটা কথা বলা দরকার, ঘরের ভিতর ধুলোর মধ্যে আমাদের পায়ের ভিজে জুতোর ছাপ পড়ছে। কিন্তু ভদ্রলোকের পায়ের ছাপ পড়লো না, অথচ তিনি আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেন। এটা বিশ্বনাথ না লক্ষ্য করলেও আমি লক্ষ্য করেছি, তাতেই আমার একটু সন্দেহ হল, কিন্তু বিশ্বনাথকে কিছু বললাম না। প্রায় এক মিনিটেরও কম সময়ে মধ্যে ভদ্রলোক চলে এলেন হাতে তিনটে-চারটে লেবু। তারপরে একটা ছুরি দিয়ে সেই লেবু কেটে একটা বড় ঘটিতে দিলেন। তারপর তাতে নুন চিনি দিয়ে গুলিয়ে দুটো গ্লাসে ভর্তি করে আমাদের দিলেন। যখনই আমি গ্লাসটা মুখের কাছে তুললাম তখনই একটা বিকট পচা গন্ধ লাগলো, মনে হল গ্লাসের ভেতরে পচা ডিম ছিল, বা গ্লাসটা ডিমের অমলেট বানানোর জন্য ব্যবহার করা হতো এবং ভালো করে ধোয়া হয় নি, তাই গন্ধ ছাড়ছে। আমি একটুও খেতে পারলাম না। কিন্তু বিশ্বনাথ একটুখানি মুখে দিল তারপরে আবার গ্লাসটা রেখে দিল।

ভদ্রলোক দুটো লেবু আমাদের হাতে দিলে দিয়ে বললেন, এগুলো আপনারা নিয়ে যান বাড়িতে গিয়ে সরবত খাবেন। আমাদের গাছের লেবুতে অনেক রস আছে। এইটা আমার মনে ধরল, দুটোই আমি প্যান্টের পকেটে রাখলাম। এতক্ষণে আস্তে-আস্তে বৃষ্টি কমেছে আর আমাদের যেতে হবে এখনও অনেকটা পথ। তাই বিশ্বনাথ বলল, "স্যার চলুন, আর দেরী করা ঠিক হবে না।"

আমিও তাই ভাবছিলাম, অতএব ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা মোটরসাইকেলে চেপে লালগোলার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। জঙ্গিপুরে পোঁছে একটা চায়ের দোকান দেখতে পেয়ে আমি বিশ্বনাথকে বললাম, "তুমি চা খাবে বলছিলে... সামনের চায়ের দোকানে দাঁড়াও।"

আমরা চায়ের দোকানে ঢুকে বেঞ্চিতে বসে দোকানদারকে বললাম, "দুটো চা দেবেন?"

দোকানদার দুটোকে গেলাসকে ভালো করে গরম জলে ধুয়ে তাতে চা দিয়ে আমাদের দিলেন। বাহিরে বৃষ্টি থামলেও ঠাণ্ডা আমেজটা আছে। তাই গরম চা'টা বেশ তৃপ্তি লাগলো। আমি বিশ্বনাথ কে বললাম,"হালদারবাবু যে লেবু দিয়েছে তা তোমার কাছে রাখো। আমি হোটেলে থাকব আমার দরকার নেই," এই বলে পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম লেবু নেই। এ পকেট, ও পকেট, ব্যাগ সব দেখলাম কোথায় লেবু পেলাম না। বিশ্বনাথ বলল, "বোধহয় রাস্তায় পরে গেছে..."

হঠাৎ দোকানদার আমাদের কথা শুনতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, "আপনারা কোন হালদার বাবুর কথা বলছেন?"

আমি বললাম, "এই একটু দূরে মাঠের মাঝখানে একটা বাড়ি আছে, ওইখানে আমরা গিয়েছিলাম। বৃষ্টি পড়ছিল তাই আমরা অল্প সময়ের জন্য দাঁড়িয়েছিলাম।"

দোকানদার বলল, "আপনারা কি বাড়ির মধ্যে গিয়েছেন?"

আমি বললাম, "হ্যাঁ গিয়েছিলাম। ওখানে সৌমেন হালদার বলে এক বয়স্ক ভদ্রলোক আছেন, তার স্ত্রীও আছেন। তারা আমাদের লেবু শরবত খেতে দিয়েছিলে। এছাড়া গোটা দুটো লেবু আমাকে দিয়েছিলেন বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য। সেই দুটো রাস্তায় পরে গেছে বোধহয়।"

ভদ্রলোক বললেন, "আপনারা কি লেবুর জল খেয়েছেন?"

আমি কিছুটা ইতস্তত করে বললাম, "হ্যাঁ... মানে... গেলাস খুব পচা গন্ধ ছাড়ছিল বলে আমি খাইনি, কিন্তু আমার সহকর্মী বিশ্বনাথ একটু খেয়েছে।"

তখন ভদ্রলোক একটু মাথা চুলকে বললেন, "বসুন," এই বলে তিনি দুটো কাগজে একটু করে নুন নিয়ে, তাতে মন্ত্র বলে আমাদের হাতে দিয়ে বললেন, "এটা আগে খেয়ে নিন, তারপর জল খাবেন। তার পরে চা খাবেন।"

আমি বললাম, "কেন কি হয়েছে?"

তিনি বললেন, "আপনি আগে এটা করুন, তারপর আপনাকে বলছি পুরো ঘটনা।"

পেট খারাপ হলে আমার মা মাঝে মধ্যে আমাকে জোয়ান আর নুন মিশিয়ে খেতে দিতেন। এটা আমি জানি, পেটের গোলমালের খুব ভালো ওষুধ নুন আর জোয়ান। তাই এটা খেতে আমার আপত্তি হল না। আমি খেলাম, তাই দেখে বিশ্বনাথও খেলো। একটু পরে ভদ্রলোক একটু নিচু স্বরে আমাদের বললেন, "আপনারা যেখানে গিয়েছিলেন সেটা হালদারের বাড়ি ঠিকই, কিন্তু ওটা হানাবাড়ি, বসতবাড়ি নয়। ওখানে কেউ জীবিত থাকে না। যে সৌমেন হালদার আপনাদের লেবুর জল দিয়েছিল, সে মারা গিয়েছে আজকে পাঁচ বছর হল। তার দুজন ছেলে আছে ঠিকই, তারা বহরমপুরে থাকে, ব্যবসা করে। এখানে কেউ আসে না। এই বাড়িটা এলাকার লোকের কাছে হানাবাড়ি হিসেবেই খ্যাত। এখানে দিনের বেলাতেও কেউ যায় না। অনেকেই নাকি রাত্রিবেলায় ওই ভদ্রলোককে সাদা কাপড় মুড়ি দিয়ে লেবু গাছ থেকে লেবু তুলতে দেখেছে। সৌমেন বাবুর স্ত্রী মারা যায় এক অজানা জ্বরে। তারপর ছেলেরা অনেকবার বাবাকে নিজেদের কাছে রাখতে চেয়ে ছিল, কিন্তু তিনি যান নি। স্ত্রী বিয়োগের ছয় মাসের মধ্যে তিনিও মারা যান। ছেলেরা বাড়ীটা ভাড়া দেবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কোন ভাড়াটে পুরো একমাস থাকেনি। সবাই বলত, রাত্রি বেলায় কে যেন পুরো বাড়ি দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে। মাঝে মধ্যে ঘরের জিনিসপত্র এদিক-ওদিক সরে যায়।"

খানিকটা দম নিয়ে ভদ্রলোক আবার বললেন, "আমি গুণিন, ভুতের উপস্থিতি বুঝতে পারি। আপনাদের দেখে আমার মনে হয়েছে কোন কালো ছায়া আপনাদের পিছে-পিছে আসছে। তাই আমি নুন পরা দিয়েছি, ও কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।"

আমি দোকানদার ভদ্রলোককে সমর্থন করে বললাম, " এটা হতে পারে, কারণ দুটো বিষয়ে আমার সন্দেহ হয়েছিল। প্রথমত, ঘরে কোনও আলো নেই কেন? এত অন্ধকারের মধ্যে লোক থাকে কি করে? এবং ঘরটা ভীষণ স্যাঁতসেঁতে, কোনও রোগীর পক্ষে এই রকম ঘর ভালো নয়। দ্বিতীয়তঃ যখন আমাদের সামনে দিয়ে ভদ্রলোক লেবু তুলতে গেলে তখন তার পায়ের ছাপ কিন্তু মাটিতে পরছিল না। অথচ আমরা যখন ঘরে ঢুকি তখন আমাদের পায়ের ছাপ এদিকে-ওদিকে ছিল।

বিশ্বনাথ বলল, "আপনি এটা দেখেছেন, কিন্তু আমাকে বলেন নি?

আমি বললাম, "আমার অডিটরের চোখ, কাজেই কোন কিছুই আমার চোখে ফাঁকি দেওয়া যায় না। তাছাড়া ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে, তারপর উঠনের লেবু গাছ থেকে লেবু তুলে ফিরে আসতে প্রায় তিন মিনিট সময় লাগার কথা। অথচ ভদ্রলোক এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে ফিরে এলেন কি করে? তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল।"

দোকানদার ভদ্রলোক বললেন, " তাহলে আপনাদের সাহস আছে বলতে হবে। আপনারা জেনে শোনে ওর কাছ থেকে লেবুর সরবত খেয়েছিলেন। তবে ভয় নেই, আমি নুন পোরা দিয়ে দিয়েছি, আপনাদের কোন ক্ষতি হবে না।"

এর পর আমরা চায়ের কাপটা রেখে পয়সা দিয়ে আবার মোটর সাইকেলে উঠে পরলাম। যখন হোটেলে পৌঁছলাম তখন রাত্রি সাতটা। আমি বিশ্বনাথকে বললাম, "তুমি রাত্রি দশটা-এগারোটা নাগাদ একবার আমাকে ফোন করবে, কিরকম আছো তা জানাবে। তোমাদের বাড়িতে এ বিষয়ে কোন কথা না বলাই ভালো।"

ও ঠিক সাড়ে দশটায় আমাকে ফোন করেছিল। আমরা দুজনেই ভালো আছি, কোন অসুবিধা হয়নি। এর দু'দিন পরে আমি আমার কাজ শেষ করে কলকাতায় আবার ফিরে আসি। এটা আমার জীবনের একটা ঘটনা।
( সমাপ্ত )


Next Bangla Story

All Bengali Stories    153    154    155    156    (157)     158   


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717