Home   |   About   |   Terms   |   Library   |   Contact    
A platform for writers

মৃত্যুদূত

bengali online story reading

-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ আমাদের এই ওয়েবসাইট ( RiyaButu.com )-এ প্রকাশিত গল্পগুলির মধ্যে থেকে কিছু গল্প নিয়ে এবছরই প্রকাশিত হবে আমাদের 'রিয়াবুটু'র গল্প'।
--------------------------



List of all Bengali Stories

মৃত্যুদূত
লেখিকা - শ্রীপর্ণা দে, কলকাতা
( ১ ম পর্ব )


##
ঘরের সিলিং পাখাটা ধীর গতিতে ক্যাঁচ-ক্যাঁচ শব্দে ঘুরছে। নাইট বাল্বের মৃদু আলো ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। ঘড়িতে সময় সন্ধ্যে ছ'টা। অদূরের অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কার ভাগ্যে মৃত্যু যে কখন লেখা আছে কে জানে! মশারির ভিতর অম্লান শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে আর ঈষৎ কম্পিত ঠোঁটে সে বিড়বিড় করে পরিচিত- অপরিচিত ব্যক্তির মৃত্যু সংখ্যা গণনা করছে। চার দিনের জ্বরে তার শরীরের বারোটা বেজে গেছে। ডাক্তার দেখিয়ে নিয়মমাফিক ওষুধ খেয়েও জ্বর যেন সারতে চাইছে না। শুকনো কাশি হচ্ছে। শরীর প্রচণ্ড দুর্বল। ব্লাডপ্রেসারটাও লো। তার সঙ্গে মাঝেমধ্যেও খিঁচুনি শুরু হচ্ছে। চারদিকে কোভিড পরিস্থিতি যা মহামারীর আকার নিয়েছে তা ভয়ের বিষয়। অম্লানকে ঘিরে তার স্ত্রী বিপাশার ভয়, শঙ্কা বাড়ছে। বিপাশা আজ সকালে কোভিড পরীক্ষার জন্য অম্লানকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু অম্লান বলল,"আজ দিনটা দেখি। কোভিড যদি পজিটিভ আসে তাহলে তো হাসপাতালের বিল মেটাতে শেষ হয়ে যাব। আমার চাকরিটাও নেই।"

স্ত্রী বিপাশা আর চার বছরের মেয়ে রিঙ্কিকে নিয়ে অম্লানের ছোট সংসার। আট বছরের বিবাহিত জীবন তার। অবশ্য দু'বছর আগে অম্লানের বাবা রমাপদবাবু ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ তিনি কার্ডিয়াক হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। রমাপদবাবুর মৃত্যুর আগে তাঁর পেনশনের টাকায় বেশ স্বচ্ছল ভাবেই সংসার চলত। বাবার মৃত্যুর পর অম্লানের কাঁধে সংসারের বোঝা এসে পড়ে। একটা ছোট-খাটো কোম্পানীতে চাকরি করে কোনরকমে চলে যাচ্ছিল। কোভিড মহামারী ঘোষণার পর দেশজুড়ে লকডাউন শুরু হলে অম্লানের কোম্পানি চাকরি থেকে তাকে ছাঁটাই করে। সেই চাকরি আদৌ আর ফিরে পাবার সম্ভাবনা নেই। চার মাস ঘরে বসে থেকে সে যেন আরও অসুস্থ বোধ করছে।

বিয়ের সময় অম্লানের বয়স ছিল ত্রিশ। গোলগাল সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। লম্বা পেটানো শরীর। চওড়া বুকের ছাতি। গায়ের রঙ ফর্সা। মাথা ভর্তি হালকা কোঁকড়ানো চুল। মুখে চাপ-দাড়ি। মুখশ্রীর মধ্যে একটা অদ্ভুত সারল্য। ধারালো নাক। স্বপ্নে ভাসা চোখ। সব মিলিয়ে নায়কোচিত চেহারা বললেও ভুল হয় না। অম্লানের স্ত্রী হিসাবে বিপাশা তার বাহ্যিক রূপের কাছে অনেকটাই ম্লান। ছয় বছরের ছোট বিপাশাকে যখন অম্লান বিয়ে করে বহরমপুরের বাড়িতে নিয়ে আসে তখন তার বয়স চব্বিশ। গায়ের রঙ ময়লা। মাঝারি উচ্চতা। মোটাসোটা শরীর। ছোট-ছোট দু'চোখ। নাক বসা। গাল ভারী। দুধে সরের আস্তরণের মতো মাথায় পাতলা চুল। অম্লান- বিপাশার যখন বিয়ে হয় তখন পাড়া প্রতিবেশীরা নতুন বউকে দেখতে এসে বলেছিল — সুন্দর ছেলেদের কখনো সুন্দরী বউ জোটে না।

অম্লানের বয়স এখন সাঁইত্রিশের ঘরে। গত আট বছরে অম্লানের চেহারা এত ভেঙে গেছে যে পূর্বের চেহারার সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। বর্তমানে বিপাশার- অম্লান একেবারে মানানসই। চার মাস বেকার অবস্থায় থাকার ফলে সাংসারিক চিন্তা ভাবনা তাকে বয়সের তুলনায় আরও বুড়ো করে দিয়েছে। জমানো টাকায় সংসার চলছে। কিন্তু সে বোঝে, জমানো অর্থের উপর বেশিদিন ভরসা করে থাকা যাবে না। জমানো অর্থ আর ঘড়ায় তোলা জল একই ব্যাপার। বাইরে থেকে দুটোকেই জোগান না দিলে যতই হিসাব করে চলো তা ফুরাতে বাধ্য। হিসাবের অতিরিক্ত অর্থ তাদের নেই।

অম্লানের শরীর খারাপে সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছে বিপাশা। ভদ্র, মার্জিত, শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত লাজুক এবং মুখচোরা স্বভাবের। বাইরের জগত সম্পর্কে সে একেবারেই অনভিজ্ঞ। বিয়ের পর অম্লান চেয়েছিল বিপাশাও চাকরি করুক। দুজনের উপার্জনে সংসারের চেহারার খানিকটা পরিবর্তন আসবে। কিন্তু বিপাশার পক্ষে চাকরি যে সম্ভব নয় তা সে অম্লানকে জানিয়ে দিয়েছিল, "আমার দ্বারা সংসার সামলে চাকরি-বাকরি হবে না বাপু। ওটা তুমিই করো। সারাদিন সংসার সামলাবো। আমাদের যখন বাচ্চা হবে তখন তাকে মানুষ করব। আমার চব্বিশ ঘণ্টা তোমাদের নিয়েই কেটে যাবে।" অম্লান বিপাশার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে জোর করেনি।

সংসার নিজের ছন্দে চলছিল। কিন্তু রমাপদবাবু মারা যাবার পরই বিপাশা বুঝতে পারে যে আর্থিক সঙ্গতি না থাকলে অনেক কিছু থেকে পিছিয়ে আসতে হয়। তাকেও পিছিয়ে আসতে হয়েছে অনেক কিছু থেকে। মেয়ে রিঙ্কিকে ইংরাজি মাধ্যম স্কুল থেকে ছাড়িয়ে সাধারণ সরকারি স্কুলে ভর্তি করতে হয়েছে। কাজের লোক ছাড়িয়ে সংসারের যাবতীয় কাজ বিপাশাকে নিজের হাতে করতে হচ্ছে। অর্থ সাশ্রয়ের জন্য টিভির কেভল কানেকশন কেটে দেওয়া হয়েছে। ফ্রিজটা আগেই বিক্রি করে দিয়েছে অম্লান। খাওয়াদাওয়ার বিলাসিতা অনেকখানি ছেঁটে ফেলতে হয়েছে। আগে যেখানে প্রতিদিন মাছ অথবা মাংস হতো এখন সপ্তাহে একটা দিন মাছ আসে। তাও কোনো-কোনো সপ্তাহে সেটাও জোটে না।

বিপাশা ভাবে যে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দিন-দিন যা দাম বাড়ছে তাতে উপার্জনের পথ বার করা ছাড়া কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই। তার স্বামীর স্বল্প আয় কড় গুণে হিসাব করে ব্যয় করতে হয়েছে। তাই অম্লানকে না জানিয়ে সে মাস দুয়েক হলো বাইরের কাজ করছে। পাড়ার বাইরে চারটে বাড়িতে হোম ডেলিভারি খাবার দেয়। মধুদার মুদিখানায় সকালের সময়টায় বসে হিসেবের খাতা লেখে। বিকালে কাগজের ঠোঙা বানিয়ে দোকানে বিক্রি করে। কাজের ব্যস্ততা তার সময় কেড়েছে। আকালের বাজারে কাজ নির্বাচন করে কাজ করার ফুরসৎ সে পায়নি। পেটে বিদ্যে থাকায় এসব কাজে তার সঙ্কোচ বোধ হয়েছিল। দুটো টিউশনি পাওয়া গেলে তার ভালো হতো। সাংসারিক অভাব তাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় নামিয়েছে। কোনো কাজই এখন তার কাছে ছোট নয়। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে-করতে মাঝে-মধ্যে বিপাশার চোখে জল আসে। অক্লান্ত পরিশ্রমে তার শরীর একেবারে শীর্ণ হয়েছে। সে হাঁপিয়ে ওঠে সংসারের জাঁতাকলের নির্মম পেষণে।

অম্লানের মতোই সংসারের চেহারাটা খারাপ হয়েছে। বিপাশা সংসারের হাল শক্ত করে ধরায় কোনো রকমে চলে যাচ্ছে। অম্লানের চাকরি হঠাৎ করে চলে যাওয়ায় সংসারের নগ্ন কঙ্কালসার শরীরটা বেরিয়ে এসেছে। অসুস্থ অম্লানের মাথায় হাত দিয়ে বিপাশা অসহায় বাচ্চা মেয়ের মতো কেঁদে ফেলল। কপালে চোখের জলের ফোঁটা পড়তেই অম্লান চোখ খুলে বিপাশার বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকাল। সে বিপাশার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল, "বাচ্চা মেয়ের মতো কাঁদছ কেন! আমি কি মরে গেছি নাকি!"

বিপাশা অম্লানের মুখে হাত দিয়ে বলল, "এসব কথা একদম বলবে না। যত অলক্ষুণে কথা তিন-সন্ধ্যাবেলায়। আমার কান্নার কপাল। তাই কাঁদছি।"

অম্লান গলা খুসখুসে কাশি কেশে বলল, "জানি তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে। একাকী সারাদিন মুখ বুজে অভাব- অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। ঈশ্বর ছাড়া পাশে কেউ নেই। চাকরি চলে যাওয়ায় পাড়া- প্রতিবেশীরা আমাদের বাড়িতে আসা- যাওয়া বন্ধ করে দিলো। বোধ হয় অনেকেই ভাবল যদি আমরা ওদের কাছে সাহায্য চাই। আচ্ছা বাবার বন্ধু সমীর কাকু, মালতী কাকিমা কি এসেছিল?"

বিপাশা চোখ মুছে বলল, "না, কেউ আসেনি। মানুষ আজকাল বড় স্বার্থপর। তোমার যেদিন প্রথম জ্বর হলো সেদিন মালতী কাকিমা এসে উপদেশ দিলেন। আমাদের রিঙ্কি নাকি ওনার নাতিকে ভেংচি কেটেছে। মেয়েকে ভালো শিক্ষা দিতে বললেন। জানো, মানুষ যতক্ষণ বেঁচে আছে ততক্ষণই তার দাম।"

— "ঠিকই বলেছ। সমীর কাকু এই মালতী কাকিমার চিকিৎসায় বাবার কাছ থেকে ত্রিশ হাজার টাকা, বাড়ি করতে এক লক্ষ টাকা ধার নিয়েছিলেন। পরে অবশ্য দু'বছরের মধ্যে শোধ করে দিয়েছিলেন। দুঃসময়ে পাশে থাকার কথা আজকাল কেউ মনে রাখে না।"

— "কাল বিকেলে সুনীতা মাসিমা এসেছিলেন কিভাবে সংসার চালাচ্ছি দেখতে। তিনি এসে শুনলেন তোমার জ্বরের কথা।"

— "ওই মাসিমা তো সাংঘাতিক। উনি কোনো খবর জানা মানে গোটা দেশ জানা।"

— "তোমার শরীরের কথা না বললেও হতো। কিন্তু পরে শুনলে বলবে বৌমা তুমি কিছু বলোনি তো!"

— "রিঙ্কি কোথায় গো? তিন দিন ওকে দেখিনি।"

— "রিঙ্কি, বায়না করছিল এ ঘরে আসার। আমি ওকে আসতে দিলাম না। খেলনা নিয়ে খেলতে বললাম। তুমি সম্পূর্ণ সেরে ওঠো আগে।"

– "ভালো করেছো। এই অবস্থায় আমার কাছে না আসাই ভালো। তুমিও কম এসো। তাছাড়া সবসময় তুমি মাস্ক, গ্লাভস ব্যবহার করছো না।"

– "আমি ছাড়া তোমাকে দেখবে কে! আর আমি ঘনঘন তোমার মুখটা না দেখে থাকতে পারব না।"

– "তোমার কিছু হলে রিঙ্কিকে দেখবে কে! খুব চিন্তা হচ্ছে জানো। চার মাস সংসারে একটা টাকা রোজগার নেই। এভাবে কতদিন চলবে! আমার ভালোমন্দ কিছু হয়ে গেলে তোমাদের দেখবে কে! আর তুমি তো বাইরে বেরিয়ে রোজগার করতে পারবে না।"

– "এতদিন আমি রোজগারের চেষ্টা করিনি। তোমাকে বলিনি; আমি বাইরের কাজ করছি দু'মাস হলো। পাড়ার বাইরে চারটে বাড়িতে হোম ডেলিভারি খাবার দিই। মধুদার মুদিখানায় সকালের সময়টায় হিসাবের খাতা লিখি। কাগজের ঠোঙা বানিয়ে বিক্রি করি। আমার কাজে বড় কিছু না হোক বাজার খরচা, তোমার ওষুধের খরচ, রিঙ্কির দুধের খরচা হয়ে যাচ্ছে। দারিদ্র্যকে আটকাতে মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা করে।"

— "বিপাশা, তুমি শিক্ষিত মেয়ে। গ্রাজুয়েশন করেছো। এসব তোমার কাজ নয়। তাছাড়া তোমার খুব কষ্ট হবে। আমি একটু সুস্থ হয়ে গেলে যা হোক কিছু করে নেব।"

– "সে তুমি সুস্থ হলে করবে। শিক্ষার দাম কে দেবে! আমার মতো বিদ্যা এখন ভুরিভুরি। তাছাড়া বাজারে জিনিসের দামে আগুন লেগেছে। তোমার ওষুধের অনেক দাম। ডাক্তারের দেওয়া ওষুধের মধ্যে দুটো ওষুধ তো তিন চারটে দোকান ঘুরে খুঁজে পাওয়া গেল না। এরকম অবস্থায় যদি কুড়ি টাকাও উপার্জন হয়, তাও আমাদের কাছে অনেক। তুমি বাধা দিও না।"

অম্লানের চোখ দুটো জলে ভরে এলো। ঝাপসা চোখে সে বিপাশাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিল। সে বলল, "সত্যিই তুমি আমার লক্ষ্মী বউ। অনেক ভাগ্য করে তোমাকে পেয়েছি।" রিঙ্কি দরজার কাছাকাছি এসে ডাকল — "মা, খিদে পেয়েছে।" অম্লানের সঙ্গে কথা বলতে-বলতে কখন সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত নেমেছে বিপাশা বুঝতেই পারেনি। অম্লানকে বিপাশা বলল, "তুমি শুয়ে থাকো। আমি খাবার দিয়ে যাচ্ছি। সময় মতো ওষুধ খাওয়া আছে।" অম্লান কাশতে-কাশতে বলল, "আমার খিদে তেষ্টা নেই। মাঝে মধ্যে সারা বুক জুড়ে ব্যথা হচ্ছে।" বিপাশা অম্লানের গায়ের ঢাকাটা বুকের কাছে টেনে দিয়ে বলল, "বাহ রে। না খেলে শরীর সারবে কি করে! আর তুমি সুস্থ না হলে আমার কষ্টের ভাগ কে নেবে!" বিপাশার ছেলেমানুষি কথা শুনে অম্লান স্মিত হাসল।

বিপাশা অম্লানকে খাবার, ওষুধ খাইয়ে দিল। সে বলল, "আমি আজ এই ঘরে শোব। তোমাকে একা রাখতে ইচ্ছে করছে না। গত দু'দিনের চেয়ে তোমার কাশিটা বেড়েছে। তুমি শোও। আমি রিঙ্কিকে ঘুম পাড়িয়ে আসছি।" অম্লান বলল, "তুমি বরং রিঙ্কির কাছেই থাকো। আমার একা থাকতে কোনো অসুবিধা হবে না।" বিপাশা তার কথা কানেই তুলল না। সে রিঙ্কিকে ঘুম পাড়িয়ে অম্লানের ঘরে এলো।

ঘড়িতে সময় রাত বারোটা। অম্লানের ঘুম কিছু আগেই ভেঙে গেছে। তার শরীরটা আনচান করছে। কাশতে-কাশতে তার গলাটাও শুকিয়ে গেছে। কাশির আওয়াজে বিপাশার ঘুম ভেঙে গেল। সে ধড়পড় করে উঠে বসে বলল, "কি হয়েছে তোমার! শরীরে কষ্ট হচ্ছে!"

অম্লান হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, "আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলো।" বিপাশা টেবিলের উপর রাখা ডায়েরির পাতা উল্টে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকল। অম্লান জোরে শ্বাস টেনে বলল, "আমি আর পারছি না..."

বিপাশা বলল, "এখুনি গাড়ি এসে যাবে।" কাঁচা ঘুম থেকে রিঙ্কিকে তুলে বিপাশা পি.পি.ই কিট পড়িয়ে তৈরি করে দিল। অ্যাম্বুলেন্স আসামাত্র বিপাশাও কোভিডের সমস্ত সুরক্ষা বিধি মেনে গাড়িতে উঠল। অম্লানের অবস্থা ভালো নয়। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। সে মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। বিপাশা অ্যাম্বুলেন্স চালককে বলল, "দাদা, একটু তাড়াতাড়ি চলুন। কাছে যে হসপিটাল, নার্সিংহোম পাবেন সেটাতেই চলুন।"

প্রায় কুড়ি মিনিটের মধ্যে এল. এস. হসপিটালের সামনে অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়াল। অম্লানকে দ্রুত নামিয়ে নিল বিপাশা। অম্লান প্রায় ঝিমিয়ে পড়েছিল। হসপিটালের এক সিস্টারকে বিপাশা বলল, "ওনাকে তাড়াতাড়ি অক্সিজেন দেবার ব্যবস্থা করুন।"

— "ঠিক আছে। আপনি ওপিডিতে ষাট হাজার টাকা জমা করে দিন। কে হন উনি?"

— "আমার স্বামী। ষাট হাজার!! এত টাকা তো আমার কাছে হবে না।"

— "কত হবে?"

— "ত্রিশ হাজার মতো।"

— "আপনার স্বামীকে তাহলে কোনো সরকারি হসপিটালে নিয়ে যান। এখানে ওনার চিকিৎসা হবে না।"

— "ত্রিশ হাজার নিন। আমাকে ফেরাবেন না। সরকারি হসপিটালে বেড পাওয়া খুব মুশকিল। ওনার এক্ষুনি চিকিৎসা না হলে ভালো- মন্দ কিছু ঘটে যাবে। আমি ঘণ্টা-খানেকের মধ্যে বাকি টাকাটা নিয়ে আসছি।"

— "আপনি বোঝার চেষ্টা করুন। হসপিটালের একটা সিস্টেম আছে।"

— "কি সিস্টেম! একটা মানুষের জীবন সঙ্কট। আর আপনি সিস্টেম বোঝাচ্ছেন! আমি বাকি টাকা নিয়ে আসছি।"

— "আপনি ওয়েট করুন। আমি কথা বলে দেখছি। ত্রিশ হাজার আপনি জমা করুন।"

টাকা জমা করে অম্লানের মুখের দিকে তাকিয়ে বিপাশা চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। রিঙ্কি আদো গলায় বলল, "বাবা, মা তোমার জন্য কাঁদছে। তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হও।" বিপাশা মেয়ের কথা শুনে ফুঁপিয়ে উঠল। দশ মিনিট পর সিস্টার এসে বিপাশাকে বলল, "আমরা আপনার স্বামীকে ভর্তি নিয়ে নিচ্ছি। আপনি বাড়ি গিয়ে টাকা নিয়ে আসুন। তিন ঘণ্টার মধ্যে টাকা জমা করুন।" অম্লানকে নিয়ে অন্য দুজন সিস্টার ইমারজেন্সি কেবিনে চলে গেল। বিপাশা কাঁদতে-কাঁদতে সিস্টারকে বলল, "অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমি টাকা নিয়ে আসছি। আমার স্বামীর চিকিৎসার যেন কোনো ত্রুটি না হয়।" সিস্টার ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে গেলেন।

রিঙ্কিকে কোলে নিয়ে বিপাশা হসপিটালের বাইরে এলো। তাকে দেখে অ্যাম্বুলেন্স চালক রুক্ষ স্বরে বলল, "আপনার আক্কেল নেই। কতক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছি। ভাড়াটা মিটিয়ে দিয়ে যাবেন তো।"

– "দাদা, আমার ভুল হয়েছে। আসলে আপনার গাড়িতেই আমরা ফিরে যাব। ভাড়া কত দেব?"

— "আপাতত সাত হাজার টাকা দিন। এটা একটা ট্রিপের ভাড়া। আপ আর ডাউন ভাড়া আলাদা। চোদ্দ হাজার টাকা হয়। কম করে আপনি দশ হাজার দিয়েন।"

— "দশ হাজার টাকা আধ ঘণ্টা গাড়ি না চালিয়ে! আপনারা মানুষের অসহায় অবস্থায় গলা কাটছেন। আমার কাছে এত টাকা হবে না।"

– "আরে বললাম তো সাত দিয়েন। মাল ছাড়ুন তো। আমি কাটি। রাত বারোটার পর এটাই চার্জ। আপনার তো ভাড়া করে ওঠা উচিত ছিল। দিন, দিন যা আছে দিন। রাস্তায় মাঝরাতে নাটক করবেন না।"

– "আমি আপনার গাড়িতে ফিরব না। আমার এত টাকা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। হসপিটালের বিল মেটাতে গিয়ে আমার কাছে একটা টাকা নেই। বিশ্বাস করুন দাদা। সাত হাজার টাকা এই মুহূর্তে আমি কোথা থেকে দেব!"

— "আমার গাড়িতে ফিরবেন কি ফিরবেন না সেটা আপনার মর্জি। সব জায়গায় টাকা চাইলে আপনারা দিতে পারেন। আর ড্রাইভার চাইলে দিতে পারেন না। এত লাফরা করছেন কেন!"

বিপাশা কি করবে বুঝতে না পেরে নিজের সোনার কানের রিং খুলে অ্যাম্বুলেন্স চালকের দিকে বাড়িয়ে বলল, "এই নিন। এটা রাখুন। এটা বিক্রি করলে সাত হাজারের বেশিই পাবেন।"

– "যতসব ফালতু কেসে জড়াবেন নাকি! মাঝরাতে সোনার জিনিস খুলে দিচ্ছেন।"

পরের পর্ব

Next Bangla Story



List of all Bengali Stories


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717