-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার - মে, ২০২৪' স্বরচিত গল্প লেখার প্রতিযোগিতা, ( প্রতি বছর মে মাসে )
Result
--------------------------
List of all Bengali Stories
◕
আমরা মানুষ
লেখিকা: জলি বসু ঘোষ, বাবা - মাখন লাল ঘোষ, বটতলা, বহরমপুর, কোলকাতা
( নির্বাচিত গল্প, 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার - মে, ২০২৩' )
##
ভূমিকা:
একটা রেললাইন ধরে দৌড়ে চলেছে সে, অজস্র মানুষের কোলাহলকে পিছনে ফেলে, এক মুহূর্তের ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে পিছনে ফিরে তাকানো, কিছু সময়ের স্থবিরতা...বুকের ভিতরের হাপরের মত ওঠা নামা...ট্রেনের হুইসেলের শব্দ, দানবের মত ধেয়ে আসা ট্রেন... অসম্ভব ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠে বসলো সমু ওরফে সমর্পিত আমাদের গল্পের নায়ক, না কি নায়িকা? কি বলবেন ওকে? তার দেহের আর মনের দুই আলাদা সত্ত্বার মিশেলে সে নিজেই মাঝে-মাঝে অসহায় বোধ করে। তার পুরুষালি দেহের ভিতরের থেকে যখন মাঝে-মাঝেই মেয়েলি মনটা বিদ্রোহ করে ওঠে, সমস্ত কিছু বেড়া ভেঙে বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু কি করবে ও? ওর বাড়ির মানুষগুলোকেও যে বড় ভালোবাসে সমু, তাদের কোনও অস্বস্তিতে ফেলতে সে চায় না। কিন্তু এই ভাবেই কি সে কাটিয়ে দেবে সারাজীবন, বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের কথা ভেবে? আজকাল মনটা বড় বেশি বিদ্রোহ করছে, মাঝে-মাঝে সমুরও মনে হয় সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে সে চলে যাবে এক অচেনা পৃথিবীতে যেখানে তার মত মানুষ শ্বাস নিতে পারে মুক্ত বাতাসে, যেখানে অপরিচিতের ভিড়ে হারিয়ে যাবে সে, যেখানে তাকে নিয়ে কেউ লজ্জা পাবে না, নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হবে না। যেখানে সে একজন মানুষ হিসেবেই বাঁচবে, নিজের মত করে। কিন্তু কোথায় যাবে ও? যাব বললেই কি যাওয়া যায়?
#
প্রথম অধ্যায় : সমর্পিতর পরিবার
ঘরে ঠাণ্ডা-মেশিনের শীতলতায়ও ওর জামা ভিজে গেছে। আবার আজও একই দুঃস্বপ্ন... এই নিয়ে চারদিন। ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ, তার উপরে সানাই বাজছে, তাই কেউ শুনতে পায় নি। আমাদের গল্পের মুখ্য চরিত্র সমুর দিদি অর্পিতার ওরফে অপুর আগামী কাল বিয়ে উপলক্ষে সানাই বাজছে। ওদের বাবা সমরেন্দ্র চৌধুরী উচ্চপদস্থ সরকারী চাকুরীজীবী ছিলেন। অত্যন্ত রাশভারী প্রকৃতির হলেও মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে উদারহস্ত, তাছাড়া আর্থিকভাবে উনি যথেষ্ট সচ্ছল। ওনার মেয়ে ডাক্তার, বিয়ে হচ্ছে ওরই কলেজের বন্ধু অর্পণের সঙ্গে, ছেলেটিও পেশায় ডাক্তার, একই মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা এবং একই জায়গায় চাকরি ওদের। ছেলেটির পরিবারও খুবই আধুনিক এবং শিক্ষিত। অতএব আপত্তির কোনও জায়গাই নেই।
সমুও অঙ্ক নিয়ে মাস্টার্স করেছে, এখন চাকরির চেষ্টা করছে। কিন্তু ওর যে এই সমস্যা, যদিও ও এটাকে সমস্যা বলে মানে না, ও ভাবে ওর দেহটা পুরুষালি হলেও মনে প্রাণে একজন নারী। তাঁর হাঁটা চলা, গলার স্বর সবই মেয়েলী, কিন্তু চাকরির ইন্টারভিউতে তো প্রভাব ফেলে।
ছোটবেলায় ব্যাপারটা সবাই মজা হিসেবে নিত, দিদির সঙ্গে পুতুল খেলা, দিদির ফ্রক পড়া। আসলে দিদিভাইয়ের সঙ্গে ওর প্রায় পাঁচ বছরের পার্থক্য, দিদি ওকে ওর খেলার পুতুল ভাবতো। কিন্তু একটু বড় হলে ব্যাপারটা সকলের কাছে স্পষ্ট হল। বাবা তো ভীষণ রাগারাগি করতো মায়ের উপর; মায়ের প্রশ্রয়ে হয়েছে, আগে কেন খেয়াল করেনি ইত্যাদি। বহমান সময়ের সাথেই আপন ছন্দেই নিজের নারীস্বত্তা নিয়েই বেড়ে উঠলো সে। ঘুণ ধরা সমাজের প্রাচীনপন্থী মানুষের বর্বরতার শিকার হতে-হতে, নিজেকে নিজের মত করে গুটিয়ে নিয়ে গুটি পোকার মতই বেড়ে উঠলো সে। ভিতরে যতই বর্ষার মেঘ গুমরে মরুক, প্রজাপতির মত উড়ে বেড়ানো আর তার হলো না। নিজেকে পুরুষের মত করে গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও অবচেতনে ওর চাল-চলনে মহিলা সুলভ কমনীয়তাই ধরা পরে যেত। একটা সময় সবাই চেষ্টা করা ছেড়ে দিলো, পরিবারের লোকও।
বেশিরভাগ পারিবারিক অনুষ্ঠানেই ও যেত না, এক্ষেত্রে বাবার অপছন্দই প্রাধান্য পেয়েছিল। পারিবারিক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন বা সমবয়সী বন্ধুদের সাথেও মেলা-মেশারও স্বাধীনতা ছিল না তার। মায়ের চোখের জল আর বাবার অনুশাসনের মাঝে নিজেকে বড় অসহায় লাগতো। দিদিভাই শুধুমাত্র ছিল এই দম বন্ধ পরিবেশের মধ্যে এক ঝলক মুক্তির হাওয়া। কলেজে পড়াকালীন বাড়ি আর কলেজের বাইরে দু-একবার সিনেমায় গেছে বন্ধুদের সাথে, কিন্তু সেখানেও তিক্ত অভিজ্ঞতা। যেমন কালকের বিশেষ দিনটায় দিদিভাইয়ের সঙ্গে কাটানোর ইচ্ছে থাকলেও সেটা দমন করে রাখতে হবে।
আত্মীয় স্বজনের সমাগমে মেতে উঠেছে বিয়ে বাড়ি, কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলের বাড়ির আত্মীয়স্বজনদের আসার কথা। তাই সে ঘর-বন্দি, বাবার কড়া হুকুম। তার মন পাখিটা মাঝে-মাঝে ডানা মেলতে চাইলেও তাকে সে মনের খাঁচাতেই আটক রাখে। আসলে সে চায় না তার জন্য কেউ বিব্রত হোক। আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ এখনো সমুদের মত মানুষদের মেনে নেওয়ার মত শিক্ষিত হয় নি। শুধু দিদির জেদের কাছে সবাই পরাস্ত। দিদিকে সাজানোর সমস্ত ভার সমুর উপর, এ ব্যাপারে বাবার মতামতও ধোপে টেকে নি।
#
দ্বিতীয় অধ্যায় : দিদিভাইয়ের বিয়ের দিন
আজ ভোরবেলাটা একটু অন্যরকম। সকাল থেকেই বিয়ে বাড়িতে ব্যস্ততার আমেজ; সমুর মনে বিষাদের মেঘ। ছোটবেলা থেকে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বড় হয়ে ওঠা। সুখ-দুঃখের সকল অনুভূতি সে ভাগ করে নিতো দিদিভাইয়ের সাথে। আবদার করা বা ঝগড়া করার লোক একটাই ছিল এই বাড়িতে। দিদিভাইও গতকাল ওর ঘরে এসে কেঁদে ফেললো। এমনিতে অর্পিতা মানে অপু খুবই শক্ত ধাতের। জানে, ও চলে গেলে ভাই সত্যি খুব একা হয়ে যাবে।
দিদির সব অনুষ্ঠান থেকে দূরেই সরে রইলো সমু। দিদিভাইয়ের কোনও ক্ষতি সে চায় না। দুপুরের পর দিদি নিজে এসেই ওকে বললো, কি রে আমায় সাজাবি বলেছিলি। সমু দিদির জোরাজুরিতে সাজাতে বসলো। অসম্ভব সুন্দর লাগছে দিদিকে। সবাই খুব প্রশংসা করলো।
অপুর বিয়ে অনুষ্ঠান চলছে, সমু দাঁড়িয়ে রইলো এক কোণায়, দিদিভাই কিছুতেই ছাড়লো না। বিয়ে প্রায় শেষ, সমু দাঁড়িয়ে দেখছিলো, দিদিভাইকে কি সুন্দর লাগছে সিঁদুর পরে। ওর ভিতরের নারী সত্ত্বাটা জেগে ওঠে ভিতর থেকে, নিজেকে বিয়ের কনে রূপে দেখতে ইচ্ছে করে ওর। বিয়ে শেষ হয়েছে, বর-কনেকে নিয়ে বাসর জাগার প্রস্তুতি চলছে, কে-কে থাকবে এই নিয়ে চলছে জল্পনা। সমু নীরবে ওর ঘরের দিকে এগোলো, অপু লক্ষ্য করে ছুটে এসে হাতটা চেপে ধরলো, বললো তোকেও থাকতে হবে, তুই পালিয়ে-পালিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন? অপু বরাবরই খুব জেদি, তাছাড়া দিদিভাই আজ একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে তাই সমু শেষ পর্যন্ত গিয়ে বসলো বাসরে।
হয়তো বা এই ঘটনাই তার জীবনের বাঁকটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। বেশ ভালোই জমে উঠেছে বাসর। সবাই গান গাইছে, ঠাট্টা-ইয়ার্কি চলছে, এই সময়ে অপর্ণদার এক বন্ধু, ছেলেটির নাম নীলাভ, হঠাৎ এসে বললো, ভাই তুমি এবার কিছু একটা করো। ছেলেটির কথায় নেশার আবেশ মিশে রয়েছে, আচরণেও অসভ্যতা প্রকাশ পাচ্ছে, তা সত্ত্বেও বরযাত্রী বলে কিছু বলতেও পারলো না সমু। বাসরে ওর নিজের মাসতুতো ভাই বোন, খুড়তুতো দাদা, বোন অনেকেই ছিলো। ঘটনাটা ওখানেই ঘটলো। অপর্ণদার আর দিদিভাইয়ের আরও কিছু বন্ধু-বান্ধবও ছিলো বাসরে। নীলাভ যখন এসে ওর হাতটা টেনে ধরলো, সমুর মাথা লজ্জায় অবনত। দিদিভাই মাথাটা নিচু করে আস্তে-আস্তে বললো, তুই ঘরে যা। কিন্তু ওর এক খুড়তুতো দাদা আছে, যৌন বিকারগ্রস্ত, নানা রকম অসভ্যতা করার চেষ্টা করেছে সমুর সাথে, কিন্তু সমুর বলিষ্ঠতার কাছে নতি স্বীকার করেছে, আজ সে পূর্বের অপমানের প্রতিশোধ নিলো। বললো, কি রে সমু, কিছু তো একটা কর, তোর দিদির বিয়ে বলে কথা, বরযাত্রীরা বলছে এত করে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে এটা একটা সম্মানের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। সমু একটা গান গাওয়ার চেষ্টা করলো, ওর গলায় মেয়েলী আবেশ শুনে সবাই হাসতে শুরু করলো। ওর দাদা আর ওই ছেলেটি সবচেয়ে বেশী অসম্মান করলো ওকে।
সমু নির্বিকার ভাবে গান শেষ করে, ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ঘটনাটা এখানেই শেষ নয়, কিছুক্ষণের মধ্যে আত্মীয়স্বজন মহলে গুঞ্জন শুরু হলো তাকে নিয়ে। দিদিভাই আর অপর্ণদা ব্যাপারটা সামলানোর চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হলো। দিদিভাইয়ের বাসরটা কেমন যেন ম্লান হয়ে গেল। সমু ঘরে এসে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। আচ্ছা এটা কি ও চেয়েছিল? এই ঘটনার কোনও দায় কি তার ছিল?
ভোরের আলো ফোটার কিছুক্ষণ পর বাবা এলেন ওর ঘরে, দরজা বন্ধ করে দিলেন। সমরেন্দ্রর মাথায় তখন আগুন জ্বলছে, আত্মীয়স্বজন থেকে বন্ধুবান্ধব সবাই নানা টিপ্পনী কাটছে। তার পিসিমা তো সমরেন্দ্রকে ডেকে বলেই দিলেন, দেখ বাপু সমর, আমার অত রাখ ঢাক নেই, তোর ওই মেয়ে-পানা ছেলেকে তুই বাপু এই ক'টা-দিন অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিতে পারতিস, তোর সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের পরিবারেরও তো মাথা হেঁট হলো অপুর শ্বশুরবাড়ির কাছে?
সমরেন্দ্র সমুকে বললেন, তুই আর কত ক্ষতি করবি আমাদের? কত মাথা নত হবে তোর জন্য! তোর তো জীবনে কিছু হবার নেই, মেয়েটাকেও কি শ্বশুরবাড়িতে ঘর করতে দিবি না শান্তিতে? সমু প্রথমে চুপ করে রইল, তার চোখে জল। সমুকে চুপ করে থাকতে দেখে ওর বাবা আরও রেগে গেলেন। বললেন, কি রে চুপ করে আছিস কেন? জবাব দে। তোকে তো আমি ঘর থেকে বেরোতেই মানা করেছিলাম, তুই কোন সাহসে বেরিয়েছিলি? সমু ধীরে-ধীরে বললো, আমি যেতে চাইনি, দিদিভাই জোর করে...
সমরেন্দ্র এবার আরও রেগে গেলেন, বললেন, দিদিভাই বললেই তুই যাবি! তুই জানিস না তুই নিজে কতটা লজ্জার কারণ আমাদের কাছে! প্রচণ্ড রাগে সমরেন্দ্র মারতে শুরু করলেন সমুকে। বেশ কিছুক্ষণ পর উনি যখন ঘর থেকে বেরোলেন সমু পরে রইলো বিছানায়, চোখের জলও শুকিয়ে গেছে ওর। প্রায় অচৈতন্যর মত পড়ে রইলো সে। রাত কেটে ভোরের আলো ফুটলো, কেউ খোঁজও নিলো না ওর।
#
তৃতীয় অধ্যায় : সমুর সিদ্ধান্ত
কোনও একটি ঘটনা মানুষের জীবনকে এলোমেলো করে দেয়। সমুর ক্ষেত্রেও তাই হলো। এই ঘটনায় ও নিজের পরিবারের থেকে আরও দূরে সরে গেলো ৷ দিদিভাই যাবার সময় একবার এলো ওর ঘরে, ওকে জড়িয়ে খুব কাঁদলো, তারপর আস্তে-আস্তে চলে গেলো ঘর ছেড়ে।
কিছু আত্মীয়স্বজন রইলো, কিছুজন চলে গেলো। এরপর দুদিন সমু নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বেরোলো না। আজ দিদিভাইয়ের বৌভাতের অনুষ্ঠান, বাড়ি পুরো ফাঁকা। কেউ একবারও ওকে যাবার জন্য বললো না। ভেবেছিলো, মা অন্ততঃ একবার বলবে বা দিদিভাই ফোন করবে; কোনোটাই হলো না।
বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। ও আস্তে-আস্তে দিদিভাইয়ের ঘরে এলো, তারপর দরজাটা বন্ধ করলো। অপুর ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসলো। প্রসাধনী সামগ্ৰী ছড়িয়ে রয়েছে এলোমেলো ভাবে। একটা লিপস্টিক তুলে নিলো হাতে...কিছুক্ষণ পর আয়নায় নিজেকে দেখে নারী বলে মনে হয় তার। উঠে দিদির একটা শাড়িও পড়লো। আয়নার সামনে চুপ করে বসে রইলো কিছু সময়, ভাবছে কি করবে সে, এভাবে তিল-তিল করে রোজ মরতে পারবে না সে। দিদির আলমারি থেকে কয়েকটা চুড়িদার ও অন্তর্বাস নিয়ে ঘরে এলো সে, এখনো কেউ ফেরেনি, রাত প্রায় ১১ টা, ওদের বাড়ীর কাজের লোক দাসুদা খাবার দিয়ে গেছে ঘরে, কিছু না বলে খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লো সমু।
প্রায় ভোর চারটা বাজে, সমু উঠে পড়লো, ওর পড়ার টেবিলে একটা চিরকুটে লিখলো...আমি চলে যাচ্ছি, তোমরা আমায় খুঁজো না, আমার মধ্যের নারী নিয়ে আমি লজ্জিত নই, কিন্তু তোমাদের অপমানিত হতে দেখতেও আমার আর ভালো লাগছে না। তাই চলে যাচ্ছি...আমার কোনও অভিযোগ বা অভিমান নেই কারোর উপর, তোমরা ভালো থেকো...
সমুর পড়নে ওর দিদির চুড়িদার, হাতে একটা ব্যাগ, তাতে ওর সার্টিফিকেট, কিছু জামাকাপড় আর ওর কিছু জমানো টাকা। বেড়িয়ে তো পড়লো, কিন্তু কোথায় যাবে সে? পথ ঘাট নিস্তব্ধ, ভোরের আলো এখনো ফোটেনি...হাওড়ার একটা বাস পেলো, ভোরের প্রথম বাস, তাতেই উঠে পড়লো।
#
চতুর্থ অধ্যায় : একা পথ চলা শুরু
ভোরবেলায় ট্রেনগুলো ফাঁকাই থাকে। একটা লোকাল ট্রেনে উঠে পড়লো, আনমনা হয়ে জানলার ধারে বসে আছে, চোখের জলের বাঁধ মানছে না। কামরায় গুটিকয়েক লোক। কেউই কারোর দিকে লক্ষ্য করছে না। ভোরবেলায় বেশিরভাগই ঝিমোচ্ছে। সমু ঠিকই করতে পারছেনা কোথায় যাবে। কিছুক্ষণ বাদে একটি ছেলে পাশে এসে বসলো। বললো, কিছু যদি না মনে করেন, কি হয়েছে আপনার, আমায় বলতে পারেন।
ছেলেটিকে দেখে ভদ্ৰই লাগছে, কিন্তু এক মুহূর্তের চেনায় কি ভাবে সব বলবে। ছেলেটি আর কিছুই জিজ্ঞাসা করলো না, ওর উল্টো দিকের জানলার ধারে গিয়ে বসলো।
#
পঞ্চম অধ্যায় : আলাপ একটি নতুন মানুষের সাথে
বেশ কিছু সময়ের পর...
সমু একটু ধাতস্থ, টুকরো কিছু আলোচনা, ছেলেটির সাথে। ওর থেকেই শুনলো ওর দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি। ছেলেটি একটি অনাথ আশ্রমের সাথে যুক্ত, নাম পলাশ দাস। বাড়িতে বাবা, মা আর দাদা, বৌদি। ওনারা গ্রামে থাকেন, চাষাবাদেই চলে সংসার। ছেলেটির সাবলীল কথায় একটু স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলো সমু। তারপর ধীরে-ধীরে ওর জীবনের সমস্ত ঘটনা বলতে শুরু করলো...
ট্রেনটা খুব জোরে চলছে, জানলায় চোখ যায়, প্রকৃতির পেলবতা রুক্ষ রূপ নিয়েছে কখন খেয়ালই করেনি সে। প্রকৃতির রুক্ষতার সাথে কি আশ্চর্য মিল ওর জীবনের। ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেলো ছেলেটির কথায়। ছেলেটি বললো, আপনি যদি ভরসা করেন আমার উপর তাহলে হয়তো আপনার জীবনের একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে। আপনার জীবনেও ভালোবাসার আর ভরসার জায়গার অভাব, ওদেরও...দেখুন না চেষ্টা করে, আপনি যদি আপনার ভালোবাসার ছায়ায় ওদের একটু শীতলতা দিতে পারেন। হয়তো আপনার মধ্যের নারীস্বত্তা মাতৃত্বের আস্বাদ পাবে ওই ছোট-ছোট চারা গাছগুলোর পরিচর্যায়।
#
ষষ্ঠ অধ্যায় : সমুর নবজন্ম
ঝাড়খণ্ড আর পশ্চিম বঙ্গের সীমানায় এই গ্রামটা, নাম সুন্দরপুর, সত্যি নাম সার্থক। পলাশের সাথে ট্রেন থেকে সমু যখন নামলো তখন বেলা প্রায় বারোটা। ওরা একটা সাইকেল ভ্যানে চড়ে পৌঁছে গেল 'শান্তি নীড়' এ। ওরা গেট খুলে ঢুকতে-না ঢুকতেই ছুটে এলো কচিকাঁচার দল। পলাশ পকেট থেকে বের করে লজেন্স দিলো, সামান্য উপহারেই উদ্ভাসিত ওদের মুখ। পলাশ এগিয়ে গেলো সমুকে নিয়ে অফিস ঘরের দিকে। ওকে বারান্দায় বসিয়ে ভিতরে গেল, মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ফিরে এলো, তারপর সমুকে নিয়ে ঢুকলো। সমু ভিতরে ঢুকে দেখলো একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলা চেয়ারে বসে, অসম্ভব ব্যক্তিত্যময়ী অথচ মাতৃসমা পেলবতা ওনার মুখে। উনি সমুকে আলিঙ্গন করলেন যখন, ওর চোখ দিয়ে শুধু জলের ধারা বইছে...
উনি সমুকে পরিচয় করিয়ে দিলেন বাচ্চাদের সাথে... বললেন, ইনি তোমাদের নতুন মা, ওনাকে মামণি বলে ডেকো তোমরা...
#
সপ্তম অধ্যায় : উপসংহার
বেশ কিছু বছর কেটে গেছে। আজ সমুর সমস্ত জগৎ জুড়ে তার বাচ্চারা। তাঁদের সুখ, দুঃখ, রোজনামচার সঙ্গে জড়িয়ে ওদের মামণি...
সমুকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি, ওর পরিবারের লোকেদের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও। হয়তো সমুরা হারানোর জন্যই জন্মায়। কোনও সাধারণ জীবন-যাপনের জন্য ঈশ্বর সমুদের তৈরি করেন নি। মানুষ হয়ে মানুষের মত করে বাঁচার জন্যই ওদের জন্ম। আমাদের সবার মত সমুদেরও সমাজে সসম্মানে বাঁচার অধিকার আছে। আসুন না, আমরা যে মানুষ, সেই পরিচয়কে সত্যি করে তুলি আর পৃথিবীকে সব ধরণের মানুষের বসবাস যোগ্য করে তুলি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে তুলে দিই এক বৈষম্যহীন পৃথিবী। অপেক্ষা সেরকম নতুন এক ভোরের।
(সমাপ্ত)
Next Bangla Story
List of all Bengali Stories
## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers.
The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation.
Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##
◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717