-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার - মে, ২০২৪' স্বরচিত গল্প লেখার প্রতিযোগিতা, ( প্রতি বছর মে মাসে )
Result
--------------------------
List of all Bengali Stories
◕
প্রথম রিপু
লেখিকা - জয়ন্তী চক্রবর্তী, ২৪ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ
( 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার, মে - ২০২৪' স্বরচিত গল্প প্রতিযোগিতার একটি নির্বাচিত গল্প )
##
একেই বোধহয় বলে রাইটার্স ব্লকেজ। কিছুতেই লিখতে পারছি না; অথচ কিছুদিন আগেও এমন ছিল, অন্তত দু হাজার শব্দ না লিখলে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যেতে পারতাম না। কি যেন এক নিদারুণ অস্বস্তি খচখচ করত ভেতরে। আর এখন এই তিন চার মাস হতে চলল একটা অনুগল্পও বের করতে পারিনি মগজ থেকে। জেদের বসে রেগে, বিস্তর খোঁচাখুঁচি করে একটা লাইন দশেকের কবিতা যাও-বা বের হলো, পড়তে গিয়ে দেখলাম, ক্লাস টু-এর বাচ্চারাও এর চেয়ে ভাল লিখতে পারবে। সঙ্গে সঙ্গে ডিলিট করে দিলাম। এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি জেদাজেদি করে আর যাইহোক, লেখা আসে না। লেখা কোথা থেকে কিভাবে যে আসে তা আজও আবিষ্কার করতে পারিনি। তাই ভিখারির মতো অঞ্জলি পেতে বসে আছি। ঘড়িতে রাত দুটোর ঘণ্টা বেজে গেল।
আছি দেশের বাড়ি তে। আমাদের এই সেকেলে শরীকি বাড়িটার বয়স প্রায় একশো বছর হবে। ঠাকুর্দাদারা ছিলেন পাঁচ ভাই। তাঁদের ছিল পারিবারিক পাটের ব্যবসা। তাঁরা সবাই মিলে শহরতলির এই এক বিঘা জমির ওপরে বিশাল বাড়িখানা যখন কিনেছিলেন, তখন ওপার বাংলা থেকে হুড়হুড় করে শরণার্থীরা বানের জলের মতো ছুটে আসছে এপারে। এপারের মুসলিমরাও হাঁড়ি কুঁড়ি, বিছানা বালিশের পুঁটুলি মাথায় নিয়ে স্ত্রী পুত্রের হাত ধরে বন জঙ্গলের পথ বেয়ে হেঁটে চলেছেন ওপার বাংলার উদ্দেশ্যে। তাদেরই কেউ জলের দামে বেচে দিয়েছিলেন বাড়িখানা। আমার ঠাকুরদারা বাড়িখানা কিনে নিয়ে নতুন করে সারিয়ে, রঙ করে চারপাশে পাঁচিল ঘিরে নাম দিয়েছিলেন 'অক্ষয় নিবাস'। তারপর অবশ্য কেটে গেছে আরো প্রায় আশি বছর। অক্ষয় নিবাস এখন ক্ষয়ের কবলে। শরিকরা সবাই প্রায় একে একে কলকাতায় চলে গেছে বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট ভাড়া করে। শুধু বাবার সেজো কাকার বড় ছেলের পরিবার নিতান্ত দুস্থ হওয়ায় পড়ে আছে এখানেই, একতলার খান-তিনেক ঘর নিয়ে। আর দোতলার দক্ষিণের একটা ঘরে, আমি মাঝে মাঝে এসে থাকি। আর থাকে আমাদের এক দূর সম্পর্কের বিধবা পিসি তাঁর প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে, দোতলার পশ্চিমের একেবারে কোনের একখানা ঘরে। তাছাড়া এতবড় বাড়ির ওপর-নিচে বাকি পাঁচ খানা ঘরই বারোমাস তালা বন্ধ হয়ে পড়ে থাকে। সারানোর অভাবে বাড়িটার দশা একেবারে জরাজীর্ণ। এখানে ওখানে বট অশ্বত্থ গজিয়ে গেছে। পাঁচিলটা প্রায় নিশ্চিহ্ন। এখানে ওখানে ভাঙা ইঁটের গাঁথুনির দু-চারটি ভগ্নাংশ পড়ে আছে, বৃদ্ধের শূন্য-প্রায় মাড়ির মতো। এদিকে ওদিকে আগাছার জঙ্গল। তারমধ্যে সাপ-খোপও থাকতে পারে। মাঝে মাঝে বড় বড় গোসাপ বেরিয়ে আসে। সারাবাড়ি চক্কর দিয়ে আবার কোথায় যেন হারিয়ে যায়। হঠাৎ একটা কাল পেঁচা ডেকে উঠলো কু...কু...। আড় চোখে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত প্রায় দুটো বাজে। হ্যারিকেনের আলোটা একবারে কমিয়ে দিয়ে উঠে পড়লাম। এবার একটু যেন ঘুমঘুম পাচ্ছে। ঘুমানো যাক। আজও এক কলম লিখতে পারলাম না। ওদিকে পূজো সংখ্যার লেখার জন্যে সেই এপ্রিল থেকে তাগিদ দিয়ে চলেছেন পত্র-পত্রিকার সম্পাদকরা। হঠাৎ কি পৃথিবী থেকে সব গল্প হারিয়ে গেল!!
বাথরুমে গিয়ে মুখে হাতে পায়ে ভাল করে জল দিয়ে এলাম। বালিশ গুছিয়ে বিছানায় বসা মাত্র হঠাৎ আমার চোখ চলে গেল দেয়ালের দিকে। হ্যারিকেনের অস্পষ্ট আলোয় দেখলাম সারা দেয়াল জুড়ে কিসের যেন ছিট ছিট দাগ। গত কাল থেকে এখানে খুব ঝড়-বৃষ্টি হয়ে চলেছে। কারেন্ট নেই। এই গ্রাম এলাকায় একটু ঝড়-ঝাপটা হলেই ট্রান্সফর্মার উড়ে গিয়ে কারেন্ট চলে যায়। তাই সন্ধ্যের পর থেকে এই হ্যারিকেনই ভরসা। ঘরের সেই আবছা ক্ষীণ আলোয় দেখতে পেলাম সারা দেয়াল জুড়ে কিসের যেন ফোঁটা ফোঁটা কালচে কালচে দাগ। অবাক হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ আগেও তো কোথাও কিছু ছিল না। তা হলে কি বাইরের দেয়ালে বটের গজিয়ে ওঠা চারার শেকড় এই ঘরের ভেতরের দেয়ালের গায়েও পৌঁছে গিয়েছে? আগে তো লক্ষ করিনি? ভালো করে দেখবার জন্য উঠে হ্যারিকেনের পলতেটাকে বাড়িয়ে দিলাম। সামান্য একটু বাড়িয়ে তুলে ধরতেই একটা বিষণ্ণ মরা আলো ছড়িয়ে পড়ল সারা ঘর জুড়ে। সেই আলোতেই এবার স্পষ্ট দেখতে পেলাম দেয়াল জুড়ে যেন ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগ। চমকে উঠলাম। কোথা থেকে এল এত রক্ত! আলোটা দেয়ালের আরো কাছে আনতে মনে হল রক্তের দাগটা যেন টাটকা। এমনকি, রক্তের একটা বিশ্রী আঁশটে গন্ধও যেন ভেসে এল নাকে। গা-টা কেমন যেন গুলিয়ে উঠলো আমার। কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগলো। আগেও তো কতবার এসেছি এখানে। থেকেছি এই ঘরে, একা। কৈ কখনো তো এমন হয়নি। আমি হ্যারিকেনটা যথাস্থানে নামিয়ে রেখে দিলাম। চশমা খুলে, শিখা না কমিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কিন্তু সমানে কি যেন একটা অস্বস্তি হতে লাগলো। মনে হতে লাগলো এই ঘরের মধ্যে আরো কে একজন যেন আছে। উঠে বসলাম। স্বাভাবিক ভাবেই চোখ চলে গেল সেই দেয়ালের দিকে। এবার মনে হলো সেখানে কাঁচা হাতে বড়ো বড়ো এবড়ো- খেবড়ো অক্ষরে কি যেন একটা লেখা আছে। হ্যারিকেন হাতে নিয়ে উঠে এলাম দেয়ালের কাছে। চশমাটা চোখে পরে নিতেই দেখতে পেলাম দেয়ালের গায়ে লেখা আছে, "খুব কষ্ট"।
এখানে কেউ কি খুব কষ্টে আছে? তাহলে আর যাই হোক আমার কোনো ক্ষতি সে করবে না। সে সাহায্য চাইছে আমার কাছে। এবার আমি ভয় ভুলে গেলাম। বড় করুণা হলো অদেখা তার প্রতি। অস্ফূটে বললাম, "কে তুমি? তোমার কিসের কষ্ট? আমাকে বলতে পারো..."
দেয়ালের গায়ে আবার ফুটে উঠলো রক্তের অক্ষর, "বড় তেষ্টা"।
আমি দেয়ালের গায়ে ফুটে ওঠা লেখাটা পড়ে বেশ জোরে জোরে বললাম,"তুমি কোথায়? আমি তো তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না। কি করে সাহায্য করব?" এবার বেশ কিছুক্ষণ কোনো লেখা ফুটল না দেয়ালে। কি করা উচিত ভাবছি এমন সময় আবার ফুটে উঠল লেখা, "একটু জল"।
আমি এবার বললাম,"তুমি কে? আমাকে বলো সব। তা না হলে আমি তোমায় কোনো সাহায্য করতে পারব না।" এবার হঠাৎ দেখলাম হ্যারিকেনটা দপদপ করতে লাগলো। বার দশেক দপদপ করে শেষে নিভে গেল ঘরের একমাত্র আলোটা। আমি মন শক্ত করে কাঠ হয়ে বসে রইলাম। আমি ভূতে বিশ্বাসী নই। তবে আত্মায় বিশ্বাস করি। শুনেছি তাদের না ঘাঁটালে তারা খামোকা কাউকে বিরক্ত করে না। হঠাৎ আমার ঘাড়ের কাছে কে যেন বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সেই শ্বাস এতোটাই ঠাণ্ডা যে আমার মনে হল যেন একমুঠো বরফ ছড়িয়ে দিল কেউ ঘাড়ের ওপর। কিছুক্ষণ আমার চারিদিকে মৃদু দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। আমি বললাম, "তুমি যদি সব কিছু বলে দাও,তবে আমি হয়তো তোমার জন্য কিছু করতে পারি।" এবার সেই অশরীরী আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠল, "খুন"।
সেই ফিসফিস কণ্ঠস্বর শুনে আমার মনশ্চক্ষে একটি কঙ্কালের করোটির ছবি ভেসে উঠলো। বুকের ভেতরটা সহসা যেন মনে হলো একদম শূন্য, ফাঁকা। তবু মনের জোর হারালাম না। একবার কেশে গলাটা একটু পরিষ্কার করে নিয়ে বললাম, "কে খুন করেছে তোমায়?"
"মনিরুল।"
"সে কে?"
"আমার ভাই।"
"তোমার নিজের ভাই? কেন সে তোমায় খুন করল? কি করেছিলে তুমি তার?"
"আমি আমি আমি..."
"হ্যাঁ বলো। কোনো ভয় নেই। কি করেছিলে?"
এবার আবার একটা ভারি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আত্মা বলতে শুরু করলো তার জীবনের করুণ কাহিনী।
"আমি আশাবুল। মণি আমার যমজ ভাই। আমারা দু'ভাই মিলে কাপড়ের ব্যবসা করতাম। ঢাকা থেকে কাপড় এনে কলকাতার বাজারে বেচতাম। আবার কোলকাতা থেকে সৌখিন কাপড় নিয়ে গিয়ে বেচে আসতাম ঢাকার বাজারে। ভালো চলত ব্যবসা। দু'ভাইয়ে বড় মনের মিল ছিল আমাদের। কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারতাম না। একে অপরকে ফেলে এক কণা খাবারও খেতুম না। একটা রুটি জুটলে আধখানা করে খেতুম। বাইরে যাবার তখন একটাই ভালো কাপড়। দু'জন পালা করে পরতুম। একটু একটু করে ব্যবসায় উন্নতি হলো। আমরা দু'জন মিলে একটু একটু করে এই বাড়িখানা করলুম। খুব ভাব ছিল দু'জনায়।"
"তারপর?"
"তারপর মণি একদিন বলল,"দাদা, তুমি এবার একটা বিয়ে কর। সারাদিন খেটে-খুটে বাড়ি ফিরে একমুঠো রান্না ভাত তো খেতে পাবো। রোগ-বালাই হলে একটু সেবা পাব। পরিষ্কার কাচা জামা কাপড় পাব।" ভেবে দেখলাম, আমারও বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে, বিয়েটা এই বেলা করে নেয়া দরকার। বলতে গেলে মণিরুলই বিয়েটা দেওয়ালো। আমাদের মহাজনের মেয়ে। বসিরহাটে বাপের বাড়ি। দেখতে খুব সুন্দর। ঘরের কাজকর্ম ও করত খুব মন দিয়ে। আমাকে ভালোও বাসত খুব। নামেও পরী, সে কাজেও ছিল পরী। যেন উড়ে উড়ে সারা বাড়ি মাথায় করে রাখত।"
"তারপর? "
"তারপর কখন যে মণিরুলের মনে পাপ ঢুকলো জানতে পারিনি। সেবার ঢাকায় গেছি, একা। মণিকে দিয়ে গেছি এখানকার বাজার সামলাবার দায়িত্ব। ওদিকে আমি যাবার পর-পরই দাঙ্গা লাগলো ওদেশে। হিন্দু মুসলমান মারামারি কাটাকাটি চলল। সে কী ভীষণ দাঙ্গা। রক্তে ভেসে গেল দেশ। ঢাকার পথ-ঘাট জন-মানব শূন্য। পুলিশ টহল দিচ্ছে দিন রাত। আমি ভয়ে ভয়ে আর বের হলাম না। এক বন্ধুর বাড়িতেই ঘাপটি মেরে পড়ে রইলাম দিন পনেরো। তারপর ধীরে ধীরে দাঙ্গা কমে এলো। লোকজন বের হতে লাগলো পথে ঘাটে। আমিও গুটি গুটি বাড়ির পথ ধরলাম। ঢাকা মেল সেদিন খুব লেট করেছিল। বাড়িতে যখন এসে পৌঁছলাম, তখন অনেক রাত। বাড়ির সামনে এসে সদর দরজায় কড়া নাড়লাম। অনেকক্ষণ ঠকঠক করবার পর মনিরুল এসে দরজা খুলে আমাকে দেখে যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। আমি হেসে বললাম, 'মরিনি রে ভাই। এই দ্যাখ জলজ্যান্ত বেঁচে আছি। তোর ভাবিকে ডাক।' মণিরুল খুব কড়া গলায় বলল, 'তুমিই যে আমার দাদা, তার প্রমাণ কি?' আমি অবাক হয়ে বললুম, 'তার মানে?' মণিরুল বলল,'আমার কাছে পাকা খবর আছে, আমার দাদা দাঙ্গায় খুন হয়েছে। ভাবি খুব কান্নাকাটি করছিল বলে তার বাপ-মা এসে তাকে নিয়ে গেছে।' আমি কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর বললুম,'ঠিক আছে, আমি চললুম বসিরহাটে। আমার বিবিই বলবে আমি জিন্দা না ভূত...' বলেই পিছন ফিরে হন হন করে হাঁটা দিলাম। বিগত সারা রাত জাগা, পেটে এক-কণা দানা-পানি নেই। হঠাৎ পিছন থেকে বড় একটা ইটের টুকরে এসে পড়ল মাথায়। চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লুম। তখন মনিরুল আমার মাথাটা পাকা রাস্তার ওপর ঠুকতে-ঠুকতে বলল, 'মরিসনি যদি তবে মর এবার। তোর বিবিকে আমি নিকা করবো। এখন থেকে ও হবে আমার বিবি।'"
"তারপর?"
আত্মার শরীর থাকে না, তাই চোখও থাকে না। চোখে জলও থাকে না। তবু সেই মোটা পর্দার মতো ঘন অন্ধকার ঘরে কেমন যেন মনে হলো আত্মাটা কাঁদছে। আমি তাকে কাঁদবার জন্য সময় দিলাম। মনের মধ্যেটা আমারও কাঁদছিল। হায় রে মানুষ ! রিপুর শেকলে আষ্টে-পৃষ্ঠে বাঁধা। স্নেহ, মমতা, সম্পর্ক সব কিছু মুহূর্তে বন্যার জলের মতো ভাসিয়ে নিয়ে যায় রিপুর তাড়না। কোনো কিছুই তাকে আটকাতে পারে না। বেশ কিছু ক্ষণ দু'জনেই চুপচাপ। শেষে আমিই বললাম,"তারপর?"
আত্মা বলল, "এদিকে তখন রাত প্রায় শেষ। একটু বাদেই লোকজন চলাচল শুরু হয়ে যাবে। মণিরুল আমার পা ধরে টানতে টানতে বাড়ির মধ্যে আনল। তারপর গাঁইতি চালিয়ে ঘরের এই দেয়ালটায় একটা লম্বা গর্ত বানিয়ে ফেলল আর সেই গর্তের মধ্যে ঠেলে-ঠুলে গুঁজে দিল আমার শরীরটা। তখন বাড়ির পাঁচিল তৈরির কাজ চলছিল। সেজন্যে গাঁইতি, বালি, সিমেন্ট সব কিছু মজুত ছিল বাড়িতে। এমনকি মিস্ত্রীরা তাদের কর্ণিক, কড়া, ওলোন ইত্যাদি সব কিছু রেখে যেত। সেই সব দিয়ে মনিরুল রাতারাতি দেওয়ালটা আগের মতো গেঁথে ফেলল। পরদিন একটা বড় আলমারি এনে রেখেদিল দেয়াল ঘেঁষে।"
"তারপর?"
"তারপর আর কি? ওরা নিকা করল একমাস যেতে না যেতে। এই ঘরে ওরা রাতে থাকত। উঃ সে কী অসহ্য কষ্ট। আমি মরে গিয়েও প্রত্যেকটা দিন দগ্ধে দগ্ধে মরতে লাগলাম।"
"তারপর?"
"শেষে আর থাকতে না পেরে ভয় দেখাতে লাগলাম। একদিন বৌ আমার ছায়া দেখে ভিরমি খেয়ে উল্টে পড়ল চৌকাঠের ওপর। তখন কি আর জানি ওর পেটে আমার বাচ্চা?"
"সে কী! তাই নাকি? তারপর?"
"তারপর আর কি? নিজের অজান্তে মেরে ফেললুম নিজের বাচ্চাটা। পৃথিবী থেকে আমার শেষ চিহ্নটাও মুছে গেল। কী আফসোস! কী কষ্ট! উঃ! আর সহ্য করতে পারছি না।"
আমি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। ঘড়িতে ঢং ঢং করে তিনটে বাজল। ভোর হয়ে আসছে। একটু পরেই আলো ফুটতে শুরু করবে। আমি বললাম, "সকাল হতে চলল। এখন তুমি বলো আমি তোমার জন্যে কি করতে পারি। কি করলে তুমি কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে?"
আত্মা বলল, "সেই ঘটনার পর ওরা তাড়াতাড়ি বাড়ি বেচে দিয়ে ঢাকায় চলে গেল। শুধু আমি পড়ে রইলুম একা এই দেয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে। কি করে যে বোঝাই আমার কী কষ্ট ! আর কতকাল এই কষ্ট পেতে হবে আমাকে? তুমি তো লেখক। বলতে পার না কিসে আমার শান্তি?"
আমি পড়ে গেলাম মহা দুশ্চিন্তায়। সত্যিই তো। একটা অসহায় কাতর আত্মা আমার সাহায্য চাইছে আকুল হয়ে। কিন্তু কিভাবে ওর মুক্তির ব্যবস্থা করব ভেবে পেলাম না। হিন্দু শাস্ত্র বলে ঠিকমত অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন করে চিতা ভস্মাবশেষ গঙ্গায় সমর্পণ করলে আত্মার মুক্তি হয়। কিন্তু আশাবুল তো মুসলিম। হিন্দুর আচার অনুষ্ঠান তো ওর ক্ষেত্রে খাটবে না। আমি ভাবতে লাগলাম। দেয়াল ভেঙে কঙ্কালটা বের করে কবরে দেবার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা মোটেই সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। আমি এখানে থাকি না। স্থানীয় মুসলমানদেরও চিনি না। তাছাড়া এত বছর বাদে এসব করতে গেলে থানা-পুলিশ হবার ভয়ও আছে। আমি নিতান্ত ছাঁ পোষা গৃহস্থ। সকাল হলেই কলকাতায় পালাবো। কেন শুধু শুধু এত সব ঝামেলায় জড়াতে যাব? মনে মনে এই সব ভাবছি এমন সময় আত্মা আবার ফিস ফিস করে কথা বলে উঠলো আমার কানের কাছে।
"লেখক বাবু, আত্মার জাত নেই গো। যতক্ষণ শরীর, ততক্ষনই জাত। গঙ্গা, পদ্মায় একই জল। আত্মার দেহ নেই। জ্বালা যে আমার ভেতরে। তার শান্তি কিসে বাবু? কিসে? কিসে?"
জানলার বাইরে দেখলাম অনেক দূরে ঊষার আকাশের এক কোনে ফিকে হয়ে আসছে অন্ধকার। আমি উঠে পড়লাম। বুঝতে পারলাম আত্মাটা আর এখানে নেই। বাইরে বেরিয়ে বারান্দায় অস্থির ভাবে পায়চারি করতে লাগলাম। সত্যিই তো, এই অশান্ত দুঃখী আত্মাটাকে কি করে ওর ভেতরের ক্ষোভ, দুঃখ, ঈর্ষা আর বিশ্বাসঘাতকতার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেব? বড় সাধারণ, ছোটো মাপের একজন লেখক ছাড়া আমি তো আর কিছুই নই।
ভোর হয়ে গেছে। দেখলাম আমাদের সেই আশ্রিত পিসি এক ঘটি গঙ্গা জল নিয়ে সদর দরজা থেকে উঠোনে, তুলসি তলায়, ঠাকুর ঘরের চারিদিকে জল ছেটাতে ছেটাতে চলেছেন। আমার কি মনে হলো, বললাম, "পিসি, তোমার হয়ে গেলে ঘটিটা একটু আমায় দিও।"
পিসি বলল, "কি করবি বাবা? তোরা তো এসব বিশ্বাস করিস না।"
আমি বললাম, "করি গো করি। কথায় আছে না, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।"
পিসির হাত থেকে গঙ্গা জলের ঘটিটা নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। যেদিকের দেয়ালে গত রাত্রে রক্তের অক্ষর ফুটে উঠেছিল সেই দিকের দেয়ালে ঘন ঘন গঙ্গা জল ছিটিয়ে দিতে দিতে বললাম,"মুক্ত হও তুমি, নব দেহ ধারণ কর। জন্ম নাও, তোমার প্রিয় মানুষের কোলে। একদিন যার হিংসার বলি হয়েছিলে তুমি, তারই কোলে পিঠে চড়ে, তারই আদরে, যত্নে, ভালবাসায় মুছে যাক সব গ্লানি, তোমার আত্মার চৈতন্য থেকে। তাদের ভালবাসো। তাদের ক্ষমা করো। মুক্ত হও তুমি। সকল যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হও। শুদ্ধ চৈতন্যময় হয়ে নব জন্ম হোক তোমার।"
আশাবুলের মুক্তি হয়েছিল কিনা জানি না, তবে তার প্রায় বছর দুই বাদে, একটা বড় বৈষয়িক কাজে আবার গিয়েছিলাম দেশের বাড়ি। একটি রাত মাত্র ছিলাম। সে রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলাম। স্পষ্ট মনে আছে। দেখছিলাম একটা ফুটফুটে বাচ্চা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। একপাশে বাবা আর একপাশে মা দুটি হাত দিয়ে পরম মমতায় আগলে রেখেছে তাকে। ঘুমের মধ্যেই বাচ্চাটা ফিক ফিক করে হেসে চলেছে। কে জানে কোন জন্মের কি মধুর স্মৃতি মনে পড়েছে তার!
( সমাপ্ত )
Next bangla story
## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers.
The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation.
Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##
◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717