-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার - মে, ২০২৪' স্বরচিত গল্প লেখার প্রতিযোগিতা, ( প্রতি বছর মে মাসে )
Result
--------------------------
List of all Bengali Stories
◕
আবর্ত
লেখক: আলী রাইহান স্বপ্ন, বাবা: মোঃ আলী আশরাফ, রংপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ
( 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার, মে - ২০২৪' স্বরচিত গল্প প্রতিযোগিতার একটি নির্বাচিত গল্প )
##
ছিমছাম সুন্দর পরিষ্কার করিডোর জানালা দিয়ে প্রাণ জুড়ানো বাতাস বইছে। বৃষ্টির শেষে বয়ে বেড়াচ্ছে ঝড় হাওয়া আর একটা বৃষ্টি-ভেজা গন্ধ। পুরো পরিবেশটা কেমন যেন আচ্ছন্ন! কিন্তু করিডোরের সামনে থাকা কেবিনে এই আচ্ছন্নতা প্রবেশ করতে পাচ্ছে না। সেখানে অন্য এক পরিবেশ। তাড়াহুড়ো, চিৎকার, কান্না, ডেফিব্রিলেটরের বিপিং শব্দ আর ডাক্তারের চেঁচিয়ে বারবার clear বলার প্রতিধ্বনি। মেয়েটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে তরুণ ডাক্তারটি। শেষ বারের মতোও শক দিয়েও যখন ECG মনিটরে হৃৎস্পন্দন দেখতে পাওয়া গেল না তখন তার প্রচেষ্টা থামলো। ২০ মিনিট ধরে বিরতিহীন ভাবে CPR এবং শকের পর তরুণ ডাক্তারটিকে তার সবচেয়ে অপছন্দের কাজটি করতে হলো। ডাক্তারদের একটা চিরায়িত ব্যাপার মৃত্যু ও মৃত্যুর সময় ঘোষণা। এর আগেও অনেককে মৃত ঘোষণা করেছে; তাও কেন প্রতিবার মন খারাপ হয় রিয়াজের সে এখনো জানে না। না জানলেও প্রতিবার কাজটি করতেই হয়।
"রিজিয়া হাসান। বয়স ১৫। মৃত্যুর সময় ১০:১৫ মিনিট। মৃত্যুর কারণ ড্রাগ ওভার-ডোজের ফলে কার্ডিয়াক এরেস্ট।" রিজিয়ার মা-বাবার আহজারি থেকে বের হতে হলো রিয়াজকে। আরো রোগী পরে আছে। রোগীর অভিভাবককে সমবেদনা জানানোর সময়টিও তার কাছে নাই। কেবিন থেকে বের হয়েই মধ্যবয়সী এক নারীর সামনে পড়লো। এতক্ষণ কেবিনের স্বচ্ছ জানালা দিয়ে সব দেখছিলেন তিনি।
"ম্যাম, আমি খুবই দুঃখিত। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, কিন্তু বাঁচাতে পারলাম না..." কথাটা শুনেই হুশ ফিরলো মিসেস রাত্রি জামানের। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। রিয়াজও তার পরবর্তী রোগীকে দেখতে গেল। মিসেস জামানও চলে এলেন হাসপাতাল থেকে। তার আরও একটি ব্যর্থতা। কিন্তু সেটা মেনে নিয়েই এগোতে হবে, উপায় নেই। চেষ্টা করেও সবাইকে ফিরাতে পারবেন না কালো জগৎ থেকে। তবু তার চেষ্টা করে যেতে হবে। তার সামনে এখন বসে আছে ৪০-৫০ বছরের এক ভদ্রলোক। তার সাথে তার স্ত্রী ও ১৪-১৬ বছরের মেয়ে। ভদ্রলোকটি চেহারা শক্ত করে আছেন, যেন কাঁদতে চান, কিন্তু কাঁদবেন না। তার স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে তার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "ভালো থাকিস মা। আমি প্রতি সপ্তাহে দেখা করতে আসবো।"
মেয়েটি মাথা থেকে হাত সরিয়ে হিংস্র চোখে বললো, "আমি এখানে থাকবো না। বাড়ি চলে। আমি এখানে থাকবো না।" তার মা আরো কেঁদে উঠলেন। ভদ্রলোকটি তার স্ত্রীকে কোনমতে সামলিয়ে নিয়ে বের হলেন মিসেস রাত্রির রুম থেকে। তাদের মেয়ে রুপাও তাদের সাথে বেড়িয়ে আসতে চাইল, "আমি এখানে থাকবো না, আমি চলে যাব..."
মিসেস রাত্রি তাকে ধরে ফেলে বললেন, "তুমি পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পর তোমার বাবা-মার সাথে যাবে রুপা।" রূপাকে সামলাতে হিমশিম খেতে হলো তাকে। অনেক কষ্টে রুপাকে রাতের খাবার খাইয়ে ঘুম পারানো হলো।
"আপা, রূপার এই ঔষধগুলো কই রাখবো?"
"এখানে রাখো, জামিলা। কালকে থেকে ওকে দেওয়া হবে।"
জামিলা এই রিহ্যাবের সবচেয়ে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন নার্স। জামিলা এত কাজ করেন যে, মিসেস রাত্রিকে কাজ করতেই হয় না বলা চলে।
সকালে রূপাকে নিয়ে আরো ঝামেলা হলো। মিসেস রাত্রি এসে দেখেন রূপা সকালের খাবার খায় নি। নবনী তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। নবনী এই রিহ্যাবের আর এক কর্মক্ষম সহযোগী। তার শুধু একটাই খারাপ গুণ সে রাগে বেশি। বয়স কম কিন্তু রাগ অনেক বেশি। রূপার সাথে না পেরে যখন হাতাহাতির অবস্থা তখন রাগ সামলাতে না পেরে নবনী রূপার গালে কষে এক চড় মারলো। রূপা পড়ে যাচ্ছিল, মিসেস রাত্রি তাকে ধরে নবনীর দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালেন। নবনী এই দৃষ্টিকে খুব ভয় পায়। তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরে পড়লো ও। মিসেস রাত্রি জানেন নবনী খুবই ভালো মেয়ে। ওর মন খুবই নরম কিন্তু রাগটা অনেক বেশি। এটা নিয়ে যে কতবার নবনীকে বলেছেন, তার ইয়ত্তা নাই। যাই হোক, মিসেস রাত্রি রূপাকে নিজের মেয়ের মতো আদর যত্ন করে খাওয়ালেন। এতে রূপা একটু স্বাভাবিক হলো। মিসেস রাত্রি তার সাথে কিছুটা কথাবার্তাও বললেন। মিসেস রাত্রির সাথে তার কিছুটা ভাবও হলো, কিন্তু রূপার বন্দি-বন্দি থাকার অস্বস্তিটা গেল না। দুপুরে মিসেস রাত্রির সাথে আবার কথা বললো রূপা। "ম্যাম, আমার খুব খারাপ লাগছে, অস্বস্তি হচ্ছে। আমাকে একটা জিনিস খেতে দেবেন। আমার কাছে টাকা আছে। এই দেখেন," বলে তার কাছে লুকানো টাকা বের করে দেখালো। ৫টা হাজার টাকার নোট।
"কী খেতে চাও তুমি?"
"ইয়াবা ম্যাম। ওটা নাহলে ফেনসিডিল। খুব টেস্টি খেতে। এনে দিবেন ম্যাম?"
১৫-১৬ বছরের কোনো মেয়ের কাছে এমন কথা শুনে অবাক হওয়ার কথা যে-কারোরই। কিন্তু মিসেস রাত্রি হলেন না। প্রথম-প্রথম এই রিহ্যাব সেন্টার যখন শুরু করেছিলেন তখন অবাক হতেন। এখন সবই তার কাছে স্বাভাবিক। রাস্তার ৮-৯ বছরের বাচ্চাকেও ড্যান্ডি খেতে দেখলেও আর অবাক হতে পারেন না। শুধু এক চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
"দিব। তবে তার আগে তোমার দুপুরের ভাত খাও আর এ ঔষধটা খাও।"
"ঔষধটা আমি খাব না।"
"তাহলে আমিও এনে দেব না..."
"আচ্ছা এনে দেন আগে, তারপর খাব।"
"না এখনই খেতে হবে। আগে খাও, তারপর এনে দিবো।"
"আচ্ছা।"
রূপাকে তিনি অন্য মেয়েদের সাথে ভাত খেতে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছেন এই মেয়েদের সাথে রাগা-রাগী করে মাদকের নেশা ছাড়ানো যায় না। তাদের আশ্বাস দিয়ে, তাদের সাথে একাত্ম হয়ে, মিলেমিশে তাদের এই ভয়ংকর অভ্যাস থেকে দূরে নিয়ে যাওয়া যায়। এতে সবচেয়ে বেশি দরকার পরিবারের সহযোগিতা। ভাতের সাথে রূপাকে drug detox-এর ঔষধটা খাওয়ানো হলো। এই মেয়েদের দেখে মিসেস রাত্রির বুকটা হাহাকারে ফেটে পড়ে। কত বয়সই বা এদের? জীবনের কত কিছু দেখা বাকি, তাও ভয়াল এক নেশায় জীবনকে শেষ করার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে! কেউ-বা কলেজের, কেউ-বা স্কুলের, কেউ সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছে। কখনো বন্ধু-বান্ধবের চাপে, কখনো trend অনুসরণ করতে গিয়ে, বাড়িতে অশান্তি, প্রেমে বিচ্ছেদ ইত্যাদি কোন-না কোনভাবে এরা নিজেদের জীবন ধ্বংস করার পথে পা বাড়িয়েছে। এই মেয়েরা নিজেরাও জানে এটা তাদের জন্য ক্ষতিকারক; কিন্তু নেশা কাটিয়ে উঠতে পারে না। মিসেস রাত্রি মনে মনে যখন এসব কথা ভাবছিলেন তখন হঠাৎ করে পিছন থেকে কে যেন দু'হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। পিছনে ঘুরতেই সাদা অ্যাপ্রোণ পড়া তিথিকে দেখতে পেলেন। তিথিকে দেখে মিসেস রাত্রির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তিথিকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন তিনি। তিথি জিজ্ঞেস করলো, " কেমন আছো মা?"
না, তিথি মিসেস রাত্রির মেয়ে না। মা হওয়ার সৌভাগ্য তাকে আল্লাহ দেন নি, কিন্তু অসংখ্য মেয়ের কাছে 'মা' শব্দটি শোনার সৌভাগ্য তাকে দিয়েছেন।
"আলহামদুলিল্লাহ। ভালো। তুই কেমন আছিস?"
"আছি মা, আলহামদুলিল্লাহ ভালো।"
"তানভীর কেমন আছে?"
"ওর কথা বলো না। ঐ বোকা লোকটাকে যে কেন বিয়ে করেছিলাম। ওর বোকামির সব ঠ্যালা শেষে আমাকেই সামলাতে হয়। তবে ওর মনটা অনেক ভালো।"
"হুম। বোকা মানুষরাই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।"
"হুম..." তিথি একটু লাজুক ভাবে বলে।
"জরুরি বিভাগ থেকে ফুরসৎ মিললো এখানে আসার?"
"আর বলো না। সকাল থেকে ৫টা দুর্ঘটনা, ২টা সার্জারি সব সেরে বের হলাম। আবার রাতে সার্জারি আছে। তোমার সাথে দেখা করে বাড়ি যাব তাই আসলাম।"
"ভালো করেছিস। চল আমার সাথে ভাত খেয়ে তারপর বাসায় যাস..."
"চলো..."
তিথিকে যখনই দেখেন তখনই মিসেস রাত্রির অবাক লাগে। সেই ১৪ বছর বয়সে তিথি এসেছিলো এখানে। বাবা মারা গেছিলো, মা আবার বিয়ে করেছিলো, সৎ বাবার পরিবারে অশান্তি, এই বয়সে তার ব্যর্থ প্রেম সবকিছু একসময় তাকে টেনে নিয়ে এসেছিলো মাদকের দিকে। স্কুলের এক বড় আপুর কাছ থেকে মাদক পেয়েছিল প্রথমে। তারপর নেশা শুরু হয়। তিথির মা তিথিকে ফেলে রেখে যায় এখানে। তিথিকে দেখতেও আসতো না। ২ বছর পর খবর পাওয়া যায়, তিথির মা-ও মারা গেছে। তিথিকে পরম যত্নে মাদকের নেশা থেকে বের করে আনেন মিসেস রাত্রি। তারপর নিজে বড় করে তোলেন ওকে। এখন সে জরুরি বিভাগের বড় এক সার্জন। রিজিয়াও মিসেস রাত্রিকে 'মা' বলে ডাকতো। এই রিহ্যাবের বেশির ভাগ মেয়েই তাকে 'মা' বলে ডাকে। রিজিয়া যেদিন সুস্থ হয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো তখন মিসেস রাত্রিকে বলেছিলো, "মা, তোমাকে অনেক মিস করবো। মাঝে মাঝে দেখা করতে আসবো তোমার সাথে। আর প্রতিজ্ঞা করলাম আর কখনো মাদক ছুঁয়েও দেখবো না।"
রিজিয়া প্রতিজ্ঞাটা শেষ পর্যন্ত রাখতে পারে নাই। রূপার কী হবে? সেও কি শেষ পর্যন্ত তাকে 'মা' ডাকবে? সে কি তিথির মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবে, নাকি রিজিয়ার মতো মৃত্যুর পথ বেঁছে নেবে?
"তোমার কফিটা ধরো!"
ধ্যান ভাঙলো মিসেস রাত্রির। কফি হাতে তার স্বামী সুমন চৌধুরী। বারান্দায় তার চেয়ারের পাশে আরেকটা চেয়ার টেনে নিয়ে কফি হাতে বসলেন। এই মানুষটাকে খুব ভালোবাসেন মিসেস রাত্রি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিক্স বিভাগের প্রধানের পদ ছেড়ে 'আবর্তন নারী রিহ্যাব' খোলার কথা যখন বলেছিলেন মিসেস রাত্রি তখন এই লোকটি শুধু বলেছিলো, "কোনো সাহায্য লাগলে বলো..."
তার সহযোগিতার জন্যই এ রিহ্যাবটি করতে পেরেছেন মিসেস রাত্রি।
"কি ভাবছিলে?" কফি খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে সুমন চৌধুরী।
"ভাবছিলাম রুপার কি হবে?"
"তুমি তো সর্বোচ্চ চেষ্টাই করছো। ভালো কিছু হবেই।" স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে কথাগুলো বললেন সুমন চৌধুরী।
"হুম..." মিসেস রাত্রি ভাবেন, সময়ের আবর্তে তিনিও তো সেই অন্ধকার জগৎ থেকে ফিরে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন। রূপা আর তার মতো মেয়েরা কেন পাবে না সে সুযোগ?
( সমাপ্ত )
Next bangla story
List of all Bengali Stories
## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers.
The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation.
Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##
◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717