-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার - মে, ২০২৪' স্বরচিত গল্প লেখার প্রতিযোগিতা, ( প্রতি বছর মে মাসে )
Result
--------------------------
List of all Bengali Stories
◕
অভিমানী কাশফুল
লেখিকা - মায়া মিত্র, বাবা - রবি মণ্ডল, নিউ আলিপুর, কোলকাতা
( 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার, মে - ২০২৪' স্বরচিত গল্প প্রতিযোগিতার একটি নির্বাচিত গল্প )
##
"ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর,
পর কৈনু আপন আপন কৈনু পর।
রাতি কৈলাম দিবস দিবস কৈনু রাতি।
বুঝিতে নারিনু বঁধু তোমার পীরিতি। "
বিভোর হয়ে তাকিয়েছিল রুশা। এমন শ্রী-রূপ দর্শন করে চক্ষের জলে সে ভাসবে না, তা কি হয়? সমগ্র দেহ মন জুড়ে একটাই নাম প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল তার, রাধামাধব রাধামাধব! কি এক অপূর্ব ভাবে বিলীয়মান হয়ে যাচ্ছিল তার হৃদয়। সম্মুখ পশ্চাতের অগণিত জনতার ভিড়েও তার স্মরণে শুধুই সেই দশখানি অনিন্দ্য কান্তি মূর্তি আর সে নিজে। দুই পার্শ্বে চারজন করে মোট আটজন সখী সমাবেশে মধ্য স্থানে শ্রীরাধিকা সহ বংশীবদন। তাদের নীলাম্বরী রূপের আভায় আভাসিত চতুর্দিক। শঙ্খ, ঘণ্টা, খোল, করতাল সহযোগে ভক্তগনের সুমধুর কৃষ্ণনাম কর্ণ কুহরে যেন মধু সঞ্চারণ করে চলেছে অবিরত। মনে মনে স্বগতোক্তির ন্যায় মধুসূদনের নিকট নিজ হৃদয়-দ্বার উন্মুক্ত করে রাখল রুশা। "হে করুণাসিন্ধু! হে কৃষ্ণপ্রিয়া! তোমাদের শ্রী চরণে নিজ সব পাপ পুণ্য অর্পণ করলাম। অন্যায় যদি বা কিছু করে থাকি ক্ষমীও মোরে।"
মন্দির থেকে বেরিয়ে রুশা এদিক অদিক তাকিয়েও সম্যককে কোথাও দেখতে না পেয়ে ভারী উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ল। শত শত অচেনা চেহারার মাঝে আপন মানুষটিকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় নিজ দৃষ্টি যতদূর সম্ভব মেলে ধরার চেষ্টা করছিল সে। এই সময়গুলোতে সে খুব অসহায় বোধ করে। হৃদয়ের দোলাচল বাড়তে থাকে ক্ষণিকের ব্যবধানে। এমন সময় হঠাৎ চোখে পরে দূরে সেই অমলিন হাসিটি নিয়ে তারই অপেক্ষায় অপেক্ষারত সম্যক। মনে পড়ে যায় চণ্ডীদাসের সেই দোঁহা—
'যথা তথা যাই, আমি যত দূর চাই,
চাঁদ মুখের মধুর হাসে তিলেকে জুড়াই।'
নীল আর লালে মেশানো একটা হ্যান্ডলুম শাড়ি পরেছিল রুশা। সঙ্গে মানানসই হালকা লাল পাথরের হার আর অক্সিডাইসড ও লাল রঙে মেশানো ঝোলা দুল। খোলা চুল আর কপালে মাঝারি আকারের মেরুন লাল রঙের টিপ; আর লিপস্টিক সেই রঙে রাঙ্গানো। রুশা সুন্দরী নয় তবে আকর্ষণীয়া অবশ্যই। মন্দিরে আসবে বলে শেষ রাতে উঠে স্নান সেরে সুন্দর করে সেজেছে। সম্যক জানে সেটা তার জন্যই। মুগ্ধ-দৃষ্টি নিয়ে সেও তাকিয়ে রইল রুশার দিকে। একটু মজাও লাগছিল তার, রুশাকে এমন আনচান করতে দেখে। বরাবরই খুব ভালবাসে সে রুশার এমন অসহায় মুখখানি দেখতে। কি অপরূপ লাগে তাকে দেখতে এমন সময়গুলোতে। রুশা কাছে থাকলেই একটা মুগ্ধতার রেশ ছড়িয়ে রাখে চারিদিকে। একটা ভাললাগা ঘিরে থাকে সম্যকের মনে। কি এক অদম্য আকর্ষণে সে আজও রুশার মোহমুক্ত হতে পারেনি। এক আকণ্ঠ ভালোলাগা জড়িয়ে থাকে সর্বক্ষণ। শুধুই কি শারীরিক তৃপ্তি এর কারণ; নাকি আত্মিক তৃপ্তিও জড়িয়ে আছে এই নারীটিকে ঘিরে? তার জীবনের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির খেলায় রুশা অবশ্যই একটা বিরাট প্রাপ্তি তার কাছে। সে-কথা সে অকপটে স্বীকার করে এসেছে চিরকাল। তাই তার দিক থেকে সম্ভাব্য কোন সুখ থেকেই বঞ্চিত করতে চায় না রুশাকে। বাকি জীবনটা তার পাশে থেকে যেতে চায় একজন বন্ধু, সহমর্মীর মত।
রুশা কাছে আসতেই তার নিকটে এসে কানে কানে বলে সম্যক, "কি এত খুঁজে বেড়াচ্ছিলে বলতো? এমন করে খুঁজলে তো স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণও এসে ধরা দেবে তোমায়।"
রুশা কপট রাগে তার দিকে তাকিয়েই হেসে ফেলল। এ এক মহা জ্বালা হয়েছে তার। দূরে থেকে কতই না রাগ, অভিমান, ঝগড়াঝাঁটি করেছে তার, কিন্তু সম্মুখে নিরবিচ্ছিন্ন আকর্ষণ ছাড়া কিছুই বোধ করেনি সে আজ অবধি। মনে মনে গুণে দেখল আজ প্রায় উনিশটা বছর পেরিয়ে গেছে তাদের বন্ধুত্বের। কত ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে আজও অমলিন।
ভোরের আরতি শেষে মন্দিরের দ্বার বন্ধ হলে ভক্তদের আনাগোনা কমে এল। পুরোপুরি সকাল হতে এখনও বেশ কিছুটা সময় বাকি। মন্দিরের প্রধান দ্বার হতে ডান দিকের রাস্তাটা ধরে মিনিট দশেক এগোতেই বাঁয়ে খোয়া ওঠা মেটে রাস্তাটা চোখে পড়ে। এদিকটা লোকালয় কিছুটা ক্ষীণ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে দু-এক খানি বাড়ি একে অপরের থেকে সম্মানীয় দূরত্ব বজায় রেখে অন্ধকারে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ভক্তদের আবদার সামলাতে ব্যবসায়ীদের হাত পড়েছে এই চত্বরেও। প্রকৃতি নিরুপায়, তবুও আপাতত খামখেয়ালীপনায় দূরে মাঠ জুড়ে শয়ে শয়ে ধুসর কাশবনের সারি বদ্ধ সমারোহ। মধ্য শরতের ভোরে একটা হিমেল মাদকতা ছড়িয়ে থাকে, যা এই মুহূর্তে আসমান বেয়ে এসে ভিড়েছে রুশার দেহ মনে। সে ঈষৎ উৎকণ্ঠিত আবার মৃদু সলজ্জ ভঙ্গিতে সম্যকের পাশে পাশে এগিয়ে চলেছে। আলো আঁধারই রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হাত বাড়িয়ে সম্যকের হাতটা ধরল রুশা, এই প্রথমবার। সম্যকের বাম হাতে নিজের হাতটা গলিয়ে তাকে ছুঁয়ে হাঁটতে লাগলো সে। ভারী অদ্ভুত, আজ-অব্ধি ঘরের বাইরে একে অপরের হাত ধরেনি তারা। আসলে তাদের সম্পর্কটা কোনদিনই ঠিক প্রেমের পর্যায়ে পৌঁছায়নি। প্রেম আর বন্ধুত্বের একটা সীমারেখায় আটকে পড়েছে তারা। না এগোতে পারছে, না পারছে পিছিয়ে যেতে। ঊষালগ্নের কোমল শীতল সমীরণের সঙ্গে সম্যকের সুমধুর স্পর্শ আরও বেশি করে পাওয়ার জন্যই হয়ত রুশা আরও ঘন হয়ে এল সম্যকের পাশে। চলার পথে একটি-দুটি করে শব্দ জুড়ে জুড়ে কথার পাহাড় গড়ে যাচ্ছিল সম্যক। যার কিছু কিছু রুশার কানে পৌঁছলেও মস্তিষ্কে আঘাত করছিল বলে মনে হল না। সেও দু-একটি আল গোছে শব্দ ছুঁইয়ে সম্যককে বোঝানোর চেষ্টা করছিল যে, সে এই ক্ষণেও একজন ভাল শ্রোতা; যাতে তার এবং সম্যকের উভয়েরই বিপরীতধর্মী মনোযোগে কোন গোল না বাধে। এভাবেই একসময় হোটেলের সম্মুখে পৌঁছে গেল তারা। হোটেলটি নতুন তৈরি ও একটু ভিতরের দিকে, তাই লোকজন এমনিতেই কম। রুশাদের রুমটা তিন তলায়। আরও একটা পরিবার ছিল, তারা আজই চলে যাবে জানিয়েছে রিসেপ্সনের ছেলেটি। তাকে অণুরোধ করেছিল রুশা, ভালো ব্যালকনিওয়ালা কোন রুম দিতে। নিজেই খুঁজে খুঁজে অনলাইনে বুক করেছিল হোটেলটি।
সম্যক প্রথম যেদিন প্রস্তাবটা তার সম্মুখে রাখে, থমথমে মুখে শুনেছিল সে। রোমকূপ বেয়ে নেমেছিল একটা মেরু শীতল অনুভূতি। এর আগে যতবার ওরা বেড়াতে বেড়িয়েছে কেউ না কেউ তাদের মাঝে ছিল, অনেকটা ফ্যামিলি ট্রিপের মত। তারা দুজনে একাকী সময় কাটিয়েছে বহুবার নিয়মিত ভাবেই। কিন্তু শহরের বাইরে একাকী সময় কাটানোর কথা ভাবেনি কেউই। বাধা আছে অনেক। রুশা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। যুক্তিবাদী সম্যক পরস্পর যুক্তির ঝুলি সাজিয়ে ব্যক্ত করে তার মনের কথা।
মধ্যবিত্ত মনের দোটানায় প্রথম ছেদ পড়ে, যদি কেউ দেখে ফেলে!! বন্ধুত্বের মোড়কে লুকিয়ে থাকা ব্যক্তিগত সম্পর্কের রেণু সুমধুর, কারণ তার উপর নরম সুবাসিত পাপড়ির নিরাপদ আচ্ছাদন রয়েছে। সেটা সরে গেলে সৌরালোকে যদি সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সে দায় কার হবে? কেনই বা তারা এ ক্ষতির ভার নিতে যাবে? অনেক কষ্টে অনেক বছর পর একটা মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছতে পেরেছে সে। আবার সব কিছু ঘেঁটে গেলে সামলাতে পারবে না। সে থামে, সম্যককেও থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সে তো বরাবরই দ্বিধাহীন, বন্ধনহীন, পূর্ণরূপে উন্মুক্ত-মনা একজন মানুষ। তাকে বোঝানোর ক্ষমতা রুশার নেই। তার কাছে সংসার মানেই একটা দায়িত্ব, যার কাছে সে দায়বদ্ধ। তার বাইরে বাকি জীবনটা তার সম্পূর্ণ নিজের। দুজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ নিজেদের পারিবারিক দায়িত্ব সম্পূর্ণ রূপে পালন করার পর, কাউকে আঘাত না দিয়ে, একে অপরের সম্মতিক্রমে বেঁচে থাকার নির্যাস স্বরূপ যদি কোন আশ্রয় গড়ে তোলে, তবে তা যেকোনো অন্য বাহ্যিক সম্পর্কের ন্যায়ই সমান সম্মানীয়; তার জন্য লজ্জা বা গ্লানি বোধ করা মনুষ্যত্বের কাছে অন্যায়। তার সেই গ্লানি নেই; রুশারও থাকা বাঞ্ছনীয় নয়।
গ্লানি যে রুশার মনে আছে তা কিন্তু নয়। তবু সে অবাঞ্ছনীয় পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে এড়িয়ে যেতে চায়। সম্যকের মত সংসারের প্রতি তার কোন দায় নেই। সে তার একমাত্র কন্যা রাহীকে নিয়ে যথাযথ জীবন যাপন করছে। তার জীবনের টালমাটাল পরিস্থিতির অনেকটাই সামাল দিতে পেরেছে সম্যকের আন্তরিক সান্নিধ্যে এবং সাহায্যে। বিগত পাঁচটা বছর কম যুদ্ধ তো তাকে করতে হয়নি পায়ের নিচে নড়বড়ে মাটি টাকে শক্ত করতে। এক মুহূর্তের জন্যও আলগা হয়নি সম্যকের হাত। যত দিন এগোচ্ছে মনের মধ্যকার জমাট বাঁধা অন্ধকারের রাশ কমছে। আলো ঢুকছে ফাঁক ফোকর দিয়ে। অলিন্দ পথে প্রবেশিত ক্ষীণ আলো আর পবনের মেল বন্ধনে ধীরে ধীরে কাটছে কু-সংস্কারের ছায়া। বিংশ শতকের সপ্রতিভ আলোয় সম্পর্ক মানেই যে রক্তের সমীকরণ অথবা সমাজ অর্চিত বাঁধন এমন কৃত্রিম ভাবনায় মন আর উচাটন হয় না। বরং যে সম্পর্কে দায় হীন ভারহীন যেখানে স্ব-ইচ্ছার উন্মেষ সম্ভব; তেমন সম্পর্কে বিশ্বাস গাঢ় হচ্ছে ক্রমশ। ছোট বেলায় দুপুর রোদে শুকোতে দেওয়া অন্যের আচার চুরি করে খাওয়া, অন্যের বাগানের ফল পাকুড় চুরি করার মত একটা চোরা স্বাদ অবশ্য সে অনুভব করে এতে। তখনও সেই নিষ্পাপ চৌর্য বৃত্তিতে যেমন কোন গ্লানির মিথ্যে-ভার ছিল না, এখনও তেমনই একটা ভাবনার স্রোত বহে যায় অন্তরের গভীর হতে। সে অনুভূতি বড় শান্তির আবার লোভেরও। সেই লোভটাই বড় হয়ে উঠেছিল সে-সময়, যখন সম্যক তার প্রস্তাবে একের পর এক যুক্তির ইট সাজিয়ে অট্টালিকা গড়ার চেষ্টায় ব্রতী। সম্যককে একাকী সে অনেক সময়ই পেয়েছে। কিন্তু উন্মুক্ত আকাশের নিচে, অগণিত অচেনা জনতার স্রোতে ভীষণ চেনা দুটো মানুষের আকাঙ্ক্ষিত হৃদয় ধ্বনি শুনেছে কি কখনও? গৃহে ফেরার তাগিদ নেই, সাংসারিক দায়বদ্ধতার এক ঘেয়েমি নেই, অফিসের নিত্য নৈমিত্তিক চাপান উতর ডিঙিয়ে দু-তিনটে অলীক দিন কাটানোর নেশা গ্রাস করে ফেলতে লাগলো রুশাকে। সব সংশয় কাটিয়ে যেদিন হোটেলটা বুক করতে পেরেছিল, সেদিন থেকেই তার পিঠের দুই পাশে দুটো ডানা গজিয়ে গেছে যেন। দারুণ খুশি হয়েছিল সে।
একটা দুটো করে বেশ কিছু অলীক স্বপ্নের সুতো দিকে একটা মায়াজাল রচনা করে রেখেছিল রুশা। একান্ত গোপন সেই সেই ইচ্ছেগুলোর অনেকটাই সম্যককে ঘিরে। আজ যখন অযাচিত ভাবে সেই সব অলীক স্বপ্নের পূরণ ঘটছে চক্ষের সম্মুখে তখন যেন তলিয়ে যাচ্ছে সে। হোটেলটি যেন এক মায়া পুরী আর গোটা আধ্যাত্মিক শহরটাই একটা মায়াজগতে পরিণত হয়েছে এই মুহূর্তে।
অক্টোবরের শুরু, ক'দিন বাদেই মা মহামায়ার আগমন ঘটবে ধরায়; স্বভাবতই চারিদিকে একটা সাজ সাজ রব। জানালার ওপারে পশ্চিমের মাঠ জুড়ে সার সার কাশফুলের মেলা। স্বচ্ছ কাঁচের পথ ধরে দৃষ্টি গিয়ে মিলেছে রোঁয়া-ওঠা মিহি নরম কাশফুলের সারিতে। হাওয়ায় মাথা দুলিয়ে রুশার সঙ্গে অব্যক্ত কথোপকথন জুড়েছে তারা। পিঠের উপরে সম্যকের পুরুষালি ঠোঁটের আদর শুষে নিচ্ছে তার মুখ্য কোমলতা। সে এই মুহূর্তে তার উদ্ধত, অমানবিক আদরের আঘাতে রুশার দেহ মনকে আবিষ্ট করে ফেলেছে। আপ্লুত দেহের ঝাপসা দৃষ্টির সম্মুখ হতে বারে বারে সরে সরে যাচ্ছে কাশফুল গুলো। অভিমানী কাশফুলের সারির মান ভঞ্জনে রুশার ক্ষীণ স্মৃতির পরশ বুলিয়ে গেল নির্মলেন্দু গুণের কবিতার কয়েকটি পংতি—
ওগো কাশের মেয়ে,
আজকে আমার চোখ জুড়াল তোমার দেখা পেয়ে
তোমার হাতে বন্দী আমার ভালবাসার কাশ
তাইতো আমি এই শরতে
তোমার কৃতদাস।
প্রেমের শহর বৃন্দাবনের ন্যায় এখানেও লোকের মুখে মুখে ফেরে রাই গোবিন্দের বাণী। সন্ধ্যারতি শুরুর বেশ কিছুক্ষণ পূর্বেই উভয়ে উপস্থিত হল মন্দির প্রাঙ্গণে। বিশাল প্রাঙ্গণ জুড়ে চতুর্দিকে সুবেশিত ভক্তের ভিড়। সুতি বা রেশমের ঘাগরা চোলিতে অনেকেই স্বেচ্ছায় গোপিনীর সাজ ধারণ করেছে। রুশাও পড়েছে ঘন সবুজ বর্ণের লম্বা ঝুলের সিল্কের স্কার্ট সঙ্গে মেরুন রঙের টপ। খুব সহজ ভঙ্গিমায় সে এই মুহূর্তে সম্যকের সঙ্গে হাসি খেলায় মেতেছে। গোটা একটা দিন কাটিয়ে ওঠার পর মনের খাঁজে লুকিয়ে থাকা দ্বিধাময় ভয়টা কেটে যাওয়ায় সে এখন পরিপূর্ণ রূপে উন্মুক্ত। রুশাকে এমন সাবলীল দেখতে সম্যকের সব থেকে বেশি পছন্দ। এই একটা কারণেই হয়ত তার আর রুশার মাঝে সামাজিক স্বার্থপরতার বেড়াজাল গড়ে ওঠেনি কখনও; নয়ত কবেই এই অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক চুকে বুকে যেত। জীবনে নারীদের আনাগোনা তো কম হয়নি। তাদের জটিল মানসিকতায় ভারী অসহায় বোধ করে সে। তাদের আকাঙ্ক্ষা এবং বক্তব্যের মাঝে যে বিস্তর ফারাক সেই শূন্যতায় হারিয়ে গেছে সে বরাবর। সম্পর্ক নিয়ে কূট কাচালি তার পছন্দ নয়। সে নিজেও যেমন স্পষ্ট বক্তা তেমনি স্পষ্ট বক্তব্যের আশা রাখে সে অপর পক্ষের কাছে। সম্যকের বিশ্বাস, সম্পর্ক মানেই দেওয়া নেওয়ার মেল বন্ধন। সে সম্পর্কের দায় নিতে ভয় পায় না, তবে তার মাপকাঠি যেন স্বচ্ছ হয়। সে স্বার্থপর নিশ্চয়, কিন্তু অপরের স্বার্থে আঘাত করা তার অভিধানের বাইরে। প্রেম, বিবাহ, বন্ধুত্বের নিটোল খেলায় প্রমাণ হয়েছে সে আনাড়ি। মন থেকে ভীষণ ভাবে চেয়েও যেন সেভাবে কাউকেই খুশি করতে পারেনি। নারী শরীরের উত্থান পতন সম্পর্কে সে যতটা আত্মবিশ্বাসী; নারী মন ততটাই ধোঁয়াশা তার কাছে। সেক্ষেত্রে রুশা অবশ্যই একটি ব্যতিক্রমী চরিত্র। তার সব ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়েছে এই মেয়েটি। তার আন্তরিক বিশ্বাস রুশাকে এখানে এনে সে যতটা খুশি হয়েছে তার থেকে বহুগুণ বেশি খুশি হয়েছে রুশা নিজে। মানুষের আসল চরিত্র উদ্ঘাটিত তখনই সম্ভব যখন তাকে নিজের মত থাকতে দেওয়া হয়।
স্বাধীন স্বত্বার চরম আত্মপ্রকাশে রুশাকে উচ্ছল প্রজাপতির ন্যায় লাগছিল। ওকে এভাবে আগে কখনও পায়নি সম্যক। থেকে থেকেই আদর করতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। রুশাও যেন সদা সর্বদা তৈরি থাকে তার আদর চরম ভাবে উপভোগ করার জন্য। বহু বছরের চেনা একটা শরীর, চেনা আঘ্রাণ; আর স্বভাবসিদ্ধ অভ্যাসে কিছুটা মলিন হয়ে যাওয়াটাই তো স্বাভাবিক ছিল; তবুও কেন জানি না কোন জাদুবলে রুশা আজও আগের মতই রয়ে গেছে, আজও তার দেহে একই রকম আগুন অনুভব করে সম্যক। বয়স আর জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা সামলেও কি করে সে নিজেকে এতটা সমর্পিত করতে পারে, ভাবলেও মাঝে মাঝে অবাক হয় সে। ভীষণ খুশি হয় সম্যক অন্তত একটি মানুষকে সে সুখী করতে পেরেছে এই ভেবে। এও তো জীবনের এক চরম প্রাপ্তি।
"কি এত ভাবছ বল তো?"
রুশার ডাকে ঘোর কাটে সম্যকের। হাসিমুখে জবাব দেয়, "কই কিছু না। ভাবনা চিন্তা তো তোমার কাজ।"
"আর তোমার কি কাজ?"
"তোমাকে জব্দ করা।"
"আচ্ছা ! কিভাবে?"
সম্যক রুশার কাছে ঘন হয়ে এসে ধীরে উত্তর দেয়, "গোটা একটা রাত পড়ে আছে। এত তাড়া কিসের জানার?"
মুহূর্তে রুশার তামাটে শরীর বেয়ে একটা হিমেল ঢেউ খেলে যায়। মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নেয় সে। সম্যকের দিকে তাকাতেও লজ্জা করছে তার। তার এই চেনা স্বভাবটায় ভারী মজা পায় রুশা। ক্ষণিকের লজ্জা কাটিয়ে সম্যকের দিকে তাকায় সে। দুষ্টুমির হাসিখানি এখনও ঠোঁটের কোণে লেগে রয়েছে তার। রুশার খুব ইচ্ছে হয় সেখানে একটা মৃদু চুম্বন রাখার, কিন্তু নিরুপায় হয়ে মাথাটা নিচু করে নেয় আবার। ক্ষণে ক্ষণে পিছলে পড়া মনটাকে মৃদু তিরস্কার করে। ভীষণ অসভ্য হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
আরতির সময় আসন্ন। মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে দুইজনে। আজ রাই কিশোরীর বেশে প্রকৃতির হাতছানি। ঘন হরিৎ ঘাগরা চোলির মধ্যে মধ্যে রূপোলী আভা। সেই আভার আগুনে আলোকিত মাধবের কালো মুখখানি। ললিতা,বিশাখা, চম্পকলতা, চিত্রা সহ আরও গোপীগণের দৃষ্টিও আরোপিত মদন মোহিনীর পানে। মনে পড়ে গেল সেই দৈবিক রূপে মুগ্ধ বড়ু-চণ্ডীদাস 'শ্রী কৃষ্ণ কীর্তন'-এ বৃন্দার রূপের বর্ণনা করেছিলেন—
বিভিন্ন ফুলের উপমায়।
তমাল কুসুম চিকুর গণে।
নীল কুরুবক তোর নয়নে।।
সুপুট নাসা তিলফুলে।
দেখি তোর গণ্ডযুগ মহুলে।।
আধর সুরঙ্গ বান্ধুলী ফুলে।
দৈব প্রেম বোধ হয় এমনি ভাবে ঘটে, যার পবিত্র মায়ায় হয় চতুর্দিক উদ্ভাসিত। নইলে এই ঘোর কলিযুগেও কেন মানব সমাজ কৃষ্ণপ্রেমে এমন মাতোয়ারা। রুশা লক্ষ্য করে দেখেছে ঐ প্রস্তর মূরতি পানে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেই হৃদয়ে এক অপূর্ব ভাবের উন্মেষ ঘটে। কপোলদ্বয় জলমগ্ন হয়ে পড়ে। মনের মধ্যকার সকল সংকীর্ণতা দূর হয়ে একাধারে মোহমুক্তি ঘটে অপর পারে মোহাচ্ছন্ন হয়। সে এক অনন্য অনুভূতি, ভাষায় অপ্রকাশণীয়।
টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। কণা কণা জল বিন্দু আদর স্পর্শ বুলিয়ে যাচ্ছিল তাকে। একটা গাছের নীচে গোলাকার চাতালটায় গিয়ে বসলো দু'জনে। একটু পড়েই মন্দিরের দ্বার রুদ্ধ হবে। ছন্ন ছাড়া পথিকের ন্যায় ভক্তরা ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে, ব্যস্ততা নেই কারো। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিপর্ব দূর থেকে লক্ষ্য করছিল রুশা। তার হৃদয়ের গহীনেও কী চলেছে আসন্ন রজনীর প্রস্তুতি। কাল সকালেই তারা ফিরে যাবে যে যার জগতে। সাময়িক শূন্যতা ঘিরে আসে মনে। দীর্ঘ সুখে বঞ্চিত তার জীবন এইরকম কণা-সম মুহূর্তের খুশির স্পর্শেই বেঁচে থাকে। সে এতেই তৃপ্ত। আফসোস নেই তিল মাত্র। ভাবতে বসলে তো প্রাপ্তির তুলনায় অপ্রাপ্তি আর বঞ্চনার ঝুলিতে ভরে যাবে তার কোল। মনের নিম্নচাপের ভারসাম্য বজায় রাখতে তাই মাঝে মধ্যেই নিজেকে খুশি রাখতে তৎপর হয় সে। যেমনটা এবারে করেছে। মন বলছে আজকের রাতটা আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকতে চলেছে। সম্যকের কাছ থেকে এমন কিছু আদায় করে নিতে হবে যার স্মৃতি বহন করবে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।
গোটা ফ্লোরটাতে আজ রাতে তারা দুজন। রিসেপসনের ছেলেটি জানাল, কোন অসুবিধা হলে তাকে জানাতে। অসুবিধা তো দূরের কথা, মনে মনে খুশিই হল তারা। সম্যকের আদরে তলিয়ে যাওয়ার সময় রুশার কোনোদিনও কোন হুঁশ থাকে না। তবুও সামান্য গা ছমছমে ভাবটা এড়িয়ে যেতে পারেনি সে। মন্দির থেকে ফেরার সময় সম্যকের স্পর্শ এমনিতেই তাকে মোহের আলোয়ানে মুড়তে থাকে ধাপে ধাপে; তার উপরে এই মৃদু অপ্রাকৃতিক পরিবেশ মোহ গ্রস্ত করে তোলে তাকে। রুশার মন তার কাছে এখনো কিছুটা কুয়াশাগ্রস্ত মনে হলেও সম্যক বোঝে তার দৈহিক ভাষা। এবিষয়ে সে প্রথম থেকেই সপ্রতিভ। আজকের রাতটা সে নিজেও খুব আশাবাদী। এমন রাত্রি তার কাছেও নব্য রূপে প্রকাশিত। এর প্রতিটি ক্ষণের নির্যাস প্রাণ ভরে গ্রহণ করে নিতে চায় সে। রুশার প্রতি তার আদর, সম্মান, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা সব কিছুই প্রকাশিত হয় তার দৈহিক সুখের মাধ্যমে। সে আদ্যোপান্ত পুরুষ মানুষ। ভাবনা অপেক্ষা ভাবের প্রতিই তার আগ্রহ। যা দর্শনীয় যা চরম ভাবে প্রকাশ্য তাতেই তার বিশ্বাস। মন হতে দেহে প্রবেশের এই বহুল প্রচলিত যাত্রাপথে দেহ হতে মনে অণুপ্রবেশের এই বৈপরীত্য সৃষ্টি এবং তার প্রমাণ তার আত্মসম্মানে একটা নতুন পালক যোগ করেছে। এর জন্য সে রুশার কাছে কৃতজ্ঞ।
( সমাপ্ত)
Next bangla story
List of all Bengali Stories
## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers.
The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation.
Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##
◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717