Home   |   About   |   Terms   |   Library   |   Contact    
A platform for writers

অন্তর্দাহ

Online bangla Story

-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার - মে, ২০২৪' স্বরচিত গল্প লেখার প্রতিযোগিতা, ( প্রতি বছর মে মাসে ) Result
--------------------------



List of all Bengali Stories

অন্তর্দাহ

লেখক: দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়, পিতা: ৺নিতাই চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নয়াসরাই, হুগলি

##

পরপর দুটো ট্রেন চলে গেল; পারলো না ব্রীহি। ভয়ে? নাকি মায়ায়!

"না, ভয়ে নয়। মরণে আমার ভয় নেই। ভয় আমার শুধু এই ঘৃণ্য , কলঙ্কিত জীবন বয়ে বেড়াতে; শেষ করতে নয়। বিশেষত কালকে রাতের ওই অবাঞ্ছিত‌ ঘটনা ঘটার পর। ছিঃ ছিঃ; এখনও যেন আমি আমার সর্বাঙ্গে এক অসহনীয় জ্বালা বয়ে বেড়াচ্ছি। নিজের ওপর আর নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য ঘেন্নায় গা-টা ঘিনঘিন করছে। এমন ঘৃণা ঘটনাও ঘটতে পারে কারও জীবনে? কেউ শুনেছে কোনওদিন? কোথাও? অনেক ভেবে, অনেক নিদ্রাহীন রাত, অনেক বিরামহীন প্রহর কাটিয়ে, এ-ছাড়া অন্য কোনও উপায় খুঁজে না পেয়েই না শেষকালে আমি একমাত্র সমাধান হিসেবে নিজেকে শেষ করার উদ্দেশ্যেই আজ এই গহীন রাতে এই রেল ব্রিজে এসে দাঁড়িয়েছি! কিন্তু দু'- দু'বার চেষ্টা করেও পারিনি। কোনও এক অদৃশ্য শক্তি যেন পেছন থেকে বারবার আমাকে...। যা হওয়া উচিত ছিল স্বাভাবিক ভাবে, আনন্দে, উৎসবে তাই হয়ে গেল বড় অশ্লীল, অন্যায্য ভাবে। কলঙ্কের কালিমায় ক্লেদাক্ত এক অভাবনীয় অঘটনের ফসল এক প্রাণ তিলে তিলে বৃদ্ধি পাচ্ছে আমারই গর্ভে। নারী জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ আমাকে পেতে হচ্ছে এমন এক কলুষের মধ্যে দিয়ে, যা এক অচিন্তনীয় দুর্ঘটনার চিহ্ন। সমাজের চোখে, বিবেকের কাছে যা মহাপাপ, যা গর্হিত। হয়তো এ আমার ভবিতব্য; কিম্বা পুর্বজন্মের অজানা কোনও অক্ষম্য অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত। কিন্তু কোনও ভাবেই আমার কাছে গ্রহণীয় নয়। তবুও মনটা যে কেন বারবার..."

তাহলে কি ব্রীহি সেই সর্বশক্তিমান, সর্বব্যাপীর হাতের ক্রীড়নক, নাকি অন্তরের অন্তঃস্থলে সৃষ্ট অযাচিত কোনও মমতার শিকার! না; মায়া নয়, মমতা নয়। তার মনুষ্যত্ব-বোধ, তার বিবেক বারবার বাধা হয়ে তার মনকে দুর্বল করে দিচ্ছে। ‌ ব্রীহির মনের ভেতর থেকে কে যেন কেবলই বলে উঠছে, "নিজেকে শেষ করার স্বাধীনতা যদি-বা তোমার থাকেও; আর একটা অসহায় প্রাণকে হত্যা করার অধিকার কি তোমার আছে?" ভেবেছে। কাল রাতভর, আজ সারাদিন ধরে ভেবেছে, কিন্তু মরণ ছাড়া এই অসহ মানসিক যন্ত্রণা, নিজের কাছে নিজের এই অনপনেয় কলঙ্ক ও লজ্জা থেকে মুক্তির আর দ্বিতীয় পন্থা বা একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে পায় নি মাত্র বাইশ বছর বয়সী বেচারা ব্রীহি।

চোখে একটা তীব্র আলো পড়তেই ডানদিকে তাকিয়ে দেখে ব্রীহি; বাঁকের মুখে একটা ট্রেন আসছে। ‌ ইঞ্জিনের চোখ ধাঁধানো আলোয় দু'পাশের গাছপালা, ঝোপঝাড় অন্ধকার থেকে ক্ষণিক আলোয় এসে আবার আঁধারে ডুবে যাচ্ছিল; যেমন তার জীবনের এক একটা মুহূর্ত জীবন্ত এক একটা ছবি হয়ে উঠে আসছে তার মনের আয়নায়; তাকে ছিন্নভিন্ন করে সরে যাচ্ছে তারা আরও একটা অসহনীয় যন্ত্রণাময় ছবি সামনে আসার সুযোগ করে দিয়ে। কিন্তু আর না। ওই তো এগিয়ে আসছে শমণ। ক্রমশ এগিয়ে আসছে তাকে সমস্ত গ্লানি, সব সঙ্কট ও প্রতি মূহুর্তের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে। সব দ্বিধা, সব সংশয় উপেক্ষা করে ব্রীহি অপেক্ষা করছিল সেই কাঙ্ক্ষিত মূহুর্তের। অপেক্ষা করছিল সমস্ত ক্লেদ, সব অপরাধ-বোধ থেকে চিরদিনের মতন নিস্কৃতি পাবার জন্য। আর মাত্র কয়েক সেকেন্ডের অপেক্ষা। তারপর...? চিরমুক্তি।

সেদিনও চরম উৎসাহে, উত্তেজনায়, নতুন জীবনের অজানা বৈচিত্রের আকর্ষণে, যৌবনের উন্মাদনায় ব্রীহি উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল সেই শুভক্ষণের যখন সে নতুন করে নতুন জীবন শুরু করবে নতুন একজনের চিরসাথী হয়ে। খানিক ভয়, একটু লজ্জা, অজানা এক পুলকে বারবার শিহরিত হচ্ছিল সে। পাকা দেখা হয়ে যাবার পর থেকে কি হবে, কেমন হবে সেটা নিয়ে যেমন একটা অজানা ভয় ছিল; তেমনই রোমাঞ্চ ছিল মনের গভীরে লালিত নানা রঙে রাঙানো স্বপ্ন পূরণ হবার আনন্দে। আরও পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতনই। কনে সাজানো হয়ে গিয়েছিল। কণি পিসিই সাজিয়ে দিয়েছিল। সিম্পল সাধারণ ঘরোয়া সাজ; যা চোখ ধাঁধানো মেকি চাকচিক্য অপেক্ষা রুচিশীল ও স্বাভাবিক সৌন্দর্যে উজ্জ্বল। অযথা চারটি কসমেটিকস মাখিয়ে আসল ব্রীহির সৌন্দর্যটা নষ্ট করে নকল এক ব্রীহি হতে চায়নি সে। টকটকে ফর্সা। সুন্দর গঠন। চোখ, নাক, ঠোঁট, চিবুক সব মিলিয়ে এক কথায় বেশ সুন্দরী সে। সুন্দর দেখাবার জন্য কৃত্রিম সাজের তার প্রয়োজনও হয় না; আর ব্রীহি সেটা জানেও। যদিও সে জন্য তার কোনও অহঙ্কার নেই, বরং তার সহজ সরলভাবে সকলের সঙ্গে মেলামেশা ও তার নিজস্ব ব্যক্তিত্ব তাকে বন্ধু-বান্ধব ও পরিজনদের মধ্যে প্রিয় করে তুলেছে। বড় ভালো মেয়ে সে। তার হবু বরও বেশ সুন্দর; শুনেছে সে; দেখেনি। সম্বন্ধ করে বিয়ে তার। বাবু এত মাতৃভক্ত যে বলে দিয়েছে 'মায়ের পছন্দই তার পছন্দ।' নিজে একবার দেখতেও আসেনি। তাই ব্রীহিরও আর দেখা হয়নি। ছবি অবশ্য দেখেছে। কিন্তু চাক্ষুষ না দেখে কি পুরোপুরি ভরসা করা যায়? অনেক সময় ছবিতে বিভ্রম ঘটায়। তবে তার হবু বরের ক্ষেত্রে সে সম্ভাবনা কম। কণি পিসি পাকা কথার সময় ওদের বাড়ি গিয়েছিল; ফিরে এসে বলেছিল, "তোর বর তো একেবারে রাজপুত্তুর রে! দেখে এলাম। একেবারে রাজযোটক হবে। সামলে রাখিস।" কণি পিসিটা যেন কি! সকলের সামনে..., কথাটা শুনে একটু লজ্জা লেগেছিল ব্রীহির সেই সময়; কিন্তু ভালোও লেগেছিল খুব। কিন্তু কেন যে এমন হলো! 'ঘরেও নহে; পারেও নহে' অবস্থায়, আজ তার দুঃখ ভাগ করে নেবারও কেউ নেই এই বিনা দোষে বিপর্যস্ত, বিশৃঙ্খল জীবনে। ভাগীদার করতে চায়ও নি সে অন্য কাউকে। তাই কাউকে বলেনি সে এতবড় অশৈরণের কথা।

সমবয়সী বন্ধু ও নিকট আত্মীয়রা নানারকম রঙ্গ-তামাসা করে মাতিয়ে রেখেছিল পরিবেশ। হা-হা, হি-হি-র মধ্যে বেশির ভাগ কথাই ছিল বিবাহ পরবর্তী সময়ে নারী পুরুষ সম্পর্ক সম্বন্ধিত। নব্য বিবাহিতাদের লক্ষণরেখা মানার কোনও দায় ছিল না। নিজের নিজের সদ্যলব্ধ রোমাঞ্চ ও অভিজ্ঞতা বর্ণনা করায় কোনও সংকোচই ছিল না কারও। ভালোই লাগছিল ব্রীহির আবার একটু লজ্জাও করছিল। সে নিজেও মনে মনে নানা রঙের মধুর স্বপ্ন বুনে চলেছিল আনমনা হয়ে মুখে দুষ্টু-দুষ্টু, তৃপ্তিভরা মৃদু হাসি নিয়ে। স্বপ্নজগৎ থেকে কঠিন বাস্তবে ফিরে এলো ব্রীহি হঠাৎই 'বর এসেছে; বর এসেছে' চিৎকার শুনে। হুড়োহুড়ি করে সবাই দৌড়লো বর দেখতে তাকে একা ফেলে রেখে। তারও ইচ্ছে করছিল ওদের সঙ্গেই দৌড়ে গিয়ে ওর হবু বরকে এক নজর দেখে আসে। কিন্তু সেটা সম্ভব ছিল না; সমাজ মানে না। উঁকি ঝুঁকি মেরেও একটুখানি দেখার উপায় নেই তার। বরাসন সেই বৈঠকখানায়। লুকিয়ে লুকিয়েও একবার এক ঝলক দেখার কোনও রাস্তাই নেই। অগত্যা ছবিতে দেখা বরকেই আর একবার নতুন করে মনশ্চক্ষে দেখতে থাকলো সে। শুভদৃষ্টির সময়ও ভালোভাবে দেখা হলো না। অতগুলো লোকের সামনে ড্যাবড্যাব করে দেখা যায়!! এক নজরে একটুখানি দেখে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিয়েছিল সে। নিজের বরকে প্রথম ভালো করে দেখলো ব্রীহি বাসরঘরে ভোরের দিকে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর। তাও ওপাশ ফিরে শুয়ে থাকায় মুখের একপাশটা। আশ্চর্য হয়ে দেখেছিল সে, বিহানের ডান কানের নিচে একটা কালো মতন তিল। মুচকি হেসে ভেবেছিল ব্রীহি; কণি-পিসি ঠিকই বলেছিল, 'একেবারে রাজযোটক হবে। ' আর কণি পিসির কথামত বরটাকে বোধহয় 'সামলেই রাখতে' হবে। সামলেই তো রাখতে চেয়েছিল। থাকতেও তো চেয়েছিল একান্ত আপন হয়ে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। কিন্তু কোন মহাপাপে যে আজ...

ট্রেনটা এগিয়ে আসছে। খানিকটা দূরে আলো পড়ে রেল লাইনটা চকচক করছে। আর বড় জোর ত্রিশ হাত দূরে মুক্তি। আর কয়েক মূহুর্ত পরে ব্রীহি থাকবে না। থাকবে না সমাজের চোখেই শুধু নয়; তার নিজের কাছেও কলঙ্কিত, নীতিবিরুদ্ধ, অভাবিত, অঘটনের ফসল এই প্রাণের চিহ্ন। এই কাঁটা যা দিনে দিনে ক্রমশ বড় হচ্ছে তারই দেহে। যার স্বতঃস্ফূর্ত আবাহন হওয়া উচিৎ ছিল শঙ্খধ্বনি ও পারিবারিক আশা আকাঙ্ক্ষার পূর্ণতায়, তারই আজ অকাল বিসর্জনের অপেক্ষা।

বিহানের ডান কানের নিচে তিলটা দেখে আশ্চর্য হলেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি ব্রীহি। বরং সবাই ঘুমোচ্ছে এই সুযোগে বিহানকে ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখে মনে মনে ভেবেছে, 'আমার বরটা বেশ সুন্দর। ' ভগবানকে সেদিন মন থেকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। তারপর ভোরের আলো ফুটতেই গাঁটছড়াটা কাঁধে ফেলে খুশি খুশি মুখে ভেতরবাড়ি চলে গেছে তৈরি হতে শ্বশুরবাড়ি যাবার জন্য। তারপর একসময় নিজে কেঁদে আর সবাইকে কাঁদিয়ে বিহানের পেছু পেছু ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িতে উঠে চোখের জল মুছেছে ব্রীহি। এক বিচিত্র সুখানুভূতি আর প্রিয়জনদের ছেড়ে যাবার বেদনা মিলেমিশে কিরকম একটা অদ্ভুত ঘোরলাগা অবস্থায় ঢুলতে ঢুলতে একসময় বোধহয় একটু চোখ লেগে গিয়েছিল তার। হঠাৎ শঙ্খধ্বনি, মুহুর্মুহু উলুধ্বনি আর মহিলা-পুরুষের সম্মিলিত কন্ঠস্বরে চোখ খুলে দেখে একটা পাঁচিল ঘেরা সুন্দর করে সাজানো দোতলা বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের গাড়ি। একজন সুন্দরী তরুণী তার হাত ধরে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে বলল, "এসো বৌদি..."

'এসো বৌদি'! তার মানে ননদ। কিন্তু সে যে শুনেছিল, বিহান 'এঁদের' মানে তার শ্বশুর শাশুড়ির একমাত্র সন্তান! সে কি তবে ভুল শুনেছিল? তা কি করে হবে? এই তো দুদিন আগেও পাশের বাড়ির খেমি কাকিমা মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মাকে বলেছিল, "ভালোই তো দিদি; কথায় বলে ননদী বিষের কাঁটা। এই বেশ ঝাড়া হাত-পা। ননদ-দেওরের ঝামেলা নেই।" পরে আরও অনেক কথা হয়েছিল খেমি কাকিমা আর মায়ের মধ্যে। বিয়ের সাতকাহন। ব্রীহি আর কান দেয় নি সে সব কথায়। তার মন তখন অন্য জগতে উড়ছিল প্রজাপতির মতন। 'তবে? এখন ননদ এলো কোথা থেকে? দুর সম্পর্কের কেউ? হবে হয়তো বা পাড়ার কোনও ঘনিষ্ঠ পরিবারের মেয়েও হতে পারে। সমবয়সী বলেই মনে হয়। বন্ধুত্ব? হতেই পারে।' তারই হাত ধরে সে গিয়ে দাঁড়ালো বেশ সুন্দর করে সাজানো একটা ঘরের দরজার সামনে; তার পেছনে তার বর বিহান গাঁটছড়ায় বাঁধা। আলতো একটু হাসির রেখা ফুটে উঠল ব্রীহির ঠোঁটে। নাপিত ছোকরাটা খুব ফাজিল ছিল। গাঁটছড়া বাঁধার সময় বলেছিল, "এ এমন বাঁধন দিলাম; স্বয়ং বেম্ভাও খুলতে পারবে না এই গিঁট। সারাজীবন একে অন্যের সাথে লেপ্টে থাকবে জোড়া শালিকের মতন।" লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল ব্রীহি। উপস্থিত সবাই হো হো করে হেসে উঠেছিল। মনে মনে ভেবেছিল সে, "ছোঁড়াটার মুখের কোনও রাখ-ঢাক নেই। অসভ্য!" চমক ভাঙ্গল ননদিনীর কথায়। "কই গো! বরণ-টরণ করবে? নাকি নতুন বউ দাঁড়িয়ে থাকবে দোরগোড়ায়?", একজন সধবা ভদ্রমহিলা হাত তিন চার দুরে একটা ছোট্ট হাঁড়িতে দুধ জাল দিচ্ছিলেন; দুধটা উতলে উঠতেই হাত দুটো জোড় করে বেশ স্পষ্ট করেই বলে উঠলেন, "সংসারে সুখ সম্পদ উতলে উঠুক।" তারপর এক সময় বরণ, আলতা-পা ইত্যাকার যাবতীয় স্ত্রী আচারের পুলক-মাখানো অত্যাচার-পর্ব শেষ হবার পর বিহান আর সে এখন বাড়ির ঠাকুরঘরের সামনে হাতজোড় করে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে। ‌ ঠাকুর-প্রণাম হয়ে যাবার পর গিন্নী-মা আশীর্বাদি ফুল নিয়ে ছেলে বিহান আর নতুন বউ ব্রীহির মাথায় ঠেকিয়ে আশীর্বাদ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে খানিক তাকিয়ে রইলেন। ব্রীহির কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। চোখে চোখ রাখতে না পেরে চোখ নামিয়ে নিয়েছিল সে। সেই সুন্দর মেয়েটাকে দেখিয়ে শাশুড়ি ঠাকরুন পরিচয় করিয়ে দিলেন, "এই তোমার একমাত্র ননদ তনু।"

"আসলে আমার নাম তনিশা। তনিশা সুর। সবাই ছেঁটে কেটে সুবিধে মত তনু করে নিয়েছে। আমি কিন্তু সেই রায়বাঘিনী ননদী নই বরং আমাকে বন্ধু ভাবতে পারো," বলল সপ্রতিভ তনু। ব্রীহি ছোট্ট করে মিষ্টি একটু হাসলো। খুচ-খাচ আরও কিছু পারিবারিক আচার তখনও বাকি। ক্লান্ত লাগলেও হাসি মুখে সমস্ত আচার পালন করলো সে; কোনও দিকে যেন কোনও ত্রুটি না থাকে। বলা যায় না কোন দিক দিয়ে কোন অলক্ষণ ভবিষ্যৎে কোন অনিষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়!

ব্রীহি কনজারভেটিভ নয়; রীতিমতো শিক্ষিত। আধুনিক ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সে যেমন পরিচিত; তেমনই মা, বাবা, সমাজের কাছে শেখা কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রতি উদাসীনও নয়। তার মতে, 'মানলে তো ক্ষতি নেই; কিন্তু না মেনে অযথা ঝুঁকি নেবার কি দরকার? কুসংস্কারই হোক বা অপ্রয়োজনীয়ই হোক; এত লোক যখন মানে তখন সেই বা উল্টোপথে হেঁটে সকলের বিরাগভাজন হতে যাবে কেন? বিশেষত একটু কষ্ট করলে যদি মা, বাবা, আত্মীয়স্বজন এবং আশপাশের সবাই খুশি হয়, সুখী হয় তাহলে অকারণে অশান্তি ডেকে আনা অর্থহীন নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছু নয়।'

এত দেরি হচ্ছে কেন গাড়িটা আসতে! এতক্ষণ তো আরও কাছে এসে যাওয়া উচিত ছিল। সিগনাল পায়নি বোধহয়। দাঁড়িয়ে আছে। সেটাই নিয়ম। নিয়ম ভেঙে ভুল করলে দুর্ঘটনা অবশ্যম্ভাবী। "কিন্তু আমি কি এমন ভুল করলাম যে আমার জীবনে এই দুর্ঘটনা? এই টানাপোড়েন? আমি তো সমস্ত শুভাকাঙ্ক্ষী গুরুজনদের কথা শুনে, সামাজিক রীতি রেওয়াজ মেনেই চলেছি সারাজীবন। তাহলে? তাহলে কেন, কবে, কি ভুল হয়ে গেল আমার? নাকি আমাকে ভুলের জালে জড়াবার জন্য, আমার জীবনটাকে ভেঙেচুরে তছনছ করে দেবার জন্য কোনও এক অদৃশ্য শক্তি ফাঁদ পেতে রেখেছিল? হ্যাঁ, তাই। নিশ্চয়ই তাই; তা না হলে ভুল করে ভুল ঠিকানায় আমাকে পাঠানো হলো কেন?" বিদ্রুপ-ভরা একটা হাসি ফুটে উঠল ব্রীহির ঠোঁটে। বড় করুন সে হাসি। মনে মনে ভাবলো বেচারা, "ভগবানেরও ভুল হয় তাহলে!"

আজ কালরাত্রি। স্বামীর মুখ দেখতে নেই। কেন এ নিয়ম কে জানে! হয়তো দুটো অপরিচিত প্রাণকে নতুন জীবন, নতুন সম্পর্ক, নতুন সম্বন্ধে জড়িয়ে পড়ার আগে মানসিক প্রস্তুতি নেবার সুযোগ করে দেবার জন্যই এই সাময়িক দূরত্ব রক্ষার বিধান বা হয়তো পরস্পরের প্রতি আরও আকর্ষণ, আরও নিবিড় করে পাবার আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টির জন্য বিচ্ছিন্ন করে রাখার এই নিদান; জানে না ব্রীহি। খুঁটিনাটি সমস্ত ক্রিয়া-কর্মাদি সুচারুভাবে শেষ হবার পর শাশুড়ি ঠাকরুন বললেন, "যাও বৌমা। ধরাচুড়ো সব ছেড়ে চান করে বিশ্রাম করো গিয়ে। অনেক ধকল গেছে। দেখো আবার ঘুমিয়ে পড়ো না যেন। একেবারে চারটি মুখে দিয়ে টানা একটা ঘুম দিয়ে নেবে; শরীরটা ঝরঝরে হয়ে যাবে।" কথাগুলোর মধ্যে কেমন যেন একটা মা-মা ভাব ছিল। খুব ভালো লেগেছিল ব্রীহির। মনে মনে ভেবেছিল, 'মা-ই তো!' নতুন বাড়িতে, নতুন পরিজনদের মধ্যে, নতুন পরিবেশে অনেকের সাথে পরিচিত হয়ে আর পরিচিতি পেয়ে কেটে গেল তার সারা দিন। রাতও। এলো নতুন ভোর। ব্রীহির জীবনে নতুন এক স্বপ্নময় ভোর; অজানা, অচেনা এক রঙিন জীবনে প্রবেশের ছাড়পত্র নিয়ে।

আজ তার ফুলশয্যা। একজন নারীর বহু যত্নে লালিত সম্পদ, দেহে মনে নির্দ্বিধায় দয়িতের কাছে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে সমর্পণের রাত। চাওয়া পাওয়ার মেলবন্ধনে হাসিখুশি সুখী দাম্পত্য গড়ে তোলার প্রথম সোপানে পা রাখা। সকাল থেকেই কারণে-অকারণে শিহরিত হচ্ছিল ব্রীহি। সারা জীবনের সঙ্গীকে চেনার এবং নিজেকে পুরোপুরি চেনানোর অপেক্ষায়। মনের কোন গোপন কোটরে যেন আনন্দের তুফান জেগেছিল তার। সঙ্গে ছিল একটু উদ্বেগ, একটু শঙ্কা। বারেবারে মনের কোণে একটাই প্রশ্ন বিব্রত করছিল তাকে, 'আমি কি নিজেকে তার উপযুক্ত করে তুলতে পারবো? সে কি আমাকে নিয়ে সুখী হতে পারবে? গড়ে তুলতে পারবো নিজেকে তার মনের মতন করে?'

পেরেছিলাম তো আমি। আমি যে পেরেছিলাম তার নিশান তো আমি এখনও বয়ে বেড়াচ্ছি নিজের দেহে। না, ফুলশয্যার রাতে আমি এই উপহার পাই নি। সেদিন তো প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে গল্প করতে করতেই প্রায় ভোর হয়ে গেল। রাত তখন পৌনে তিনটে কি তিনটে হবে; ও বলেছিল, 'এবার ঘুমিয়ে পড়। ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই।' তারপর আমার কপালে আলতো করে একটা..., সেই ছিল আমার প্রথম পুরুষ স্পর্শ।

না। পুরুষ স্পর্শ তো এর আগেও কতবারই পেতে বাধ্য হতে হয় মেয়েদের। বারো তেরো বছর বয়স হতে না হতেই বাসে-ট্রেনে, রাস্তায়-ঘাটে, দোকানের ভিড়ে। কিছু অনিচ্ছাকৃত আবার কিছু ইচ্ছাকৃত শয়তানি। ওই বয়সেই মেয়েদের ব্যাড টাচ এবং ইনোসেন্ট টাচ সম্বন্ধে একটা ধারণা আপনাআপনিই তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু বিহানের সেই স্পর্শে এমন একটা মাদকতা, একটা অনুরাগ-ভরা আবেশ ছিল যে ব্রীহি ভেতর থেকে শিউরে কেঁপে কেঁপে উঠেছিল। তখন যেন আরও বেশি কিছু পাবার আকাঙ্ক্ষায় পাগল হয়ে উঠেছিল তার দেহ, তার মন। আর আজ? আজ মনে হচ্ছে, 'ছিঃ, ঘেন্না। ঘেন্না এ জীবনে।'

'বিহানের দেহের পুরুষালি গন্ধে আমি মাতাল হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু বিহানের সংযম আমাকে সংযমী হতে শিখিয়েছিল। চরম প্রাপ্তির সেই পরম মূহুর্ত তোলা রইল তখনকার মতন। যে বিষফল এখন কাঁটার মতন বিঁধছে আমার বুকে; সেই বিষ আমি বড় আনন্দের সাথে গ্রহণ করেছিলাম আরও তিনদিন পরে অষ্টমঙ্গলায় বাপের বাড়ি গিয়ে। তখন যদি জানতাম...,'

"উফ্! ভগবান! কেন তুমি এত নির্দয়, এতটা নিষ্ঠুর, এতখানি পাষাণহৃদয়? যদি জানালেই তাহলে আরও আগে জানালে না কেন? আগে জানালে এমন ঘৃণ্য , অশ্লীল কাণ্ড, এমন নীতি-হীন নির্লজ্জ ঘটনা তো ঘটতো না!"

কি হলো গাড়িটার? অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে! হেড লাইটটা ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসছে যেন। যে গাছগুলো এতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল; সেগুলো আবার আবছা হতে হতে অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে! পেছনের গাছগুলো আলোর রোশনাইয়ে ঝলমলিয়ে উঠছে। তবে কি গাড়িটা ফিরে যাচ্ছে? হয়তো লাইনে কোনও কাজ ছিল; সারা হয়ে গেছে তাই ফিরে যাচ্ছে। "কিন্তু আমার তো আর ফিরে যাবার কোনও উপায় নেই। আমার পেছনে অশালীন এক কলঙ্কময় জীবন; সামনে ঘোর অন্ধকার। জীবনের শুরুতেই জীবন শেষ করার আহ্বান।"

নিচের দিকে তাকালো ব্রীহি। কলকল করে বয়ে চলেছে শান্ত, পবিত্র পতিতোদ্ধারিনী গঙ্গা। কিন্তু তার বুকে শান্তি নেই। একটা ঝড়, একটা তুফান যেন বয়ে চলেছে তার বুকের মধ্যে। অসহ এক মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করছে সে। "আমাকে উদ্ধার করবে মাগো? আমি যে হঠাৎই পতিত হয়ে গেছি মা। বিনা দোষে, নিজের অজ্ঞাতেই কলঙ্কের কালি মেখেছি আমি আমার অন্তরে-বাহিরে, সর্বাঙ্গে!" ডুকরে কেঁদে উঠল ব্রীহি। সেদিনও এ-রকম ভাবেই কেঁদে উঠেছিল সে যখন জানতে পেরেছিল বিহান তার...,

অষ্টমঙ্গলা করে ফিরে আসার দিন পনেরো পরে যখন তার স্বাভাবিক জীবনচক্র বিঘ্নিত হলো, তখনই সন্দেহ হয়েছিল ব্রীহির। তারপর যখন পরের মাসেও... তখনই সে আনন্দে শাশুড়ি মাকে খবরটা দিয়েছিল। উচ্ছ্বসিত শাশুড়ি মা খুশিতে জড়িয়ে ধরেছিলেন তাকে। চোখে আনন্দাশ্রু; গদগদ হয়ে বলেছিলেন, "কি সুখবর যে শোনালি মা; মন ভরে গেল। নাতনী হলে নাম রাখবো...,"

"এ্যাঁ? নাতনী?"

"হ্যাঁ। আমি নাতনীই চাই। একটা মেয়ের যে আমার..." গলাটা যেন হঠাৎ ভারী হয়ে গিয়েছিল মায়ের সেদিন। "বেঁচে থাকো মা; সুখী হও। যা, ঠাকুরঘরে গিয়ে প্রণাম করে আয়।"

আনন্দের আতিশয্যে দুড়দুড় করে সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নাবছিল ব্রীহি ঠাকুরঘরে যাবার জন্য। শাশুড়ি চেঁচিয়ে উঠলেন, "আস্তে! আস্তে আস্তে যাও মা। বেশি হুড়োতাড়া করো না। এই সময়ে একটু সাবধানে থাকতে হয়।" ব্রীহি শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে নেবে ঠাকুরঘরে গেল প্রণাম করতে। রোজ চান করে এসে ঠাকুর প্রণাম করে সে। তবে সেটা যেন খানিকটা গতানুগতিক রুটিন পালন করা। ঠাকুর ঘরের চৌকাঠে মাথা ঠেকিয়ে নিয়ম রক্ষা করা। আজ কিন্তু ঠাকুরঘরে ঢুকে প্রতিটি ছবি, প্রতিটি মূর্তি আলাদা আলাদা ভাবে দেখে ভক্তিভরে প্রণাম করলো ব্রীহি। মঙ্গল কামনা করলো তার সন্তানের, স্বামীর, সংসারের সকলের। সেই সময়ই নজর পড়েছিল ছবিটার ওপর। নানান দেব দেবীর ছবির একপাশে একটা বাচ্চা মেয়ের ছবি। বছর দু' আড়াই বয়স হবে। টকটকে ফর্সা রঙ। একটা ইজের আর একটা পেনিফ্রক পরে সামনের খান চারেক দাঁত বার করে গালভরা হাসি নিয়ে যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। বেশ মিষ্টি মিষ্টি দেখতে। মোটা-সোটা, লদলদে, গাবলুগুবলু। দেখলেই চটকে আদর করতে ইচ্ছে করে। কে মেয়েটা? ঠাকুরের সিংহাসনের পাশে আলাদাভাবে বেশ যত্ন করে রাখা! মুখটা আরও কাছে নিয়ে গিয়ে দেখলো ব্রীহি। বেশ পুরোনো হয়ে গেছে সাদা কালো ছবিটা। জায়গায় জায়গায় একটু আবছা মতন হয়ে গেছে। কিন্তু মুখটা যে বেশ মিষ্টি সুন্দর সেটা অনায়াসে বোঝা যাচ্ছে। সামনে পেতলের প্লেটে একটা ললিপপ। ললিপপ কেন? বোধহয় ভালোবাসতো। তবে কি এই বাড়িরই কোনও মেয়ে অকালে...! বা অন্য কোনও স্নেহের পাত্রী? বা..., কিন্তু এতদিনেও তো এর কথা কারও মুখে শোনেনি সে! এত যত্ন করে, গুরুত্ব দিয়ে যার ছবি ঠাকুরের আসনের পাশে রাখা; সে তো নিশ্চয়ই হেলাফেলার কেউ নয়। তবে? কেন সে জানতে পারে নি এতদিন? কেন কেউ জানায় নি তাকে?

কে! কে এই মেয়েটা? জানতে খুব ইচ্ছে করছে। শাশুড়ি মাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। উনি বলছিলেন, 'একটা মেয়ের আমার বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা।' কিন্তু কেন? তবে কি তাঁর এই মেয়ে পাবার ইচ্ছের পেছনে অজ্ঞাত কোনো কারণ লুকিয়ে আছে! কোনও দুঃখজনক অকালমৃত্যু বা অন্য কোনও ব্যাথা-ভরা অঘটনের ক্ষত? জানতে হবে। মায়ের কাছেই জানতে হবে।

অপরিসীম কৌতূহল নিয়ে ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে এলো ব্রীহি। কে ওই মেয়ে? কিই বা সম্পর্ক তার এই বাড়ির সঙ্গে। অদম্য কৌতূহল। নানা প্রশ্ন গিজগিজ করতে থাকলো তার মাথায়। নিচে থেকে ওপরে এসে ব্রীহি দেখল শাশুড়ি ব্যালকনিতে একটা বেতের চেয়ারে স্থির হয়ে বসে আছেন শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে। কিছু যেন ভাবছেন জগৎ সংসার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাস হয়ে। ব্রীহি খুব আশ্চর্য হল হঠাৎ এই পরিবর্তন দেখে। যে মানুষটা কিছুক্ষণ আগেও প্রাণ-খুলে হাসতে হাসতে জড়িয়ে ধরেছিলেন তাকে, সেই মানুষটাই হঠাৎ এমন গম্ভীর হয়ে গেলেন কেন? কি এমন ভাবছেন মা অমন আত্মগত, তন্ময় হয়ে? কোনও দিকে কোনও কারণ খুঁজে না পেয়ে সে ভাবলো, 'দুর! এমনিই হয়তো চুপ করে আছেন। আমিই তিলকে তাল বানাচ্ছি। নিশ্চয়ই হবু নাতনীর কথা ভাবছেন।' তাই কাছে গিয়ে ব্রীহি আস্তে করে ডাকলো, "মা..."

এমনভাবে চমকে তাকালেন তিনি; মনে হলো নিজের ওপর যেন তাঁর নিজেরই কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না এতক্ষণ।'

সেদিন আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু আজ যখন আমার সব শেষ হয়ে গেছে; প্রাণটাই শুধু যায়নি বলে এখনও হৃৎস্পন্দন হচ্ছে; অবাঞ্ছিত একটা কাঁটা এখনও বেঁচে থাকার আশায় বৃদ্ধি পাচ্ছে আমারই দেহে, এখন আমি বুঝতে পারছি কার চিন্তায় মা তখন মগ্ন ছিলেন। বিরহ যন্ত্রণায় বিবশ হয়ে মা তখন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন আকাশের দিকে কার কথা ভেবে। বুঝতে পারছি কার শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য তিনি একটা নাতনীর আশা করেছিলেন!

"বলছিলাম, ঠাকুরঘরে ওই ছোট্ট মেয়েটার...,"

কথাটা সম্পূর্ণ হবার আগেই মা বলে উঠলেন,"একটু চা করে আনবে বৌমা? মাথাটা বড্ড ধরেছে।"

মনে হলো যেন এড়িয়ে যেতে চাইলেন আমার প্রশ্নটা। "হ্যাঁ মা, এখুনি আনছি।" তাড়াতাড়ি রান্না ঘরের দিকে ছুটলো ব্রীহি। কিন্তু মনে একটা খটকা লেগে থাকলো। 'প্রশ্নটা কি মা এড়িয়ে গেলেন? কিন্তু কেন?' কিছুই আন্দাজ করতে পারলো না সে। কিন্তু কৌতূহল বড়-বালাই। দুদিন পরে শাশুড়ির চুল আঁচড়ে দিতে গিয়ে একই প্রশ্ন করলো সে। এবারও কোনও উত্তর পাওয়া গেল না। অথচ কৌতূহল দমন করতেও পারছে না ব্রীহি। তবুও আর কোনও প্রশ্ন না করে শাশুড়ি মায়ের চুলে চিরুনি চালাতে থাকলো সে আনমনে। কিছুক্ষণ পরে মনে হলো মা যেন নাক টানছেন আর তাঁর পিঠটা যেন মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। বোধহয় কাঁদছেন; মনে হলো। তাড়াতাড়ি চিরুনি রেখে সামনে গিয়ে দেখে মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন; চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল ঝরে পড়ছে। ব্রীহি অনায়াসেই আন্দাজ করতে পারলো তার কৌতূহলের সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে জড়িত এই চোখের জল। অপরাধী মনে হলো নিজেকে। ভাবলো কথাটা না তুললেই হতো। "মা! কাঁদছো কেন মা?" বলে চোখের জল মোছাতে গেল ব্রীহি।

"মা রে..." বলে ব্রীহিকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরলেন সরলা দেবী, ব্রীহির শাশুড়ি। "তুই আমাকে ছেড়ে যাসনে মা! কথা দে, তুই আমাকে ছেড়ে যাবিনে কোনওদিন?"

"কেন? তোমাকে আমি ছেড়ে যাবো কেন?"

"ও যে ছেড়ে গেল? আমাকে একেবারে নিঃস্ব করে ছেড়ে চলে গেল?"

"কে তোমাকে ছেড়ে চলে গেল?"

"ওই যে; ওই মেয়েটা। যার ছবি..., তার জায়গায় আমি যে তোকেই বসিয়েছি রে মা!"

"কার ছবি ওটা? কে হয় ও তোমার?"

"বলবো। তোকে আমি সব বলবো। তার আগে তুই কথা দে; খোকাকে কিছু বলবি না! ও কিছু জানে না; মনেই নেই ওর। আর মনে থাকবেই‌ বা কি করে; ওর তো তখন চার বছর আর বিতানের বয়স দুই।"

"বিতান কে?"

"আমার মেয়ে। ওই ছবি। এতদিনে তোর বয়সী হতো..."

"তবে কি কোনও অসুখ বিসুখে ছোটবেলায়ই...?"

"না, না। ও আছে। আমার স্থির বিশ্বাস আজও বিতান কোথাও না কোথাও ঠিক আছে।"

বহু বছরের চেপে রাখা ব্যাথা ঝরঝর করে ঝরে পড়তে লাগলো জল হয়ে তাঁর দু চোখ ছাপিয়ে। ব্রীহি আদর করে তাঁকে জড়িয়ে ধরে, পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে থাকলো। কিছুক্ষণ পরে খানিকটা থিতু হয়ে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন তিনি, "হারিয়ে গেল। হারিয়ে ফেললাম আমি বোধহয় নিজেরই দোষে। গঙ্গাসাগরে পুণ্যি অর্জন করতে গিয়ে পূর্বজন্মের কোন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে এলাম আমি, কে জানে! আমি, উনি আর দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে চারজন গেলাম আর ফিরলাম তিনজন। ওই মেলায় মেয়েটা যে আমার কোথায় হারিয়ে গেল; আর ফিরে পেলাম না।"

'হারিয়ে গেল? ' ভাবছিল ব্রীহি। 'তাই বোধহয় মা তাঁর নাতনীর মধ্যে নিজের হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে ফিরে পেতে চান।' "হারিয়ে গেল? মানে? কি করে?" ভেজা ভেজা গলায় জিজ্ঞেস করল সে।

"দু'দিন মেলায় ঘুরে কপিল মুনির আশ্রমে পুজো দিয়ে, গঙ্গা স্নান করে খুশি মনে ফেরার দিন কি মতিচ্ছন্ন হলো আমার, নাকি গ্রহের ফের জানি না মা, ভাবলাম বাড়ির কাজের মেয়ে দুটোর জন্য টুকিটাকি কিছু কিনে নিয়ে যাই। ওরা আশা করে। একটা বড় মনোহারী দোকানে এটা-ওটা বাছছি; বিতান আমার শাড়িটা ধরে আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। ওর বাবা পাশের দোকানে খোকার বায়নায় একটা খেলনা-বন্দুক নিয়ে দরাদরি করছিল। দাম মেটাতে গিয়ে নজর পড়লো বিতান আমার পাশে নেই। কোথায় গেল? এই তো ছিল আমার গা ঘেঁসেই দাঁড়িয়ে, কাপড়টা ধরে। এখন নেই। কোথায় গেল এই ভিড়ে ওইটুকু মেয়ে? বুকটা ধড়াস করে উঠলো আমার অন্য এক ভাবনায়। ধরে নিয়ে গেল না তো কেউ ভুলিয়ে ভালিয়ে? বাচ্চা ছেলেমেয়ে চুরির কথা তো প্রায়ই শোনা যায়।"

ব্রীহি খুব মন দিয়ে শুনছিল এবং মনে মনে ভাবছিল, 'কি হলো তাহলে ওই মেয়েটার?' শিউরে শিউরে উঠছিল তার বুকটা আতঙ্কে; মেয়েটার সম্ভাব্য বিপদের কথা ভেবে।

"চিন্তায়, ভয়ে রাস্তার দিকে ছুটলাম আমি। 'বিতান রে! ও বিতান!' বলে চেঁচাতে চেঁচাতে। গিজগিজে ভিড়। আমার গলার আওয়াজ ডুবে গেল পূণ্যার্থীদের চিৎকার আর চেঁচামেচিতে। তবুও মা আমি। ওই ভিড় ঠেলেই এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতে লাগলাম। দু'পা এগোই তো তিন পা পিছিয়ে আসতে হয় লোকেদের ধাক্কায়। সকলেরই তাড়া যে! কোন্ অভাগিনী মায়ের কোন্ বিতান হারিয়ে গেছে, সে খবর কে রাখবে! হন্যে হয়ে এদিক- ওদিক, এ দোকান, সে দোকান খুঁজে বেড়ালাম। হঠাৎ মনে হলো গঙ্গার দিকে যায়নি তো! ছুটলাম দুজনে গঙ্গার দিকে। কোনও খোঁজ পেলাম না। একে জিজ্ঞেস করি, ওকে জিজ্ঞেস করি কিন্তু..., খুঁজে দিতে পারতো যে, সেই ভগবানই মুখ ফিরিয়ে নিলে কে আর আমার হারা-নিধিকে খুঁজে দেবে বল? এদিকে ক্রমশ সন্ধ্যে হয়ে আসছে। কনকনে উত্তুরে হাওয়া; একা একা কি খাবে, কোথায় শোবে, হয়তো বা ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে..., হু হু ‌করে উঠলো বুকটা দুশ্চিন্তায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও যখন কোনও হদিশ করতে পারলাম না তখন পুলিশ ক্যাম্পে গিয়ে রিপোর্ট লেখানো হলো। তারা সব শুনে দু' কথা শোনাতে ছাড়লে না। 'কেমন মা আপনি! মেয়েটার হাত ছেড়ে দিয়ে শখের কেনাকাটাই বড় হলো?' তাদের দোষ নেই। আমি তো নিজেই ভাবছিলাম, 'আমি মা নই। একটা পিশাচ, ডাইনী আমি একটা। তা না হলে নিজের মেয়েকে নিজে সামলাতে পারলাম না? হারিয়ে ফেললাম?' পুলিশ একটা ছবি চাইলো। কিন্তু ছবি কোথায় পাবো? শেষে ওর বাবার নাম ঠিকানা লিখে নিল ওরা। মাইকে ঘন-ঘন ঘোষণা করতে লাগলো। বিতান শুধু নয়; আরও কত লোক যে এই মেলায় হারিয়ে গেছে; হারিয়ে যায় রোজ তা বুঝতে পারলাম ওই পুলিশ ক্যাম্পে গিয়ে। বাড়ি আর সেদিন ফেরা হলো না। আরও দুদিন থেকে অনেক খোঁজখবর করা হলো; কিন্তু না। কোনও খবরই পাওয়া গেল না। কোথায় যে লুকিয়ে রাখলো মেয়েটাকে ভগবান! হাসতে হাসতে চারজন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম, আর ফিরলাম তিনজন কপিল মুনির আশীর্বাদে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে। এতদিন ধরে কত প্রার্থনা, কত মিনতি করলাম আমি ভগবানের কাছে কিন্তু ওই কঠিন, কঠোর বিধাতা সন্তানহারা এক মায়ের চোখের জলের আজও কোনও মূল্য দিল না রে মা; কোনও মূল্য দিল না।"

একটা বেদনা-ভরা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের জলটা আরও একবার মুছে নিলেন কন্যা-হারা মা সরলা। "মুখে কিছু না বললেও সহ্য করতে পারেন নি বিতানের বাবা এই আঘাত। একদিন রাতে শুয়ে সকালে আর উঠলেন না। বিহানের তখন ছ' বছর বয়স। মেয়েছেলের কই মাছের প্রাণ; না মেরে জিইয়ে রাখলেন ঠাকুর শত পাপের পাপী আমাকে, হয়তো বিহানের জন্যই। তা না হলে ছেলেটাও আমার কোথায় ভেসে যেতো।"

পুরো পরিবেশটাই তখন থমথমে। নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে শুধু শাশুড়ি মায়ের গুমরে গুমরে কান্নার আওয়াজটুকুই শোনা যাচ্ছে। বাক্যি-হারা ব্রীহিও। কি-ই বা বলার থাকতে পারে এমন একটা মর্ম-বিদারক ঘটনা শোনার পর! সবকিছু শোনার পর ব্রীহির মনে নানান প্রশ্ন জট পাকিয়ে তাকে বিহ্বল করে তুলেছিল। তার মধ্যে একটা প্রশ্ন তার মনটাকে বারবার অস্থির করে তুলছিল। 'মেয়েটার কি হলো? বেঁচে আছে? থাকলে কি অবস্থায় আছে? কোথায় আছে? কোনও সহৃদয় পরিবারের আশ্রয়ে নাকি...' কেঁপে উঠলো ব্রীহি নারী-জীবনের নিকৃষ্টতম সম্ভাবনার কথা ভেবে।

'টাইম হিলস্ দ্য' উণ্ড। ' কথাটা অনেকাংশে সত্যি। কিন্তু সম্পূর্ণ নিরাময় হয় কি? বোধ হয় না। ভেতরে ভেতরে একটা ক্ষত থেকেই যায়। কোনও কারণে অকস্মাৎ সেই ক্ষতে একটু খোঁচা লাগলেই আবার রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়। তাই হয়েছিল সরলা দেবীর; হঠাৎ ব্রীহির নির্দোষ কৌতূহলে। কিন্তু আস্তে আস্তে কিছুদিন পরে সেই বিশ্রী, থমথমে পরিবেশটা কেটে গিয়ে পূর্বাবস্থা ফিরে এলো। আবার জীবন চলতে থাকল আপন গতিতে, তার নিজস্ব ছন্দে।

বিহান এবং ব্রীহির পারস্পরিক সম্পর্ক অতি মধুর। একে অপরের প্রতি সম্পূর্ণ সমর্পিত। বিশ্বাস, ভরসা, ভালোবাসা বাইরে থেকে আমদানি করা যায় না। হৃদয় থেকে উৎসারিত এ এক অমূল্য সম্পদ যা সকলের ভাগ্যে জোটে না। হৃদয় দিয়ে হৃদয় পাবার আনন্দ, সুখ, তৃপ্তি অপরিসীম। দানে ও গ্রহণে পরিপূর্ণ ছিল তাদের অন্তর। সুখী দাম্পত্য বোধহয় একেই বলে। মাকে নিয়ে কোনও সমস্যা ছিল না তাদের। সরলা দেবী নিজেও ছেলে-বউ নিয়ে সুখে ছিলেন। তাই বিহান আর ব্রীহির কাছে মা বোঝা হয়ে দাঁড়ান নি বরং তিনি ছিলেন তাদের নিশ্চিন্ত, নিরাপদ আশ্রয়।

বিহান যখন খবরটা ব্রীহির মুখে প্রথম শুনলো তখন সে আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিল। তার উচ্ছ্বাস দেখে ইয়ারকি করে বলেছিল ব্রীহি, "অত লাফিয়ো না। এখন খুব সাবধানে থাকতে হবে।"

"মানে?"

নিজের হাত দুটো দিয়ে মুখটা ঢেকে লজ্জায় রাঙা ব্রীহি জানিয়েছিল, "এখন আর দুষ্টুমি করা চলবে না।"

কিন্তু যৌবন আর কবে নিষেধাজ্ঞা মেনে চলেছে! ব্রীহিকে কাছে টেনে নিয়েছিল বিহান। একটু ইতস্তত করে ব্রীহিও ভেসে গিয়েছিল সমর্পণের জোয়ারে। তৃপ্তির চরম শিখরে পৌঁছেছিল তারা সেদিন। ভয় পেয়েছিল বোধহয় বিহান। পরের দিন সকালেই এক পরিচিত গাইনীর কাছে নিয়ে গিয়েছিল তাকে। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তিনি বললেন, "কোনও চিন্তা নেই। সব ঠিক আছে; স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে কোনও বাধা নেই।" খুশি মনেই বাড়ি‌ ফিরেছিল সেদিন দুজনে।

'ডাক্তার বলেছিলেন সব ঠিক আছে। কিন্তু তখন কি জানতাম যে এই ঠিকটাই এক চরম বেঠিক পাপের ওপর প্রতিষ্ঠিত? তখন কি জানতাম; কি এক বীভৎস বিচ্ছিরি ভুলের গোলকধাঁধায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে আমার জীবন? আর তারই মাশুল আজ দিতে হচ্ছে আমাকে? বিনা দোষে; নিরুপায় হয়ে।'

বিতানের হারিয়ে যাবার কাহিনী শুনে শাশুড়ির জন্য তো বটেই, নিজের মায়ের জন্যও মনটা আকুলিবিকুলি করছিল ব্রীহির। অনেকদিন বাপের বাড়ি যায় নি সে। সেই অষ্টমঙ্গলার পর আর একবার মাত্র গিয়েছিল। তাও দু' দিনের জন্য। তাই কন্যাশোকে বিধ্বস্ত শাশুড়ি মা একটু থিতু হলে একদিন বাপের বাড়ি যাবার অনুমতিটা সে অনায়াসে আদায় করে নিয়েছিল। বিহান কোনও আপত্তি করেনি। শুধু করুণ দৃষ্টিতে ব্রীহির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, "পনেরো দিন! তাহলে আমার কি হবে?"

পাশ বালিশটা বিহানের দিকে ঠেলে দিয়ে, "এই নাও; সঙ্গিনী দিয়ে গেলাম।" বলেই তাড়াতাড়ি পালিয়েছিল ব্রীহি।

শুক্রবার বাপের বাড়ি এসেছে ব্রীহি। আজ বৃহস্পতিবার। এই সাতদিন বন্ধু-বান্ধব, বাবা-মা, পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা, আড্ডা-মশকরায় দিব্যি কেটে গেছে। প্রাণ খুলে বাজার করেছে বাবা; আর ভালো মন্দ রান্না করেছে মা। বারেবারে বলেছে মা, "এই সময় নিয়মিত ভালো করে খাওয়া দাওয়া না করলে পেটের-টার স্বাভাবিক বাড় হবে কি করে?" মাঝে মাঝে বিহান আর শাশুড়ির কথা ভাবনায় আসেনি তা নয়; কিন্তু আবার নতুন উচ্ছ্বাসে চাপা পড়ে গিয়েছে সব দুর্ভাবনা। শুধু রাতের বেলা ঘুম আসতে একটু দেরি হতো। চোখের সামনে ভেসে উঠতো বিহানের মুখটা। বিশেষ করে ওর কানের পেছনের তিলটা। কতবার যে হাত দিয়ে ও স্পর্শ করেছে; আর একবার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করতো ওর।

নাতি-নাতনী হবে, এ খবর আগেই পেয়েছিলেন শোভনা; ব্রীহির মা। মনে মনে স্থির করেছিলেন মেয়ে এসে যখন দু'দিন থাকবে, তখন সত্যনারায়ণের শিরনি দেবেন। আজ বৃহস্পতিবার। সকালে সত্যনারায়ণ পূজোর পর ভক্তিভরে ঠাকুরকে, মা-বাবা আর অন্যান্য গুরুজনদের প্রণাম করে আশীর্বাদ নিয়েছিল ব্রীহি। পুরোহিত মশাইও প্রসাদি ফুল মাথায় ঠেকিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন তাকে।

আজ এই নিশুতি রাতে একলা এই রেল ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে তার মনে হচ্ছে, 'আশীর্বাদ!' মূল্যহীন ফালতু একটা কথা। কোনও মূল্য আছে এই কথাটার? তা যদি থাকতো তাহলে তার এমন হলো কেন? মা-বাবার আশীর্বাদ তো লোক দেখানো ভড়ং ছিল না! ধাপ্পাবাজি বা কৃত্রিম ছিল না। তাহলে?'

দুপুরে একটু বেশি ঘুম হয়ে গেছে। বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে বসে হাবিজাবি ভাবছিল আর বড় বড় হাই তুলছিল। বেশি ঘুমের দরুনই হোক অথবা অন্য কোনও কারণেই হোক, গা-টা ম্যাজম্যাজ করছিল। 'একটুখানি নড়াচড়া করা খুব দরকার। তা না হলে এই আলস্য ভাব যাবে না। ' ভাবলো ব্রীহি। বারান্দার শেষ প্রান্তে ঠাকুরঘরের পাশেই একটা লম্বাটে ছোট্ট ঘর আছে; ওই ঘরেই ঠাকুমার আমলের একটা বড় সিন্দুকের ভেতরেই পুজোর বাসনপত্রগুলো থাকে। পালা-পার্বণে বা পুজো অর্চনায় বের করা হয় আবার পরিস্কার করে তুলে রাখা হয়। কাজের মাসী পুজোর বাসনপত্রগুলো মেজে পরিস্কার করে দরজার কাছে উপুড় করে রেখে গিয়েছিল। হঠাৎ কি মনে হলো; ব্রীহি ভাবলো, 'সারাদিন মায়ের খুব ধকল গেছে। যাই, বাসনগুলো সব গুছিয়ে তুলে রাখি।' বিয়ের আগে এসব কোনওদিন মাথায় আসেনি। দিব্যি হেসে খেলে বেড়িয়েছে প্রজাপতির মতন। বাসনগুলোতে হাত দিতে না দিতেই মা একেবারে হাঁ হাঁ করে উঠলো। "থাক, থাক। তোকে তুলতে হবেনা; আমি সময় মতন তুলে রাখবো। এই সময়..."

"অত আতুপুতু করো না তো! ছেলেপুলে আর কারও হয় না, তোমার মেয়েরই শুধু..., আমি ঠিক পারবো।"

শোভনা আর কিছু বললেন না।

সিন্দুকটাকে বাইরে থেকেই দেখেছে ব্রীহি এতদিন। ওর ভেতরে পুজোর বাসনপত্র থাকে এইটুকুই জানে সে ‌। কোনওদিন খুলে দেখেনি। আদরের একমাত্র মেয়ে; হৈ-হুল্লোড় করে বন্ধু-বান্ধব, আড্ডা, স্কুল-কলেজ আর পড়াশোনা নিয়েই কেটে গেছে এতগুলো বছর। কোনও কাজ করার দরকারও হয়নি কখনও, মা করতেও দেয়নি কোনওদিন। এই হাবি-জাবি মালপত্র ঠাসা ঘরে ঢোকার প্রয়োজন বা ইচ্ছে কোনওটাই হয়নি কোনওদিন। বিয়ের পরই যা টুকটাক শাশুড়িকে সাহায্য করেছে গৃহস্থালি কাজে। ব্যাস, ওইটুকুই।

সিন্দুকের ডালাটা খুললো ব্রীহি। বেশ ভারী। পুরোনো আমলের জিনিস। এখনকার মতন শুধু দেখনাই নয়; কাজেরও। ডালাটা খুলে দেখে সিন্দুকটার দু'পাশেই আড়াআড়ি ভাবে এদিক থেকে ওদিক ঢাকনা দেওয়া লম্বা দুটো প্রকোষ্ঠ। যেন ছোটখাটো জিনিস আলাদা করে রাখার ব্যবস্থা। গ্রাহ্য না করে বাসনগুলো ভালো করে গুছিয়ে রেখে ডালাটা বন্ধ করতে গিয়ে কি মনে হলো, একটার ঢাকনা খুলে আশ্চর্য হয়ে গেল ব্রীহি। মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। তার ছোটবেলার খেলনা-পাতি সব যত্ন করে রাখা। এ্যালিউমিনিয়ামের সব ছোট ছোট হাঁড়ি, কড়াই, হাতা, খুন্তি ইত্যাদি কত যত্ন করে আজও রেখে দিয়েছে মা। সেই কত বছর আগের। 'মা আমাকে কত ভালোবাসে।' চোখ দুটো একটু চিকচিক করে উঠলো ব্রীহির, আনন্দে গদগদ হয়ে। একদলা কান্না যেন বুক ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল। এ কান্না আলাদা। এ হলো খুশির কান্না, সুখের কান্না। খেলনাগুলোতে আদর করে হাত বুলোতে বুলোতে ভাবল সে, 'মায়েরা এইরকমই হয়।' স্বাভাবিকভাবেই অন্য দিকটাও একবার দেখার আগ্রহ দমন করতে পারলো না ব্রীহি। এই দিকটা আবার দুটো ভাগে ভাগ করা; পার্টিশন দিয়ে। একটা খোপে কতগুলো বহু পুরোনো ধাতব মুদ্রা। হাতে নিয়ে দেখলো সবই ব্রিটিশ আমলের। কোনওটায় রাণী ভিক্টোরিয়ার আবার কোনওটায় রাজা পঞ্চম জর্জের মুখ খোদাই করা। খানিকটা নেড়েচেড়ে রেখে দিল যেখানে ছিল সেখানেই। অন্য খোপটায় একটা পুঁটলিতে কি যেন বাঁধা আর তার নিচে একটা খাম। পুঁটলিটা খুলে এক জোড়া সোনার বালা, একটা সরুমত চেন আর একটা ছোট্ট আংটি দেখে খুশিতে ঝলমল করে উঠল ব্রীহির মুখ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেখল সে। 'নিশ্চয়ই এগুলো আমার ছোটবেলার। মা রেখে দিয়েছে যত্ন করে। আমার মা কি ভালো।'কালের প্রকোপে সোনার সে ঔজ্জ্বল্য আর নেই। কেমন যেন ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে গেছে। হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ বসে বসে মনে করার চেষ্টা করল তার ছোটবেলার কথা। এইগুলো পরে তাকে কেমন দেখাতো সেটা কল্পনা করতে চেষ্টা করছিল সে মনে মনে। কিন্তু কিছুই মনে পড়ছিল না। একটা সময়ের আগের জীবনটা যেন কুয়াশাচ্ছন্ন, ঝাপসা। কিচ্ছু মনে পড়ে না। চমকে উঠলো ব্রীহি মা শোভনার ডাকে। "কিরে! কি করছিস এতক্ষণ ধরে? এখনও গোছানো হয়নি?" তাড়াতাড়ি গয়নাগুলো আবার পুঁটলিতে বেঁধে যথাস্থানে রেখে উত্তর দিল ব্রীহি, "হয়ে গেছে; আর পাঁচ মিনিট।"

গয়নাগুলো রেখে খামটার মধ্যে কি আছে দেখার আগ্রহে তখন-তখনই ডালাটা বন্ধ করতে পারলো না। খামটা তুলতে গিয়ে দেখে কেমন যেন আটকে গেছে। বহুদিন কারও হাত পড়েনি বোঝা গেল। সাদা খামটা সময়ের চাপে হলদেটে হয়ে গেছে। কতদিনকার কে জানে! তবে বেশ পুরোনো। খুব সাবধানে আস্তে আস্তে খামটা হাতে নিল ব্রীহি যাতে ছিঁড়ে না যায়। বহুকষ্টে খুলে দেখলো একটা সাদাকালো বাচ্চা মেয়ের ছবি আর একটা খবরের কাগজের কাটিং। মেয়েটার গায়ে ফুলহাতা একটা সোয়েটার, মাথায় টুপি। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। মুখখানা গোমড়া; একটু আগেও বোধহয় কাঁদছিল। দু'হাতে দুটো বালা, গলার সরু চেনটা মুখে নিয়ে বোধহয় চুষছিল ‌। বাঁ হাতে একটা ললিপপ। ছবিটা দেখে চমকে উঠলো ব্রীহি। 'এ কি করে সম্ভব? এই ছবি এখানে এলো কি করে? এ যে অসম্ভব। অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে বিতানের সঙ্গে। ঝপ করে দেখলে গুলিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু...-, ধ্যাৎ এ আমার মনের ভুল। বিতানের ছবি? অসম্ভব। তবুও বুকটা হঠাৎ ধড়ফড় করতে লাগলো। গলাটা কেন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে মনে হলো। উল্টে পাল্টে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্ন দিক থেকে নানান ভাবে দেখতে থাকলো ব্রীহি ছবিটাকে। সংশয় কিছুতেই আর যায় না। সাদৃশ্য থেকে বৈসাদৃশ্য খুঁজে বার করাই যেন এখন তার প্রধান লক্ষ্য। শেষে নিশ্চিত হলো, 'অনেকটা একরকম বটে, কিন্তু একই নয়। তা ছাড়া ওর ছবি এখানে আসবেই বা কি করে!' আর একবার ছবিটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো ব্রীহি। পুরোনো ছবি। কোথাও একটু ঝাপসা মতন হয়ে গেছে আবার কোথাও একটু কালচে ছোপ ধরে গেছে। একটা চোখ তো বোঝাই যাচ্ছে না; খোঁদল হয়ে গেছে রং উঠে। নাকটা যেন একটু থ্যাবড়া মনে হচ্ছে। বিতানের নাকটা টিকোলো না হলেও অতটা চাপা নয়। মিলের থেকে বুঝি অমিলই বেশি মনে হচ্ছে এখন। তবুও গলার চেন আর বালাজোড়া তাকে যেন ধন্দে ফেলে দিয়েছে। ডিজাইনটা যেন ও বাড়ির ছবিতেও একইরকম। ছবিটা আর একটু কাছে এনে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলো ব্রীহি। সংশয় তবুও গেল না। মনে মনে ভাবলো, 'একই ডিজাইনের গয়না তো কত লোকেরই থাকে; তাই না! একটাই তো আর তৈরি হয়নি। কিন্তু ললিপপ? কাকতালীয়? নিশ্চয়ই তাই।' নিজের সঙ্গেই তর্ক করতে থাকলো ব্রীহি নিজে। শেষে ঠিক করলো, 'মাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।' কিন্তু মনকে যতই প্রবোধ দিক, মনটা খচখচ করতেই থাকলো। 'যদি এই ছবি বিতানেরই হয় তা হলে এ বাড়িতে এলো কি করে? তাও আমারই মায়ের কোলে! মায়ের কোলে বিতান। তাহলে আমি কই? আমি নেই কেন? খেলনা পাতিগুলো কার? আমার না বিতানের? নাকি আমাদের দুজনের! একসঙ্গে খেলতাম দুজনে? কই মনে পড়ে না তো! গয়নাগুলো ওরই। ও বাড়ির ছবিতেও দেখেছি। তাহলে আমার কই? নেই কেন?'

দুরুদুরু বুকে কাগজের কাটিংটা খুব সতর্ক হয়ে তুলে নিল ব্রীহি। থরথর করে হাত দুটো কাঁপছে। বুকের ভেতর কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে পিটছে। ধক ধক করে প্রতিটি হৃৎস্পন্দন যেন তার কানের পর্দায় আঘাত করেই চলেছে। একটা বিচ্ছিরি সন্দেহ কাঁটার মতন বিঁধছে তার বুকে। ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে তার অন্তর। বহু পুরোনো কাগজ। গাছের শুকনো পাতার মতন মেন মড়মড় করছে। একটু অসাবধান হলেই ঝুরঝুর করে গুঁড়ো হয়ে যাবে। অক্ষরগুলো অস্পষ্ট, পড়াই যায় না প্রায়। কেমন ধেবড়ে গেছে। মাঝখানে একটা ছবি। ওর হাতে ধরা ছবিটার মতনই। একই সোয়েটার, একই টুপি সেই বালা আর চেন মুখে নিয়ে। হাতে ললিপপ। তার মানে কাগজে বিজ্ঞাপন দেবার জন্যই এই ছবি তোলা হয়েছিল। কিন্তু কার ছবি? কে এই মেয়ে? যদি এটা বিতানই হয়, তাহলে ও এখানে কেন? কি করে এলো? বিতান তো হারিয়ে গেছে। তাহলে? কি সম্পর্ক এই ছবির এ বাড়ির সঙ্গে?'

বারেবারে সেই একই প্রশ্নে জর্জরিত হতে থাকলো ব্রীহি। উত্তর কোথায়? কে দেবে তার প্রশ্নের উত্তর? তাই শেষ পর্যন্ত কাগজের ওই অস্পষ্ট লেখাগুলোর মধ্যেই হাঁতড়ে খুঁজতে লাগলো সে তার বিক্ষত অন্তরের সান্ত্বনা। বেশ কষ্ট করে অনেক চেষ্টার পর যে দু'দশটা শব্দ পড়তে পারলো; তাতেই বুঝতে পারলো ব্রীহি কাগজটা বাবার দেওয়া হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ কলমে, দেড়-দু বছরের একটা মেয়েকে গঙ্গাসাগরের মেলায় কুড়িয়ে পাওয়ার বিজ্ঞাপন। বিতানের গঙ্গাসাগর মেলায় হারিয়ে যাওয়া আর বাবার ওই মেলাতেই একটা মেয়েকে কুড়িয়ে পাওয়ার‌ মধ্যে একটা সূক্ষ্ম যোগসূত্র আছে বলে মনে হলো তার! আর তখনই মাথাটা ঘুরে গেল, ঝিমঝিম করতে লাগলো সর্বাঙ্গ। 'বাবার কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া, বাচ্চা একটা মেয়েকে গঙ্গাসাগরের মেলায় কুড়িয়ে পাওয়া, হয়তো বিতানকে। হ্যাঁ। নিশ্চিতভাবে বিতানকেই। বিতানও তো গঙ্গাসাগর মেলাতেই হারিয়ে গিয়েছিল। দুটো বাড়িতে একই ছবি, একই গয়না, সেখানেও প্লেটে ললিপপ আর এখানেও হাতে ললিপপ তাই তো প্রমাণ করে। কোনও সন্দেহ নেই এ বিষয়ে। আহা! বেচারা মেয়েটা হয়তো ললিপপ খেতে ভালোবাসতো। কিন্তু তাহলে বিতান কই? সে তো বাড়ি ফেরে নি! সে কি তবে মারা গেছে? হারিয়ে গেছে আবার কোনওভাবে? বিতানের নাম তো মায়ের বা বাবার মুখে কখনও ব্রীহি শোনেনি! কেন শোনেনি? একটা মেয়ে নেই; কিন্তু ছিল তো একসময়। আর তার কথা একবার মুখেও আনলো না কেউ এত বছর ধরে! কি কারণ হতে পারে! কেন এই গোপনীয়তা? ইচ্ছাকৃত? নাকি ভুল! এতবড় একটা ঘটনা সবাই ভুলে গেছে? অস্বাভাবিক এই ভুল। খুবই অস্বাভাবিক এবং রহস্যজনক।' হঠাৎ কেন জানি মনে হলো ব্রীহির, 'এমন নয়তো যে বিতান নেই; কিন্তু আছে!' মানুষের মন। বড় বিচিত্র এর গতিবিধি। কোন অলিগলি দিয়ে বিচরণ করে কার কোন তন্ত্রীতে গিয়ে যে অকস্মাৎ আঘাত করে তার ঠিক ঠিকানা নেই।

'নেই কিন্তু আছে' এই ভাবনাটা জাঁকিয়ে বসতে লাগলো ব্রীহির মনে। কিছুতেই এই অস্বস্তিকর ভাবনা থেকে মুক্ত করতে পারলো না নিজেকে। দগ্ধ হতে থাকলো ভেতর ভেতর। 'তবে কি...? না। অসম্ভব, অমূলক এ ভাবনা।' ডুকরে কেঁদে উঠল ব্রীহি। নিজের মনেই বলে ওঠলো, 'না। আমি ব্রীহি, আমি ব্রীহি। আমার মায়ের আদরের মেয়ে আমি; বাবার একমাত্র সন্তান।'

জোর গলায় আমি ব্রীহি; আমার মায়ের আদরের মেয়ে বলা সত্ত্বেও একটা তীব্র অনিশ্চয়তাবোধ দগ্ধ করতে থাকলো তাকে। নিজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে থপ করে মেঝেতেই বসে পড়ল সে। চোখ দুটো জ্বালা করতে করতে অস্পষ্ট ঝাপসা হয়ে গেল তার দৃষ্টি। অবিরল ধারায় চোখ দিয়ে বইতে থাকল তার নিজের এতদিনের পরিচয় হারাবার আশঙ্কা। বেশ খানিকটা কাঁদতে পারলে বুকের ভার কিছুটা লাঘব হয় বটে; তবে সম্পূর্ণ দুরীভূত হয় না। অনেকক্ষণ কেঁদে একটু ধাতস্থ হয়ে সিন্দুকের ডালাটা বন্ধ করে কাগজের কাটিং আর ছবিটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো ব্রীহি। আস্তে আস্তে নিজের ঘরে গিয়ে একটা সুরক্ষিত জায়গায় ওই দুটো লুকিয়ে রেখে ঘরের আলোটা নিভিয়ে শুয়ে পড়লো এক-বুক হতাশা আর মনের মধ্যে অসহ এক দহন-জ্বালা নিয়ে। তখন সবেমাত্র সন্ধ্যে নেমেছে। নানা কাজে ব্যস্ত শোভনা এতক্ষণ আর এদিকে নজর দিতে পারেন নি। কিন্তু মেয়েকে অমন ধীর গম্ভীরভাবে নিজের ঘরে যেতে দেখে ভয় পেলেন তিনি। 'শরীর খারাপ হলো নাকি আবার! গম্ভীরভাবে ঘরে চলে গেল? তখনই বারণ করলাম; কথা শুনলে তবে তো! কম ভারী তো নয় ওই সিন্দুকের ডালাটা! দেখি আবার কি হলো।' সব কাজ ফেলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটলেন শোভনা মেয়ের ঘরের দিকে। দরজাটা ভেজানো ছিল। খুলে আলোটা জালতেই মুখ ঘুরিয়ে তাকালো ব্রীহি মায়ের দিকে, "কিছু বলবে?"

"না; এই ভর সন্ধ্যাবেলা এসে শুয়ে পড়লি, ভাবলাম শরীর-টরীর আবার খারাপ হলো নাকি?"

"না, এমনিই। মাথাটা একটু ধরেছে।"

"দাঁড়া। চা করি; কড়া করে এক কাপ লিকার চা খেলে ছেড়ে যাবে। আয় তুই।"

ব্রীহির কথা বলতে ভালো লাগছিল না। তাই আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করেই রইল। শোভনার মনে হলো মেয়ের চোখদুটো একটু যেন ফোলা ফোলা। ভাবলেন, বরের জন্য হয়তো মন খারাপ করছে; মনে মনে একটু হেসে নিশ্চিন্ত মনে চলে গেলেন তিনি। সত্যিই ব্রীহি কাঁদছিল। বিতানের জন্য সত্তিই তার দুঃখ হচ্ছিল। আহা! বেচারা কোথায় হারিয়ে গেল? অভিমান হচ্ছিল মা-বাবার ওপর। কেন তারা বিতানের প্রসঙ্গ কোনওদিন তোলেনি তার কাছে! কেন এড়িয়ে গেছে; লুকিয়েই বা রেখেছে কেন? আর এই লুকোচুরির ভাবনাটা মাথায় এলেই সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। একটা সন্দেহের কাঁটা খোঁচা মারছে তাকে। ‌ শিউরে উঠছে সে বারেবারে। চোখের জল আর বাধা মানছে না।

দুটো দিন কেটে গেল শুধু বিতানের কথা ভেবে ভেবেই। প্রয়োজনের বাইরে কোনও কথা বলতে ইচ্ছে করে না; বলেও না। কেমন যেন খোলসের মধ্যে গুটিয়ে ফেলেছে সে নিজেকে। উচ্ছল, প্রাণবন্ত, হাসিখুশি মেয়েটা কেমন যেন হঠাৎই মিইয়ে গেছে। সব-সময় কি যে ভাবে কে জানে! রুচি নেই খাওয়ায় কিন্তু দুটো খেতেই হয়। মায়ের মন; শোভনা মেয়ের এই হঠাৎ পরিবর্তনে চিন্তিত হলেন। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার কথা চিন্তা করলেন মনে মনে। কিন্তু তার আর প্রয়োজন হলো না। আরও দুদিন ধরে অনেক ভেবে, সমস্ত ঘটনাগুলো কাটাছেঁড়া করেও যখন কোনও কার্যকারণ বুঝতে পারলো না ব্রীহি, তখনই একদিন দুপুরবেলা...শোভনা তখন সব কাজকর্ম সেরে নিজের ঘরে‌ একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। চোখটা একটুখানি লেগে গিয়েছিল। হঠাৎ ব্রীহি এসে থাকলো, "মা!"

চোখ খুলে তাকালেন শোভনা। "আয়, খুকি আয়। কিছু বলবি?" আস্তে আস্তে মায়ের কাছে এসে একটু ইতস্তত করে শেষে সিন্দুকে পাওয়া ছবিটা মা শোভনাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো ব্রীহি, "এ মেয়েটা‌ কে মা?"

"ওমা! এটা তুই কোথায় পেলি? এটা তো তোরই ছোট বেলার ছবি।"

বেফাঁস বলে ফেলেছেন বোঝার আগেই "মা!!!" বলে আর্তনাদ করে উঠলো ব্রীহি। মাথাটা বনবন করে ঘুরতে লাগলো। মাথা ঘুরে পড়েই যাচ্ছিল; কোনওরকমে টাল সামলে নেবার চেষ্টা করলো খাটটা ধরে। শোভনাও ধরে ফেললেন মেয়েকে। মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন স্নেহময়ী মা, "কি হলো মা? শরীর খারাপ করছে?"

"না। শরীর ঠিক আছে। হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গেছিল।"

"বোস, বোস। খাটে উঠে বোস। সেদিন বারণ করলাম; শুনলি না। এই সময় ভারী কাজ কেউ করে? কোথাও চোট ফোট লাগলে কি কেলেঙ্কারি হবে বলতো?"

'চোট তো লেগেছেই মা! ' মনে মনেই ভাবলো ব্রীহি। 'গভীর চোট। ওই ছবিটা আমার! অনেকটা বিতানের মতনই দেখতে। হতে পারে আমার দেখার ভুল বা অমিল কোথাও কিছু আছে; আমার নজরে পড়ছে না। কিন্তু অমন অবহেলাভরে খামের ভেতর পড়ে ছিল কেন? একমাত্র মেয়ের ছবি। তবে কি কিছু লুকোনোর চেষ্টা? তার ওপর ওই বিজ্ঞাপনের কাটিং? আমার ছোটবেলার আর অন্য কোনও ছবি নেই কেন বাড়িতে? এতদিন মনে হয়নি; কিন্তু আজ মনে হচ্ছে! কেন নেই? সবারই তো থাকে! আমার নেই কেন? মুখে ভাত, জন্মদিন বা অন্য কোনও ছোটবেলাকার ছবি? আমার ছোটবেলাটা কেন হারিয়ে গেল? এমন নয় তো যে আমার মুখে ভাত অন্য কোথাও হয়েছিল? জন্মদিনে পায়েসের চামচ অন্য কেউ মুখে তুলে দিয়েছিল? অন্য কোনও কোলের উষ্ণতায় আমার শৈশবের কিছু অংশ কেটেছে? তবে কি আমার 'আমি'-টা আসল আমি নই?' প্রশ্নের পর প্রশ্ন তোলপাড় করে তুললো তাকে। আর ধরে রাখতে পারলো না নিজেকে। হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো, "মা! আমি কে?"

চমকে উঠলেন শোভনা হঠাৎ এই প্রশ্নে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, "এ কেমন কথা! সেই ছোটবেলা থেকে তোকে এতবড় করে তুললাম; আর আজ..."

"কত ছোটবেলা থেকে মা?"

"তার মানে? কি হয়েছে আজ তোর?"

এইবার বিজ্ঞাপনের কাটিংটা বার করলো ব্রীহি। "বাবার দেওয়া বিজ্ঞাপনেও ওই একই ছবি। আমারই ছবি। তার মানে আমাকে গঙ্গাসাগরের মেলায়..., কোন মায়ের কোল থেকে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম মাগো!"

"ছিঁড়ে ফেল, ছিঁড়ে ফেলে দে ওই কাগজ। ছিঁড়ে ফেল ওই ছবি। ওর আর আজ কোনও মূল্য নেই। তুই আমার মেয়ে, আমি তোর মা।" ফুঁপিয়ে কেঁদে দু হাতে জড়িয়ে ধরলেন শোভনা মেয়েকে, যেন আবার হারিয়ে না যায়। বিড়বিড় করে নিজেকেই যেন আশ্বাস দিতে থাকলেন, "আমার মেয়ে। আমারই মেয়ে তুই। আমিই তোর মা।"

"হ্যাঁ মা। তুমিই তো আমার মা। তোমার আঁচলে আশ্রয় পেয়েছিলাম বলেই তো আজও আমি তোমার আদরের খুকি হয়ে বেঁচে আছি। তা না হলে কোন অতল আঁধারে আমি হয়তো তলিয়ে যেতাম। বাঁচতামই না হয়তো।"

"খুকি! চুপ কর। চুপ কর খুকি।"

"কিন্তু আমার জীবনের প্রথম দেড়-দু বছর যে হারিয়ে গেল আমার জীবন থেকে। হারিয়ে গেল আমার আর এক মায়ের কোল। যে মায়ের কোলে শুয়ে আমি প্রথম আলো দেখলাম! প্রথম নিশ্বাস নিলাম! যার বুকের মধু পেয়ে আমি ধন্য হয়েছি; সেও তো আমারই মা! সেই অভাগী হয়তো আমারই স্মৃতি আঁচলে বেঁধে কেঁদে কেঁদে পাথর হয়ে গেল। তখন যদি পুলিশে রিপোর্ট করতে! ওরা হয়তো করেছিল।"

"তোর বাবাও তাই বলেছিল। আমিই বারণ করি।"

"কেন মা? বারণ করলে কেন?"

"আমার ভয় ছিল, পুলিশ ঠিকমতো খোঁজখবর না করে হয়তো কোনও অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দেবে। তছনছ হয়ে যাবে মেয়েটার ভবিষ্যৎ। বেঁচে থাকার জন্য মরতে হবে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে। সমাজের কলুষ গায়ে মেখে তিলতিল করে ধ্বংস হয়ে যাবে বেচারা। তাই তোকে নিয়ে বাড়ি চলে এলাম। সেদিন ছিল মেলার শেষ দিন। বাড়িমুখো লক্ষ লক্ষ ভক্তের চিৎকার চেঁচামেচিতে চাপা পড়ে গেল তোর কান্না। গরম দুধ আর বিস্কুট খেয়ে আমারই শালটা জড়িয়ে আমার কোলেই ঘুমিয়ে পড়লি তুই। নিঃসন্তান আমি ভাবলাম, ঈশ্বর আমার প্রার্থনা শুনেছেন। কপিল মুনির আশীর্বাদে আমি সন্তান লাভ করলাম। কিন্তু বিবেক? যার গেল তার কথা ভেবে একটা অপরাধ-বোধ কাঁটা হয়ে‌ অহর্নিশি বিঁধতে থাকলো বুকের মধ্যে। মনে হলো, এ পাপ। একটা ঘোর অন্যায় করছি আমরা মেয়েটার প্রতি, তার মায়ের প্রতি। তখনই তোর ওই ছবি আর ওই বিজ্ঞাপন। "

'কিন্তু কিছুই লাভ হলো না। নিট ফল শূন্য।' ভাবলো ব্রীহি। 'দুষ্টমতি বিধাতা শয়তানি করে এমন ভবিষ্যৎ লিখলো যে তারই সৃষ্টি ব্রীহি শৈশবেই মূলহীন হয়ে শেষে কিনা বিনা অপরাধে সংসারে আজ মূল্যহীন আবর্জনা হয়ে গেল।'

অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে শেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন শোভনা, "সাতদিন গেল, দশদিন গেল, শেষে এক-মাস দু'মাস করে ছ-ছটা মাস কেটে গেল, কেউ কোনও খবর নিল না। ততদিনে তুইও বেশ খানিকটা মানিয়ে নিয়েছিস। তোর ওই কচি গলায় মা ডাকটা বড় মিষ্টি লাগতো। মনে ভয় হতো যদি তোকে শেষ পর্যন্ত হারাতে হয়! কিন্তু ঈশ্বরের অসীম করুণা, কেউ এলো না তোর ওপর দাবি নিয়ে। আস্তে আস্তে তুই আমার মেয়ে হয়ে গেলি আর আমি তোর মা।"

এরপর আর কি বলার থাকতে পারে! অভিযোগই বা করবে কার বিরুদ্ধে? নীরবে চোখের জলে ভাসতে থাকে দুজনেই; আপন আপন ভাবনায়। একজন পেয়ে হারানোর শঙ্কায় চিন্তিত আর‌ একজনের ঈশ্বরের কাছে কাতর প্রশ্ন। 'ভগবান! এ কোন সঙ্কটের আবর্তে আমাকে ফেললে ঠাকুর! আমি ব্রীহি আবার আমিই বিতান! তাহলে বিহান আমার কে? বিতানের সহোদর; তাহলে ব্রীহির কে? যে আসতে চলেছে তার পরিচয়ই বা কি তবে? অরুচিকর, অভাবনীয় এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎই বা কি?'

ব্রীহির খাওয়ায় রুচি নেই, রাতে ঘুম নেই, দিনে বিশ্রাম নেই। বুকের ভেতর থেকে একটা বোবা কান্না যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। চোখের সামনে ভাসতে থাকে ওই মায়ের কান্নায় ভেজা মুখটা। মনে হয় ছুটে গিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে, 'কেঁদো না মা, কেঁদো না। এই তো আমি বিতান। তোমার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে।' কিন্তু সম্ভব নয়। ভূমিকম্প হয়ে যাবে। ছারখার হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে দুটো পরিবার। এ ছাড়াও এই দুই সংসারে তার প্রকৃত অবস্থান নিয়ে 'তাহলে আমি কে?' প্রশ্নে দিশেহারা ব্রীহি অনেক ভেবেও কোনও কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছিল না। একটা প্রশ্নই জেরবার করে দিয়েছিল তাকে। 'কি আমার ভবিষ্যৎ? কিসে আমার মুক্তি এই কলুষিত ঘৃণ্য সম্পর্কের গোলকধাঁধা থেকে?'

দুই মায়ের ওপরই প্রচণ্ড অভিমান হয়। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। 'সম্বন্ধ করার সময়ে ওরাও বলল না ওদের একটা মেয়ে ছিল; হারিয়ে গেছে। আর এরাও প্রকাশ করলো না যে এই মেয়ে তাদের আত্মজা নয়; সাগরের মেলায় কুড়িয়ে পাওয়া! তাহলে হয়তো এই দুঃসহ জীবন্মৃত অবস্থা হতো না তার!' ডুকরে কেঁদে ওঠে ব্রীহি কিন্তু এই দুর্বিসহ দুর্বিপাক থেকে আশু মুক্তির কোনও পথ খুঁজে পায় না। অন্তর্দ্বন্দ, তমসাচ্ছন্ন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, এক ধরনের পাপবোধ তাকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছিল আর তারই ফলে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল ব্রীহি আর তার ছাপ তার চেহারায় ফুটে উঠেছিল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাই একদিন তাকে যেতে হলো ডাক্তারের কাছে মা শোভনার চাপে। ডাক্তারের ভরসায় নিশ্চিন্ত হলেন উদ্বিগ্ন শোভনা, কিন্তু কোনও পরিবর্তন হলো না ব্রীহির। 'আমি কে? কি আমার পরিচয়? বিহান আমার কে? কি সম্পর্ক আমার তার সঙ্গে? কোন মহাপাপে আজ আমার অস্তিত্বই বিপন্ন?' এই সমস্ত প্রশ্নে জর্জরিত ব্রীহি খাঁচায় আবদ্ধ পাখির মতন ছটফট করছিল। খুঁজে বেড়াচ্ছিল একটা মুক্তির উপায়, একটু আলোর সন্ধান।

সময় বসে থাকে না; বসে থাকেওনি। অসহায়, বিহ্বল, কিংকর্তব্যবিমূঢ় ব্রীহির চিন্তায় চিন্তায় আরও এক সপ্তাহ কেটে গেল। কাল তাকে ও বাড়ি ফিরে যেতে হবে। কিন্তু কোন পরিচয়ে ফিরে যাবে সে? আবার সেই কলঙ্কময়, নীতি-বিগর্হিত, ন্যক্কারজনক সম্পর্ক মেনে নিতে হবে? বিদ্রোহ করা যাবে না, অভিযোগ করা যাবে না, কারও কাছে প্রকাশ করা যাবে না। নিজের অন্তর্দাহে নিজেকেই জ্বলে পুড়ে মরতে হবে। যেতে ইচ্ছে করছে না; আবার নিজের গর্ভধারিণী মাকে একবার দেখার জন্য মনটা ছটফট করছে ব্রীহির। সবচেয়ে ভয় তার বিহানকে নিয়ে। সে তো কিছুই জানে না! বিতান হয়ে ব্র্রীহি বিহানের দাবি মেটাবে কি করে? এড়িয়েই বা যাবে কি করে? কতদিন? দোটানায় পড়ে সারা রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারলো না সে। কোনও অজুহাতও খাড়া করা গেল না। এক বুক হতাশা আর দুশ্চিন্তা নিয়ে এক মাকে কাঁদিয়ে, নিজেও কেঁদে ব্রীহি এসে পৌঁছলো আর এক মায়ের কাছে। এখানে এসে অশান্তি যেন আরও বেড়ে গেল। 'আমি যে, আসলে আমি নয়' হয়ে বেঁচে থাকা যে কি যন্ত্রণা; পদে পদে সেটা অনুভব করতে থাকলো সে। আসলে মা; কিন্তু মা ছাড়াও আরও একটা অসামাজিক, অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার লজ্জা অস্থির করে তুললো তাকে। বিহানের কথা ভাবলে তো লজ্জায়, ঘেন্নায় গা-টা যেন রি-রি করে গুলিয়ে উঠে বমি পায়। সরলা দেবী ভাবেন এই সময় তো এরকমই হবার কথা। বমি পাওয়াটাই স্বাভাবিক। নানারকম ঘরোয়া টোটকা দিয়ে পুত্রবধূকে খানিক স্বস্তি দিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু আসল অসুখের শেকড় যে অনেকটাই গভীরে। অচিন্তনীয় সে সমস্যা। সেখানে পৌঁছানোর ক্ষমতা তো সরলা দেবীর ছিল না; থাকার কথাও নয়। পারেনও তিনি পৌঁছতে। দিনের বেলাটা মায়ের সাথে লেপ্টে থেকে সংসারের টুকিটাকি কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখলেও দিন যত শেষের দিকে এগোয় ততই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে ব্রীহির বিভীষিকাময় রাতের কথা ভেবে। আজ শরীর খারাপ, কাল ভালো লাগছে না, পরশু বড় ঘুম পাচ্ছে ইত্যাদি অজুহাত দিয়ে কতদিন আর নিজেকে রক্ষা করা যায়! রক্ষা করা গেলও না।

বিহানের কোনও দোষ নেই। প্রকৃতির স্বাভাবিক তাড়না, স্বীকৃত সামাজিক সম্বন্ধের অধিকার চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল ব্রীহির সমস্ত প্রতিরোধ। লজ্জায় ঘেন্নায় কাঠের পুতুলের‌ মতন মৃতবৎ পড়ে থেকেছে ব্রীহি। প্রতি মুহূর্তে নিজের মৃত্যু কামনা করেছে; কিন্তু সহ্য করতে হয়েছে সব চোখ বন্ধ করে, দাঁতে দাঁত চেপে। নিজেকে অসহায় ধর্ষিতা বলে মনে হয়েছে। আতঙ্কিত হয়েছে এই ভেবে, এইতো শেষ নয়! এমন ঘটনা তো বারবার ঘটবে। কিভাবে রক্ষা করবে সে নিজেকে? কি করে ঠেকাবে বিহানকে? বিহান ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু ঘুম ছিল না ব্রীহির চোখে। পঁয়ত্রিশ চল্লিশ মিনিট শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে থেকেও মনে হয়েছে শরীরের ক্লেদ যেন কিছুতেই যাচ্ছে না। শিরায় শিরায় এক অসহ দহনে যেন জ্বলে যাচ্ছে সমগ্র শরীর। অপবিত্র, অচ্ছুৎ মনে হচ্ছে নিজেকে। মনে হচ্ছে সারা অঙ্গে বিষ্ঠা মেখে বসে আছে সে ঘৃণ্য এক কীটের মতন। 'এই কি জীবন?' নিজেকেই প্রশ্ন করেছে বারবার। 'এ বেঁচে থাকা কি বেঁচে থাকা?' তবুও পরের দিন মায়ের সামনে সুখী সুখী, খুশি খুশি ভাব দেখিয়ে অভিনয় করতে হয়েছে; সব কষ্ট, সব দুঃখ চাপা দিয়ে। সারাদিন কেটে গেছে চিন্তায় চিন্তায়। কিসে মুক্তি? কিসে নিস্তার এই নির্দয়, কঠিন ফাঁস থেকে? ক্রমশ দিনশেষে এগিয়ে এসেছে সন্ধ্যে। তারপর আবার রাত। ভয়ে জবুথবু হয়ে কুঁকড়ে একপাশে শুয়ে থেকেছে ব্রীহি আরও একবার নিগৃহীত হবার আশঙ্কায়। কিন্তু না। আজ আর বিহান তার কাছে দাবি করেনি কিছু। কিন্তু এই ছাড় তাকে স্থায়ী নিশ্চিন্ততা দিতে পারেনি। পারবেই বা কি করে? আজ না হয় কাল তাকে আবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাঁক মাখতে হবে সে জানে; অশ্লীল এক সম্পর্কের জালে আটকা পড়ে।

'কলুষিত দেহ, ক্ষতবিক্ষত অন্তর নিয়ে সারারাত সন্ধান করেছি আমি এই জঘন্য, নোংরা অবস্থা থেকে মুক্তির উপায়।' নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করেছে ব্রীহি বারবার। নিজেকে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে খাড়া করে ব্রীহির নষ্ট, ভ্রষ্ট জীবনটাকে উল্টেপাল্টে কাটাছেঁড়া করে দেখেছে সে। শেষে মনে হয়েছে এই অসম জীবনযুদ্ধে তার জেতার কোনও সম্ভাবনা নেই। সে অতি নগণ্য এক অসহায় নারী আর তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ কুচক্রী, শঠ, নির্দয়, অমিতশক্তিধর ওই বিধি। ওই বিধিই বিনা কারণে তাকে শৈশবে মাতৃহারা করেও আর এক মায়ের কোলে বাঁচিয়ে রেখেছে আরও যন্ত্রণা দেওয়ার জন্য। কি দরকার ছিল? উপহার দিয়েছে এমন একটা সংসার যেখানে সবকিছুই অবৈধ। কি দরকার ছিল? অবৈধ পুত্রবধূ হয়ে এই সংসারে তার এই অবস্থান। অবৈধ তার দেহে যে তিলে তিলে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেই নিষ্পাপ প্রাণ। অবৈধ বিতান নামের এই মেয়েটার ব্রীহি হয়ে বেঁচে থাকা। কি দরকার ছিল বাঁচিয়ে রাখার? প্রথম থেকে তার এই বেঁচে থাকাটাই অবৈধ, অসামাজিক, অপ্রয়োজনীয়। তাই মৃত্যু। মরণই তার ভবিতব্য, এ দুর্বিসহ অন্তর্দাহ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় মৃত্যু। হ্যাঁ, মৃত্যুই একমাত্র সমাধান।

না। মরণে ব্রীহির কোনও ভয় নেই। নেই কোনোরকম পাপবোধ। যে আকন্ঠ পাপে সে ডুবে আছে তার তুলনায় আত্মহত্যা কোনও পাপই নয়। একটাই দুঃখ; নিজের মাকে পেয়েও পাওয়া হলো না। কষ্ট পাবে মা। ও বাড়ির মায়েরও বুকটা মোচড় দিয়ে উঠবে। বিহানও হয়তো কিছুদিন উদাস হয়ে থাকবে। ব্রীহির স্মৃতি তাকে উত্যক্ত করবে। কিন্তু সে তো কয়েকদিন। সময় ক্ষত নিরাময় করে। আস্তে আস্তে একদিন এদের ক্ষতও নিরাময় হবে। বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে যাবে ব্রীহি নামের ভাগ্যবিড়ম্বিত মেয়েটা। কিন্তু তার এই গভীর ক্ষত তো নিরাময় হবার নয় বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বারবার।

'কত রাত হলো কে জানে! তবে কি ভোর হতে চললো? পুব আকাশটা কি একটু ঘোলাটে হয়ে উঠেছে? রাতের শেষ ট্রেনটা কি চলে গেছে? মনে হয়। এবার লোকজন আসা যাওয়া শুরু হবে। তবে কি আজ আর...! 'হঠাৎ একটা নিশাচর পাখি তীক্ষ্ণ কটু স্বরে রাতের নিস্তব্ধ গাম্ভীর্য ভেঙে চুরমার করে চিৎকার করতে করতে উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে। যেন বলে গেল 'চিন্তা কি? মা গঙ্গা তো রয়েছে। ' করুণ একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল ব্রীহির ঠোঁটে। ওপর দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো না পাখিটাকে। অনেক দুরে পালিয়ে গেছে। কিন্তু তার তো পালাবার উপায় নেই! কোথায় পালাবে ব্রীহি? নিচে কুলকুল করে বয়ে চলেছে সর্বদুখহর, কলুষনাশিনী মা গঙ্গা। পতিতের আশ্রয়, দুঃখীর নির্ভর। 'মাগো! তুমি তো পতিতোদ্ধারিনী। তুমি কি উদ্ধার করবে আমাকে? আমি যে বিনা অপরাধে, বিধাতার রসিকতায় পতিত হয়ে গেছি মা! তুমি ছাড়া কে আমাকে উদ্ধার করবে? কে আমাকে আশ্রয় দেবে মা?"

ভোররাতে গঙ্গার জলে ভারি কিছু পড়ার আওয়াজ শুনতে পেলো না ঘুমন্ত পৃথিবী। শুধু কয়েকটা পাখি হঠাৎ ঘুম ভেঙে খানিক পাখা ঝটপট করে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। ব্রীহি ভেসে গেল হয়তো ভুল করে তাকে ভুল ঠিকানায় পাঠিয়েছিল যে, সেই তারই কাছে।
( সমাপ্ত )


List of all Bengali Stories


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717