উঠান পূজা
ত্রিপুরার ছোট গল্প
- হরপ্রসাদ সরকার, ধলেশ্বর-১৩, আগরতলা
৩০-০৪-২০১৮ ইং
-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার - মে, ২০২৪' স্বরচিত গল্প লেখার প্রতিযোগিতা, ( প্রতি বছর মে মাসে )
Result
--------------------------
◕ অনেক আগের কথা। এক দুর্ব্যবসায়ী বটপলাল; খুব লোক ঠকানো ব্যবসা তার। গ্রামের মানুষও নানা কারণে তার কাছে না গিয়ে আর পারে না। দুষ্ট বটপলাল এই সুযোগকে নিজের জন্য কাজে লাগিয়ে,
গরীব মানুষদের নানা ভাবে ঠকিয়ে দিনের পর-দিন খুব ধনী হয়ে উঠল। অনেকে তাকে খুব বোঝাল, কিন্তু বটপলাল লোক-ঠকানো ব্যবসা থেকে এক চুলও সরে এল না।
শেষে মানুষের অন্তরের অভিশাপ একদিন ঠিক ফলল। এক ঝড়ের রাতে ঘরের পাশের গাছের এক ছোট্ট ঢাল ভেঙ্গে পড়ল তার মাথায়। অন্ধ হয়ে গেল বটপলাল।
অন্ধ জগতে সত্যি এবার অন্ধকার নামতে শুরু করল। ক্রমে বটপলালের জীবনে দুর্দিন আসতে লাগল।
কর্মচারীরা মালিকের দুর্বলতার, অক্ষমতার সুযোগ নিয়ে টাকা-পয়সা আর লেন-দেনে খুব গরমিল করতে লাগল। কয়েক মাসের মধ্যেই বটপলালের এত বড় ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল; খুব দেনায় পড়ে গেল বটপলাল।
খুব টানা-টানি শুরু হয়ে গেল সংসারে। এদিকে পয়সার টানা-টানি ওদিকে রোজগার বন্ধ। এই অবস্থায় ঘরে রোজগার বন্ধ হয়ে গেলে যা হয়, তাই হল!
খুব কলহ শুরু হল সংসারে। সব দোষ এসে একে-একে চাপতে লাগল বটপলালের মাথায়। খুব অল্প দিনের মধ্যে নিজের ঘরেই এক মূল্যহীন কানা পয়সায় পরিণত হল সে।
কপালে শুধু ধুর-ধার, বকা-ঝকাই ঝুটতে লাগল। বাড়ির চাকর-বাকড়রাও আজকাল তার কথা শুনে না, উল্টো ধমক মারে। অন্ধ বটপলালের কিছুই করার থাকে না।
অন্ধকে নিত-নিত কে আর কত সেবা করবে?
বটপলালের ছেলেরা নিজের-নিজের রাস্তা তৈরি করে বৌ-বাচ্চা নিয়ে পালিয়ে গেল। বটপলালের স্ত্রী তো অনেক আগেই মারা গিয়েছিল। সে স্বামীর পাপের জগতে ডুবে থাকতে চায়নি। বছর ঘুরতে না-ঘুরতেই বটপলালের কপালে
খুব দুর্দিন নেমে এল। নিঃসঙ্গ বটপলাল না পায় অন্ন, না পায় পথ্য, না পায় সেবা, না পায় আলো। তবু আশার কথা এত দুঃসময়েও তার এক বৃদ্ধ ভৃত্য, ধনু তাকে ছেড়ে যায়নি। ধনুর তিন লোকে কেউ ছিল না; এই বৃদ্ধ বয়সে সে যাবে কোথায়!
তাই সে মালিককে বলল, "মরি আর বাঁচি, আপনার সাথেই থাকব কর্তা।" ধনু মালিককে যা খেতে দিত, বটপলাল তাই খেত। শেষ সময়ে দুই বৃদ্ধ একে অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে বাঁচতে লাগল।
বটপলালের বিশাল বাড়িতে অনেক গাছ ছিল, অনেক ফুল-ফল ছিল। তাই বিক্রি করে দুই বৃদ্ধের এক সংসার কোনও ভাবে চলতে লাগল।
একদিন সারাদিন কিছু খেতে না পেয়ে বটপলাল ধনুকে দু-কথা খুব মন্দ বলে দিল। রেগে গিয়ে ধনুও তার মালিককে খুব গালা-গাল দিতে লাগল। সে মালিকের সকল দোষ, পূর্বের সকল অন্যায়, সকল পাপ কর্ম মালিকের সামনে আয়নার মত
তুলে ধরতে লাগল। আজ আর বটপলালের কিছুই বলার ছিল না। কারণ ধনু কোনও কিছুই মিথ্যা বলেনি। অন্ধ হয়েই আজ এক ধন-অন্ধ নিজেকে চিনতে পারল। এই প্রথম নিজের কৃতকর্মের জন্য খুব আফসোস হতে লাগল তার।
মনে খুব অনুতাপ জাগল। অন্ধ হয়েই তার মনের সকল চোখ খুলে গেল। সে অনুভব করতে লাগল; আজ আর কাউকে দোষ দিয়ে কোনও লাভ নেই। কারোর প্রতি আজ আর তার কোনও অভিযোগ, অনুযোগ রইল না।
যা অদৃষ্টে এসেছে, সব আগের কৃতকর্মের ফলেই সুদ সমেত ফিরে এসেছে। এ সব নিয়ে ভেবে আর কাজ নেই, বরং এবার মুক্তির চিন্তা করা যাক। তাই সে এবার মুক্তির চিন্তা করতে লাগল।
ধনুকে বলল, "ধনু, আমি তো নরকে বাসই করছি রে। এই নরক বাসই বাকী জীবনটা করে যেতে হবে। এই নরক থেকে আমার উদ্ধারের কোনও রাস্তা কী নেই?"
ধনু তার নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে মালিককে পরামর্শ দিল, "আমি তো জ্ঞানী, গুণী লোক নই কর্তা। আমার তো এত জ্ঞান-বুদ্ধিও নাই। তবে শুনেছি পরিষ্কার-পবিত্র মনে নাকি ভগবান বাস করেন।
আপনিও একবার চেষ্টা করে দেখুন না!"
এই কথাটা বটপলালের মন-মগজে খুব বিঁধল। বহু আগে সে একবার এক সাধুর মুখে বাল-গোপালের নাম শুনেছিল, বাল-গোপালের মাহাত্ম্য শুনেছিল। সেই কথাটাই আজ বটপলালের মনে পড়ল।
সে বারান্দায় চুপ-চাপ, মনে-মনে বাল-গোপালের নাম জপ করতে লাগল। এমনিতে অন্ধ বটপলালের তো আর কোন কাজ ছিল না। আগে সে বারান্দায় বসে নিজের দুর্ভাগ্যকে দুষত,
নিজের পরিবার পরিজনদের মন্দ বলত, নিজের কর্মচারীদের আর গ্রামবাসীদের গালি দিত; ওভাবেই তার দিন কাটত। এখন আর সেই সব কথা মনেও আনে না বটপলাল।
শুধু নীরবে বাল-গোপালের নাম জপ করে যায় সারাদিন। এতে করে কিছুদিনের মধ্যেই নিজের মনে খুব শান্তি পেতে লাগল সে। এমন শান্তি জীবনের আর কোনদিন সে পায়নি। এমন আনন্দ সে আর কোনদিন অনুভব করেনি।
মনে হল প্রাণটা যেন এক স্নিগ্ধ-শীতল গাছের ছায়ায় বসে আছে। একটা আনন্দ-আনন্দ ভাব, উৎসব-উৎসব ভাব, খুশি-খুশি ভাব সব সময় তার মনে বিরাজ করতে লাগল।
ক্রমে তার মনে হতে লাগল, চোখ গিয়ে ভালই হয়েছে; মনে শান্তিটা ফিরে এল।
একদিন ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে ধনু খুব অবাক হয়ে গেল। সে দেখল অন্ধ মনিব, তার অন্ধ হাতে ঘরের সামনের উঠানটা ঝাড়ে-পোঁছে খুব সুন্দর বানিয়ে ফেলছে।
দাওয়ার পাশে ছোট-ছোট সদাবাহার ফুল গাছ ছিল, সেই ফুল দিয়ে উঠান সাজাচ্ছে। খুব অবাক হল ধনু।
ভাবতে লাগল, "কর্তা কী পাগল হয়ে গেল নাকি? মাথায় দোষ পড়েনি তো? এই উঠানে গত দুই-তিন বছরে মাত্র এক-দু'জন ছাড়া কেউ পা দেয়নি। তবে এই উঠানকে কেন এত আদর সৎকার?
যাক গে, করুক গে; অন্ধ-বুড়া যখন এই করে শান্তি পাচ্ছে, করুক গে। খালি-পিলি বসে-বসে আর কেঁচ-কেঁচ তো করবে না!"
কিন্তু না; প্রতিদিন সকালটা-বিকালটা এমনি করে কাটতে লাগল। অন্ধ বটপলাল উঠান ঝাড় দেয়, সদাবাহার ফুল দিয়ে উঠান সাজায়, তারপর চুপ-চাপ বারান্দায় বসে থাকে।
আগের মত সে আর খাবার নিয়ে চীৎকার-চেঁচামেচি করে না, মানুষকে গালা-গাল দেয় না। কেমন যেন পাল্টে গেছে বটপলাল।
দিন আসে দিন যায়। এমনি করে-করে বহুদিন কেটে গেল। ঝড়-বৃষ্টি-তুফান সব এল, গেল; কিন্তু বটপলাল নিজের কাজ করতে ভুলল না। ভিজে-ভিজে নিজের কাজ করতে লাগল সে।
ধনু অনেক বাধা দিল, বকাবকি করল, কিন্তু কে শুনত কার কথা। দিন এমন করেই ঘুরতে লাগল এক বৃদ্ধের।
বহুদিন পরে হঠাৎ একদিন এক সাধু এসে হাজির হল সেই উঠানে। খুব তপ-জ্ঞানী, খুব তেজস্বী সাধু। সাধুর উপস্থিতি টের পেয়ে ধনু দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।
বটপলাল তখন তার অন্ধ হাতে থেরে-থেরে উঠান সাজাচ্ছে।
সাধু অতি সুমধুর কণ্ঠে বটপলালকে জিজ্ঞেস করলেন, "আমি বহুদিন যাবত লক্ষ্য করছি, আপনি অন্ধ, তবু প্রতিদিন সকাল-বিকাল উঠান ঝাড় দিচ্ছেন, পরিষ্কার করছেন, ফুল দিয়ে উঠান সাজাচ্ছেন; কেন? কার জন্য?"
বটপলাল হাত জোর করে হেসে বলল, "আপনাকে কী বলব সাধু-মহারাজ! আমি তো অন্ধ, নিজের কৃত-কর্মের ফল ভোগ করছি।
এক ধনু ছাড়া আমার নিজের আত্মীয় পরিজনও সবাই দূরে চলে গেছে। তাই বাল-গোপালের নামে ভর দিয়েই মরণের দিন গুনছি। তবু তার মাঝেই একদিন মনে হল, সকল শিশুরাই তো বাল-গোপাল।
আমার উঠানটাকে শিশুদের জন্যই ছেড়ে দেই। ওরা আসুক, প্রাণ ভরে খেলা করুক, আনন্দ করুক এই উঠানে। আমার এই উঠানে ওদের খেলায় যেন কোন ব্যাঘাত না ঘটে।
তাই আমি রোজ সকাল-বিকাল এই উঠানটাকে সাজাই। আমি জানি ওরা আসবে, প্রাণ ভরে খেলা করবে, খেলা শেষে হাসতে-হাসতে ফিরে যাবে।"
"কেউ কী আসে এখানে খেলা করতে?"
"হ্যাঁ, রোজ আসে। কত শিশু আসে। সবাই খুব মজা করে খেলা করে। সকালেও আসে, বিকালেও আসে। ওরা আসলেই আমার মনটা-প্রাণটা ভরে উঠে।
সব দুঃখ বেদনা ভুলে যাই। খুব শান্তি পাই মনে। তাই তো রোজ সকাল-বিকাল উঠানটিকে সাজিয়ে রাখি তাদের জন্য।"
ধনু পাশ থেকে বক-বক করে বলল, "কী পাগলের মত কথা বলছেন কর্তা? কোন ছেলে, কোন শিশুরা? আমি তো কোনদিন কাউকে এখানে আসতে দেখিনি। আপনার মাথাটাই বুঝি খারাপ হয়ে গেল!" এই বলে সে ধপ-ধপ পায়ে
ঘরের ভিতর চলে গেল।
ধনুর কথা শুনে বটপলালের দু'চোখ বেয়ে ঝর-ঝর করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। অসীম খুশিতে, আনন্দে সে শুধু দুই হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে রইল।
সেই তেজস্বী সাধুর চোখ বেয়েও জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। তিনিই শুধু জানেন, এই অশ্রুর মানে কী?
রাজবংশী সিরিজের অন্য গোয়েন্দা গল্প:
মাণিক্য
সর্দার বাড়ির গুপ্তধন রহস্য
প্রেমিকার অন্তর্ধান রহস্য
All Bengali Stories
22
23
24
25
26
27
28
29
30
31
32
(33)
34
35
## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers.
The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation.
Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##
◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717