সময় আসে সময় যায়
লেখক - প্রসেনজিৎ ঘোষ, বেলঘরিয়া, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ
০১-০৮-২০১৯ ইং
-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার - মে, ২০২৪' স্বরচিত গল্প লেখার প্রতিযোগিতা, ( প্রতি বছর মে মাসে )
Result
--------------------------
◕ সময় আসে সময় যায়
আকাশটা আজ বেশ ক'দিন ধরেই সেই এক নাকি সুরে কেঁদে চলেছে। ভোরের আলোর যে দ্যুতি তা মেঘ-রূপী নিটোল হাতের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। আর আকাশের সাথে-সাথে পাল্লা দিয়ে নদীটাও যেন বে-রসিক হয়ে উঠেছে।
বাঁধানো ঘাটটার কাছে যে গর্তটা ছিল, একদিনের বরষায় তা আরও বেড়ে গিয়ে ফুলে ওঠা জল গুলোকে অবিরত পাক খাইয়ে, শুরু থেকে শেষ আর শেষ থেকে শুরু করাচ্ছে।
রং তুলির কাজটা বেশ ভালই জানা ছিল, তার উপর হাতের সূক্ষ্ম কাজ এবং ভিন্নধর্মী ভাবনা নীলের জীবনে একটা আলাদা মাত্রা দিয়েছিল। কিন্তু এর ফল যে খুব একটা সুখপ্রদ ছিল তা নয়, বরং কণ্টক-বিজড়িতই ছিল বেশী।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই কোনও রকমে নিজেই নিজেরটা তৈরি করে অফিস ছুটতে হয়। যদিও নামি-দামি অফিস ঝাঁ চকচকে ফার্নেস করা সব কিছু এবং দেশি-বিদেশি কাস্টমার সামলে সকাল থেকে রাত অবধি
রোদে জলে পুড়ে নিজের সমস্তটা নিংরে দিয়ে মাসান্তে যেটুকু আয় হয় তা দিয়ে এত বড়ো জাহাজের মত সংসার টেনে নিয়ে যাওয়া বাঙালি নিম্নবিত্তদের কাছে একান্তই প্রতিকূল।
বৃদ্ধ বাবা-মা, ভাই-বোন নিয়ে পাঁচ ছয় জনের পরিবারে মাস গেলে কমপক্ষে ন্যূনতম যে খরচ, তা অফিসের এই সামান্য ক'টা টাকায় চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সত্যিই অসম্ভব। আর দাদারা যদিও শরিক বড়ো-বড়ো কোম্পানির,
সব বড়ো-বড়ো পোস্টে কর্মরত হলেও অহংকারী বৌদিদের নিত্যদিনের মুখ কালা-কালি নীলের জীবনে আরও একটা মাত্রা যোগ করেছে। সর্বোপরি যে অভিজ্ঞতা সে এ-বয়সে অর্জন করেছে, এক কথায় তা অবিশ্বাস্য।
নীল মনে নীল চক্রবর্তী, বছর দশেক আগের একজন পেশাদার নামকরা আর্টিস্ট। বহু বিখ্যাত ছবির জন্মদাতা তথা তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনের যে সমস্ত বাঘা-বাঘা যুবকরা তখনকার রাজ্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল
তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন। কিন্তু তখনকার সেই প্রাণচঞ্চল উন্মাদনার ফল ছিল খুবই খারাপ। আর্ট কলেজের যে রমণী তার কুড়ি বছরের জীবনে ফাগুনের রং ছড়িয়েছিল; রাজনীতি, সততা আর দারিদ্রের রঙে
বিবর্ণ হয়ে সেও একদিন হারিয়েছিল নদীর স্রোতে, সময়-রূপী সাগরের বুকে। এমনকি সদ্য ডিগ্রি করার পর বড় দাদার মহানুভবতায় যে চাকরিটি জুটেছিল রং আর তারুণ্যের জোরে, তাও দিনে-দিনে হয়ে গেছে ফ্যাকাসে।
প্রবল জেদ আর হার না মানার মানসিকতা কালের গর্ভে তাকে ক্রমেই করে তুলেছে এক অভিজ্ঞ পোড় খাওয়া ব্যক্তিত্ব।
নীল চক্রবর্তী আজ মদ খায়। কিন্তু তা কেবল মাতলামি করার জন্য নয়, খায় এই বয়সে এত অভিজ্ঞতা, যদিও দুঃখ ভুলে থাকার জন্যই। তবে নেশাটা প্রধানত অফিস থেকে বেরোনোর পরেই।
এতে মনের সাথে-সাথে ক্লান্তিটাও কেটে যায়। আর সেই সাথে পুরনো প্রণয়ীর যে বিষাক্ত স্মৃতিটা আজও বুকের মধ্যে দগ-দগ করে জ্বলছে, সেটা অনেকটা ভুলে থাকার জন্য।
এখন পুজোর মরসুম চলছে তাই অফিসে বিভিন্ন জায়গা থেকে, এমনকি দেশ-বিদেশ থেকেও প্রচুর অর্ডার আসে বিভিন্ন থিম, মডেল, চার্ট,বিজ্ঞাপনে লে-আউট, ছবির কমিকস এর জন্য।
আজ শনিবার তাই অফিসের রমাকান্তবাবু একটু তাড়াতাড়িই আসতে বলেছিল। যদি বিদেশ বিভুই এর কোনও অর্ডার আসে সেটা যেন নীলকেই দেওয়া যায়। এই একটি মাত্র লোক তাকে খুব স্নেহ করে কিন্তু তা
কেবল নীল একজন ভালো কর্মচারী বলে নয়, বরং তার প্রতিভাটা যাতে হারিয়ে না যায় এই ভয়ে। হয়তো একজন আঁকিয়েই একজন আঁকিয়ের দাম বোঝে।
আজ অফিসে এক বিদেশ ভিভুই এর একজন আর্টিস্ট এসেছেন। রমাকান্তবাবুর প্রত্যাশা মত নীল তার সামনে এসে দাড়াতেই ভদ্রলোক বললেন, "আপনি তো শুনলাম ভালো আর্টের জ্ঞান রাখেন।
কিছু নতুন জিনিস দেখান দেখি!"
কথাটা শুনে নীলের নিজের প্রতি একটা তাচ্ছিল্যের হাসি এলো। তার মত একজন শিল্পীকে আজ এই কথাও শুনতে হচ্ছে একজন দু'দিনের হতে রং-মাখা মানুষের কাছে!
এটাই নিয়তি। নীল চাকরি বাঁচানোর চেষ্টায় চুপ করে শুধু গিলে নিলো সব।
ভদ্রলোককে বলতে হয়নি। তার কথা মত নীল আজ সারাদিন তাকে নিয়ে কাটিয়ে দিল। অনেক কষ্ট করে বেছে-বেছে যে কটি ছবি এই বিদেশির পছন্দ হল তাও অবশেষে বিসর্জন দিতে হল মাত্রাতিরিক্ত যৌনতার কারণে।
নীল আজ খুব ইতস্তত করছিল। গোধূলির নিয়ন আলোয় তার মুখ কেমন যেন বিবর্ণ লাগছিল। না-বলা কিছু কথা তাকে হাতুড়ি পেটানোর মত আঘাত দিয়ে যাচ্ছিল।
হয়তো আজ তার উপার্জনের যে সুযোগ ছিল তা হাত ছাড়াই হবে। পথের ধারে গজিয়ে ওঠা একচালার চায়ের দোকানে পড়ন্ত বিকলে ক্ষণিকের পরিচিত এই মানুষটির সাথে কথা বলতে-বলতে ভদ্রলোক বলে উঠলেন, "আচ্ছা বলুন তো,
আজকালকার ছবিতে এত যৌনতা কেন?"
ভদ্রলোকের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে নীল বলল, "প্রত্যাশা, অভাব আর দারিদ্র্যের পারস্পরিক সংঘর্ষেই আমাদের জীবন ক্ষয়ে দিচ্ছে।"
এরকম উত্তর শুনে ভদ্রলোক কিছুক্ষণ থমকে রইলেন। হয়তো এর অর্থগুলো নিজের উত্তর এর সাথে মিলিয়ে নিচ্ছিলেন। তারপর বললেন, "আপনি তো খুব ভালো ছবি আঁকতেন রমাকান্তবাবুর থেকে শুনেছি, দেখাবেন?"
প্রশ্নটা যেন বহু বছর পর কেউ তাকে করলো! ঘাড় নেড়ে নীল সম্মতি দিতেই ভদ্রলোক বললেন, "চলুন তাহলে দেখে আসি।"
ভদ্রলোকের কথা শুনে নীলের বুকটা হঠাৎ পাথর হয়ে গেলো। দশ বছর আগের চরম উন্মাদনা, জেদ আর খামখেয়ালিপনায় সে প্রকৃতি, পরিবেশ আর প্রেয়সীর যে ছবিগুলো এঁকেছিল, সেগুলো কিভাবে এ-কে দেখবে!
তাছাড়া তার ত নিজস্ব কোনও স্টুডিও নেই। আর এই ভিন-বাসিকে সম্মান জানানো... ইত্যাদি কথা ভাবতে-ভাবতে নীল অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো। আসলে সে যে এক কালে ছবি আঁকত, এই কথা সে নিজেই ভুলতে বসেছিল।
দশ বছর আগের পুরনো ছবি সংসারে কোথায়, কিভাবে আছে তা সে নিজেই জানে না।
যাই হোক, বেতের তৈরি চেয়ারে বসে দোচালা ঘরের নিয়ন আলোয় ভদ্রলোক নীলের ছবি গুলো দেখতে-দেখতে হঠাৎ দুটি ছবির দিকে তাকিয়ে যেন অভিভূত হয়ে গেলেন; একটি প্রেয়সীর আর একটি ডিঙ্গির মাঝে
নীল আর তার প্রেয়সীর আলিঙ্গনের ছবি।
"স্ট্রেঞ্জ!" ভদ্রলোক ছবি দুটো হাতে নিয়ে বলে উঠলেন। ভদ্রলোক আরও বললেন, " আপনি এত বড় শিল্পী অথচ এখানে সামান্য মাইনের টাকায় পরে আছেন? কেন?"
নীল যে সামান্য মাইনে পায় এটা তার আর রমাকান্তবাবু ছাড়া এই ভিনদেশীর পক্ষে জানা অসম্ভব। তবু নীল চুপ করে রইলো। ভদ্রলোক আবারও বললেন, "যদি কিছু মনে না করেন তবে একটা কথা বলি, আপনি আমাদের দেশে আসুন।
আমরা আপনাকে যথার্থ সম্মান জানাব।"
নীল কোনও উত্তর করলো না, শুধু একটু হাসল। বুঝতে বাকি রইলো না, এটা তার পিছুটান। ভদ্রলোক এবার প্রেয়সীর ছবিটা হতে তুলে বললেন, "ইনি কি আপনার পরিচিত?"
কথাটার মানে বুঝতে নীল সময় নিল, তারপর ঘাড় নেড়ে বলল, "হু,আমার এককালের হারিয়ে যাওয়া অতীত। আমার প্রেয়সী।"
ভদ্রলোক এবার সিগারেটে সুখটান দিতে-দিতে আবারও একবার আগের প্রস্তাবটি দিলেন এবং অবশেষে বললেন, "আপনাকে দেখেই বুঝেছিলাম, বলতে সাহস করিনি। আসলে আপনার এই অতি পরিচিত 'ইনি' আমার সহকর্মী,"
ছবির দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক বললেন, "আমরা একই সাথে কাজ করি। আর আমি যতদূর তাকে চিনি, সেও আজও আপনারই প্রতীক্ষার বসে আছে পথ চেয়ে। আমি জানি না আপনাদের মধ্যে কি হয়েছিল,
কেন আপনারা আলাদা হয়ে দূরে-দূরে থেকে একে অপরকে আজও ভালোবেসে যাচ্ছেন। তবে এই প্রতীক্ষার অবসান আপনি না গেলে মিটবে না।" কথাটা বলে ভদ্রলোকের ঠোঁটে একটা যুদ্ধজয়ের হাসির রেখা ফুটে উঠল।
হঠাৎ করে নীলের বাস্তবটা যেন পুরো পাল্টে গেল। বহুকাল আগে যা শুধুই ছলনা মনে হয়েছিল, তার সবটাই যেন তাকে আজ গ্রাস করে যেতে লাগলো। তবে দোষ কি তারও কম ছিলনা!
পার্টি,আন্দোলন, যৌবনের উন্মাদনায় সেও কি মানুষ চিনতে ভুল করেনি? জীবনের এতটা পর্ব, এতটা কষ্টের ভাগীদার তাহলে কি সেও নয়? .... নীল আর ভাবতে পারল না।
এতক্ষণ বাদে নীল ভদ্রলোকের এদেশে আসা, এত স্টুডিও থাকতে রমাকান্তবাবুর স্টুডিওতে আসা আর যেচে তার বাড়িতে ছবি দেখা, সব কিছুর কারণ যেন সিনেমার মত তার কাছে পরিষ্কার হতে যেতে লাগলো।
আজ দশ বছর পরেও, দূরে থেকেও তার প্রেয়সী তাকে এত ভালবাসে? আজও তার খোঁজ রাখে? আজও তাকে মনে পড়ে! তার জন্যে এই লোককেও এখানে পাঠায়..... উত্তেজনায় যেন সে কথাই বলতে পারছিল না।
চুপ করে রইলো। সে ফ্যল-ফ্যল চোখে তার প্রেয়সীর ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল।( সমাপ্ত)
গোয়েন্দা গল্প ও উপন্যাস:
নয়নবুধী
মাণিক্য
সর্দার বাড়ির গুপ্তধন রহস্য
প্রেমিকার অন্তর্ধান রহস্য
লুকানো চিঠির রহস্য
All Bengali Stories
46
47
48
49
50
51
(52)
53
54
## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers.
The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation.
Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##
◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717