Home   |   About   |   Terms   |   Library   |   Contact    
A platform for writers

রবীন্দ্রবাবুর রবীন্দ্রনাথ

Bengali Story

All Bengali Stories    80    81    82    83    84    85    86    87    (88)     89   

-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ আমাদের এই ওয়েবসাইট ( RiyaButu.com )-এ প্রকাশিত গল্পগুলির মধ্যে থেকে কিছু গল্প নিয়ে এবছরই প্রকাশিত হবে আমাদের 'রিয়াবুটু'র গল্প'।
--------------------------



রবীন্দ্রবাবুর রবীন্দ্রনাথ

লেখিকা - রিয়াঙ্কা সাহা, সি রোড, নোনা চন্দনপুকুর, ব্যারাকপুর, উত্তর চব্বিশ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ

"দাদা, এই নিন চা।"

যে লোকটি স্টাফ-রুমে চা দিয়ে গেল তার দিকে এক ঝলক তাকিয়েই চমকে উঠলেন রবীন্দ্রবাবু। রোগা-প্যাংলা, ঘোর কালো আর ঝাঁটার কাঠি-মার্কা খান-কতক চুল মাথার দু'দিকে সযত্নে রক্ষিত থাকলেও মাথার সামনে ও পিছনে তেল চকচকে টাক মাঝবয়সী লোকটির। রবীন্দ্রবাবুর হঠাৎ মনে পড়ে গেল,
"ভূতের মতন চেহারা যেমন নির্বোধ অতি ঘোর-
যা-কিছু হারায় গিন্নি বলেন, 'কেষ্টা বেটাই চোর।'"-পুরাতন ভৃত্য।
হ্যাঁ, ছোট্টবেলায় স্কুলে পড়েছিলেন কবিতাটা। প্রতিদিন লাঞ্চ ব্রেকে স্কুলের পাশের চায়ের দোকান থেকে চা দিয়ে যায় ঝন্টু। আজ ঝন্টু চা নিয়ে আসেনি। এই লোকটিকেও আগে কখনও দেখেননি রবীন্দ্রবাবু। বললেন, "তোমাকে তো আগে কখনও দেখিনি। ঝন্টু আসেনি আজ দোকানে?"

"ঝন্টু আমার খুড়তুতো ভাই। ঝন্টু অসুস্থ, তাই আমি এলাম।"

"অ। তা তোমার নাম কি?"

লোকটি দু'পাটি দাঁত বের করে হেসে বলল, "কেষ্টা।"

শুনে তো রবীন্দ্রবাবুর বিষম খাবার জোগাড়। ঠিকই ধরেছিলেন তিনি, 'পুরাতন ভৃত্য'। লোকটি চলে যাওয়ার পরও চিন্তাটা অনেকক্ষণ মাথা থেকে বের করতে পারলেন না তিনি। এসব কি হচ্ছে আজকাল তার সাথে; বিদঘুটে যতসব কাণ্ড। বইয়ের চরিত্র কি কখনও বাস্তবে নেমে আসতে পারে? ধুর, না না।

রবীন্দ্রবাবু মানে রবীন্দ্রনাথ সমাদ্দার হরিদেবপুর হাইস্কুলের অঙ্কের শিক্ষক। বেশ লম্বা-চওড়া, গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ পঞ্চাশোর্ধ রবীন্দ্রবাবু। স্কুলে, বাড়িতে, পাড়ায় তার যেমন সুনাম, দুর্নামও তেমনই। তিনি দারুণ অঙ্ক শেখান। এ এলাকায় তার চেয়ে ভালো অঙ্কের মাস্টার পাওয়া দুষ্কর। গাধা পিটিয়ে ঘোড়া বানাতে তিনি সিদ্ধহস্ত। ফেল করা ছাত্র-ছাত্রীরা, অঙ্কে যাদের দারুণ ভয়, তাদের বাবা-মায়েরা রবীন্দ্রবাবুর শরণাপন্ন হন। তারা জানেন রবীন্দ্রবাবুর কাছে পড়লে তাদের ছেলে-মেয়েরা পাশ করবেই। এদিকে রবীন্দ্রবাবুর দুর্নাম এই যে, তিনি রবীন্দ্র-বিরাগী। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন, রবীন্দ্রনাথ সমাদ্দারের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে অনীহা। এমনকি কবিগুরুর নামের সাথে মিলের কারণে নিজের রবীন্দ্রনাথ নামটাও তার দরুন না-পসন্দ। পাড়ার ছেলে-ছটকারা সেটা জানে বলেই রবীন্দ্রবাবুকে দেখলেই তারা প্যাঁক মারে, "কবিগুরু চললে কোথায়?" বয়স্করাও কম যান না। হয়তো রবীন্দ্রবাবু বাজারের ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছেন, ও পাড়ার অনন্ত ঘোষালের সঙ্গে দেখা। অনন্তবাবু হাঁক মারলেন, "কি রবীন্দ্রবাবু, বাজারে চললেন নাকি!" তারপরেই আওড়ালেন,
"জলপাইগুড়ি থেকে এনে কই জিয়োনো।
চাঁদনিতে পাওয়া যাবে বোয়ালের পেট কি?"
কবিতাটা যে 'দামোদর শেঠ' সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না রবীন্দ্রবাবুর। অনন্তবাবুর ছড়া কাটা শুনে ব্রহ্মতালু তেতে ওঠে তার। তবু তিনি ভাবলেন মাথা গরম হলেও দাঁতে-দাঁত চেপে সব সহ্য করে নেবেন। কিন্তু অনন্তবাবুর খ্যাঁক-খ্যাঁক হাসি দেখে তিনি আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। রেগে-মেগে বলেই ফেললেন, "আমি কই না বোয়াল কিনব, তা জেনে আপনি কি করবেন মশাই? নেই কাজ তো খই ভাজ। যত্তসব আহাম্মক!"

"আমাকে আহাম্মক বললেন আপনি? আপনি নিজে কি মশাই? আপনি...আপনি...আপনি একটা অসামাজিক, একটা আন-কালচার্ড লোক।"

ব্যস শুরু হয়ে গেল ঝগড়া। ভাগ্যিস আশেপাশে লোকজন জড়ো হয়ে গিয়েছিল, তাই বোধহয় ঝগড়াটা হাতাহাতিতে পরিণত হতে-হতেও হল না। রবীন্দ্রবাবুর এই রবীন্দ্র-ভীতির মূলে আছে তার ছেলেবেলা। তার পরিবার ছিলেন রবীন্দ্রানুরাগী। তার রবীন্দ্রনাথ নামটি ঠাকুরদারই দেওয়া। ঠাকুরদা ছিলেন বিখ্যাত রবীন্দ্র গবেষক। বাবা, মা, ঠাকুরদা আর দুই ভাই-বোনকে নিয়ে ছোট্ট পরিবার ছিল তাদের। বাড়িতে রবীন্দ্রচর্চার পরিবেশ ছোট থেকেই দেখে এসেছেন তিনি। তার বাবা পেশায় ছিলেন সরকারি চাকুরে, কিন্তু নেশায় লেখক। অবসর সময়ে রবীন্দ্রনাথের বই থেকে গল্প, কবিতা পড়ে ছেলেমেয়েদের শোনাতেন বাবা। মা ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। রবীন্দ্রবাবুর মনে আছে, প্রতি রবিবার রেডিওতে 'গল্পগুচ্ছ' নামে একটি অনুষ্ঠান হত। সেখানে রবীন্দ্রনাথের লেখা 'গল্পগুচ্ছ' থেকে বিভিন্ন গল্প পাঠ করতেন সঞ্চালক। তার পরিবার সেই অনুষ্ঠান শোনার জন্য সারা সপ্তাহ উদগ্রীব হয়ে থাকত। রবীন্দ্রবাবুর কিন্তু একদমই ভাল লাগত না। তবু বাধ্য হয়ে তাকে শুনতেই হত। এমন রবীন্দ্রপ্রেমী পরিবারের ছেলে হয়ে রবীন্দ্রবাবু যে কিভাবে এমন রবীন্দ্র-বিরাগী হলেন, সে ভারি আশ্চর্য! কখনও-কখনও এমন হয়, যে জিনিস চাপিয়ে দেওয়া হয়, তার প্রতি স্বাভাবিক ভালো লাগাটাই চলে যায়। রোজ-রোজই যদি কচি পাঁঠার ঝোল খাওয়া হয়, তবে দিন-দুয়েকের মধ্যে নির্ঘাত পেট ছাড়বে। রবীন্দ্রবাবুর হয়েছিল সেই দশা। অবশ্য সবার এমন হয় না। সবার তো আর হজম ক্ষমতা সমান হয় না।

স্কুলে পাঠ্যবইয়ে বেশিরভাগই থাকত রবীন্দ্রনাথের কবিতা। অন্য কবির কবিতা মুখস্থ করে ফেললেও রবীন্দ্রনাথের কবিতা কিছুতেই তার মুখস্থ হত না। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে একবার তিনি বলেছিলেন 'তালগাছ'। বলা ভালো, তিনি শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করে উঠতে পারেননি-
"তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে...উঁকি মারে আকাশে...আকাশে...মনে কালো মেঘ ফ্যাকাসে... সারাদিন ঝরঝর থরথর...তারপর...তারপর..."

"থেমে যাও এরপর..." বাংলার স্যার হরনাথবাবু হাসতে-হাসতে বলেছিলেন। রবীন্দ্রবাবু দেখেছিলেন বন্ধুরা হো-হো করে হাসছে। লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল তার। রবীন্দ্রনাথের জন্যই কবিতা, গান, নাটকের প্রতি একধরণের বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছিল রবীন্দ্রবাবুর। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ক্রমশ নীরস মনে হতে থাকে তার। তিনি ভেবেই পেতেন না, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এত মাতামাতির কি আছে। এখন স্ত্রী এবং ছেলেকে নিয়ে ছোট সংসার রবীন্দ্রবাবুর। বাবা, মা, ঠাকুরদা মারা যাওয়ার পর বাড়ি থেকে রবীন্দ্রচর্চার পাটই তুলে দিয়েছেন তিনি। বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের যত বই ছিল সব স্থানীয় লাইব্রেরিতে দান করে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ঠাকুরদার লেখা বই বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেছেন। বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের যত ছবি ছিল সে সবও বিক্রি করে দিয়েছেন। রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিন পাড়ায় মাইকে বেজে চলা রবীন্দ্রসঙ্গীত যাতে কানে না আসে, সেইজন্য সেদিন তিনি দরজা-জানালা বন্ধ করে বাড়িতে বসে থাকেন। তার স্ত্রী, ছেলে জানে তার এই খ্যাপাটে স্বভাবের কথা। তাই তারাও রবীন্দ্রবাবুকে বিশেষ ঘাঁটায় না।

স্কুলে বাংলার শিক্ষক অরূপবাবুর সাথে তার আদায়-কাঁচকলায়। কারণটা ঐ রবীন্দ্রনাথ। অরূপবাবুর মুখে সবসময় লেগেই আছে রবীন্দ্রনাথের লাইন। এ নিয়ে তিনি রবীন্দ্রবাবুকে খোঁচা দিতে ছাড়েন না। এই তো এই সেদিন অরূপবাবু গান ধরলেন,
"তোমার অসীমে প্রাণ-মন লয়ে..."

"এটা কি গানের ইস্কুল নাকি অরূপবাবু? কি আজেবাজে, ফালতু সব গান গাইছেন। এটা কাজের জায়গা। বিরক্ত করবেন না।"

"রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ফালতু বলছেন? অবশ্য আপনি কি বুঝবেন গানের মর্ম?"

"গান আমাকে শেখাতে আসবেন না আপনি। গানের গ-ও যদি জানতেন তাহলে কি এসব ছাইপাঁশ গাইতেন! রবীন্দ্রনাথকে লোকটাকে নিয়ে যে এত মাতামাতির কি আছে বুঝি না বাপু।"

"আপনার মত রুচিহীন লোকের রবি ঠাকুরকে বোঝার সাধ্য নেই। আপনি বাঙালির লজ্জা। যে মানুষটা বাঙালিকে বাঁচতে শেখালেন, দেশকে নোবেল পুরস্কার এনে দিলেন তাকে অপমান করছেন আপনি।"

ঝগড়াটা আরও কিছু দূর গড়াত যদি-না পাশ থেকে কৃষ্ণনাথবাবু মধ্যস্থতা করতেন। অরূপবাবু কিন্তু সহজে ছেড়ে দিলেন না। তিনি সোজা হেডমাস্টারের কাছে নালিশ করলেন রবীন্দ্রবাবুর নামে। তিনি বললেন যে, রবীন্দ্রবাবু তাকেই শুধু অপমান করেননি, কবিগুরুকেও অপমান করেছেন। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। বেশিরভাগ শিক্ষকই অরূপবাবুকে সমর্থন করলেন। শেষ পর্যন্ত অবস্থা সামাল দিতে হেডমাস্টার রবীন্দ্রবাবুকে ডেকে বললেন, "ছিঃ ছিঃ, কি লজ্জার কথা বলুন তো রবীন্দ্রবাবু! শিক্ষক হয়ে আপনার এমন কাজ মানায়? রবি ঠাকুরকে আপনার পছন্দ নয় জানি। তা বলে আপনি অন্যের পছন্দে বাধা দিতে পারেন না, অপমানও করতে পারেন না। বাচ্চা ছেলেদের মতো ঝগড়া করছেন আপনারা। এরকম ঘটনা ভবিষ্যতে যেন আর না ঘটে সেটাই আশা করব।"

রবীন্দ্রবাবু বুঝলেন তিনি একটু বেশিই মাথা গরম করে ফেলেছিলেন। নিজের ব্যবহারের জন্য নিজেই লজ্জা পেলেন তিনি। সেদিন বাড়ি ফেরার পরই প্রথম ঘটনাটা ঘটল। বাড়ির দরজা খুলতেই দেখেন ছোট্ট ফুটফুটে একটা মেয়ে। বয়স পাঁচ-ছয় বছর হবে। চুলে দুটো ঝুঁটি বাঁধা। ফ্রক পরে আছে মেয়েটা। আধো-আধো স্বরে বলল," কে তুমি?"

"তুমি কে?"

"আমি মিনি।"

"বাহ, ভারি মিষ্টি নাম তো তোমার। এবার দরজাটা ছাড়ো, আমাকে ভেতরে যেতে দাও।"

"না, আগে বলো তুমি কে? কাকিমা বলেছে দুষ্টু লোককে ঘরে ঢুকতে দিতে নেই।" মিনি তার ছোট্ট দুটো হাত দিয়ে প্রাণপণে দরজা আগলানোর চেষ্টা করল। রবীন্দ্রবাবু না হেসে থাকতে পারলেন না, "আমি এ বাড়িতেই থাকি। আমি দুষ্টু লোক নই, আমি ভালো লোক। এবার আমাকে ঢুকতে দাও।"

এরইমধ্যে রবীন্দ্রবাবুর স্ত্রী চলে এলেন আর মিনিও দরজা ছেড়ে দিল। স্ত্রীকে বললেন, "এই মিষ্টি দারোয়ানটিকে কোত্থেকে পেলে বলো তো?"

"আমাদের নতুন প্রতিবেশী রহমতের মেয়ে গো।"

ড্রয়িংরুমে এসে দেখেন রহমত সস্ত্রীক বসে আছে। রবীন্দ্রবাবুর মন খচখচ করতে লাগল 'মিনি', 'রহমত' নামগুলো শুনে।

রহমতের বয়স বেশি নয়। ত্রিশের সামান্য বেশি হবে। একমুখ দাড়ি-গোঁফ দেখে তাকে পাক্কা কাবুলিওয়ালাই মনে হয়। রবীন্দ্রনাথের লেখা কাবুলিওয়ালা গল্পটা রেডিওতে শুনেছিলেন ছেলেবেলায়। সেই গল্পের প্রধান দুই চরিত্র রহমত ও মিনি। রবীন্দ্রবাবু মুখ ফসকে হঠাৎ "কাবুলিওয়ালা" বলেই বিব্রত বোধ করলেন।

রহমত হেসে ফেলল, "ঠিকই ধরেছেন। আমার বাবা রবীন্দ্রনাথের ভক্ত ছিলেন। তাই আমার নাম রেখেছেন রহমত। আমি নিজেও রবীন্দ্রনাথের বড় ভক্ত। তাই মেয়ের নাম রেখেছি মিনি।"

রবীন্দ্রবাবুর মনে পড়ল তার নিজের নামকরণের কথা। তিনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিন্তু তার মুখ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের লেখার নাম বেরোল কি করে? সেই কোন-কালে শুনেছিলেন গল্পটা। এখনও মনে আছে? তিনি লক্ষ্য করেছেন কাবুলিওয়ালা নামটা বলার পর তার স্ত্রী মুচকি হেসেছে। 'ছিঃ ছিঃ!' স্কুলে, বাড়িতে আজকাল সব জায়গাতেই হাসির পাত্র হয়ে উঠছেন তিনি। ভাগ্যিস তার ছেলে তখনও স্কুল থেকে বাড়ি ফেরেনি। নইলে ছেলের কাছেও তার প্রেস্টিজ থাকত না নির্ঘাত। রবীন্দ্র-বিরাগীর মুখে রবীন্দ্র-রচনার নাম...কি লজ্জা, কি লজ্জা!

দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটল এর কিছুদিন পরেই৷ রবীন্দ্রবাবু বাড়িতে ছাত্র-ছাত্রীদের অঙ্কের টিউশন দেন। সেদিন বারো-তেরো বছর বয়সী একটি ছেলেকে নিয়ে হাজির এক ভদ্রলোক। ভদ্রলোক বললেন,"আমি সুবলচন্দ্র ধর আর এই আমার ছেলে সুশীলচন্দ্র ধর।"

রবীন্দ্রবাবু বেশ ভালো করে নিরীক্ষণ করলেন ভদ্রলোককে। যার নাম সুবলচন্দ্র তার শরীরে বলের এত অভাব? ভদ্রলোক একটু বেশিই রোগা। সুবলবাবু আবার বললেন, "সেভেনে পড়ে আমার ছেলে। কি বলব স্যার, এত বদমাশ না ছেলেটা। স্কুলে যাওয়ার নাম শুনলেই ওর যত পেট কামড়ায়, জ্বর আসে। সারাদিনে পড়াশোনার নামগন্ধ নেই। খালি টো-টো করে ঘুরে বেড়ানো। বছর-বছর অঙ্কে ফেল করছে। ছেলেটা যদি আপনার কাছে পড়ে স্যার, তাহলে আমি একটু নিশ্চিন্ত হই।"

সুশীলচন্দ্র বেশ চঞ্চল। রবীন্দ্রবাবু লক্ষ্য করলেন, ছেলেটা তার সামনে চুপ করে বসে থাকলেও তার চোখ সবসময় এদিক-ওদিক ঘুরছে। অর্থাৎ সুশীলচন্দ্র মোটেই সুশীল বালক নয়। তার চেহারাও বাপের ঠিক বিপরীত। ছেলেটি বেশ স্বাস্থ্যবান, সুবলচন্দ্রের মতো নয়। বাবা-ছেলে দু'জনের নামের কি বিড়ম্বনা! 'ইচ্ছাপূরণ'! রবীন্দ্রনাথের 'ইচ্ছাপূরণ'-এর দুই চরিত্র সুবলচন্দ্র ও সুশীলচন্দ্র। আবার রবীন্দ্রনাথ! গল্পগুচ্ছ তো তার পিছু ছাড়ছে না। তার নিজের নামের বিড়ম্বনাও কি কম নাকি? রবীন্দ্রনাথের রবীন্দ্রনাথে নিরাসক্তি। রবীন্দ্রবাবুর বেশ রাগ হচ্ছিল। সুবলচন্দ্র আর সুশীলচন্দ্রের ওপর। শুধু তাই নয়, তিনি নিজের ওপরও বেজায় বিরক্ত হলেন। একবার ভাবলেন সুশীলচন্দ্রকে পড়াবেন না। তারপরই তার মনে হল সেটা করলে তিনি নৈতিকতার দিক থেকে নিজের কাছেই অনেক নিচে নেমে যাবেন। অগত্যা তিনি সুশীলচন্দ্রকে ভর্তি নিলেন তার কোচিং ক্লাসে।

এই নিয়ে পরপর কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেল। রাতে শুয়ে-শুয়ে ভাবছিলেন রবীন্দ্রবাবু। প্রথমে কাবুলিওয়ালা, তারপর ইচ্ছাপূরণ, তারপর...তারপর পুরাতন ভৃত্য... যোগসূত্র মেলানোর চেষ্টা করলেন তিনি। এরপর কি আসতে চলেছে কে জানে! কঙ্কাল বা মণিহারা গল্পের চরিত্ররা নয় তো! ভয়ে শিউরে উঠলেন রবীন্দ্রবাবু। ভূতে তার ভারি ভয়। কঙ্কাল আর মণিহারা দুটোই ভীষণ ভয়ের গল্প যে না, না, না এসব নিশ্চয়ই তার মনের ভুল। সেদিন স্কুলে অরূপবাবুর সাথে বাক-বিতণ্ডা হওয়ার ফল এসব। সেদিনের ঘটনাটা তিনি ভুলতে পারেননি, তাই এসব ভাবছেন। কিন্তু পরপর তিনবার চরিত্রগুলোর সাথে দেখা হল তার। তিনবারই কি মনের ভুল না কি এসব নেহাতই কাকতালীয়! ঘুম এল না রবীন্দ্রবাবুর। তিনি সারা রাত ছটফট করতে লাগলেন।

সেদিন হঠাৎই এল খবরটা। স্কুল বন্ধের নোটিশ। সারা পৃথিবী করোনা নামক এক ভাইরাসের থাবায় বিপন্ন। এই ভাইরাস একবার শরীরে ঢুকলে আসে মৃত্যু, খুব দ্রুত। রোগটা নাকি সংক্রামক, খুব তাড়াতাড়ি ছড়ায়। এর হাত থেকে বাঁচতে হলে একে অপরের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। তাই স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সারা দেশে জারি হল লকডাউন। দোকানপাট, বাজার, অফিস, ট্রেন-বাস, কলকারখানা সব অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। মানুষেরা ঘরেই বন্দী আজ। এই বন্দীদশাতেই এক বিকেলে রবীন্দ্রবাবুকে বারান্দায় মুক্তকণ্ঠে গাইতে শোনা গেল,
"বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখ তাপে ব্যথিত চিতে নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখে যেন করিতে পারি জয়..."
হ্যাঁ, রবীন্দ্রসঙ্গীতেই প্রাণ খুঁজে পান তিনি আজকাল। রবি ঠাকুর ছাড়া এত জীবনীশক্তি তিনি খুঁজে পাবেন কোথায়! রবীন্দ্রবাবু কিছুদিন ধরেই তার মধ্যে এক আশ্চর্য পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন। গল্পের এইসব চরিত্রগুলো যাদের সাথে তার দেখা হল তারা তার ভীষণ পরিচিত। ছোট্টবেলায় বহুবার পড়েছেন, বহুবার শুনেছেন গল্পগুলো। আজ মনে হচ্ছে চরিত্রগুলো, গল্পগুলো, কবিতাগুলো তো মোটেই খারাপ নয়। সৃষ্টির মতো স্রষ্টাকেও বেশ ভালো লাগছে তার আজকাল। না কঙ্কাল কিংবা মণিহারার চরিত্রদের সাথে তার দেখা হয়নি। তবে অমলের সাথে দেখা হয়েছিল একদিন, হাসপাতালে। 'অমল', সেই যে ডাকঘর নাটকের 'অমল'। রবীন্দ্রবাবুর শরীরেও অণুজীব বাসা বেঁধেছে কি না সেই পরীক্ষা করাতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই অমলের সাথে তার দেখা। তার নিজের টেস্ট রেজাল্ট নেগেটিভ এলেও অমলের এসেছে পজেটিভ। তবে তার দৃঢ় বিশ্বাস অমলের রোগমুক্তি ঘটবে। প্রাণশক্তিতে ভরপুর এই বাচ্চা ছেলেটি। অমল ঠিক সেরে উঠবে। তিনি নিশ্চিত অমলের সাথে সত্যিই দেখা হয়েছিল তার। না এটা তার মনের ভুল নয়, হতেই পারে না।
(সমাপ্ত)
Next Bengali Story


All Bengali Stories    80    81    82    83    84    85    86    87    (88)     89   


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717