Home   |   About   |   Terms   |   Library   |   Contact    
A platform for writers

স্বামীজি, শ্রীরামকৃষ্ণ এবং ১৬ই আগস্ট

লেখক - শিলাজিৎ কর ভৌমিক, ধলেশ্বর, আগরতলা

All articles    পর্ব ৪    পর্ব ৫    পর্ব ৬    পর্ব ৭    পর্ব ৮    

-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ আমাদের এই ওয়েবসাইট ( RiyaButu.com )-এ প্রকাশিত গল্পগুলির মধ্যে থেকে কিছু গল্প নিয়ে এবছরই প্রকাশিত হবে আমাদের 'রিয়াবুটু'র গল্প'।
--------------------------



swami-vivekananda

◕ স্বামীজি, শ্রীরামকৃষ্ণ এবং ১৬ই আগস্ট

লেখক - শিলাজিৎ কর ভৌমিক, ধলেশ্বর, আগরতলা

# অনেক বছর আগে, স্কটিশচার্চ কলেজে একদিন জনৈক ইংরেজির অধ্যাপক অনুপস্থিত থাকায় অধ্যক্ষ উইলিয়াম হেস্টি ক্লাস করলেন। সেদিন তিনি ওয়ার্ডসওয়ার্থের একটা কবিতা পড়াচ্ছিলেন। কবিতার নাম ‘এক্সকার্সান'। এই কবিতায় কবি বোঝাতে চাইছিলেন যে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কবির মনটা অতীন্দ্রিয় রাজ্যে চলে যেত। ছাত্রদের মনে এই তাত্ত্বিক কথাগুলো ঢুকছিল না। তখন হেস্টি সাহেব বলেছিলেন, "আমি মাত্র একজনকে আমার চোখের সামনে এমতাবস্থায় দেখেছি। তিনি দক্ষিণেশ্বরের শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস। তোমরা সেখানে গিয়ে তাঁকে দেখলে ব্যাপারটা ভালোভাবে বুঝতে পারবে।"

এই ক্লাসটা, উপস্থিত ছাত্রদের মধ্যে একজনের জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছিল। ছেলেটি ছিল কলেজের অন্যতম মেধাবী ছাত্র। সেই ছেলেটি আর অন্য কেউ নয়, শিমুলিয়ার নরেন্দ্রনাথ দত্ত। যার ডাকনাম ছিল নরেন।

ছোটবেলা থেকেই নরেন ছিল প্রচণ্ড জ্ঞানপিপাসু, আর খুব আধ্যাত্মিক মনোভাব ছিল তার। সবসময় ঈশ্বর সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা থাকত তার। ছোটবেলা থেকে সে খুব ধ্যান করত। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সংস্পর্শে আসার পর সেই অভ্যাস আরও জোরালো হয়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ প্রায়শই যুবকদের জিজ্ঞেস করতেন যে, ধ্যান করে কার কি অভিজ্ঞতা হল। নরেন একদিন বলল, এক জ্যোতির্বিন্দু তার ভ্রুকুটির মাঝখানে এসে পড়ে। তারপর সেই জ্যোতির্বিন্দু আলোর রশ্মি হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এসব শুনে বুঝতে পেরেছিলেন যে, নরেনের বিরল যোগবল আছে। কাজেই, সকলের সামনে তিনি তার প্রশংসা করতেন। নরেনের মনে প্রায়ই একটা প্রশ্ন ঘুরপাক করত: ঈশ্বর আছে কি নেই? একদিন সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যে সে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হল। দেবেন্দ্রনাথ তখন গঙ্গাবক্ষে এক নৌকোয় বসে ধ্যানমগ্ন ছিলেন। সেই জায়গায় ঢুকে নরেন সেই চরমতম প্রশ্নটি করে ফেলেছিল যা সে এতদিন করেনি, "আপনি কি ঈশ্বর দেখেছেন?"

নরেনের ওই প্রশ্নের জন্যে মহর্ষির ধ্যানভঙ্গ হয়েছিল। তিনি সরাসরি সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নরেনের চোখের উপর চোখ রেখে বলেছিলেন, "তোমার যোগীর ন্যায় চোখ আছে।"

নিজের প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে হতাশ হয়ে নরেন ওখান থেকে চলে যায়। এরপর সে ব্রাহ্ম সমাজের বাঘা-বাঘা নেতাদের সেই একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। কিন্তু কেউ তাকে সদুত্তর দিতে পারেনি।

১৮৮১ সালে নরেন তখন এফ. এ. পরীক্ষার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেই সময় পাড়ার জনৈক ব্যক্তি সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে দক্ষিণেশ্বরের শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিমন্ত্রিত ছিলেন। সুরেনবাবুর প্রয়োজন ছিল এক সুগায়কের, যে ঠাকুর শ্রীরামকৃষকে ভজন গেয়ে শোনাতে পারবে। কাজেই, নরেনের ডাক পড়ল। নরেন সব শুনে এক কথায় রাজি। কেননা, এই শ্রীরামকৃষ্ণের কথা সে হেস্টি সাহেবের মুখে শুনেছিল। আর বুঝেছিল যে এই ঠাকুর তাকে ঈশ্বরদর্শনের ব্যাপারে সদুত্তর দিতে পারবেন। যেদিন ঠাকুর সুরেন মিত্তিরের বাড়িতে এলেন, সেদিন নরেন গাইল। ঠাকুর তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন, এবং নরেনের শারীরিক লক্ষণ এবং ভাব-তন্ময়তা লক্ষ্য করে রীতিমতো মুগ্ধ হলেন। সুরেন মিত্তির ও নরেনের এক নিকট আত্মীয় 'রামচন্দ্র দত্ত'র কাছে নরেনের পরিচয় জানতে চাইলেন ঠাকুর। পরিচয় পেয়ে ঠাকুর তাঁদের বললেন দক্ষিণেশ্বরে নরেনকে নিয়ে যেতে। এমনকি, তিনি নরেনকে সরাসরি নিমন্ত্রণ করলেন।

নরেন দক্ষিণেশ্বরে যেতে রাজি হওয়ায় সুরেন্দ্রনাথ মিত্র তাকে নিয়ে গেলেন দক্ষিণেশ্বরে। নরেন সেখানে গিয়ে সোজা ঠাকুরের কক্ষে ঢুকলেন। ঠাকুর তাকে একটা মাদুরে বসালেন। এরপর তাকে একটা গান গাইতে বললেন। নরেন তিন-চারটা ব্রহ্মসঙ্গীত গাইল। তার মধ্যে ‘মন চলো নিজ নিকেতনে' শুনে ঠাকুর ভাব-সমাধিতে লীন হয়ে গেলেন। গান শেষ হওয়ার পর ঠাকুর তাকে আর এক কক্ষে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করলেন। এবং নরেনকে মিছরি, মাখন ও সন্দেশ খেতে দিলেন। তারপর তাকে অত্যন্ত আবেগ তাড়িত কণ্ঠে বললেন, "এতদিন পরে এলে? কতদিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম, সেটা একদম ভাবলি না?" এরপর ঠাকুর নরেনকে এমন একটা কথা বললেন যেটা শুনে নরেন আকাশ থেকে পড়ল। তিনি বললেন, "জানি প্রভু, তুমি সেই নররূপী নারায়ণ। জীবের উদ্ধার করতে তুমি এই শরীর ধারণ করেছ।"

একথা শুনে নরেনের মনে হল, ঠাকুর বদ্ধ উন্মাদ। সে বিশ্বনাথ দত্তের পুত্র। তাকে ঠাকুর এ সমস্ত কথা বলছেন কেন? যাই হোক, নরেন মুখ বুজে এসব শুনল। এরপর ঠাকুর নিজ হাতে তাঁকে মাখন, মিছরি ও সন্দেশ খাওয়ালেন। নরেন বারবার বলছিল, "আমাকে খাবারগুলি দিন। আমি আমার সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে খাব।" ঠাকুর কোনও কথাই শুনলেন না। কক্ষ থেকে বেরোবার সময় ঠাকুর নরেনকে বললেন, "বলো, তুমি শিগগির একদিন একা আমার কাছে আসবে?" নরেন না করতে পারল না। সে বলল, "আসব।"

কক্ষের বাইরে ঠাকুর উপস্থিত শিষ্যগনের সামনে নরেনকে জিজ্ঞেস করলেন, "ঘুমোবার আগে তুমি কি একটা জ্যোতি দেখতে পাও?" নরেন বলল, "হ্যাঁ।" ঠাকুর তখন বললেন, "বাঃ! সব মিলে যাচ্ছে। ও ধ্যানসিদ্ধ।" সেই সময়, নরেন তাঁর সেই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে ফেলল, "আপনি কি ঈশ্বরকে দেখেছেন?" ঠাকুর উত্তর দিলেন, "হ্যাঁ, দেখেছি; যেমন তোদের দেখি। তবে তার চেয়েও অনেক বেশি ঘনিষ্ঠভাবে। হ্যাঁ, ঈশ্বরকে দেখাও যায়, তাঁর সঙ্গে কথাও বলা যায়। অনেকেই বিষয়-আশয়ের দুঃখে কাঁদে, ভগবানকে নিয়ে কজনে কাঁদে। সরলভাবে ভগবানকে ডাকলে ভগবান অবশ্যই দেখা দেন।"

নরেন তখন মনে-মনে ভাবল যে ঠাকুর অর্ধোন্মাদ হলেও ইনি এক মহাপবিত্র ও মহাত্যাগি সিদ্ধ যোগীপুরুষ। অতএব, সেদিনকার জন্য সে ঠাকুরকে প্রণাম করে কলকাতায় ফিরে গেল।
দ্বিতীয়বার যেদিন নরেন দক্ষিণেশ্বর গেল, তখন এক অসাধারণ কাণ্ড ঘটল। একটি ঘরে একাকীতে ঠাকুর নরেনের অঙ্গে তাঁর ডান পা রাখলেন। আর সাথে-সাথেই নরেন দেখল ঘরের চারদিক দ্রুত বেগে ঘুরছে। তার মনে হল কোন অজানা জগতে সে চলে যাচ্ছে এবং এরপরেই তাঁর মৃত্যু। নরেন চীৎকার করে উঠল, "আরে! কি করছেন? আমার যে মা বাবা আছে?" ঠাকুর তখন হেসে তাঁর পা সরালেন এবং হেসে বললেন, 'তাহলে আজ থাক'। তখন নরেন আগের মতো সবকিছু দেখতে পেল। নরেনের তখন মনে হল, ওই অর্ধোন্মাদ (নরেনের আগের ভাবনায় ঠাকুর) মেসমেরিজম ও হিপ্নোটিজমের দ্বারা তাঁর উপর কি প্রভাব বিস্তার করছে? সে তো আর পাঁচজনের মতো দুর্বল চিত্তের মানুষ নয়, সে তো এত সহজে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেনি। এরপর সে দৃঢ় সংকল্প নিল যে, ঠাকুর যেন আর তাঁর মধ্যে ভাবান্তর সৃষ্টি না করতে পারে।
তৃতীয়বার যেদিন নরেন দক্ষিণেশ্বরে গিয়েছিল, তখন ঠাকুর তাকে পাশেই যদু মল্লিক নামক এক ভক্তের বাগান বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর তাঁরা গঙ্গার ধারে বাড়ির একটা কুঠিরে বসেছিলেন। ঠাকুর সেদিন ফের সমাধিস্থ হয়েছিলেন। নরেন দূর থেকে বসে সেসব দেখছিল। হঠাৎ ঠাকুর সেই অবস্থায় তাঁর কাছে এসে তাঁকে স্পর্শ করলেন। তখন নরেন সাথে-সাথে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হলেন। ঠাকুর তখন তাঁকে ওই অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করলেন, "কে তুমি, কোথা থেকে এলে, কেন এলে, কতদিন এখানে থাকবে?" ওই অবস্থাতেই নরেন যাবতীয় উত্তর দিল। ঠাকুর ওই ঘটনায় বুঝেছিলেন যে, 'ও যেদিন নিজেকে চিনবে, সেদিন আর এই দেহ রাখবে না'।

একদিন নরেন ব্রাহ্মসমাজের এক সভায় এক আচার্যের বক্তব্য শুনছিলেন। আচার্যমশাই এক বেদির উপর বসে বক্তব্য রাখছিলেন। এমন সময় ঠাকুর অকস্মাৎ উপস্থিত হলেন। সভায় উপস্থিত প্রত্যেকে অবাক। ঠাকুর সমাধিস্থ অবস্থায় বেদির উপর গিয়ে বসলেন, সভায় চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। গণ্ডগোল অত্যন্ত বেড়ে গেল, গ্যাসের আলো নিভিয়ে দেওয়া হল। নরেন ঠাকুরের পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন এবং তাঁর সমাধি ভঙ্গ হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ঠাকুর যখন নীচে নেমে এলেন, তখন নরেন তাঁকে বাইরে নিয়ে গেল এবং দক্ষিণেশ্বরের উদ্দেশ্যে ঘোড়ার গাড়ি ডেকে তাঁকে পাঠিয়ে দিল সেখানে। নরেনের প্রতি এমন অমোঘ টান ছিল ঠাকুরের। কিন্তু ঠাকুরের এই লাঞ্ছনায় খুব কষ্ট পেয়েছিল নরেন। এমনকি, সে ঠাকুরকে তিরস্কারও করেছিল। কিন্তু ঠাকুর সেটা গায়ে মাখেননি।

এরপর ঠাকুর যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, তখন তিনি শ্যামপুকুরে ছিলেন। এরপর তিনি চলে গেলেন কাশীপুরে। দুই জায়গাতেই নরেন অন্যান্য গুরুভাইদের সঙ্গে নিয়ে ঠাকুরের প্রচণ্ড সেবাযত্ন করেছিল। এই দুই পর্যায়ে ঠাকুরের প্রতি নরেনের বিশ্বাস বেড়েই চলল। যখন ঠাকুর বুঝলেন যে তাঁর শেষ সময় ফুরিয়ে আসছে, তখন তিনি নরেনের সঙ্গে অনেক সময় একাকী কাটাতেন এবং ভবিষ্যতের কাজকর্ম নিয়ে অনেক উপদেশ দিতেন।

মহাসমাধির কিছু সময় আগে ঠাকুর নরেনকে একাকী ডেকে নিজের সামনে বসালেন। নরেনের মনে হচ্ছিল যেন ঠাকুরের দেহ থেকে তেজোরশ্মি এসে তার দেহে প্রবেশ করছে। শেষে ঠাকুরের দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। তিনি নরেনকে বললেন, "আজ আমার যথাসর্বস্ব তোকে দিয়ে ফকির হলুম। তুই এই শক্তিতে জগতের কাজ করবি। কাজ শেষ হলে পরে ফিরে যাবি।"

মহাসমাধি কাছাকাছি আসতে ঠাকুর নরেনকে ফের বলেছিলেন, "দেখ নরেন, তোর হাতে এদের সকলকে দিয়ে যাচ্ছি। তুই এদের সকলকে দেখবি।"

বাকিটা ইতিহাস। ১৬ আগস্ট ১৮৮৬ সালে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব মুখে তিনবার 'মা কালী'র নাম নিয়ে মহাসমাধিতে লীন হলেন। আর সারা বিশ্বকে দিয়ে গেলেন তাঁর ভালোবাসার অন্যতম বড় নিদর্শন – স্বামী বিবেকানন্দ।
( সমাপ্ত )

তথ্যসূত্র: যুগনায়ক বিবেকানন্দ, প্রথম পর্ব – স্বামী গম্ভীরানন্দ
Swami Vivekananda – The Living Vedanta by Chaturvedi Badrinath


All articles    পর্ব ৪    পর্ব ৫    পর্ব ৬    পর্ব ৭    পর্ব ৮    


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717