নয়নবুধী
( এক পাঁজালীর প্রেমিকা )
পর্ব ৮
ত্রিপুরার ইতিহাসের পটভূমিতে রচিত একটি উপন্যাস
লেখক - হরপ্রসাদ সরকার, ধলেশ্বর, আগরতলা
( এই উপন্যাসের সকল স্বত্ব সরকারি রেজিস্ট্রিকৃত ভাবে লেখক দ্বারা সংরক্ষিত )
নয়নবুধী: সমস্ত পর্বগুলি:
All Parts
◕ নয়নবুধী
পর্ব ৮
গভীর বনে শাঁ-শাঁ করে ছুটে চলছে ঘোড়াগুলি। আকাশ তখন মেঘাচ্ছন্ন। কড়-কড় করে বিদ্যুৎ ঝরে পড়ছে আশে-পাশে। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও সিপাহিরা বীরের মত তীব্র বেগে এগিয়ে চলছে সামনের দিকে।
সৈন্যদের আবেষ্টনে পরমা সুন্দরী এক পাহাড়ি কন্যা।
আকাশের প্রবল অস্থিরতার চাপে ক্রমে-ক্রমে নয়নবুধীর মনে স্থিরতা আসতে লাগল। সে পুলকিত চোখে দেখতে লাগল অদেখা সবুজ গভীর বন-বনানীকে; এতকাল তো পাশেই ছিল, তবু কত অদেখা, কত অচেনা!
গভীর বনও এত সুন্দর হয়! এত অপরূপ শোভায় শোভিত! স্থানে-স্থানে হাজার-হাজার ফুল ফুটে আছে, সবার নামও জানে না সে।
ফুলের মন-মাতানো গন্ধে চারিদিক ম-ম করছে। মনে হল, নববধূকে বরণ করার জন্য সেজে আছেন বনদেবী। গভীর বনের মাঝে বন-প্রতিমাকে এত সুন্দর কে সাজাল?
মনের সকল দরজা একে-একে খুলে দিতে লাগল সে। বনের আয়নায় যেন প্রতিফলিত হতে লাগল নয়নবুধীর অপরূপ সৌন্দর্যে। বনের শোভায় নিজেরই প্রতিবিম্ব দেখতে লাগল সে।
সেই সৌন্দর্য, সেই শোভা রোমে-রোমে অনুভব করতে লাগল নয়নবুধী। মনে হল, আজ নিজেও বেশ সুন্দর হয়ে গেছে সে।
চারিদিক দেখে তার মনে হল, এ যেন বন নয়, গাছ-গাছালির আবরণে ঢাকা খুশি, আনন্দ, শান্তি আর নীরবতা। মনে হল, পরিশ্রান্ত পৃথিবী যেন সবার অলক্ষ্যে এখানে এসে বিশ্রাম করছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে ফুলে-ফুলে, হাওয়ায়,
পাখির ডানায়, ঘাসে-ঘাসে, বনের মেঠো পথে-পথে। যেন চন্দ্রদেব তার দশ অশ্ব-বাহী রথে প্রকৃতিকে নিয়ে এই গভীর বনের মাঝে বিলাস ভ্রমণ করছেন।
অতি ভয়ঙ্কর এই গভীর বন, নয়নবুধীর কাছে আজ এক সুখের ঠিকানা। মনের সকল দুঃখ, যন্ত্রণা সে ছড়িয়ে দিতে লাগল এই বনের কোনায়-কোনায়।
পরিণামে তার রিক্ত মন ভরে উঠতে লাগল অপার আনন্দ আর উৎসাহে। নির্মল খুশির হাসি ফুটে উঠল তার রাঙা ঠোটের ফাঁকে। বন-প্রতিমা ধরা দিল আরেক বন-প্রতিমায়।
এ যেন গভীর বনের মাঝে মায়াবী দরজার প্রহরী। হাজার-হাজার ফুলের পদতলে পড়ে আছে লক্ষ্য-লক্ষ্য ফুলেরই পাপড়ি; যেন প্রেম-ভিক্ষায়। প্রকৃতি তার এমন অপরূপ দলিল কেন এত নির্জনে, এত গহীন বলে লুকিয়ে রাখল?
আবেশিত নয়নবুধীর মনে দশকোষী তালের সুমধুর কীর্তন বহুদূর থেকে ভেসে আসতে লাগল,
"ওগো ফাগুন কভু নেয়নি বিদায় এ বন ছাড়ি-
তাহে সদাই লুটায় ফাগ দু'অঞ্জলি ভরি।
প্রেমিক সনে, যে আসে এ বনে হেরিতে বনের প্রেম-
দেখে, ছড়িয়ে আছে নিজ হৃদয় সকল বন জুরি-
নিজেই দেখে নিজের প্রেম দু'নয়ন ভরি।।"
ঘোড়ার টগ-বগ, টগ-বগ শব্দ বন-বনানী ভেদ করে বহুদূর পর্যন্ত চলে যেতে লাগল; প্রতিধ্বনির রেশ টেনে ধরতে লাগল জংলী হাওয়া। নয়নবুধী কান পেতে খুশি-খুশি মনে শুনতে লাগল সেই প্রতিধ্বনি।
ঠিক এমন সময় 'গুড়ুম' করে কান-ফাটা শব্দে একটি বজ্র কাছেই কোথাও ঝরে পড়ল। সেই আওয়াজে ছেবরা খেয়ে উঠল সে; চমক ভাঙ্গল তার, আবেশিত নয়নবুধী যেন আবার জেগে উঠল।
এরই মাঝে বহু পথ পার হয়ে গেছে ওরা। নয়নবুধী অনুভব করল, তার সঙ্গী-সাথীরা সবাই যেন খুব গম্ভীর, সবাই খুব চুপচাপ, কারোর সাথে কারোর কোনও কথা নেই। ভাল করে লক্ষ্য করল সে; না, সত্যিই তো, সবাই খুব
চুপচাপ, খুব গম্ভীর, খুব ভার-ভার হয়ে আছে। মন বলল, "নিশ্চয়ই কথাও কোনও গণ্ডগোল আছে। কী তা?"
বুঝার চেষ্টা করল সে, কিন্তু পারল না। চেয়ে দেখল তার বরের চোয়াল কাঠের মত শক্ত হয়ে আছে। বজ্র কঠিন হাতে ঘোড়ার লাগাম ধরে রেখেছে। চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। বাঘের মত হিংস্র চোখে,
স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে শুধু সামনের পথের দিকে; অন্যদের অবস্থাও তেমনি। কী ব্যাপারে, মনের মাঝে ভয় ধরে এল নয়নবুধীর। ঠিক এমন সময় তার চোখে পড়ল পথের পাশের একটি জন-মানবহীন, বিধ্বস্ত এক জনপদ।
টং ঘরগুলি জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে আছে, কিছু আধাপোড়া অবস্থায় ছিন্ন-ভিন্ন, লণ্ড-ভণ্ড। চারিদিকে শুধু সর্বনাশের চিহ্ন। তবে বেশ বুঝা যায়, এক সময় স্থানটি অতি সমৃদ্ধ এবং সুন্দর ছিল। অবাক স্বরে নয়নবুধী ওর বরকে
জিজ্ঞাস করল, "এ কী? জায়গাটার এ দশা কেন? ঘরগুলি এমন পড়ে আছে কেন? মানুষজন কৈ?"
অতি সংক্ষেপে দু'এক কথায় হীরামন জবাব দিল, "জায়গাটার নাম কৃষ্ণ সর্দার পাড়া। এই ধ্বংস সেই কুকি দস্যুদের কাজ। মাত্র কয়েকদিন আগের ঘটনা, একজনকেও জীবিত রাখেনি; এমনকি পশু-পাখীদের পর্যন্ত না।
অত্যন্ত নিষ্ঠুর ভাবে সকলকে হত্যা করেছে ওরা। এখানকার বৃক্ষ-তৃণ সব শেষ, কিছুই বাকী রাখেনি। এখনো এই দস্যুদলটি আশে-পাশের জঙ্গলেই অবস্থান করছে বলে খবর!"
আচানক ঘোড়াগুলির গতি অত্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হল। বিদ্যুতের মত ছুটতে লাগল ঘোড়াগুলি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জায়গাটা পার করতেই হবে। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল ঘোড়াগুলি। সিপাহীরা তাদের হাতে বহন করতে
লাগল উদ্ধত তলোয়ার। যে কোনও আক্রমণের মোকাবেলায় ওরা এখন প্রস্তুত। সবার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। আতঙ্কিত নয়নবুধীর মনেও চিড় ধরল। তার মনে হতে লাগল,
এই বুঝি পাশের জঙ্গল থেকে একটা তীর ছুটে আসছে, এই বুঝি সামনের জঙ্গল থেকে দস্যুরা আক্রমণ শুরু করল!
বহুক্ষণ এভাবে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যাবার পর, একটি ছোট্ট পাহাড়ি ছড়া পার হল ওরা। ছড়াটি পার হবার কিছুক্ষণ পরেই ঘোড়াগুলির গতি ধীরে-ধীরে কমিয়ে আনা হল। সিপাহীদের কঠিন মুখমণ্ডল কিছুটা শিথিল হয়ে এল।
কেউ-কেউ কয়েকটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, কারোর-কারোর ঠোটের কোনে একটু হাসি ফুটে উঠল, কেউ-কেউ একে-অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করল। নয়নবুধী বুঝতে পারল, বিপদের সীমানা বুঝি ওরা পার হয়ে এসেছে।
ওর মনেও স্বস্তি ফিরে এল। কিন্তু তবু তার মনের সন্দেহটি গেল না। মনে হল, সিপাহীদের যতটুকু খুশি থাকার কথা, কিংবা যতটুকু প্রতিক্রিয়া থাকার কথা, ততটুকু খুশি, ততটুকু প্রতিক্রিয়া কেউই প্রদর্শন করছে না।
এখনো সবাই খুব গম্ভীর, খুব চুপচাপ, খুব চিন্তিত। মনে-মনে যেন ওরা দুই পাহাড়ের হিসাব করে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুই মিলাতে পারছে না, নিজেদের দিশা খুঁজে পাচ্ছে না। নয়নবুধীর জামাই, হীরামনেরও একই অবস্থা।
আবারও কী সামনে কোনও বিপদ পড়ে আছে?
Next Part is here
গোয়েন্দা গল্প:
মাণিক্য
সর্দার বাড়ির গুপ্তধন রহস্য
প্রেমিকার অন্তর্ধান রহস্য
লুকানো চিঠির রহস্য
কান্না ভেজা ডাকবাংলোর রাত
All Bengali Stories
44
(45)
46
47
48
49
50
51
52
## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for any of that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##
◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717