ত্রিপুরা সরকারের সলিলকৃষ্ণ দেববর্মণ পুরস্কারপ্রাপ্ত শ্রী শ্যামল বৈদ্য ত্রিপুরার একজন বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক। সময় সময়ে ওনার অনেকগুলি বই প্রকাশিত হয়েছে এবং পাঠকদের কাছে খুব সমাদৃত হয়েছে। ওনার লেখা দুটি উপন্যাস ক্রমপর্যায়ে আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হচ্ছে।
-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার - মে, ২০২৪' স্বরচিত গল্প লেখার প্রতিযোগিতা, ( প্রতি বছর মে মাসে )
Result
--------------------------
কানামাছি
বাংলা উপন্যাস
লেখকঃ শ্যামল বৈদ্য, আগরতলা, ত্রিপুরা
১ম পর্ব
রাত না দিন বোঝার কোন উপায় নেই। ঘরের ভেতরটা ভীষণ অন্ধকার। জায়গাটা ঠিক কোথায় সেটাও বোঝার উপায় নেই। কতদিন এইভাবে আটকে পড়ে থাকতে হবে এখানে বুঝতে পারছে না মাধবী। তবে প্রথম দু-তিন দিন এখানে একা একা থাকতে ওর সামান্য ভয় ভয় লেগেছে বটে। কিন্তু এখন আর তেমন মন্দ লাগছে না। বিশেষ করে যেদিন প্রথম বুঝতে পারল পৃথিবীতে এই একটা জায়গা যেখানে তরুণকে একান্তে পাওয়া যায়। শ্বশুরবাড়ির ক্রমাগত নরক যন্ত্রণার চাইতে এই ফ্ল্যাটে একা পড়ে থাকা ঢের বেশি ভাল। কষ্টের দিনগুলি থেকে পালিয়ে এসে এই যে এখানে স্বাধীনভাবে পড়ে রয়েছে তা যেন বেঁচে থাকার জন্য ওকে অক্সিজেন দিচ্ছে। আজ আর কোন রাগ নেই তার মনে। আপাতত এটাই রিলিফ দিচ্ছে যে অবশেষে সব মায়া ছিঁড়ে ফেলে পালাতে সক্ষম হয়েছে। মায়া মমতা প্রেম কত শত নীতি বাক্য বিয়ের আগে থেকে মা নামতা-র মতো প্রতিদিন শিখিয়েছেন। মা-র শাসন তাকে অনেক সময় ক্লান্ত করে তুলতো। অথচ বিয়ের পর যে সংসার সে উপহার পেল তা মা-র কল্পিত সংসারের সাথে কোন মিল নেই। স্বাধীনতা হীন কোন জীবন কি কখনো কারও কাঙ্ক্ষিত হতে পারে? না মাধবী শ্বশুর বাড়ি এসেছে বলে দাসী বাদীর মতো ব্যবহার তো সে সহ্য করতে পারে না। যাকে চেয়েছিল সে মা বাবার পছন্দ নয়, কিন্তু যাকে পেল সে তো মাধবীর পছন্দ নয়। তাহলে এখন সে কী করতে পারতো? বিয়ের পর থেকে একটা দিনও মনে শান্তি পায়নি সে। তাই চির মুক্তির পথটা তাকে খুঁজতেই হল। আর সেই পথটা আসান করে দিল সেই তরুণই। আজ তার মনে শুধুই একরাশ খুশি। কষ্টের সেই প্রতিটা দিন প্রতিটি মুহূর্ত তার মনে গেঁথে আছে। সেই দিনগুলি আজ মনে হলেই রাগে ঘেন্নায় তার মনটা ভরে ওঠে। সেই দিনগুলি তাকে প্রায় পাগল বানিয়ে ফেলেছিল। অক্টোপাশের ভয়ানক বেড়াজাল থেকে নিজেকে ছিন্ন করতে পেরে অবশেষে সে মুক্ত।
দু-দিন হল সেই একইভাবে পড়ে রয়েছে মাধবী এখানে। দুপুরের খাওয়া হয়ে গেলে এখন আর ঘু্মোতে ইচ্ছে করছে না। সারাদিন রান্না করা ছাড়া আর তেমন কাজও নেই। রান্না মানেও তো শুধুই সেদ্ধ আর ভাত। আলু পেঁয়াজ আর ডিম দিয়ে ভর্তা খেতে হচ্ছে বারবার। খুবই সন্তর্পণে চলতে হয় এই অ্যাপার্টমেন্টে। কেউ টের পেয়ে গেলে আর রক্ষা থাকবে না। থানা পুলিস মিলিয়ে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘটে যাবে। তাই চুপচাপ অন্ধকারে লুকিয়ে বসে থাকা। তরুণ মাত্র একবার এসেছে এই ক-দিনে! এসেও তাড়াহুড়ো করেই ফিরে গেছে আবার। তরুণকে ছাড়া সময় যেন আর কাটতেই চায় না। কতটা সময় আর ঘুমিয়ে কাটানো যায়? ঘুমোতে ঘুমোতে এক সময় ভীষণ বোর লাগে। বিছানা দেখলেই মেজাজটা চিড়িক করে ওঠে বিরক্তিতে। তাও এখন এই বিছানা ছাড়া অন্য কোথাও পালাবার কোনও উপায় নেই। তরুণ আসবে বলে গেছে কিন্তু সাত দিন হল সে আর এ-মুখো হচ্ছে না। তাকে আরও একটু কাছে পেতে খুব ইচ্ছে করছে মাধবী-র। এই মানুষটা যেন দেবদূত হয়ে এসেছে তার জীবনে। তার কাছেই মাধবী বারবার মুক্তি খুঁজেছে বাঁচার। কিন্তু তারপরও সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। সেই দিনগুলি আর মনে করতে চায় না সে। এখন শুধুই অফুরন্ত খুশির জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকা। কখন তরুণ এসে ডাকবে, মাধু চলো তাড়াতাড়ি রেড়ি হয়ে যাও, আমাদের আজই বেরিয়ে পড়তে হবে।
কিন্তু সে যে কিছু গুছিয়ে রাখবে তার উপায়ও নেই। এক শাড়িতে মাধবী এখানে এসেছে, ফলে কাপড় চেঞ্জ্ করার উপায় পর্যন্ত নেই। তরুণকে একটা ফোন করে দেখনে সেটাও সম্ভব না। তরুণ তার সেলফোন সুইচ্-অফ করে নিয়ে গেছে। সেলফোন দিয়ে যেকোনো মানুষের লোকেশান ট্রেস্ করা খুব সহজ। তাই তার সেল্ ফোনটা সে প্রায় ছিনিয়ে গেছে। সেই যে শাড়ি খোলে তরুণের একখানা টি-শার্ট আর বারমুডা পরেছিল মাধবী তাও চেঞ্জ্ করতে পারছে না। যদি আজও সারাদিন না আসে তরুণ তাহলে কী করবে মাধবী? এখান থেকে একবার লুকিয়ে বেরোতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু তারও উপায় নেই। তরুণ বাইরে থেকে তালা মেরে গেছে কেউ ভেতরে আছে সেটা যেন বাইরের লোক বুঝতে না পারে।
হঠাৎ মাধবী-র মনে একটা উলটো কথা ভেসে উঠল। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে যে মাধবী যেন পালিয়ে যেতে না পার তার জন্য তরুণ বাইরে দামি তালা ঝুলিয়ে গেছে। তাকে যদি তরুণ সোনার ডিম পাড়া মুরগি ভেবে নেয়? অধিকার থেকে মানুষের মনে জন্ম নেয় প্রয়োজন, আর প্রয়োজনই ধীরে ধীরে ডেকে আনে লোভ। তরুণের আচরণ কেমন যেন পালটে যাচ্ছে, আগের মতো উচ্ছ্বাস, পাগলামি তার মধ্যে আর দেখতে পাচ্ছে না মাধবী। এই যে দিনের পর দিন একা ঘরে পড়ে আছে সে তা নিয়ে তরুণের মধ্যে কোনও দুশ্চিন্তা আছে বলে মনে হয়নি। ছিঃ ছিঃ এসব কেন মনে আসছে মাধবীর! যে ছেলে শুধু তাকে পাওয়ার জন্য নিজের চাকরি ছেড়ে দিতে রাজি হয়ে গেল। যে এমন একটা কাজ করতেও রাজি হল যা তাকে গারদের পিছনে পাঠিয়ে দিতে পারে দশ বারো বছরের জন্য। আর আজ তাকেই সন্দেহ করছে মাধবী! না না তরুণকে ছোটো করা এক্কেবারে ঠিক হয়নি তার। বিয়ের আগে এবং পরে তরুণ তার প্রতিটি মুহূর্ত তো মাধবীকেই দিয়েছে। ফেসবুকে, হোয়াটস্-আপ, টুইটারে রাতের পর রাত তারা একসাথে কাটিয়েছে। বিয়ে তাদের না হলেও কোনওদিন কেউ উপলব্ধি করতে পারেনি যে তারা দু-জন আলাদা। তরুণ প্রতিদিন তাকে ধৈর্য ধরে ভালো দিনের জন্য অপেক্ষা করতে বলেছে। একটা দিনও জিজ্ঞেস করতে ভুলেনি মাধবী খেয়েছে কিনা। সে প্রেমকে সন্দেহ করা ঠিক হয়নি মাধবীর। যার ভরসায় সবাইকে ছেড়ে পথে এসে দাঁড়াল তাকে কেন সন্দেহ করবে? আজ যদি তরুণ সরে দাঁড়ায় তাহলে তার ডুবে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় তো নেই। তবুও তরুণকে ছাড়া অন্য কিছু তার পক্ষে ভাবা অসম্ভব।
তবে তরুণ সত্যি জিনিয়াস! নাহলে এই নরক থেকে পালানোর পথটা এত দারুণ ভাবে কেউ করতে পারবে না। যেমন যেমন তারা প্ল্যান করেছে কাজটাও ঠিক সেইভাবেই করতে পেরেছে। সেদিনের কথা ভাবলে মনটা খুশিতে ভরে ওঠে মাধবীর। ভয় আছে, সে তো থাকবেই। ঝুঁকির কাজে কিছুটা ভয় না থাকলে তেমন মজাই থাকে না। তবে এসব কাজ তরুণ খুব নিখুঁতভাবে করতে পারে। এতদিনের মেলামেশায় সে এটুকু বুঝতে পেরেছে সত্যি তার মতো টেলেণ্টেড ছেলেই হয় না! যেকোনো কাজের ফিনিশিং এত দ্রুত আর এত সুন্দর করতে পারে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আজ একটা বছর ধরে মাধবী যে অভিশপ্ত জীবন কাটিয়েছে তার থেকে মুক্তি এনে দিয়েছে তরুণ। তাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেবে তার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না সে। না তরুণকে তার সমস্ত ভালোবাসা উজাড় করে দেবে। কারণ শুধু তার মুক্তির জন্য যেমন করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ছেলেটা তা কল্পনাও করা যায় না। নিজের জন্য কঠিন বিপদকে ডেকে আনতেও সে পিছপা হয়নি। এসব ভাবলে সব রাগ মরে যায়, শ্রদ্ধায় ভালোলাগায় আনত হয়ে যায় মাধবীর মন। একবার ফিরে আসুক তরুণ তাহলেই সব সমর্পণ করবে তার চরণে। তার হৃদয় যেন চিৎকার করে বলতে চাইছে, একমাত্র তুমিই আমার জীবনে কাঙ্ক্ষিত পুরুষ একথা।
হঠাৎ উপরের ফ্লোরে একটা স্টীল জাতীয় বাসন মেঝেতে ঝনঝন শব্দ করে পড়ে গেল। সেই শব্দের অনুরণন যেন পুরো অ্যাপার্ট্মেন্টে ছড়িয়ে পড়ল। আর কোনো শব্দ হবে কি? কান পেতে বসে রীল মাধব, না আর কোনো শব্দ নেই কোনো কথাও নেই। আবার চুপ হয়ে গেল সারাটা বাড়ি। কেন কথা হবে? হাত থেকে কিছু পড়ে যাওয়া অসাবধানতা বটে কিন্তু অপরাধ তো নয়? সেদিন তার হাত থেকে পূজার থালাটা পড়ে গেল বলে কী ঝামেলাই না করেছিলেন তার শাশুড়ি। বাড়িটা প্রায় মাথায় তুলে ছেড়েছিলেন। শ্বশুরমশাইও সেদিন একটা কথাও বলেননি। তিনিও নিশ্চয় বলতে চাইছিলেন এত অসাবধান হয়ে চলাফেরা করা তার ঠিক হয়নি। আর অনিরুদ্ধ তো মুখে সারাদিন কুলূপ এঁটে বসে থাকে। সে তার মা-র এই চিল্লাফাল্লা সারাটা দিন ধরে শুনেও একটা কথা পর্যন্ত বলল না। বাধ্য পুত্রের মতো বরং বলেছিল, সারাদিন কী ভাবতে থাকো তুমি মাধবী? কাজ তো আর কিছু করতে হয় না তোমাকে। পূজার থালাটা নিয়ে ঠিকঠাক চলতে পারো না? এভাবে থালা পড়ে যাওয়া তো অমঙ্গল ডেকে আনে।
না সেদিন কিছুই বলতে পারেনি মাধবী। কিছু বলার মতো পরিবেশ এই বাড়িতে নেই। বাড়ির সবকটা মানুষ অনেকটা রোবটের মতো চলাফেরা করে। ওরা হাসতেও জানে না, কথা বলতেও জানে না। সারাদিন যেন অফিসের বস্ হয়ে ঘোরাফেরা করে। ইস্ কী দম বন্ধ করা পরিবেশ। একটা দিন যেন কেড়ে নেয় হাজার বছরের আয়ু। জানালা দিয়ে বাইরের মুক্ত পাখিগুলিকে দেখে টপটপ করে চোখের জল ফেলতো মাধবী। একটা প্রতিশোধ স্পৃহা তার মনের মধ্যে সারক্ষন ঘুরে বেড়াত। এমন করে প্রত্যাঘাত হানবে যে তার শ্বশুরবাড়ির মানুষরা শুধু চমকেই উঠবে না প্রায় পাগল হয়ে যাবে। তাদের করা সমস্ত পাপের জন্য সেদিন অনুশোচনা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। হ্যাঁ সেই প্রত্যাঘাত সফলভাবেই করতে পেরেছে মাধবী। কেউ কিচ্ছুটি টের পায়নি। ধন্যবাদ তরুণ, এত ভালোবাসা এত দায়িত্ব নিয়ে সে তাকে মুক্ত করেছে বলে। কিন্তু আর যে তর সইছে না মাধবীর। কখন আসবে তরুণ আবার, সে এসে বুকের মধ্যে টেনে নেবে তাকে। জীবনের অনেক চাওয়া পাওয়া এবার সুদ সমেত মিটিয়ে নিতে হবে। আর অন্য কিছু ভাবতেও ভালো লাগছে না।
এই ঘরের ভিতর সময়টা যেন আর কাটছেই না মাধবীর। একা সম্পূর্ণ একা তার প্রতিটি দিন ও রাত কেটে যাচ্ছে। ঘরের ভিতর আলোটা জ্বলাতেও নিষেধ করে গেছে তরুণ। সে এসে খাবারটা দিয়ে যাবে মাঝে মাঝে বলে গেছে। কিন্তু সেদিন ওকে রেখে যে গেছে আর তো আসেনি। তাহলে সে আবার কোনও বিপদে পড়ে গেল না তো? যেটুকু খাবার ছিল তাও প্রায় শেষ হতে বসেছে। এটা নিশ্চয় হিসেব আছে তরুণের। তাই মাধবীর মনে হচ্ছে তরুণ আজ আসবে নিশ্চয় আসবে। তরুণ রারবার বলে গেছে কেউ যেন টের না পায় এই ঘরে কেউ আছে। তার কোনও অস্তিত্বই যেন এই বাড়িতে না থাকে, ছায়ার সাথে মিশে যেতে হবে তাকে। তাই তো মিশে আছে মাধবী এক ফোটা নড়াচড়া পর্যন্ত সে করছে না। কিন্তু এইভাবে দিনের পর দিন অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য তার নেই। তরুণকে পেতে জীবনের সবচাইতে বড়ো ঝুঁকি নিয়েছে, কিন্তু তারপরও যদি তাকে কাছে না পায় তাহলে তার একাকীত্ব কে ঘোচাবে? প্রতিটা মুহূর্ত তাকে প্রায় পাগল করে দিচ্ছে, কিছুতেই সময়ের যন্ত্রণা থেকে সে নিস্তার পাচ্ছে না। তরুণ বলেছে কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে, পুলিশের নজরটা সরে যাক তাহলেই সে সামনে এসে বিয়ে করবে মাধবীকে। এ-কথাই চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে মাধবীর, তাই করো তরুণ, তাই করো আমার তো দম বন্ধ হয়ে আসছে। কেউ যেন আমার বুকে চেপে বসে থাকে সারাদিন আমার দম ফলতে কষ্ট হচ্ছে। একমাত্র তুমিই আমাকে রক্ষা করতে পারো এই দুঃদময় থেকে। নিজেকে আবার সামলে নিল মাধবী। জীবনে ভালো কিছু পেতে হলে কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে। ভালো কোনও কিছুই এত তাড়াহুড়ো করে পাওয়া যায় না তার জন্য মূল্য দিতে হয়। যদি তরুণকে পেতে তার আরও হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয় তাও করতে পারবে সে।
অন্ধকার ঘরের বাইরে সিঁড়ি বেয়ে একটা পুরুষালি জুতো খটা-খট্ আওয়াজ করে উপরে উঠে যাচ্ছে। সিঁড়িতে তার ক্রমাগত আওয়াজ মাধবীর দরজা অতিক্রম করে চলে গেছে উপরে। দরজা অব্দি কান পেতে চুপ করে বসেছিল মাধবী যদি পদচারণা থেমে যায় তার ঘরের সামনে এসে। সন্তর্পণে তালা খোলার মৃদু শব্দ তার কানে আসে! প্রতিদিন পাগলের মতো অপেক্ষা করছে মাধবী, যদি তরুণ ফিরে এসে বলে, এক্ষুনি চল আমাদের পালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু না দরজা ছাড়িয়ে শব্দটা ক্রমশ সামনে চলে গেল। সে আবার ধপাস করে বিছানায় পড়ে গেল। না এই পুরুষ মানুষটা আর যেই হোক তরুণ নয়। তরুণ আরো সতর্ক হয়ে পা ফেলতো। ঘটনার পর থেকে দারুণ ভয় পেয়েছে ছেলেটা। মুখে যতই সে বলুক কিছুই হয়নি মাধু সব টিক হয়ে যাবে। কয়েকটা দিন তু্মি আমাকে কোপারেট করো প্লীজ্। কিন্তু তার বুকের মধ্যে ভয় একটা ছোটো দানার মতো শক্ত হয়ে বসে গেছে। কেন ভয় পাচ্ছে সে? তারা তো এমন কিছু প্রমাণ রেখে আসেনি যে ফেঁসে যেতে পারে। তবে যদি অনিরুদ্ধ বেঁচে যায় তাহলে সমস্যা হতে পারে। অনিরুদ্ধ বেঁচে যাবে? কী করে? এত উপর থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেলে মানুষ কী করে বাঁচবে?
না ওই পুরুষটা নিশ্চিতভাবেই তরুণ নয়। ওই পুরুষের পদশব্দ ভীষণ আত্মবিশ্বাসী লেগেছে। তার হাঁটাচলায় কোনও দুশ্চিন্তা আছে বলেও মনে হচ্ছে না মাধবীর, ভয় থাকার তো কোনো প্রশ্নই নেই। আচ্ছা এমন তো নয় – তরুণ এখানেই কোথাও লুকিয়ে লুকিয়ে তার উপর নজর রাখছে? কিন্তু তার উপর নজর রাখবে কেন তরুণ? সে তো সম্পূর্ণ অসহায়, তরুণের অনুগ্রহ না পেলে মৃত্যু ছাড়া আর কোনও উপায় নেই তার। নিজের বাড়ি শ্বশুর বাড়ি এমন কী সমাজেও মুখ পুড়িয়েছে সে। মানুষ তাকে ছিঃ ছিঃ ছাড়া আর কী দেবে? পুলিস যদি পেয়ে যায় তাহলে শাস্তিও হয়ে যেতে পারে। তরুণ এসব ভালোই জানে, তাহলে কি ইচ্ছে করেই এই প্ল্যানটা করেছে? অনিরুদ্ধ মার্ডার হয়ে যাওয়া মানে মাধবীর জন্য ওই দরজাগুলি চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া। ঝোঁকের মাথায় করে ফেলা কাজটার জন্য মাধবী নিজেও ভীষণ কুঁকড়ে আছে। কিন্তু তরুণ নিশ্চয় ঝোঁকের মাথায় কাজটা করেনি? সে অনেক পরিকল্পনা করেই ঠাণ্ডা মাথায় কাজটা করেছে।
এবার আরও এক জোড়া জুতো চলার শব্দ নিচে নেমে আসছে। এটা মেয়েদের পায়ে চলার শব্দ। বড়ো কোমল শান্ত এই পায়ের চলাফেরা। কেমন হবে এই মেয়ের বয়স? চুপ করে দরজার পাশে বসে ভাবতে তার ভালো লাগছে। সে এসব কী করেছে পাগলের মতো? বারবার ছুটে এসে দরজায় কান পেতে বাইরের মানুষের অস্তিত্বটাকে অনুসরণ করছে। এছাড়া কী করবেই বা সে এই অন্ধকার ঘরে বসে বসে। সময়টা কাটাতে হলে তার চাইতে ভালো খেলা আর কী হত পারে। মাধবী বার বার তাই অ্যাপার্টমেন্টে আসা প্রতিটি মানুষকে চেনার চেষ্টা করে। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অব্দি এই মানুষগুলিকে তার হাঁটাচলার উপর নির্ভর করে নিজের মতো করে রিড্ করে। লোকটার বয়েস কত হবে? কী ধরণের পেশার সাথে মানুষটা জড়িত। তাছাড়াও ভাবতে ইচ্ছে করে সে তার স্বামী অনিরুদ্ধ-র মতো চাপা স্বভাবের না তরুণের মত প্রাণ খোলা। প্রতিদিন একই পায়ের শব্দ শুনে শুনে এখন মাধবী ধরে ফেলতে পারে এই পদধ্বনি কার। এই অ্যাপার্টমেন্টের কাউকে সে চেনে না। তবুও শুধু পায়ে চলার শব্দ শুনে সে প্রত্যেককে এক একটা করে নাম দিয়ে দিয়েছে। সে এখন এই নামেই ওদের ডাকে আর আপন মনে তাদের সাথে চুপিচুপি কথা বলে।
এই মেয়েটার বয়স কত হবে? বয়স পঁচিশ ত্রিশ হতে পারে, তবে মেয়ে বা মহিলার চলায় একটা ছন্দ এবং নম্রতা আছে। এই পায়ের শব্দে ভয় বা সতর্ক হয়ে চলার কোনও চেষ্টা নেই। তবে আগে যে লোকটা উপরে চলে গেলেন তিনি জীবনে সফল ও আত্মবিশ্বাসী, কিছুটা অহঙ্কারীও মনে হয়। এটা মাধবী এখন প্রেডিক্ট করতে পারে। মানুষের চলাফেরার মধ্যেই থাকে মানুষের সবচাইতে বড়ো পরিচয়। একটা মানুষের হাত দেখে নয়, কপাল দেখে নয় একটা কী করে হাঁটে তা দেখেই বোঝা সহজ মানুষটা কতখানি এবং কেমন। মাধবীও তো চেয়েছিল এমন একজন পুরুষ যার দৃপ্ত পদচারণা দূর থেকে শুনেই শ্রদ্ধায় নারী হিসেবে তার মন ভরে উঠবে। তার গম্ভীর অহঙ্কারী কণ্ঠস্বর তাকে সারাদিন এক আর্দ্রতায় ডুবিয়ে রাখবে। না অনিরুদ্ধ-র মধ্যে তা নেই, সে তার মা-র দাসত্ব মাথায় নিয়ে বসে থাকে সারাদিন। একটা বাজে পুরুষ মানুষ ছাড়া আর কিছুই বলতে ইচ্ছে করে না ওকে।
মাধবী ভাবতে ভাবতেই তার একরোখা বিবেকের কাছে একবার প্রশ্ন করল, আসলে সত্যি কি অনিরুদ্ধ খুব খারাপ লোক ছিল? তার কি পতি হওয়ার মত কোনও গুণই ছিল না? তবে এটা মানে মাধবী অনিরুদ্ধকে বারবার দোষ দিলেও তার মধ্যে গুণও ছিল। শত্রুকে ভালো বলতে নেই তাই ক্রমাগত খারাপ বলে যাওয়া। কিন্তু এখন তো যুদ্ধ শেষ, অনিরুদ্ধ গো-হারান হেরেগেছে। তাই আজ তার ভালো দিকটাও ফিরে দেখতে ইচ্ছে করছে তার। অনিরুদ্ধ-র সবচাইতে বড়ো গুণ ছিল সে কখনোই বৌয়ের উপর জোর খাটাত না। মাধবীর যা অপছন্দ তা ওকে জোর করে করতে বলতো না। তাছাড়া নারী স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায় তার উপরও তার শ্রদ্ধা ছিল। শাশুড়ি যতই হইচই করুন না কেন মাধবী কোথাও একা যেতে চাইলে অনিরুদ্ধ বাধা দেয়নি। সত্যিই কি খুব খারাপ লোক ছিল অনিরুদ্ধ? অবশ্যই খারাপ ছিল, না হলে মাধবীর মতামত না নিয়ে তাকে জোর করে বিয়ে করা তার ঠিক হয়নি। ভাবতে ভাবতে বারবার কোথায় কোথায় হারিয়ে যায় মাধবী, তাও সময় আর কাটতে চায় না তার।
বাচ্চারা কখন স্কুলে যাচ্ছে আর কখন ফিরে আসছে তা এখন বলতে পারে মাধবী। কোন্ বাচ্চাটার পায়ের শব্দ কেমন, কে কত দ্রুত বা ধীরে পা ফেলে তা-ও বলতে পারে এখন। দরজার ও-পারে পায়ের শব্দ আর বায়ানাক্কা শুনেই মাধবী বোঝার চেষ্টা করে কোন্ বাচ্চাটা কত ভালো। কার মেরিট বেশি, কার মনটা ভালো বেশি, কে মা-র ন্যাওটা আর কে এখন থেকেই লিডার। মাধবী ওই বড়ো ফ্ল্যাট বাড়ির অন্য মানুষদের বোঝার চেষ্টা করে। ডেইলি বিকেল তিনটায় যে মহিলাটি তার মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে যান, তাকে আর তার মেয়ের পায়ের শব্দ চিনতে আর কোনওদিন ভুল হবে না তার। ইস্ খুব জানতে ইচ্ছে করে মহিলাটির নাম কী? তার মেয়ে ওকে ডাকে বটে তবে 'মা-মা' বলে ডাকে এতে ওই মহিলার নাম জানার উপায় নেই। এই মহিলার অত্যন্ত গোছানো পদক্ষেপ মাধবীকে তার বন্ধু অনামিকা-র কথা মনে করিয়ে দেয়। অনামিকারও তো একটা মেয়ে আছে শুনেছিল কিন্তু সে এত বড়ো হয়ে গেছে এটা কেন যেন মানতে পারছে না। তবু ওর নাম দিল মাধবী অনামিকাই। তার মেয়ের নাম শর্মিলি সেটা সে আগেই জানতে পেরেছে। তাই এই বাচ্চাটারও নাম দিল শর্মিলি। এখানে তরুণের বৌ হিসেবে যখন বসবাস করতে শুরু করবে মাধবী তখন এই মানুষগুলির সাথেই চলতে হবে তাকে। তাই আগে থেকেই সে যেন সে চিনে রাখছে সবাইকে।
হঠাৎ দু-জন পুরুষ মানুষ আচমকাই তার ফ্ল্যাটের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। সময়টা ঠিক ক-টা হবে বুঝতে পারছে না মাধবী। তবে তার মনে হল সময় হয়তো রাত ন-টা। অধিকাংশ মানুষ ঘরে ঢুকে গেছে। তারা দু-জন কে এবং কেনই এখানে এই দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারছে না মাধবী। ওরা পুলিসের লোক নয়তো? না না তারা পুলিস বা তরুণ কেউই নয়। কারণ ওরা উপর থেকে সিঁড়ি গড়িয়ে নিচে নেমে এসেছে। এখানে ফ্ল্যাটটা খালি পড়ে আছে তাই তার সামনে দাঁড়িয়ে একটু গসিপ করা। মাধবী প্রথম ভয় পেলেও এখন তার ভয় কেটে গেছে। কারণ তাদের হাসি ঠাট্টার শব্দ ওর কানে আসছে। ধীরে ধীরে সে দরজার পাশে গিয়ে কান পেতে রইল। ওরা কি বলছে তা শোনার জন্য মাধবীর মনটা ছটফট করতে লাগল। এরাও তো পুরুষ, আর এই পুরুষের কাঙ্ক্ষিত উপস্থিতি তার কাছে বড়োই প্রিয়। যা নিজের মতো করে পাওয়ার জন্য সে জীবনে এত বড়ো ঝুঁকি নিতে পারল কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে তা আজও তার কাছে অধরা রয়ে গেল। তরুণ এই ক-দিন তার পাশে এসে যদি তাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিত তাহলে মৃত্যু এলেও সে নিজের জীবন সার্থক মনে করতো। কিন্তু তরুণ যেন তার চরম পরীক্ষা নিয়ে দেখছে। কেন সে একবারও আসে না তার কাছে? কেন সে তার সমস্ত অহঙ্কার চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল না এখনও তাই বুঝতে পারছে না মাধবী।
ওই পুরুষ দু-জনের একজন ঠিক দরজাটার মধ্যেই হেলান দিয়ে দাঁড়াল। তাদের কথাগুলি অস্পষ্ট করে আসছে তার কাছে। মাধবী আলতো করে জড়িয়ে ধরল দরজাটা নিজের বুকে। তার সমস্ত কোমলতা লেপে দিল সে ওই দরজার মধ্যে। দরজার কারুকাজ তার শরীরে যে পীড়া দিচ্ছে তাও আজ কত মধুর। ওই পুরুষটাকে যদি দরজাটা ঘুরিয়ে ভিতরে নিয়ে আসা যেত তাহলে তাই করতো মাধবী। কেন যে এত নেশা জাগে মনে শরীরে সে নিজেই বুঝতে পারে না। সবই কী এতদিন ধরে একা একা পড়ে থাকার কু-ফল? মাধবী দরজার ফাঁক হয়ে যাওয়া অংশে গিয়ে চুপ করে বসে রইল। সিগারেটের পুরুষালি গন্ধ তার নাকে এসে লাগতেই কী এক নেশায় ঢুলতে লাগল মাধবী। কেউ যদি এখন তার তলপেটে ছুড়ি বসিয়ে দিত তাও সে খুশি মনেই নিতে পারতো। পুরুষের শরীরের ঘর্মাক্ত গন্ধের এই মাদকতা তার তনু মন সব আচ্ছন্ন করে রেখেছে আজ। আর পারছি না আমি তরুণ, তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।
## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers.
The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation.
Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##
◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717
২য় পর্ব
All Bengali Stories
18
19
20
21
22
23
24
25
(26)
27