Home   |   About   |   Terms   |   Library   |   Contact    
A platform for writers

রংতা দেবীর জোগাড় ( পর্ব ২ )

বাংলা গল্প

All Bengali Stories    104    105    106    107    108    109    110    (111)     112    113   

-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ আমাদের এই ওয়েবসাইট ( RiyaButu.com )-এ প্রকাশিত গল্পগুলির মধ্যে থেকে কিছু গল্প নিয়ে এবছরই প্রকাশিত হবে আমাদের 'রিয়াবুটু'র গল্প'।
--------------------------



রংতা দেবীর জোগাড় ( পর্ব ২ )
বাংলা গল্প
স্বরচিত গল্প প্রতিযোগিতার ( নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার , ২০২১) একটি নির্বাচিত গল্প
লেখক - রাজকুমার মাহাতো, সম্পা মির্জানগর, সরকারপুল, মহেশতলা, কলকাতা


11 th July, 2021

## রংতা দেবীর জোগাড়

পর্ব ২

আগের পর্ব

# পর্ব ২
পাহাড়ে পলাশ শেষের মুখে। এখন প্রায় দু-একদিন ছাড়াই পাবক আসে বুড়ির কাছে। বুড়ি সেদিন পাবককে বলেছে, "পিঙ্গল বাপ আমার, শনি আর মঙ্গলবার আসবিনে এখানে।"

পাবক বুঝতে পারেনি কেন তাকে বুড়ি এই দুইদিন আসতে বারণ করেছে। বুড়ি এখন পথ চেয়ে বসে থাকে পাবকের জন্য। পাবকও বুড়ির কাছে যাওয়ার জন্য উৎসুক হয়ে থাকে। বুড়ি কলা, পেয়ারা আপেল আরও কত রকমের ফল রাখে পাবকের জন্য। পাবক শিবুকে বলেছে এই বুড়ির ব্যাপারে। শিবুও দু-একবার এসেছে তার সাথে বুড়ির কাছে। কিন্তু শিবুকে বুড়ির যেন ঠিক মনঃ-পূত হয়নি। যে দু-দিন শিবু এসেছিল সেই দু-দিন বুড়ি পাবকের সাথে ভালো করে কথাও বলেনি। তাই শিবুকে আর নিয়ে আসে না পাবক; একাই আসে।

কিশোর মনে অজানাকে জানার আগ্রহটা বেশি থাকে। যা কিছু অসাধ্য মনে হয় তাকে সাধ্য করার জন্য উৎসুক হয়ে ওঠে এই সময় মন। পাবকেরও এখন ঠিক সেই অবস্থা। বুড়ি কেন তাকে শনি- মঙ্গলবার যেতে বারণ করেছে। সেটা জানার কৌতূহল পাবককে সেদিন টেনে নিয়ে গেল বুড়ির মন্দিরে। দিনটা শনিবার। স্কুল থেকে বেড়িয়ে পাবক শিবুর সাথেও দেখা করেনি সেদিন। সাইকেলটা নিয়ে সোজা ছুটে গেল সেই পাহাড়ের মন্দিরে। মন্দির থেকে বেশ খানিকটা দূরে সাইকেলটা একটা গাছে হেলান দিয়ে দেখতে থাকল পাবক। সেই মন্দিরে জনা-দশেক পুরুষ-মহিলার ভিড়। শাঁখ-ঘণ্টা বাজিয়ে পাহাড়ি কালির আরতি হচ্ছে, কিন্তু বুড়িকে কোথাও দেখা গেল না। এগিয়ে গেল পাবক মন্দিরের দিকে। মন্দিরের বাইরে এসে সেখানে থাকা মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখল। মন্দিরের ভেতর মায়ের মূর্তির পাশে বসে সেই বুড়ি। পুরোহিত পঞ্চপ্রদীপ দিয়ে মায়ের বিগ্রহের সাথে সেই বুড়িরও আরতি করছেন। চোখ বন্ধ করে সেই পাথরের বেদির উপর বসে আছে বুড়ি। আরতি শেষে সবাই বুড়ির পায়ে নমস্কার করছে, পাশে রাখা কত ধরনের ফল। চালভাজা, চিঁড়ে, মুড়কি। ধুপ আর ধূনার গন্ধে চারিদিক ম-ম করছে। বুড়ির পায়ে হাত রেখে কেউ বলছে, "মাগো আমার ছেলেটাকে একটা চাকরি দাও মা।" আবার কেউ বলছে, "মাগো আমার মাইয়ার জন্যি একটা ভালো ছিলা দেখে দে মা।"

বুড়ির চোখ বন্ধ, কেবল ঝোলা চামড়ার হাতটা সবার মাথায় ঠেকিয়ে আশীর্বাদ করছে সে। এত কিছু দেখার জন্য পাবক কোনমতেই তৈরি ছিল না। মনের ভেতর তখন হাজার প্রশ্নের ভিড়। যাকে সে এতদিন দেখে এসেছে সে-ই এই বুড়ি? সবাই এইভাবে পুজো করছে কেন তাকে? মায়ের মূর্তির সাথে তার আরতি হচ্ছে ! ব্যাপারটা কি? এই ধরনের নানা প্রশ্ন বিচলিত করে তুলল পাবককে। কিছুক্ষণ পর একে-একে সবাই চলে গেল সেখান থেকে। রয়ে গেল পাবক, সেই বুড়ি আর মা পাহাড়ি কালি। আরও মিনিট দশেক পর বুড়ি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল পাবক সেই ছেঁড়া আসনটা পেতে দাওয়ার খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে বুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। মুচকি হেসে বুড়ি বাইরে বেড়িয়ে এসে সেই কাঠের তক্তায় বসে বলল, "তুকে না বলেচিলুম আসবিনে শনি মঙ্গলবার।"

পাবকের মুখটা তখন লাল হয়ে উঠেছে। চোখ দুটো ফেটে জল আসতে চাইছে, কিন্তু তার মুখ ফুটে কোন কথা বের হচ্ছে না। বুড়ি এক দৃষ্টিতে পাবকের দিকে তাকিয়ে। আরও কিছুক্ষণের মৌনব্রত পালন করল দুজন। কেবল সেই না দেখা ঝর্ণার আওয়াজ আর হালকা হাওয়ায় পাতাগুলো ঝরে পড়ার আওয়াজ কানে আসছিল। কিছুক্ষণ পর বুড়ি নিজেই বলতে শুরু করল, "আমি তখন এই গাঁয়ের বউ হয়ে এয়েচি। গোলা ভরা ধান, ঝুড়ি ভরা সবজি সব থাকত আমার ঘরে। আমি আর আমার মরদ থাকতুম একটা কুঁড়েতে। খুব ভালবাসত উঁ আমায়। প্রতি বছর একবার করে এই পাহাড়ি মায়ের মন্দিরে জাঁকজমক করে পুজো হত। মেলা বসত। মাটির পুতুল কিনে দিত। মাথার খোঁপায় পলাশ লাগিয়ে দিত। খুব ভালো ছিলুম জানিস পিঙ্গল আমরা দুজন।" বুড়ি থেমে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকিয়ে রইল পাবকের দিকে। পাবক বুড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, "তারপর..."

বুড়ি আবার বলতে শুরু করল, "সে বছর গাঁয়ে মড়ক লাগল। অজানা জ্বরে এক-এক করে মরতে লাগল সব। গায়ে সেই জ্বর নিয়েই সে বনে গেছিল কাঠ কাটতি। কত বারণ করেছিলুম, কিন্তু আমার কথা শোনে নি। আর ফিরে আসেনি, পরদিন খুঁজতে গিয়ে দেখলুম পলাশের তলায় পড়ে রয়েচে। প্রাণ ছিল না সে দেহে। হাত-পা শক্ত হয়ে কাঠ হয়ে গেচিল। শরীরে পাহাড়ি পিঁপড়েরা বাসা বেঁধেছে ততক্ষণে। আমি বেঁচে রইলুম এই মড়কের সাক্ষী হয়ে।" আবার চুপ করে গেল বুড়ি। পাবক তখনও কৌতূহল মুখে তাঁর দিকে তাকিয়ে। দু-পক্ষেরই চোখের কোনে জল চিকচিক করছে। বুড়ি কাঠের তক্তা থেকে নীচে নেমে এল। পাবকের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, "পিঙ্গল বাপ আমার, কাল আসবি তো?"

পাবক মুখটা নামিয়ে বলল, " বাকিটা?"

বুড়ি আঙুল তুলে বাইরের দিকে দেখিয়ে বলল, " দেখ বাপ, সন্ধ্যে হয়ে আসছে। আজ বাড়ি যা বাপ, বাকিটা না হয় কাল শুনিস..."

আর কোন কথা বলেনি পাবক। দূরে পাহাড়ের মাঝে ধীরে-ধীরে মিলিয়ে আসা লাল সূর্যটাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল বাড়ির পথে।

#
দেখতে-দেখতে পাহাড়ে বর্ষা কেটে, লাল মাটির গরম কেটে, আবার ঘুরে কোকিল ডাক দিল। আবার গাছের সব পাতা নিজেদের ঝড়িয়ে দিল পলাশের লাল দেখাবে বলে। পাবক এখন প্রতিদিন আসে রংতা বুড়ির কাছে। বাপ মা সাধ করে নাম দিয়েছিল রংবতী। নিচের বাঙালি গ্রামে জন্ম হয়েছিল এক বর্ষার রাতে। সে কি ঝড়-বৃষ্টি। ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল নাম না জানা কত ঝর্ণা। বাঁধগুলো প্রাণপণে আঁটকে রেখেছিল বিশা- বিশাল জলাধার গুলোকে। বর্ষার এত রূপের মাঝে উজ্জ্বল রোদের মত জন্ম হয়েছিল রংরতীর। বাপ মহুয়া খেয়ে নেচেছিল। কত-কেউ দেখতে এসেছিল তাকে। তারপর বাপের সে কি কাজ। পুরুলিয়া শহরের স্কুল থেকে ডাক এল স্কুল পরিষ্কারের কাজের জন্য। সংসারে অভাব বলতে আর কিছু রইল না। তারপর এক-এক করে দীর্ঘ পনেরোটা বসন্ত পেরিয়ে এ গাঁয়ে আসা। বাপ মায়ের অমতে সাঁওতালি ছেলেকে বিয়ে করেছিল রংবতী। তাই বাপ-মা আর কোনদিন তার মুখটাও দেখেনি। এখানেও স্বামীর তিনকুলে কেউ ছিল না। সংসারটাকে মনের মত সাজিয়েছিল। তারপর সময়ের সাথে-সাথেই আবার এক-এক করে সব হারিয়ে বসে থাকল একা রংবতী।

এখন মঙ্গল কি, আর শনি কি, যে কোন দিনেই পাবক আসে এখানে। কাটিয়ে যায় একটা ভরা দুপুর অথবা একটা মনমরা বিকেল। নানা রকম ফল খেয়ে যায়। পরিবর্তে কিছুই দিতে পারে না সে। এই নিয়ে তাঁর আক্ষেপ চরম সীমায়। এমনি এক মঙ্গলবারের দুপুরে পাবক সাইকেলটা গাছে হেলান দিয়ে উপস্থিত বুড়ির মন্দিরে। বুড়ি তখন সবে খেতে বসেছে। ক্ষুদের চালের ভাত, তাতেই ডাল আর কিছু সবজি দিয়ে হলুদ ছাড়া, লবণ ছাড়া খিচুরি। আগেও বুড়িকে এই খাবার খেতে দেখেছে পাবক। আজ যেন বড় খারাপ লাগছে তার। বুড়ি ভালবেসে নিজের সব ফল গুলো তাকে খেতে দিয়ে দেয় তার পরিবর্তে সে বুড়িকে কিছুই দিতে পারে না। বুড়ি নিজেই বারণ করেছে। তার এসব বাইরের খাওয়া চলে না। কেন চলে না, সে প্রশ্নের উত্তর যদিও এখনও অজানা পাবকের কাছে। পাবককে দেখে বুড়ি খাওয়া ছেড়ে উঠে আসনটা পেতে দিল। "এয়েছিস পিঙ্গল। আয় বাপ আমার, তোর কথাই ভাবছিলুম।"

পাবক মুখটা শুকনো করে বলল, "প্রতিদিন এই আলুনি খিচুরি খেতে ভালো লাগে তোমার?"

বুড়ি ফোকলা দাঁতে হো-হো করে হেসে উঠে বলল, "আমার যে আমিষ খেতে নেই বাপ।"


পাবক উঠে দাঁড়িয়ে বলে, "কেন?"

বুড়ি কিছু না বলে খেতে থাকল। হয়ত খুব খিদে পেয়েছে। পাবক মুখটা নিচু করে বলল, "তুমি আমাকে কত ফল দাও, চালভাজা দাও। আমি তোমাকে কিছুই দিতে পারিনা। আমার দুঃখ লাগে, কষ্ট লাগে।"

বুড়ি হেসে বলল, "তুর থেকে আমি ওসব কিছু লিব না রে বাপ। তুর থেকে আমি ঠিক সময়মত আমার প্রাপ্য চেয়ে লিব। দিবি তো আমায়?"

পাবক মুখটা শুকনো করে বলে, "আমার কাল পরীক্ষা শেষ। বাবা আবার বদলি হয়েছে জলপাইগুড়িতে। আমি আর পাঁচদিন এখানে আছি। তারপর চলে যাব, কখন আর চাইবে তুমি?"

কথাটা শুনে বুড়ির মুখটা একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। মুখ নাড়াও বন্ধ করে দিল সে। আশেপাশের পাতা-ঝরা বন্ধ হয়ে গেল। সেই ঝর্ণার আওয়াজটাও আর কানে এল-না বুড়ির। একভাবে তাকিয়ে রইল পাবকের দিকে। অনেকক্ষণ, কতক্ষণ তারা নিজেরাও জানে না। পাবক মুখটা নিচু করে বলল, "বুড়ি, আমাকে আর দেখতে পাবে না। মনে থাকবে তো আমায়?"

কেঁদে ফেলল বুড়ি। পাবকের মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে খোঁনা স্বরে বলল, "মনে রাখার দরকার পড়বেক লাই বাপ। তুই একবার কাল আসিস এথা। তুকে অনেক কিছু বলব আমি। আসবি তো বাপ, ও পিঙ্গল আসবি তো?"

পাবক বুড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, "আসব।"

পাবক জানে না এই রংতা বুড়ির সাথে তার কি সম্পর্ক। কেন, কিসের টানে সে এই জঙ্গলের ভিতর এই বুড়ির কাছে বারবার আসে! চালভাজা খেতে, নাকি ফল খেতে। ঘরে রাখা ফল তার মুখে রোচে না। আর বুড়ির দেওয়া ফল কত আনন্দ নিয়ে খায় সে।

#
দু-দিন রাতে ঘুম হয়নি পাবকের। এই পাহাড় ছেড়ে এখানকার জঙ্গল ছেড়ে আবার তাকে চলে যেতে হবে অন্য ঠিকানায়। আর কোনদিন হয়ত ফিরবে না সে এই জঙ্গলে। শিবুকে খুব মনে পড়বে তার। এখানকার শাল-পিয়াল-পলাশের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোকে একটা বন্ধ বাক্সে বন্দী করে আবার নতুনের আশায় এগোবে সে সামনের দিকে। সব থেকে মনে পড়বে বুড়ির কথা। তার চালভাজা, তার ঝোলা চামড়ার হাতের সেই মাথায় হাত বোলান। তার সেই ডাক, "পিঙ্গল এয়েছিস?" কে এই বুড়িকে প্রতিদিন দেখতে যাবে। একাই ওই জঙ্গলে পরে থাকবে সে। ভেবেই কেমন যেন একটা চাপা কষ্ট হচ্ছে পাবকের।

আজ রাতে তাদের ট্রেন। আর কোনদিন আসবে না সে এই বনে। সেই না দেখা ঝর্ণাটার আওয়াজ আর কোনদিন শুনতে পাবে না সে। আজ শেষ দেখা বুড়ির সাথে। কাল বুড়িকে মায়ের থেকে টাকা নিয়ে একটা নতুন কাপড় দিয়েছে পাবক। সেটা পেয়ে বুড়ি যে কি খুশি হয়েছে। তার দু-চোখ দিয়ে ঝরে পড়েছে সেই খুশী। মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে বলেছে, "ও পিঙ্গল, বাপ আমার ভালো থাকিস। এই বুড়িকে মুক্তি দিস বাপ। তুর সব ইচ্ছে পূরণ হোক বাপ আমার।"

এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতে সাইকেলটা নিয়ে পাহাড়ের মোড় ঘুরে এগিয়ে গেল পাবক। আশে-পাশে তাকিয়ে দেখতে লাগল তার এই দুই বছরের শাল পিয়াল বন্ধুদের। ঝরে পড়া পলাশেরা যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। জঙ্গলটা যেন চেঁচিয়ে বলছে "যাস না পাবক আমাদের ছেড়ে যাস না লক্ষ্মীটি।", কিন্তু তার কাছে কোন উপায় নেই। না চাইতেও তাকে যেতেই হবে। সবাইকেই যেতে হয় একদিন। এই যেমন পলাশও বছরে একবার আসে আবার চলে যায়। পলাশ তবু প্রতিবছর আসে, কিন্তু পাবক হয়ত আর আসবে না। মন্দিরের কাছাকাছি এসে চমকে গেল পাবক। জনা-দশেক লোক জড়ো হয়ে আছে আশে-পাশে। তারপরেই মনে পড়ল, আজ তো শনিবার। তাই সবাই পুজো দিতে এসেছে হয়ত। কিন্তু আজ কোনও শাঁখ-ঘণ্টার আওয়াজ আসছে না। স্পষ্ট সেই ঝর্ণার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সাইকেলটা গাছে হেলান দিয়ে এগিয়ে গেল পাবক। মন্দিরের সামনে গিয়ে সেদিকে তাকাতেই বুকটা খালি হয়ে গেল তার। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। মন্দিরের দাওয়ায় বুড়িকে একটা ছেঁড়া কাঁথার উপর শোয়ানো। পরনে পাবকের দেওয়া সেই নতুন শাড়ি। মাথার কাছে প্রদীপ, ধূপ জ্বলছে। বুড়ির নিথর দেহটা শুয়ে আছে শেষ বিছানায়।

ধীরে-ধীরে বুড়ির পাশে গিয়ে বসল পাবক। দু-চোখ বেয়ে জল পড়ছে তার। বুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে বুড়ির শেষ কথাগুলো তার কানে ভেসে উঠল, "মরদটা মরে গেল আমি একা হয়ে গেলুম। ওদিকে মা-বাপ তো কবেই পগার পার। গ্রামের লুটুকে আমি বড় ভালবাসতুম। আমার মরদটাও ওকে ভালোবাসতো। ছোট্ট ছিলাটাকে কাঁধে নিয়া পাহাড়ে-পাহাড়ে ঘুরে বেড়াইতুম। সেই ছিলাটার যখন সেই জ্বর হল, আমি পাহাড়ি কালির এই মন্দিরে ধরনা দিয়ে পরে রইলুম। মাকে বললুম, তুই উঁকে ঠিক কর নয়ত আমি এখানে তোর সামনে মরবো। জানিনে মা সত্যি শুনছিল কিনা। মায়ের পা ধোয়া জল নিয়ে গিয়ে খাওয়াতে ছিলে একেবারে ভালো হয়ে গেল। গ্রামের যে ক'জন বেঁচেছিল সবাই মায়ের পা ধোয়া জল খেল। মড়ক সত্যিই গ্রাম থেকে চলে গেল। আর আমাকে এই মানুষ গুলার দেবী বানিয়ে গেল। সেই তবে থেকে এই মন্দিরে দেবীর সাথে উহারা আমারও পূজা করে। একে-একে সবাই গ্রাম ছেড়ে চলে গেল। পড়ে রইলুম আমি আর আমার এই পাহাড়ি মা। ধীরে-ধীরে আমি রংবতী থেকে রংতা দেবী হয়ে উঠলুম।" বুড়ি থেমেছিল। সবটাই হাঁ করে শুনেছিল পাবক। কিছুক্ষণ পর বুড়ি আবার শুরু করেছিল, "ও পিঙ্গল, আমি জানি আমার মরার পরে এরা কেউ আমায় আগুন দেবে না। দেবীকে আগুন দিয়ে কে পাপ লিবে বল। হিন্দু ঘরের মিয়ে আমি। একটু আগুন না পেলি হয়! মরেও ঘুরতি হবে এই পাহাড়ে, মুক্তি পাবক লাই যে। তাই তুকে বলেছিলুম না, তুর থেকে চেয়ে লিব। আজ চাইলুম। আমি মরার পর আমার মুখে আগুনটুকু দিয়ে দিস বাপ আমার।"

পাবক ভেজা চোখে বলেছিল, "কি যে বল বুড়ি। খামোকা এখন মরতে যাবে কেন? তুমি তো দেবী। দেবীরা আবার মরে নাকি?"

বুড়ি হেসে উত্তর দিয়েছিল, "আমাকে দেবী উহারা বানিয়েছে। আর আমি সঙ সেজে মায়ের চরণে বসে গিচি। তা ছাড়া আর উপায় কি ছেল বল? কে আমায় খেতে দিত? কেই বা রাখত? কেউ তো বেঁচে ছেল না। কথা দে পিঙ্গল আমার মুখে আগুনটুকু দিবি তুই। কথা দে।"

পাবক মাথাটা নিচু করে বলেছিল, "আমার নাম পিঙ্গল নয়, আমার নাম পাবক। এতদিন তোমার এখানে এলাম, কই কোন পিঙ্গলকে তো একবারও দেখলাম না।"

বুড়ি জোড়ে-জোড়ে হেসে বলেছিল, "যে পিঙ্গল, সেই পাবক সেই আমার আগুন।"

শিবু ঘাড় ধরে নাড়িয়ে দিল পাবককে। পাবকের ঘোরটা কেটে চোখ থেকে টপটপ করে দু-তিন ফোঁটা জল পড়ল। শিবুকে গতকাল সবটাই বলেছিল পাবক। রংতা দেবীর মরার খবর আশেপাশের গ্রামে ছড়াতে বেশি সময় লাগেনি। খবরটা শুনেই শিবু সোজা এখানে এসেছে। সবাই মিলে শাল-কাঠ জোগাড় করল। তারপর মন্দিরের পিছনের সেই ঝর্ণার ধারে দাহ হল বুড়ির। আগুন দিল পাবক। দু-একজন আপত্তি করেছিল। বলছিল ,"উঁ দেবী। উঁরকি মরণ আছে? উঁকে রেখে দে বটে, মা আমাদের আবার বেঁচে উঠবেক।"

পাবক মানে নি সে কথা। পুলিশের ভয় দেখিয়ে রংতা দেবীর মুখাগ্নি করল সে। আসলে পাবক এতক্ষণে বুঝতে পারল। পিঙ্গল বলে আসলেই কেউ ছিল না। পাবক নামের অর্থ আগুন আর পিঙ্গল নামের অর্থও আগুন। সে জানত দেবীকে কেউ আগুন দেবে না। তাই সে নিজের হাতে শেষ আগুন জোগাড় করে গেছে। পাবক সেই রাতেই ট্রেনে উঠল। পিছনে পরে রইল শাল-পিয়াল-পলাশের সেই পাহাড়, সেই মন্দির, মা পাহাড়ি কালি আর বুড়ির সেই ডাক, "ও পিঙ্গল, বাপ আমার…এয়েচিস?"
( সমাপ্ত )


Next Bangla Story

All Bengali Stories    104    105    106    107    108    109    110    (111)     112    113   


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717