অনিচ্ছার নির্বাসন
- সজীব পাল, বাঁশপুকুর, সোনামুড়া, সিপাইজলা, ত্রিপুরা
একটি নির্বাচিত গল্প
নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার, ২০২০, ত্রিপুরা
-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার - মে, ২০২৪' স্বরচিত গল্প লেখার প্রতিযোগিতা, ( প্রতি বছর মে মাসে )
Result
--------------------------
■
"আরে মশাই এই বৃষ্টি বাদলের দিনে কোথায় যাওয়া হচ্ছে?"
"ঘরে বসে হঠাৎ মনটা আনচান করে উঠলো, কেন জানি উদাস হয়ে গেলাম আচমকা!"
"শরীর ঠিক আছে তো? বয়স হলে এক জ্বালা, আজ এই কাল সেই!"
"না শরীর ঠিক আছে। ব্যাপারটা কি জানেন, পত্রিকাটা হাতে নিয়ে বারান্দায় কাঠের চেয়ার বসলাম। তারপরেই নামল বৃষ্টি । আপনি তো জানেন আমার বাড়ি আশেপাশে প্রচণ্ড গাছ গাছালি...
একলা বুড়া-বুড়ি থাকি, তাই আর সৌন্দর্যের ধার ধারি না । আমি পত্রিকাটা নামিয়ে গাছদের দিকে তাকিয়ে রইলাম বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা আর পাতাদের মধ্যে কি অদ্ভুত খেলা; বৃষ্টি পড়ছে আর পাতাগুলি কাঁপছে।
আমি মশগুল হয়ে পড়লাম, কিন্তু একটু পড়েই ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেলো। উনপঞ্চাশ বছর আগের কথা। সত্যি বলতে বাংলাদেশ তো আমার জন্মভূমি, তাই ওইখানের বৃষ্টি আর এখানের বৃষ্টি অনেক তফাত দেখি।
সেই কবে শরণার্থী হয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করলাম, আর সেই সোনার বাংলায় যাওয়া হয়নি।
কেমন আছে আমার সোনার বাংলার মানুষ? কেমন আছে জীবনানন্দের বাংলার রূপ? কেমন আছে আমার দুঃখী শহর? এই ভেবেই মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। তাই ভাবলাম ছাতাটা নিয়ে একটু বেড়িয়ে আসি।"
" কি বলেন মশাই! এত বছর হয়ে গেল কখনো যাননি বাংলাদেশ! তাছাড়া আগে তো এই দেশের মানুষ ওই দেশে অবাধে বিচরণ করতে পারতো, এখন পাসপোর্ট লাগে।"
" যায়নি কারণ, ওই মুক্তি যুদ্ধের সময় আমার বয়স একুশ, কাজেই চাইলে মুক্তি যুদ্ধে নিজের নাম লেখতে পারতাম, কিন্তু তা না করে কঠোর বিপদে আমার পবিত্র মাটিকে রেখে এসে পড়েছি।
তাই ভাবলাম বিপদে যখন পাশে থাকতে পারিনি তখন সুখের সময় গিয়ে কি লাভ? তা আমি না হয় মনকে হালকা করার জন্যে বাইরে আসলাম বৃষ্টিতে। কিন্তু আপনি?"
"আমি যাচ্ছি অনেকটা অনিচ্ছাকৃত। সুধীরবাবুর মেজো ছেলে রতনের বউ শাশুড়ির সাথে ঝগড়াঝাঁটি করে নাকি ঘরে রাখা এনডোসালফেন রাগের মাথায় খেয়ে ফেলে।
এইবার বুঝুন মশাই, আজকালকার বউদের কি মারাত্মক সাহস। শুনেছি আপনাদের যুগে বউরা শ্বশুর-শাশুড়ির উপরে কোনও কথা। বলতো না।
এখন তো শুনি কোনও-কোনও বউ নাকি স্বামীকে বেদম মারে। আচ্ছা আপনার ছেলে বউয়ের খবর কি?"
"ওরা আছে এখন ব্যাঙ্গালোর। আপনি কি চাকরিটা পেয়েছেন?"
"পেয়েছি। আমাকে তুমি করে বলবেন, আপনার ছেলের বয়েসি।"
"আচ্ছা ঠিক আছে, যাই এখন বৃষ্টি কিছুটা কমছে।"
আমরা একটা মুদি দোকানের ঝাপের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মিনিট চল্লিশ পর বৃষ্টি কমলে, অঞ্জন বাবু বিষণ্ণ ভারাক্রান্ত উদাসী মন নিয়ে উত্তর দিকে চলে গেল।
আমি একটা রিকসা ধরে কুমারঘাট রেল স্টেশনের দিকে যাচ্ছি। অঞ্জন বাবুর সাথে কথা বার্তায় জানা গেল তিনি প্রায়ই জন্মভূমির কথা ভেবে কষ্ট পান।
ওনার খুব ইচ্ছে, তিনি যদি বাংলাদেশে মরতে পারতেন তবে তার আত্মা শান্তি পেতো। ছেলে ব্যাঙ্গালোর থেকে ফোন করলেই বলে পাসপোর্ট করার জন্য, কিন্তু তিনিই সাহস পান না।
ওনার ভয়, যদি তার স্বপ্নের বাংলা, স্বপ্নের ঢাকা শহর আগের মতো শান্ত ও মানবতার না থাকে? তিনি প্রায়ই টেলিভিশনে বাংলাদেশের নানান অপ্রীতিকর ঘটনাগুলি দেখেন।
উনি বলেন, পরাধীন বাংলাতেও বাংলার নারীর ধর্ষণ হয়েছে আর স্বাধীন বাংলাতেও নারীরা ধর্ষিত। এই ভয়ে তিনি যেতে চান না।
উনি ওনার স্বপ্নের বাংলা নিয়েই এইভাবে বেঁচে থাকতে চান বাকি জীবন।
কুমারঘাট স্টেশনে নেমে পরিচিত একটা দোকানে চা-খেলাম। টাকাটা দোকানদারকে দিয়ে আরেকটু এগিয়ে বিস্মিত হলাম । হাত দশেক দূরে একটা মেয়ে, বয়স উনিশ কি কুড়ি।
জিন্স পেন্ট এবং কটনের টি-শার্ট পড়া দেখতে খুব সুন্দর, চুলগুলি কোঁকড়ানো। হাতের রুমাল দিয়ে ঘন-ঘন চোখ মুছছে। পাশে আবার বড় ব্যাগ। আশে-পাশেও কেউ নেই।
একবার ভাবলাম জিগ্যেস করি, কিন্তু কি ভেবে যেন আর করলাম না। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে; আমাকে একটু শিলচর যেতে হবে। ট্রেনে উঠতে-উঠতে দেখছি মেয়েটি ঠিক আগের অবস্থায় বসে আছে এবং চোখ মুছছে।
জিগ্যেস না করা অনুচিত হয়েছে; একলা মেয়ে হয়তো কোনও বিপদে পড়েছে।
ট্রেনের জানালার পাশে বসে আছি। ট্রেন আস্তে চলছে। যত এগোচ্ছি তত পেছনে ফেলে আসছি ঘাস মাঠ, ওই সুদূর প্রান্তে গরু এবং স্টেশনের ওই অচেনা মেয়েটিকে।
যাচ্ছি তো অনেক কাছে, তবুও মন খারাপ লাগছে। যদি কখনও আর না ফিরি? মানুষের মৃত্যু আজ জলের মতো সহজ। আমি এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি, আমার পাশে একজন কম বয়সী মহিলা এবং
পাঁচ ছয় বছরের একটি বাচ্চা বসে আছে। বাচ্চাটি তার মাকে জিজ্ঞেস করছে,"মা আমরা কবে ফিরবো?"
"জানি না!"
"বাবা কাজ থেকে বাড়ি ফিরে আমাকে না দেখলে কষ্ট পাবে ?"
মহিলা কথা বলছে না। ওই মহিলাও জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখের ত্বক মসৃণ, বাতাসে চুল গুলো উড়ে যতবার চোখে উপর আসছে ততবার আঙুল দিয়ে কানে আটকে দিচ্ছে।"
"ও মা! কথা বলছ না যে! বাবা কষ্ট পাবে না?"
"তুমি আর একটা কথাও বলবে না, চুপ করে থাকো। তোমার বাবা কষ্ট পাবে কি পাবে না আমি কি করে জানবো?"
"মা আমি জল খাবো।"
মহিলার কাছে জল নেই, দেখে বুঝা যাচ্ছে। আমার চোখে চোখ পড়ল, কিন্তু আজব মহিলা, একটিবারও জল চাইল না। আমি ট্রেনে উঠার সময় এক লিটারের একটা জলের বোতল। নিয়েছিলাম;
বললাম, "এই যে শুনছেন?"
নরম চোখে তাকিয়ে মহিলাটি বলল,"জী, বলুন?"
"আপনার ছেলে বোধ হয় জল চাইছে!"
"হুম, কিন্তু কোথায় পাই?"
"আমার কাছে আছে, এই নিন।"
কথাবার্তার মাধ্যমে জানতে পারলাম, ভদ্রমহিলার স্বামী সারাদিন নেশা করে এবং প্রতিদিন মারধর পর্যন্ত করে। ভদ্রমহিলার বাপের বাড়ি শিলচর, তাই স্বামী যখন কাজে যায়
তখন ছেলেকে নিয়ে চলে আসে এখানে। আমার সহানুভূতি হল উনার প্রতি। এত সুন্দর স্ত্রীর উপর স্বামীটি হাত তুলে কীভাবে? এমনিতে সুন্দরী মেয়েরা ভালোবাসা কমই পায়।
তিন মাস পর আমি একদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে শুনতে পেলাম, অঞ্জন বাবু নাকি গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করে দুই দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এখন বাড়িতেই চিকিৎসা হচ্ছে।
অফিসের পোশাকেই তাদের বাড়িতে গেলাম। বৃদ্ধ মানুষ, ছেলে আর বউ ব্যাঙ্গালোর থেকে এসেছে কি না, কে জানে। সারা উঠানে ঘাস, বাড়িকে ঘিরে বড়-বড় গাছ।
উত্তরের ভিটে। দুই রুমের লম্বাটে কংক্রিটের বারান্দাযুক্ত ঘরটি দেখতে বেশ ভালোই লাগে ! চমৎকার সবুজায়ন দেখে চোখ জুড়িয়ে আসে, মনে হয় আগেকার ঋষি-মুনিদের ধ্যান কুঠির।
দরজা খোলা দেখে নক না করেই ঘরে ঢুকে গেলাম।"আরে বাবা তুমি! এসো-এসো বসো!"
"আপনাকে উঠতে হবে না," আমি সিঙ্গেল সোফাতে বসলাম। "আপনার শরীর এখন কেমন মশাই?"
"বয়স হয়েছে এখন কি আর ভালো থাকার জো আছে বাবা? কি ভেবে হঠাৎ অফিসের পোশাকেই চলে আসলে?"
"আপনার অ্যাকসিডেন্টের কথা শুনেছি গতকাল, কিন্তু আসতে পারিনি।তাই আজকে অফিস থেকে সোজা চলে এলাম।"
"তোমার নামটা যেন কি বাবা? আর শুনো, আমাকে মশাই-মশাই করবে না, আঙ্কেল ডাকতে পারো না"
"আচ্ছা বেশ। আঙ্কেল আমার নাম নীলদ্বীপ ভট্টাচার্য। তবে আপনি 'নীল' বলে ডাকতে পারেন। আচ্ছা, আপনাকে দেখতে আপনার ছেলে আসেনি?"
"না বাবা, ওদের কাজের নাকি ব্যস্ততা খুব। তবে আমাকে দেখার জন্য তোমার আন্টির বোনঝি এসেছে কয়েকমাস আগে, আর যায়নি।"
"উহু, আন্টি কোথায়? দেখছি না কোথাও?"
"প্রেসক্রিপশনের কয়েকটা ওষুধ বাকি ছিল ওইটা আনতে গেছে। বসো আমি তুলিকে চা-দিতে বলি।"
অঞ্জন বাবু চা-এর কথা বলতেই পাশের ঘর থেকে একটি মেয়ের কণ্ঠ শোনা গেল। চা আসতে-আসতে প্রায় আধা ঘণ্টার মতো লাগলো।
এতক্ষণ ধরে অঞ্জন বাবুর আগের দিনের কথা গুলি শুনলাম। তৎকালীন বাংলাদেশের কথা, খুব সুখী ছিল তখনকার মানুষ। এখনকার মানুষ কর্মব্যস্ততার মধ্যে নিজেকে নিজেই হারিয়ে ফেলে।
এরই মধ্যে একটা অদ্ভুত ঘটনা গেল। ওই যে সেদিন শিলচর যাওয়ার সময় কুমারঘাট স্টেশনে একটা মেয়ে রুমাল দিয়ে চোখ মুছছিল। সে অঞ্জন বাবুর স্ত্রীর বোনঝি, এখন আমাদের জন্য চা-এর কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,"আচ্ছা, আপনি কি এখানে আসার দিন রেল স্টেশনে বসেছিলেন?"
সে একটু লজ্জা পেলো। এই কথার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। মৃদু হাসিটা ঠোঁটে আটকে রেখে বলল,"হুম।"
"কিছু মনে করবেন না, ওইদিন কি আপনি কোনও কারণে কাঁদছিলেন?"
সে আর কিছুই বলল না, লজ্জা পেয়ে চুপচাপ কাপ নিয়ে চলে গেল। অঞ্জন বাবু বললেন," খুব লাজুক মেয়ে। ওইদিন তাকে আনতে যাওয়ার কথা ছিল আমার কিন্তু ভুলে গেছিলাম।
তাই সে নাকি ভয়ে... অচেনা জায়গায় একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল..."
"আচ্ছা তাহলে আজ উঠি আঙ্কেল। আবার আসবো। সন্ধ্যা নামবে এখন।"
"আবার এসো।"
আমার কেন জানি মনে হল আমাকে আবার আসতেই হবে। পৃথিবীর এমন কিছু-কিছু জিনিস আছে যা একবার যদি মনে রেখাপাত করে তাহলে মন তার পানেই মন ছুটে চলে তাকে
আরও কাছে পাওয়ার জন্য। অথচ মন এটা জানে না, প্রিয় জিনিসটাকে কতটা কাছে পেলে বলা যায় এইখানেই মনের আকাশ শেষ। আচ্ছা তবে কি আমার তুলিকে ভালো লাগতে আরম্ভ করেছে?
( সমাপ্ত)
অন্যান্য গোয়েন্দা গল্প ও উপন্যাস:
নয়নবুধী
কান্না ভেজা ডাকবাংলোর রাত
মাণিক্য
সর্দার বাড়ির গুপ্তধন রহস্য
প্রেমিকার অন্তর্ধান রহস্য
লুকানো চিঠির রহস্য
সে তবে কে?
All Bengali Stories
62
63
64
65
66
67
68
69
(70)
71
## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers.
The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation.
Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##
◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717