-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার - মে, ২০২৪' স্বরচিত গল্প লেখার প্রতিযোগিতা, ( প্রতি বছর মে মাসে )
Result
--------------------------
List of all Bengali Stories
◕
ওরা থেকে যায়
লেখক - রাজকুমার মাহাতো, সম্পামির্জানগর, মহেশতলা, কলকাতা
( নির্বাচিত গল্প, 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার - মে, ২০২৩' )
##
(1)
সাত্যকির গাড়িটা যখন মূল সড়ক ছাড়ল তখন প্রায় অনেক রাত্রি। এখান থেকে পুরোটাই গ্রাম্য-পথ। যদিও পিচেরই রাস্তা, তবে মূল সড়কের তুলনায় অনেকটাই সংকীর্ণ। গাড়িটা 'খাতরা' পেরিয়ে গেছে প্রায় একঘণ্টা আগে। তারপর মূল সড়ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই গ্রাম্য রাস্তায় এসে ঢুকেছে। অন্ততপক্ষে গুগল ম্যাপ তাই বলছে। এখান থেকে এখনও প্রায় পঞ্চাশ মিনিট গেলে তবে লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে। সামনের সিটে 'হাঁ' করে ঘুমাচ্ছে সাত্যকির স্ত্রী ভারতী, আর পিছনের সিটে ঘুমাচ্ছে সাত্যকির মা শৈলবালা; তার কোলে সাত্যকির বছর পাঁচেকের মেয়ে আনন্দি। আনন্দি কিন্তু ঘুমের মধ্যেও ওর পুতুলটা হাতছাড়া করেনি। পুতুলটাকে ঠিক জড়িয়ে শুয়েছে মেয়েটা।
গাড়ির স্পিড ত্রিশের উপরে তোলা যাচ্ছে না, রাস্তার অবস্থা ভীষণ খারাপ। তাছাড়া কোথাও একটা লাইট পোষ্ট নেই। গাড়ির নিজস্ব আলোতে যতটা দেখা যায় আর-কি! যদিও আর কিছুক্ষণ পরেই ভোর হয়ে যাবে। সাত্যকি নিজের হাতের ডিজিটাল ঘড়িটার দিকে তাকাল, তিনটে বেজে চল্লিশ মিনিট। তার মানে সাড়ে চারটে নাগাদ ওরা পৌঁছে যাবে ওদের গ্রামের বাড়ি। আসলে সাত্যকি এই প্রথম তার গ্রামের বাড়িতে আসছে, তাও আসত না। ভারতীর জেদের জন্যই তাদের এই বাড়িতে আসা। এই বাড়ির সাথে সম্পর্ক চুকেছে আজ প্রায় বত্রিশটা বছর। সাত্যকির জন্মের নয় মাস পরেই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যায় ওর বাবা নিহাররঞ্জন সামন্ত, তারপর আর একবারের জন্যও তিনি আসেননি এই বাড়িতে, আর ছেলে বউ কাউকে আসতেও দেননি। অথচ এই বাড়ির পরিচর্যা করার জন্য বলাই কাকাকে তিনি প্রতি মাসে টাকা পাঠাতেন।
নিহাররঞ্জন পরলোক বাসী হয়েছেন আজ মাস ছয় হলো। শ্রাদ্ধ-শান্তি মিটে যাওয়ার পরের দিন থেকেই শৈলবালা বৌমার কাছে এসে বলতে শুরু করেছিলেন, "বৌমা, একটিবার আমায় আমার গ্রামের বাড়ি নিয়ে চ তোরা। সত্যকে একবার রাজি কর মা।"
ভারতীরও শখ গ্রামের পরিবেশে কিছুদিন কাটানোর। এমনিতে এদিক-ওদিক ঘুরতে গেলে গ্রাম্য পরিবেশ পাওয়া যায় বটে, কিন্তু সেগুলোতেও কেমন একটা কৃত্রিমতার ছোঁয়া থাকে। আর এটা তো নিজেদের বাড়ি। এখানে নিজেদের মত করে কিছুদিন কাটিয়ে আসতে মন্দ কোথায়? সে জানত, সাত্যকি তার কথাকেও অতটা পাত্তা দেবে না। কারণ, যতই শহরের মডার্ন পরিবেশে মানুষ হোক, সাত্যকির মধ্যে পুরুষালী একটা অহংকার লক্ষ্য করেছে ভারতী। সেটা কিনা তার বাবা নিহারবাবুর থেকেই পাওয়া। তাই ফন্দি আঁটল শাশুড়ি-বউমা মিলে। সাত্যকির সামনে মেয়েকে দাঁড় করিয়ে দিল। মেয়েকে বোঝাল গ্রামে গেলে অনেক চকলেট পাবে সে। সেখানে নাকি চকলেটের বাগান আছে। মেয়ের জেদে আর অমত করতে পারল না সাত্যকি। অফিস থেকে পনেরো দিনের মেডিক্যাল লিভ নিয়ে চলে এল তাদের গ্রামে, যার নাম 'আখুটা'।
মিনিট পনেরো পরে ঘুম ভাঙল ভারতীর। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে বলল, "কিগো, এখনও পৌঁছলাম না। আর কতটা?"
সাত্যকি বিরক্ত হয়ে বলল, "'আর পৌঁছলাম না!!' এখনও প্রায় আধাঘণ্টা। কোন গো-ভাগারে আমায় নিয়ে এলে তোমরা কি জানি!"
ভারতী মুখ টিপে হেসে পিছনে তাকিয়ে দেখল। নাতনি আর ঠাকুমা মিলে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে তখনও।
(২)
সাত্যকিরা যখন বাড়িতে এসে পৌঁছল, তখন প্রায় আলো ফুটে গেছে চারিদিকে। একেই গ্রীষ্মকাল, তার উপর চরম গরমে এসি থেকে বেরিয়েই সাত্যকির সারা শরীরটা যেন জ্বলে উঠেছিল। বড় দো-তলা জমিদার আদলের বাড়ি। মোটা-মোটা থাম আর কড়িবরগা দেখে ভারতীর মন ভরে উঠেছিল। শৈলবালা তো বাড়িটাকে দেখে কেঁদেই ফেলল। ভারতী সান্ত্বনা দিল বটে; কিন্তু মন কি আর মানে। সেই কোন কালে বাড়িটাকে একা ফেলে গিয়েছিল তারা; আর ফেরেনি। সাত্যকি মেয়েকে কোলে নিয়ে বলল, "বলাইদা আমাদের রুমটা দেখাও, শোবো এবার..." পরক্ষণেই বিরক্ত স্বরে বলল, "আর শোওয়া। এসি তো নেই।"
বলাইদা ব্যাগগুলো নামাতে-নামাতে হেসে বলল, "গ্রামের বাড়িতে এসির দরকার হয় না ছোটবাবু। আপনি ঘরে গিয়ে ফ্যানটা চালান, দেখবেন এসির মত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে ঘর।"
সারা সকালটা দুই শাশুড়ি-বউমা মিলে এদিক-ওদিক বাড়িটা ঘুরে দেখল। শৈলবালার কত স্মৃতি মনে পড়ছে বাড়িটাকে দেখে। সেই কোন-কালে বিয়ে হয়ে আসা এই বাড়িটাতে, তারপর এখানেই সাত্যকির জন্ম। সেই তুলশী তলা, সেই ঠাকুরদালান। সবটা যেন কেমন অচেনা হয়ে গেছে তার কাছে। শহরের চার দেওয়ালে বন্দির মধ্যে থেকে অতীতটাকেই বন্দি করতে ভুলে গিয়েছে সে।
দুপুরের দিকে আনন্দি ঘুরতে-ঘুরতে গিয়ে পৌঁছল দক্ষিণ দিকের একটা ঘরে। ঘরটার দরজা খোলা দেখে সে ঢুকে গেল ভিতরে। কোন আসবাবপত্র নেই ঘরটায়। এদিক-ওদিক দেখল আনন্দি। তারপর তার নজর গেল নিচে পরে থাকা একটা পুতুলের দিকে। সে সেটা তুলে নিলো। পুতুলটা পুরানো হলেও এখনও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। আনন্দি সেটা পেয়ে ভীষণ খুশি হয়ে যেই কিনা ঘর থেকে বেরোতে যাবে। অমনি আচমকা একটা আওয়াজে সে পিছন ফিরে তাকাল। কেউ যেন শান্ত স্বরে বলল, "ওটা কিন্তু আমার পুতুল!"
আনন্দি এদিক-ওদিক তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেল না। সে আবার দরজার দিকে এগোতেই আবার একটা স্বর শোনা গেল, "তুমি কি কলকাতা থেকে এসেছ?"
আনন্দি আবার পিছন ফিরে তাকাল। মনে-মনে খুব ভয় পেল, কিন্তু মুখাবয়বে তার বিন্দুমাত্র ছাপ এল না। এই স্বভাবটা সে বাবার মতই পেয়েছে। হাজার ভয়ে, হাজার টেনশনেও সাত্যকির মুখ দেখে কিছু বোঝা যায় না। আতো-আতো করে আনন্দি প্রশ্ন করল, "তুমি কে? কোথায় আছ তুমি?"
সেই একই রকম শান্ত স্বরে উত্তর এল, "আমার নাম সতু। তোমার নাম আনন্দি, তাই না?"
আনন্দি কিছুটা ভরসা পেল। নাহ, যে কথা বলছে তার একটা নাম আছে; সুতরাং, ভয়ের কিছু নেই। সে উত্তর দিল, "হ্যাঁ আমার নাম আনন্দি। কিন্তু তুমি কি করে জানলে?"
সতু উত্তর দিল, "আমি সব জানি তোমাদের ব্যাপারে। তোমার ঠাকুমা, তোমার দাদু, তোমার বাবা, তোমার মা সবাইকে আমি চিনি-গো।"
আনন্দি বেশ উৎসাহের সাথে আবার প্রশ্ন করল, "কিন্তু তোমাকে দেখা যায় না কেন? তুমি কি ভ্যানিশ-ম্যান?"
সতু হেসে উত্তর দিল, "আমার কোন আকার নেই গো। তাই আমাকে দেখা যায় না। এই ভ্যানিশ-ম্যানটা কি গো?"
আনন্দি উৎসাহ নিয়ে মেঝেতে থেবড়ে বসে পড়ল, তারপর বলল, "ভ্যানিশ-ম্যান চেনো না তুমি? ভ্যানিশ-ম্যান মানে হল অদৃশ্য মানুষ। এই যেমন তোমাকে দেখা যায় না। তাদেরকেও সেরকম দেখা যায় না।"
সতু কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় আনন্দিকে দেখতে না পেয়ে ভারতী চিৎকার করতে শুরু করল, "আনন্দি... কোথায় তুমি? আনন্দি..."
আনন্দি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "মা ডাকছে, আজ আসি। কাল আবার আসব, কথা হবে।"
সতু বলল, "ঠিক আছে, এখানে এসে সতু বলে ডাকলেই আমি চলে আসব।"
আনন্দি বলল, "তোমার মা-কে বলে আসবে কিন্তু- নাহলে যদি রাগারাগি করেন।"
(3)
এই কথার কোন প্রত্যুত্তর দিল না সতু। অনেক রাতে খাওয়া শেষ করে বাড়িটার বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল সাত্যকি। একটা সুখটান মেরে দূরের দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টিতে। আসলে সে ভেবেছিল গ্রামে এসে তার ভালো লাগবে না, কিন্তু এখানকার বিশুদ্ধ বাতাস, এখানকার মানুষদের খুব ভালো লেগেছে ওর। ঠাকুমার ঘরে শুয়েছে আজ আনন্দি। কলকাতাতেও সে ঠাকুমার ঘরেই ঘুমায়। শৈলবালা তার মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে একটা গান ধরেছেন। যে গানটা তিনি গত বত্রিশটা, না না চৌত্রিশটা বছর ধরে প্রতি রাতে আওরান।
"আয় ঘুম আয়, আয় ঘুম আয়
আমার কানা মানিকের চোখে আয় ঘুম আয়
সোনা মানিক চোখ খুললে আমার আকাশ
তারায় ভয়ে যায়, আয় ঘুম আয়-আয় ঘুম আয়...'
গানটা গাইতে-গাইতে শৈলবালার চোখদুটো জলে ভরে গেল। তিনি আঁচলের খুঁট দিয়ে জল মুছে আবার আনন্দির মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। ঠিক সেই সময় ওঁর কানে গেল একটা অস্পষ্ট আওয়াজ, 'মা...' চমকে উঠলেন শৈলবালা। হ্যাঁ তিনি ঠিকই শুনেছেন কেউ 'মা' বলে ডেকেছে তাঁকে। তিনি আনন্দির দিকে তাকালেন, ঘুমিয়ে পরেছে মেয়েটা। ধীরে-ধীরে কোল থেকে নামিয়ে দিলেন আনন্দিকে। তারপর ধীরে-ধীরে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। এদিক-ওদিক ভালো করে দেখলেন। বিশেষ করে বাড়ির পেছনে থাকা কামিনী গাছটার দিকে বেশ ভালো করে লক্ষ্য করলেন তিনি। না, সম্ভবত এটা মনের ভুল। আবার সেই পাগলামিটা ফিরে আসছে নাকি শৈলবালার? ঠিক এই কারণেই নিহাররঞ্জন ওঁকে এই বাড়ি থেকে দূরে নিয়ে গিয়েছিলেন। এক গ্লাস জল টেবিল থেকে তুলে ঢকঢক করে খেয়ে ফেললেন শৈলবালা। তারপর বিছানায় গিয়ে বসে আনন্দির মাথায় হাত বুলিয়ে মনে-মনে আওরাতে লাগলেন, "আমি কিছু শুনিনি। আমার যা আছে এরাই আছে। আর কেউ নেই আমার, কেউ নেই।"
ঠিক তখনই আবার একটা গলার স্বর ভেসে এল, "আমি আছি মা, আমি আছি।"
চমকে বিছানা আঁকড়ে ধরলেন শৈলবালা। কানের মধ্যে বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে রইলেন। নিজের অজান্তেই কখন যেন ঘুমিয়ে পরলেন তিনি, যখন চোখ খুললেন তখন ভোর হয়েছে।
(8)
সকালে ব্রেকফাস্ট করে গ্রামের দিকে ঘুরতে গেল সাত্যকি আর ভারতী। শৈলবালাকে যেতে বলেছিল তারা, কিন্তু তিনি রাজি হন নি। আর আনন্দিকেও যেতে দেন নি। তিনি বলেছিলেন, "শহরে থাকাকালীন কতটা সময় আর একসাথে পাস তোরা দুজন, এখন সময় আছে দুজন দুজনের সাথে সময় কাটা বেশি করে। আমি আর আমার নাতনী নিজেদের সময় কাটাব।"
সাত্যকিরা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আনন্দি এল সেই দক্ষিণ দিকের ঘরটায়। ধীরে-ধীরে ডাকল, "সতু? সতু আছ? ইজ সতু হিয়ার?"
মুহূর্তে উত্তর এল, "আছি তো। আর শোনো আমাকে ইংলিশ বলবে না। আমি বুঝি না।"
আনন্দি হো-হো করে হেসে উঠল সত্তুর কথায়। তারপর বলল, "এ বাবা তুমি স্কুলে যাও না?"
সতু খুব নিরাশ স্বরে উত্তর দিল, "ইস্কুল!! ঠিকমত গঠনই নিতে পারলাম না। আর ইস্কুল! ধুস, তুমি কি যে বল না!"
আনন্দি বলল, "আমার কাছে পড়তে বসবে?"
সতু হেসে বলল, "সে কি গো, আমি পড়ব? আমি যে চোখে দেখতে পাই না।"
আনন্দি খুব হতাশ হল, দুঃখ পেল মনে-মনে। সে হতাশাগ্রস্ত স্বরে বলল, "দেখতে পাও না! আহারে। শুনতে পাও তাহলে?"
সতু আবার হাসল, তারপর বলল, "হ্যাঁ ওটা পাই বটে। ভগবান দুটো ক্ষমতা আমাকে দিয়ে রেখেছেন। শোনার আর কথা বলার।"
আনন্দি কিছু একটা বলতেই যাবে, এমন সময় সেখানে এসে উপস্থিত হলেন শৈলবালা। আনন্দিকে এই ঘরে দেখে তিনি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলেন। খুব ব্যস্ত হয়ে বললেন, "তুমি এই ঘরে কেন এসেছ আনন্দি? আমি তোমাকে বারণ করে দিচ্ছি এই ঘরে আর কোনদিন আসবে না তুমি। এখুনি এখান থেকে বেরিয়ে চলো।" কথাটা বলেই একপ্রকার জোর করেই আনন্দিকে ঘর থেকে বের করে নিলেন শৈলবালা। বাইরে বেড়িয়ে ঠাম্মির হাতটা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলো আনন্দি। তারপর খুব জোড়ে চিৎকার করে বলল, "কেন আমাকে এইভাবে টেনে আনলে ঠাম্মি? ওই ঘরে আমার বন্ধু আছে। তোমার জন্য ওকে বাই বলাও হল না।"
শৈলবালা চমকে উঠলেন, প্রশ্ন করলেন আনন্দিকে "বন্ধু? কোন বন্ধু?"
আনন্দি বলল, "ওর নাম সতু।"
শৈলবালার মাথায় যেন বাজ পড়ল। তিনি আনন্দির দুই কাঁধে দুই হাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে বললেন, "কে বলল তোমাকে এই নাম? আর আমি যখন গেলাম সেখানে কাউকে দেখলাম না কেন?"
আনন্দি শান্ত স্বরে চুপি-চুপি ঠাম্মির কানে -কানে বলল, "সতুকে দেখা যায় না যে। ও তো ভ্যানিশ-ম্যান। জানো ঠাম্মি, ওর কত দুঃখ... ওর চোখ নেই। দেখতে পায় না।"
শৈলবালা ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না, আসলে ব্যাপারটা কি হচ্ছে! তিনি আনন্দিকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
(৫)
রাতে খাওয়ার টেবিলে শৈলবালা সাত্যকিকে বললেন, "আমাদের কালকেই ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা কর বাবা। এখানে আমার একেবারে ভালো লাগছে না।"
সাত্যকি আর ভারতী কিছুটা অবাক হল। ভারতী ভ্রু কুঁচকে বলল, "কিন্তু এতদিন আপনিই এই বাড়িতে আসার জন্য সবথেকে বেশি ব্যাকুল ছিলেন মা। আর এখন কিনা আপনিই..."
শৈলবালা বৌমার কথা শেষ করতে না দিয়ে বললেন, "ভুল করেছিলাম। আমার এই বাড়িতে আসাটা উচিৎ হয়নি।"
অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে সাত্যকি প্রশ্ন করল, "কেন মা?"
শৈলবালা দক্ষিণের ঘরটার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বললেন, "এই বাড়ির সাথে অনেক অতীত জুড়ে আছে বাবা, আর এখানে আসা থেকেই তারা আমায় তাড়া করে বেড়াচ্ছে।"
সাত্যকি হেসে বলল, "ওসব একটু-আধটু হয়, টেনশন করো না তুমি। আর-তো কয়েকটা দিন। আর তাছাড়া আমাদেরও এখানে এসে বেশ ভালোই লাগছে। শহরের ছুটন্ত জীবন থেকে নিজেদের একটু ধীর গতির মধ্যে আনতে পেরেছি। আর তুমি বলছ চলে যাবে, এরকম করো না মা প্লিস।"
ছেলের এই কাকুতির পর মায়ের আর কি-ই বা বলার থাকে! নিজের খাওয়া অর্ধেক ছেড়ে শৈলবালা উঠে গেলেন। বেসিনে হাত ধুয়ে চলে গেলেন নিজের ঘরে। নিজের ঘরের দরজার কাছে আসতেই শৈলবালা চমকে উঠলেন। আনন্দি জানলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলছে। তিনি খুব ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলেন, তারপর শুনতে লাগলেন নাতনীর কথাবার্তা। আনন্দি কাউকে বলছে, "আচ্ছা ওসব ছাড়ো, আমাকে বলো তোমার মা কোথায়?"
মিনিট দুই আর কোনও কথা শোনা গেল না। শৈলবালা মনে মনে খুশি হলেন, তার ভাবনাটা ভুল। আনন্দি নিতান্তই খেলার ছলে কথা বলছে হয়ত। কিন্তু পরক্ষণেই তাকে চমকে দিয়ে উত্তর এল, "তোমার পেছনে।"
মুহূর্তে শৈলবালার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল, তিনি বিস্ময়ে তাকালেন আনন্দির দিকে। তার হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে। আনন্দি ততক্ষণে পিছন ফিরে 'সতুর মা'কে দেখে ফেলেছে। আনন্দি ঠাম্মির সামনে এসে প্রশ্ন করল, "তুমি সতুর-মা ঠাম্মি?"
হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন বৃদ্ধা। আনন্দিকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। সাত্যকিদের খাওয়া তখনও শেষ হয়নি। তাদের সামনে গিয়ে হাঁপাতে থাকলেন শৈলবালা। ভারতী খাওয়া ছেড়ে উঠে তাঁকে চেয়ারে বসাল। টেবিলের উপর থেকে জলের গ্লাসটা নিয়ে মুখের সামনে ধরে বলল, "কি হয়েছে মা? জল খান।" আনন্দির দিকে তাকিয়ে বলল, হয়েছে ঠাম্মির? তুমি কিছু দুষ্টুমি করেছ?"
আনন্দি মুখটা শুকনো করে বলল, "আমি তো কিছু করি নি মা, আমি তো কেবল সতুর সঙ্গে..."
আনন্দির কথার মাঝেই চিৎকার করে উঠলেন শৈলবালা, "নেই নেই, ওই নামে কেউ নেই।" ততক্ষণে খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে সাত্যকিও। সে মায়ের কাছে গিয়ে বলল, "তুমি আগে শান্ত হও মা। কেন অমন করছ? কি সমস্যা হচ্ছে বল আমাকে!"
শৈলবালা এক গ্লাস জল ঢকঢক করে খেয়ে ফেললেন। তারপর সাত্যকির দিকে তাকিয়ে বললেন, "আমার একটাই ছেলে, আমার একটাই মানিক, সাত্যকি। আমার আর কোন সন্তান নেই, ছিল না, নেই। আমার আর কোন সন্তান নেই।"
ভারতী শাশুড়ি মায়ের বুকে হাত বোলাতে-বোলাতে বলল, "এত চিৎকার করবেন না মা। আপনার শরীর খারাপ হয়ে যাবে-তো!" তারপরেই সাত্যকির দিকে তাকিয়ে বলল, "দেখো-না, বলাই কাকাকে বলে যদি একটা ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে পার..."
সাত্যকি পিছনে ঘুরে দেখল, বলাই কাকা তাদের থেকে কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে আছেন। তার দু-চোখ ভর্তি জলে। সাত্যকি তাঁকে কিছু বলার আগেই তিনি বললেন, "ডাক্তার কিছু করতে পারবে না গিন্নি-মার। পাপ বাপকেও ছাড়ে না। তোমরা কাল সকালেই এখান থেকে চলে যাও বাবা, চলে যাও তোমরা।" সাত্যকি কিছু বলার আগেই তিনি বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।
অবাক চোখে সাত্যকি তাকাল মায়ের দিকে। দু-হাত মাথায় দিয়ে বসে আছেন বৃদ্ধা। ভারতী আনন্দিকে প্রশ্ন করল, "তুমি কি কিছু জান, ঠাম্মির কি হয়েছে?"
আনন্দি বলল, "আমি-তো সতুর সঙ্গে..."
সাত্যকি আনন্দিকে থামিয়ে বলল, "সতু কে? এই বাড়িতে আরও কেউ আছে নাকি?"
আনন্দি বলল, "হ্যাঁ আছে তো। সতু আমার নিউ ফ্রেন্ড। জানো বাবা ওকে দেখা যায় না। ও ভ্যানিশ-ম্যান।"
ভারতী হাঁটু গেঁড়ে আনন্দির সামনে বসল, তারপর ওকে পুনরায় জিজ্ঞেস করল, "সতুর সঙ্গে কি করছিলে তুমি?"
আনন্দি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, "কথা বলছিলাম। জানো মা, ও আমাদের সবাইকে চেনে। তোমাকে, পাপাকে সবাইকে..."
ভারতী নতুন কোনও প্রশ্ন করতে যাবে এমন সময় সাত্যকি আনন্দিকে জিজ্ঞেস করল, "কি বলছিল তোমাকে সতু?"
আনন্দি হেসে বলল, "ওঁকে আমি ওর মায়ের নাম জিজ্ঞেস করাতে ও ঠাম্মিকে দেখাল, আর সেই শুনে ঠাম্মি যেন কেমন একটা হয়ে গেল।"
ভারতীর হাত-পা কেঁপে উঠল। সাত্যকি মায়ের দিকে তাকাল। সতু কে? সাত্যকির মনে হাজার খানেক প্রশ্ন এসে ভিড় করল। রাতে আনন্দি বাবা-মায়ের সাথেই ঘুমল। অনেক বোঝানোর পরেও শৈলবালা ছেলে-বৌমার সঙ্গে শুতে রাজি হলেন না। তিনি জেদ ধরে বসে রইলেন, তিনি নিজের ঘরেই ঘুমোবেন। সাত্যকি একবার জিজ্ঞেস করতে উদ্যোগ নিয়েছিল যে, বলাই কাকা কোন পাপের কথা বলে গেল। কিন্তু ভারতী চোখ টিপে মানা করায় সে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।
(৬)
রাত তখন একটা। চেনা নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরেছে বাড়িটাকে। পিছনের বাঁশবন থেকে শিয়ালের আওয়াজ ভেসে আসছে, মনে হচ্ছে যেন কোনও বাচ্চা ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠেছে মায়ের দুধ না পেয়ে। বিছানার এক কোণে বসে আছেন শৈলবালা সামন্ত। আর অপর কোণে রাখা আনন্দির সেই পুতুলটা, যেটা সে দক্ষিণ কোণের ঘর থেকে পেয়েছিল। এই পুতুলটাই সেই সময় ছিল তার একমাত্র আশ্রয়, তার বেঁচে থাকার তাগিদ। শৈলবালা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সেই পুতুলটার দিকে। তার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় ঝড়ে পরছে অশ্রু। তার বুকের ভেতর আজ এক-সমুদ্র অতীত এসে জমা হয়েছে। ভারী হয়ে উঠেছে শরীরটা। শৈলবালার হাতে একখানা কাগজ রয়েছে। এতক্ষণ কি-সব যেন তাতে লিখেছেন তিনি। হয়ত তাঁর স্বীকারোক্তি। হঠাৎ খোলা জানালা দিয়ে একরাশ শীতল হাওয়া এসে ঘরে ঢুকল। শৈলবালা জানালার দিকে তাকালেন, শান্ত স্বরে বললেন, "কে? তুই এসেছিস?"
কোন উত্তর এল না।
শৈলবালা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। জানালার সামনে এগিয়ে গেলেন, বললেন, "আমি জানি তুই এসেছিস।"
একটা চাপা কান্নার আওয়াজে ঘরটা ভরে গেছে। কেউ যেন গোঙাচ্ছে, তার কান্নার আওয়াজ স্পষ্ট নয়, কিন্তু তবুও শৈলবালা অনুভব করছে সে আছে এই ঘরে, কাঁদছে সে। সারা ঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে। ধীরে-ধীরে নিজের ঝুলে যাওয়া তলপেটে হাত দিলেন শৈলবালা। এখানেই তো ছিল সে একসময়। শান্ত স্বরে বললেন, "কেন এসেছিস আবার? চলে যা এখান থেকে।"
হালকা মেয়েলী স্বরে উত্তর ভেসে এল, "কোথায় যাব?"
শৈলবালা আর ভয় পেলেন না। আবার খাটের ছত্রিটা ধরে বিছানায় বসে পরলেন। তারপর শান্ত স্বরে বললেন, "যেখানে সবাই যায়। সেখানে চলে যাও মা আমার, এই জায়গা তোমার নয় যে!"
হাসির স্বর ভেসে এল শৈলবালার কানে। শৈলবালা বললেন, "হাসছিস কেন মা? আমার দুর্দশায় তোর হাসি পাচ্ছে?"
উত্তর এল, "দুর্দশা আমার না তোমার মা?"
শৈলবালা বললেন, "সন্তানের দুর্দশা মানেই তো মায়ের দুর্দশা। আচ্ছা তুই সতু?"
সতু উত্তর দিল, "কেন আমার নাম তোমার মনে নেই মা?"
শৈলবালা হেসে বললেন, "তোর নাম দেওয়ার সময়টাও আমাকে কেউ দেয়নি।"
সতু বলল, "তুমি আর বাবা মিলে আমার নামটা তো ঠিক করেছিলে মা। মনে নেই?"
শৈলবালা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "হ্যাঁ, তোর বাবা-ই বলেছিলেন আমাদের ছেলের নাম 'সাত্যকি' রাখা হবে, আর ডাক নাম হবে 'সতু'। কিন্তু..." শৈলবালা চুপ করে গেলেন।
সতু বলল, "কিন্তু কি মা?"
শৈলবালা বললেন, "কিন্তু যখন উনি জানতে পারলেন আমার গর্ভে কন্যাসন্তান আছে। তখন আর আমার কিছু করার ছিল না।"
সতু বলল, "গর্ভে মেয়ে আছে, না ছেলে আছে, না জেনেই যে নামটা দেওয়া হয়েছিল, আমি আজও সেই নামটাই বহন করে আসছি। তাই তো আনন্দিকে আমার নামটা 'সতু' বলেছিলাম।"
শৈলবালা এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন, "একটিবার আমাকে দেখা দিয়ে যা না মা! একটিবার..."
সতু হাসল বলল, "আমার কি কোনও আকার আছে মা? আমাকে তোমরা সে সময়টা দাও নি।"
শৈলবালা হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন, বললেন, "এখনও কেন পরে আছিস এই যমপুরীতে? চলে যা এবার তুই চলে যা।"
সতু আবার হাসল, বলল, "আমরা যে এভাবেই থেকে যাই মা। চিরটাকাল আমরা এইভাবেই থেকে যাই। কোনও আকার নেওয়ার আগেই আমাদের যখন টুকরো-টুকরো করে বের করে আনা হয়, তাদের কি আর সৎকার করার মত সময় থাকে? থাকে না। ফেলে আসা হয় কোনও ভাগাড়ে। আর আমরা সেখানেই চিরটাকাল আটকে থাকি। সময়ের আগেই আমাদের তোমরা দূরে সরিয়ে দাও ঠিকই, কিন্তু সময়ের আগে সেখানে আমাদের জায়গা থাকে না।"
শৈলবালা ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠলেন, চিৎকার করে বললেন, "আমাকে ক্ষমা করে দে মা, আমাকে ক্ষমা করে দে। আমার হাতে কিছু ছিল না।"
সতু বলল, "জানো মা। যখন ওই দক্ষিণ দিকের ঘরে বাবা আর ডাক্তার তোমার গর্ভ থেকে আমায় কেটে টুকরো করে বের করে আনছিল তখন আমার মধ্যে প্রাণ ছিল। আমি চিৎকার করছিলাম, কিন্তু আমার গলার স্বর-তো ওরা শুনতে পায়নি, তাই হয়ত ওদের মায়া হয়নি। কিন্তু তুমিও কি আমার গলার স্বর শুনতে পাও-নি মা?"
শৈলবালা নিজেকে আর রুখতে পারলেন না। পরে গেলেন মেঝেতে। বুকের মধ্যে হাত চেপে ধরলেন, গোঙাতে লাগলেন। তার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এল, তিনি ছটফট করতে লাগলেন। এদিকে সারা ঘরটা 'মা' শব্দে ভরে উঠল। যেন মনে হল, পৃথিবীর সকল কন্যা-সন্তানেরা একসাথে এই ঘরে এসে 'মা' শব্দে চিৎকার করছে। সেই সকল সন্তানেরা যাদের কোনও নাম থাকে না। মায়ের গর্ভে ঠিকমত আকার পাওয়ার আগেই তাদেরকে কেটে টুকরো করে বের করে আনা হয় সেখান থেকে, তারপর তাদের ফেলে দেওয়া হয় কোন ভাগাড়ে। যাতে ওরা সেই মানুষগুলোর জীবন থেকে চলে যায়, কিন্তু আসলে তারা যায় না, ওরা থেকে যায়।
কিছুক্ষণ পর শৈলবালা নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন। পরে রইলেন মেঝেতে, তার ডান হাতটা তলপেটে চাপা। আর বাম হাতে একটা কাগজ মুঠো করে ধরা রয়েছে এখনও। সকালে উঠে শৈলবালার দেহটা প্রথম আনন্দি দেখেছিল। চিৎকার করে সে ভারতীকে ডেকেছিল। সাত্যকি আর ভারতী এসে যখন পৌঁছল ঘরে তখন সব শেষ। শৈলবালা সামন্তর দেহ ঠাণ্ডা বরফ হয়ে গিয়েছে। সাত্যকি মায়ের বাম হাতে ধরে থাকা ভাঁজ করা কাগজটা নিয়ে খুলেছিল। সেটা আসলে কেবল কাগজ ছিল না, শৈলবালার অপটু হাতে লেখা একটা চিঠি ছিল। সাত্যকি সেটা পড়া শুরু করল —
প্রিয় সাত্যকি,
আসলে ছোটবেলা থেকেই তোর বাবা অথবা আমি কেউই তোকে সতু বলে ডাকি নি। কারণ, ওই নামটা আমার প্রথম সন্তানের জন্য আমরা বরাদ্দ করে রেখেছিলাম। তুই আমাদের প্রথম সন্তান নোস বাবা। আমি যেদিন তোর বাবাকে প্রথম মা হওয়ার খবর দিলাম তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমাকে বলেছিলেন, আমাকে সোনা-রূপায় মুড়ে দেবেন। কারণ, আমি তার বংশের প্রদীপ ঘরে আনছি। কিন্তু যখনই গাঁয়ের মূল কবিরাজ মশাই আমার নাড়ী দেখে বললেন আমার গর্ভে কন্যাসন্তান আছে। তখনই তোর বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেল। তিনি আমার সাথে এমন ব্যবহার করতে শুরু করলেন যেন পৃথিবীতে কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার থেকে বড় অপরাধ আর কিছু নেই। আমাকে আদেশ করলেন, আমি যেন ওই সন্তান নষ্ট করে দিই। কিন্তু আমি তা করতে রাজি হইনি। তাই তিনি শহরের কোন এক ডাক্তারকে বেশি টাকার বিনিময়ে এখানে নিয়ে এসে আমাকে অজ্ঞান করে আমার সেই প্রথম সন্তান 'সতু'কে আমার গর্ভ থেকে কেটে টুকরো-টুকরো করে বের করে আনলেন। আমি ভেবেছিলাম, এখানেই হয়ত শেষ; কিন্তু পরে বুঝেছিলাম আসলে আমরা যেটাকে শেষ ভাবি, সবটা এত সহজে শেষ হয় না। সতুর কাটা টুকরোগুলো ওরা আমাদের বাড়ির পিছনে কামিনী গাছের গোড়ায় ফেলে দিয়েছিল। আর তারপর থেকেই এই বাড়িতে আমি ওর কান্নার আওয়াজ শুনতে পেতাম। তারপর একসময় তুই হলি আমার কোল আলো করে। তখন তোর উপর যাতে কোনও আঁচ না লাগে, তাই তোর বাবা আমাদের নিয়ে শহরে চলে গেলেন। কিন্তু এখানে এসে বুঝলাম, আমরা চলে গেলেও সে যায়নি। সে এখানেই আছে। তুই যখন এই চিঠি পাবি আমি হয়ত থাকব না। আমার একটা ইচ্ছে রাখিস বাবা। আমাকে দাহ করিস না। বাড়ির পিছনে যে কামিনী গাছটা আছে তার নীচে আমাকে সমাধি দিস,ওরা সতুকে ওখানেই ফেলেছিল। ওর টুকরো-টুকরো দেহগুলো ওখানের মাটিতে আজও মিশে আছে। আমিও সেই মাটিতেই মিশতে চাই। আমিও ওর সাথে থেকে যেতে চাই চিরটাকাল ওর মা হয়ে। ওরা যে যায় না কোথাও, ওরা থেকে যায়। হয়ত সারাজীবন ওরা এইভাবেই থেকে যায়।
ইতি,
তোদের মা
সাত্যকি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ভারতী এসে জড়িয়ে ধরল তাকে। আনন্দি দৌড়ে দক্ষিণের ঘরটায় গিয়ে আওয়াজ দিল, "সতু আছ?"
উত্তর এল, "আছি তো। যাব আর কোথায়? যাবার উপায় নেই যে। আমার মা-ও সঙ্গে আছে, কথা বলবে?"
সমাপ্ত
Next Bangla Story
List of all Bengali Stories
## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers.
The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation.
Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##
◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717