Home   |   About   |   Terms   |   Library   |   Contact    
A platform for writers

ভাঙ্গনের পরে...

Online bangla Story

-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ আমাদের এই ওয়েবসাইট ( RiyaButu.com )-এ প্রকাশিত গল্পগুলির মধ্যে থেকে কিছু গল্প নিয়ে এবছরই প্রকাশিত হবে আমাদের 'রিয়াবুটু'র গল্প'।
--------------------------



List of all Bengali Stories

ভাঙ্গনের পরে...

লেখিকা : সঙ্ঘমিত্রা রায়, বাবা- বাবুল রায়, করিমগঞ্জ বাজার, করিমগঞ্জ, আসাম

( নির্বাচিত গল্প, 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার - মে, ২০২৩' )

##

■ এক
"আম্মা হাঁড়িতে জল ফুটতেছে চাল দিবা না!"

"চাল নাই, কই থাইকা দিমু।"

"তাইলে কি আমাগোর আইজও না খাইয়া থাকতে হইব আম্মা! কাইল থাইকা ভাত খাই নাই, মুড়ি খাইয়া দিন কাটাইতাছি।"

"আমি কি করুম... এক হপ্তা হইল বৃষ্টি থামে না; কাম নাই। নদী ভইরা গেছে... জলের অভাব নাই... জল খাইয়া পেট ভইরা নে। জল খাইতে তো আর টেকা লাগে না। আল্লা, এত মানুষ মরে... আমি কেন মরি না!! তাইলে রোজ-রোজ পেটের চিন্তা থাইকা বাঁচতাম!"

"আমাগোর ভাত খাইতে হইব না আম্মা, জল খাইয়া দিন কাটামু, তবু তুমি এমন কথা কইও না!"

কথাগুলো বলে জুলেখা উনুনের পাশ থেকে ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আরিফার দিকে। ক'দিন এত বৃষ্টি হয়েছ, উনুনের ভিতরে জল ঢুকে গেছিল। ভাঙ্গা টিন কটা দিয়ে উনুন ঢেকে রাখা। এখন বৃষ্টি নাই তাই কোনমতে উনুন ধরিয়ে হাঁড়িতে জল বসিয়েছে জুলেখা। ঘরে খাবারের কিছু নেই, জমানো যা চাল ছিল দু'দিন আগেই শেষ। আরিফার মুখে মরার কথা শুনে ভালো লাগেনি দশ বছরের মেয়ে জুলেখার। আবার বলল, "তুমি মইরা গেলে আমাগোরে কে দেখব আম্মা!! আব্বা তো অসুখ হইয়া পইড়া আছে। তার চাইতে আমি মইরা গেলে একটা পেটের চিন্তা কমত।"

"চুপ কর!! মাইয়া যা মুখে আসে তাই কয়। ঠিক আছে তুই এইখানে বইসা থাক, তোর বাপে জিগাইলে কইস ভাত হইতাছে। আমি ফার্মে গিয়া দেখি যদি কিছু পাই। বৃষ্টি তো এখন একটু কমছে!"

"ফার্মে যাইবা আম্মা? তাইলে মনে হয় কিছু পাইয়া যাইবা। একটা ডিম আনবা আম্মা, নুন ভাত খাইতে ভালো লাগে না। একটা ডিম হইলে আমরা চাইর জনে খাইয়া নিমু!"

"ঠিক আছে দেখি কি হয়! নদীখান মনে হইতাছে পাগল হইয়া গেছে... কিভাবে ফুইলা উঠছে দেখ... মনে হয় আমাগো হগলরে খাইয়া ফালাইব।"

"কি হইব আম্মা নদী যদি সব ভাইঙ্গা লইয়া যায়, তাইলে আমরা কই যামু!"

"জানি না... আল্লা যেদিকে লইয়া যাইবেন হেইদিকে যামু। যেমন আমাগোর জীবন!"

আষাঢ় মাসের সকাল। টানা ক'দিন বৃষ্টির পর আজ আর বৃষ্টি নেই। মহানন্দা নদী; অন্যদিকে বন্যা হয়ে গেছে। এদিকটা একটু উঁচু তাই এখনো অল্প বাকী আছে জল আসতে। আরিফা তার ভাঙ্গা ছাতাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ফার্মের দিকে।

কয়েক বছর আগে স্বামী 'নিয়ামত'-এর সঙ্গে ছেলে, মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশ থেকে কাজের খোঁজে পশ্চিমবঙ্গে আসে আরিফা। জন্ম থেকেই নদীর চরে-চরে জীবন কেটেছে আরিফার। বাংলাদেশে পদ্মা নদীর চরে ওর বাবার ঘর ছিল। তার বাবা লতিফ আলি নদীতে মাছ ধরত, তাতেই অনেক কষ্টে চলত তাদের সংসার। ওরা সাতটা ভাই-বোন একটু বড় হওয়ার পরই লতিফ ওদের কোথাও কাজে দিয়ে দিত। একজনের পেটের চিন্তা কমলে বাকীরা একমুঠো খাবার বেশী পাবে। নিয়ামত আরিফার বড় চাচার ছেলে। আরিফার চাইতে চার বছরের বড়। নিয়ামতের পরিবারের অবস্থা একটু ভালো। তাদের নিজের বড় দুইটা নৌকা আছে, তা দিয়ে মাছ ধরে শহরে নিয়ে বিক্রি করত। নিয়ামতের বাবা কেয়ামত লতিফের পরিবারকে খুব একটা পছন্দ করত না। কিন্তু নিয়ামত ছোট থেকেই আরিফাকে ভালোবাসত। দুজনে এক সঙ্গে নদীতে সাঁতার কাটত, ডুব সাঁতার দিয়ে অনেক দূর চলে যেত দু'জনে, গাছে উঠে ফল পেড়ে খেত, গাছের মধ্যে দোলনা বেঁধে দু'জনে দুলত আরও কত কি করত দু'জনে!

ভাই-বোনদের মধ্যে আরিফা সবার ছোট। আরিফার গায়ের রং শ্যামলা হলেও চেহারাটা বেশ মায়াভরা, শরীর বেশ আকর্ষণীয়। এত দীনতার মধ্যে থাকলেও ওর দিকে অনেকেই তাকাত। নিয়ামত দেখতে সুন্দর নয়, রোগা পাটকাঠির মতো চেহারা, গায়ের রং কালো। নিয়ামত-আরিফার ভালোবাসা কোনদিন মেনে নেবে না তার বাবা কেয়ামত; সেটা তারা জানে। তাই আরিফার আঠার বছর বয়সের সময় তাকে নিয়ে ঢাকায় পালিয়ে যায় নিয়ামত। এ নিয়ে দুই ভাইয়ে খুব ঝগড়া হয়। শেষে ঠিক হয় নিয়ামত-আরিফা চরে কোনদিন আসতে পারবে না, ওদের সেখানে জায়গা হবে না। নিয়ামত সে খবর পায়। সে ঢাকার বস্তিতে থাকে আর রিক্সা চালায়। আরিফা ঘরে থাকত, আশেপাশের মেয়ে-বউরা এসে জুটত তার সঙ্গে গল্প করার জন্য। কেউ-কেউ বলত, "ও বউ, কি পুলারে ভালোবাসলা এক্কেরে পাঠকাঠির লাখান!! তোমার রূপ আছে, অন্য কাউরে ভালবাসলে পারতা!!"

"কি করুম... ভালোবাসা রূপ দেইখা হয় না... মানুষটা ভালা। আমারে খুব ভালোবাসে... অন্য কেউ হইলে হয়ত আমারে এইভাবে ভালোবাসত না। আমার লাইগা হে তার বাড়িঘর, সব সুখ ছাইড়া এখন রিক্সা চালাইতাছে। এমন মাইনষেরে ভালো না বাইসা থাকা যায়!"

"হেইডা ঠিকই... তয় তোমার মতো রূপসী মাইয়ারে ভালো না বাইসা থাকব কেমনে। বাঁদরের গলায় মুক্তার মালা জুটছে!"

"এমন কইরা কইও না... মানুষটা শুনলে মনে কষ্ট পাইব!"

আরিফার ছোট সংসারে অভাব থাকলেও ভালোবাসার অভাব নেই। আরিফা পর-পর দু বছরের ব্যবধানে ছেলে, মেয়ের জন্ম দেয়। ছেলে নাইম ছোট থেকেই কিছুটা অসুস্থ ছিল। প্রায়ই তাঁর জ্বর আসত, শ্বাসকষ্ট হত। নিয়ামত তাঁর সাধ্যমতো অনেক চিকিৎসা করিয়েছে, কিন্তু তার রোগের সঠিক চিকিৎসা হয়নি। সবই ঝাড়ফোঁক, কবচ তাবিজ এসবই হয়েছে। শেষে একজনের পরামর্শে ঢাকা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছিল কিন্তু ডাক্তার কিছু বুঝার আগেই পাঁচ বছর বয়সে মারা যায় নাইম। আরিফা, নিয়ামত খুব ভেঙ্গে পড়ে ক'দিন খুব কান্নাকাটি করেছে, কিন্তু এরপর পেটের দায়ে আবার কাজে বেরুতে হয়েছে। জুলেখাকে নিয়ে চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু এর মধ্যে তাদের জীবনে নেমে আসে আরেক বিপর্যয়। ওরা বস্তির যে জায়গায় ছিল ওদিকটায় এক বিল্ডার ফ্ল্যাট তৈরি করবে। তাই সবকিছু ভেঙ্গে ওদের উচ্ছেদ করে দিয়েছে। বিল্ডার টাকা খাইয়ে অনেকের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে, কেউ বস্তিবাসীদের পক্ষে কথা বলছে না। আরিফা, নিয়ামত ছোট জুলেখাকে নিয়ে ক'দিন ফুটপাতে কাটায়, এরপর একজনের সঙ্গ-ধরে চোরা পথে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে।

■ দুই
নূতন দেশ, নূতন জায়গা, কিন্তু থাকার কোনও জায়গা নাই। ওরা এসে উঠে মালদায়। ওখানে এসে ফুটপাতে, রেল ষ্টেশনের পাশে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কেটেছে তাদের। আরিফা বলত, " বাংলাদের ছাইড়া আইয়া ভুল করলাম নাকি জুলেখার বাপ। মনে হয় আবার বাংলাদেশে চইলা যাইতে হইব।"

"এইখানে যে অবস্থা, ওইখানেও তাই! তুই চিন্তা করিস না আরিফা, আল্লা কিছু উপায় করবেন। আমি একটা কাম ঠিক যুগাইয়া নিমু!"

"কাম পাইলে আমিও করুম, তোমারে একলা কাম করতে হইব না।"

"ঠিক আছে করিস... আগে কাম তো পাই!"

বেশ ক'দিন ঘুরতে-ঘুরতে নিয়ামত পাথর ভাঙ্গার কাজ পেল। আরিফা বলল, " জুলেখার বাপ আমিও যামু তোমার লগে।"

"না না আরিফা তুই এসব কঠিন কাম পারবি না। অন্য কাম পাইলে না হয় করিস!"

"কিসের কঠিন কাম!! খিদের জ্বালায় মনে হয় পাথর চিবাইয়া খাইতে হইব, আর পাথর ভাঙ্গতে পারুম না! ছোট মাইয়াডা কাইল সারাদিন জল খাইয়া কাটাইছে। দুইজনে কাম করলে রোজগার একটু বেশী হইব। ঠিক আছে... অন্য কাম পাইলে না হয় ছাইড়া দিমু।"

"ঠিক আছে চল তাইলে।"

শুরু হল পাথর ভাঙ্গার কাজ আর থাকার জায়গা হল রিঙয়ের ভিতর। বাইরে কোন রকমে রান্না করে তারপর তিনজনে গাজাগাজি করে রিঙয়ের ভিতরে শুয়ে পড়ত। এভাবে প্রায় বছর দিন চলার পর নিয়ামত নূতন কাজের সন্ধান পেল। হাঁস মুরগীর ফার্মে কাজ করতে হবে, আর সেইসঙ্গে ওদিকে মহানন্দার চরে একটু থাকার জায়গা পেল।

মালদা শহরের পাশ ঘিরে মহানন্দার নদীর তীরে বেশ বড় চর। ওখানে হিন্দু, মুসলমান দুই শ্রেণীর কিছু অসহায়, দরিদ্র মানুষেরা বাসা বেঁধেছে। এখানে প্রায় সবাই দিনমজুর; বিভিন্ন জায়গা ঘুরতে-ঘুরতে এখানে ওদের ঠাই হয়েছে। চরের সবাই কোনও রকমে ঝুপড়ি ঘর তৈরি করে কোনও রকমে দিন কাটাচ্ছে। পাতি টিনের চাল বা খড়ের চাল, বাঁশের বেড়া বা টিনের বেড়া চারপাশে নোংরা, কাঁদা এতেই বেচে আছে ওরা। নিয়ামত জায়গা পেল একেবারে নদীর ধারে। তবে তখন সেদিকে নদী চর দিচ্ছে, অন্য দিকে ভাঙছে। ওরা যখন এসেছে তখন শীতকাল, চারপাশ বেশ শুকনো। আরিফা পেটে খিল দিয়ে কিছু টাকা জমিয়েছিল, তা দিয়ে কোনমতে নদীর ধারে ছন-বাঁশের ঘর তৈরি করল। রান্নার জায়গা বাইরে, রান্নার পর টিন দিয়ে উনুন ঢেকে দিত। বর্ষা আসার আগে পাতি টিন দিয়ে ছোট চালা করেছিল আরিফা জন্য।

তিনজনের সংসার। নিয়ামত ডিমের ফার্মে কাজ করে মোটামুটি ভালো টাকা পেত ,তাতে চলত তাদের। তবে ওদের চর থেকে ফার্ম বেশ দূরে। যেতে-আসতে বেশ সময় লেগে যায়। একটু দেরী হলেই মদনবাবুর কাছে বকুনি খেতে হয়। মদনবাবু কথায়-কথায় বেতন কেটে দেওয়ার হুমকি দেয়। চল্লিশ বছর বয়সী মদন কুমার দাস ফার্মের ম্যানেজার। লোকটা খুব কুটিল, বদরাগী। কেউ তার মতের বিরুদ্ধে গেলে আর রক্ষে নেই। বিরাট হাঁস, মুরগীর ফার্ম। এই ফার্মে মালিকের দেখা পাওয়া যায় না। এখানে যারা কাজ করে সবাই মদনবাবুকে সমীহ করে। চরের বেশ কয়েকজন ওখানে কাজ করে। নিয়ামত সকালে দুটো পান্তা মুখে দিয়ে অন্যদের সঙ্গে ছুটে ফার্মে। অনেক কষ্টে কাজটা পেয়েছে কিছুতেই হারাতে চায় না নিয়ামত।

ঘরের পাশে একটু জায়গা ছিল, ওখানে শাকসবজি ফলাত আরিফা। বর্ষার সময় নদীর জলে ভেসে আসা কাঠ, বাঁশ সংগ্রহ করে জ্বালানির জোগাড় করত, তাছাড়া দূর-দূর হেটে গোবর এনে ঘুটে দিত। তবে গোবর, নদী থেকে কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়েও কাড়াকাড়ি, ঝগড়া লেগে যেত। আরিফা ঝগড়ায় যোগ দিত না, ওর ভাগে যা জুটে তা-ই নিয়ে খুশী মনে ঘরে ফিরত।

বেশ চলছিল আরিফা-নিয়ামতের সংসার। জুলেখা বড় হতে থাকে, আরিফা তাকে স্কুলে দিতে চায়। কিন্তু বার্থ সার্টিফিকেট না থাকায় ভর্তি করতে পারছে না। আরিফা অল্প লেখাপড়া জানত, জুলেখা তার কাছে ঘরেই অক্ষর, সংখ্যা লেখা শিখেছে; এর বেশী যেতে পারেনি। কিন্তু জুলেখার খুব ইচ্ছা সেও অন্য বাচ্চাদের মতো স্কুলে যায়। নিয়ামত একজনকে ধরেছে টাকা দিয়ে বার্থ সার্টিফিকেট বের করে দিতে। জুলেখা মায়ের সঙ্গে কাজ করতে-করতে বেশ কাজ শিখে গেছে। জুলেখার সাত বছর বয়সের সময় আরিফা একটা ছেলের জন্ম দেয়। আরিফা ছেলের নাম রাখে নাইম। তার বিশ্বাস নাইম ফিরে এসেছে তাদের কাছে। জুলেখা, নাইমকে নিয়ে বেশ আনন্দে আছে তারা।

■ তিন
কিন্তু আরিফার কপালে সুখ বেশীদিন সহ্য হল না। নাইমের একবছর বয়সের সময় নিয়ামতের ভয়ানক এক্সিডেন্ট হয়। আর তাতে তার হাত দুটো কেটে ফেলতে হয়, মাথায় চোট লাগে। কিন্তু টাকার অভাবে তেমন চিকিৎসা হয়নি। এরপর থেকে নিয়ামত সারাদিন শুয়ে বসে থাকে, আর মাঝে-মাঝে আবুল-তাবুল কি সব যেন বলে তার দেশের কথা, বাপ-মায়ের কথা। কথাগুলো কিছুটা অগোছালো আবার কখনও ঠিকঠাক কথাও বলে। চারজন লোকের পেটের দায় পড়ে আরিফার উপর। ফার্মে গিয়ে মদনবাবুর হাতে পায়ে ধরে নিয়ামতের কাজটা নেয়। চরের আরও ক'জন মহিলা যায়, আরিফা তাদের সঙ্গেই যায়। জুলেখাই এখন সংসারের সব কাজ করে; বাবা-ভাইকে দেখে।

মদনবাবু লোকটা শুধু বদরাগী নয়, লম্পটও। তার পরিবার অন্য জায়গায় থাকে, সে এখানে একাই থাকে। কালো বেটে লোকটার চোখ দুটো শেয়ালের মতো। সারাক্ষণ মেয়েদের শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফার্মে কাজ করা অনেক মেয়ে বউরা তার ভোগের শিকার হয়েছে। কেউ-কেউ স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছে, আবার কেউ-কেউ প্রথমে ধরা না দিলেও পরে কাজ হারানোর ভয়ে তার কাছে ধরা দিয়েছে। তাকে তুষ্ট না করে ওখানে কাজ করা যাবে না। আরিফা যখন ওর কাছে কাজের জন্য গিয়ে অনুরোধ করে মদনবাবু তখন তার শরীরটা খুঁটিয়ে দেখছিল। এত কষ্টেও আরিফার শরীরের আকর্ষণ কমেনি। ওখানে কি হয় নিয়ামত তা জানে, তাই ফার্মে কাজে যেতে নিয়ামত তাকে মানা করেছিল। কিন্তু আরিফা তখন সর্বস্বান্ত। নিয়ামতকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে ঘরের সব জিনিষপত্র বিক্রি করতে হয়েছে তাকে। তাই সে নিয়ামতের বারণ না শুনে চলে যায়। মদনবাবু আরিফার অনুরোধের পর বলল, "তুমি নিয়ামতের বউ... তোমারে কাজ না দিয়ে পারি। চোখের সামনে তোমরা না খেয়ে মরবে এটা মদনবাবু সহ্য করবে কি করে! তবে যেভাবে কাজ পেলে, আমাকেও একটু দেখ!"

"আমি আপনেরে কি দেখমু ম্যানেজার বাবু?"

"আমি যা বলব তাই শুনলেই হবে।"

আরিফা কিছু না বুঝেই বলেছিল, "শুনমু।" আর সেই কথার খেসারত গত এক বছরে বেশ ক'দিন দিতে হয়েছে তাকে। না হলে তাকে কাজ হারাতে হত। অন্য কোন কাজ পাওয়া এত সোজা না! আরিফা মাঝে-মাঝে লুকিয়ে এক, দুটা ডিম আনত; তা-ই দিয়ে মজা করে ভাত খেত সবাই।

বৃষ্টি শুরু হওয়ার প্রথম দু'দিন কাজে গেলেও কোনও টাকা পায়নি আরিফা। কারণ মদনবাবু একটা কাজে কলকাতায় গেছে। তার জায়গায় যে কাজ দেখছে তার পেমেন্ট করার অধিকার নেই। সব মদনবাবু আসার পর হবে। এদিকে আরিফা এরপর আর কাজে যেতে পারেনি, কারণ একে তো বৃষ্টি তার উপর নাইমের খুব জ্বর। ঘরে জমানো অল্প চাল ছিল তা শেষ হওয়ার পর কাল থেকে মুড়ি খেয়ে তারা কাটিয়েছে। ধার আনবে তেমন কেউ চরে নেই, সবার অবস্থা তারই মতো!

গত দু'বছর থেকে নদী এদিকে ভাঙ্গন ধরেছে। তবে মহানন্দার ভাঙ্গন কিছুটা চোরা স্রোতের মতো। নীচে-নীচে ভাঙ্গছে, উপর দিকে ততটা বোঝা যাচ্ছে না। ভাঙ্গতে-ভাঙ্গতে প্রায় আরিফার ঘরের সামনে চলে এসেছে। এবার নদী যেভাবে ফুলে উঠেছে তাতে মনে হচ্ছে আরও কিছু ভেঙ্গে নিয়ে যাবে। চারদিকে জল আর জল। আরিফা অনেক কষ্টে ফার্মে পৌছায়। গিয়ে দেখে মদনবাবু এসে গেছে। ফার্মে তখন মেয়েরা বিশেষ নেই কয়েকজন ছেলে আছে তারা অন্যদিকে কাজ করছে। মদনবাবু অফিস ঘরের সামনে বসে পান চিবুতে-চিবুতে মোবাইল টিপছিল। আরিফাকে দেখে বলল, "আরে আরিফা সুন্দরী তুমি দেশে আছ নাকি! আমি ভাবলাম তুমি মনে হয় আমাকে ভুলে গেছ!"

আরিফা বলল, "না না ম্যানেজার বাবু, আপনেরে কেমনে ভুলতে পারি। কয়টা টেকা দেন নাইলে না খাইয়া মরতে হইব।"

"আরে দেব-দেব, এত চিন্তা কিসের! তার আগে আমাকে খুশী করে যাও। ক'দিন থেকে তোমাদের না পেয়ে মরুভূমিতে পড়ে গেছি! রস কস বিহীন শূন্য জীবন হয়ে গেছে।"

"আইজ ছাইড়া দেন, কাইল আইসা আপনেরে খুশী কইরা যামু। একটু চাল নিয়া ঘরে যাই... জুলেখা যে আমার পথ চাইয়া বইসা আছে। কাইল থাইকা ঘরের কেউ কিছু খায় নাই..."

"যাবে-যাবে... এত তারা কিসের!!" বলে আরিফাকে টেনে ঘরের ভিতর নিয়ে যায় মদনবাবু।

জুলেখা উনুনের পাশেই বসে আছে। তার শরীর কেমন করছিল ক্ষিদেতে। জল খেয়ে নিয়েছে কয়েক গ্লাস। শুধু বসে-বসে ভাবছে মা কখন চাল নিয়ে আসবে। নিয়ামত একটু পর-পর হাঁক দেয়, " কি রে জুলেখা, ভাত হইল, পেটটা যে জ্বইলা যাইতেছে..."

"হইতাছে আব্বা একটু সবুর কর!"

কয়েকবার হাঁক দেওয়ার পর নিয়ামত বুঝতে পারে ঘরে চাল নেই। আরিফা নিশ্চয়ই চালের খুঁজে বেরিয়েছে। এর মধ্যে নাইম ঘুম থেকে উঠে গেছে নিয়ামত তাঁকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়। জুলেখাকে উনুনের পাশে দেখে বলে, "চাল নাই বুঝি, তোর মা কই গেছে চাল আনতে?"

"ফার্মে গেছে আব্বা।"

"ঠিক আছে আসুক। আমি নাইমরে লইয়া একটু হাইটা আসি!"

"আইছা যাও, ভাত হইলে তোমাগরে ডাক দিমু।"

মদনবাবুর মনোরঞ্জন করে বেশ কিছুক্ষণ পর আরিফা বেরিয়ে চাল নিয়ে ছুটতে থাকে চরের দিকে। আসতে-আসতে তার প্রায় দুপুর গড়িয়ে গেছে। এসে দেখে চরে হাহাকার লেগে গেছে। ক'দিন থেকে নদীতে ফাটল দেখা দিয়েছিল, আরিফা তা জানত না, মানে অনেকেই জানত না। আরিফা বেরিয়ে যাবার পর ফাটল বাড়তে থাকে। নদীর নীচ দিকে অনেকটা ভেঙ্গে গেছে। চরের বেশ কয়েকটা ঘর নদীগর্ভে চলে গেছে, তার মধ্যে আরিফার ঘরও ছিল। যারা চরে উপস্থিত ছিল সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। তাদের বিশ্বাস নদী আরও কিছু ভেঙ্গে নিয়ে যাবে। কেউ ভগবানের নাম নিচ্ছে আর কেউ আল্লা-আল্লা করছে। চিৎকার চেঁচামেচি, হাহাকারে পুরো চরে। হাওয়া বইছে। নিয়ামত একটা গাছের তলায় বসে কাঁদছিল নাইম তার কাছে বসে আছে।

আরিফা এসে চরের অবস্থা দেখে অস্থির হয়ে পড়ে। চালগুলো পড়ে যায় আরিফা বুঝতেই পারে না... জোরে জোরে কাঁদতে থাকে সে। চারদিকে চিৎকার-চেঁচামেচি, হাহাকার শুরু হয়ে গেছে। আরিফা বলতে থাকে,"হায় আল্লা এখন আমরা কই যামু! ও জুলেখার বাপ, আল্লা আমাগোর সব কাইড়া নিলেন, কি করুম আমরা!" কিন্তু 'জুলেখার-বাপ' কয়েকবার বলার পর তার খেয়াল হয় জুলেখা নেই। বলল, "জুলেখা কই জুলেখার-বাপ?"

" কি জানি তারে তো দেখি নাই। হ... মনে পড়ছে আমারে কইছিল ভাত হইলে আব্বা তোমাগরে ডাইকা আনুম!"

"আমি তারে উনুনের পাশে বসাইয়া গেছিলাম। তাইলে কি আমার জুলেখা নদীর জলে ভাইসা গেছে!! হায় আল্লা... আর কত কষ্ট দিবা আমাগোরে, আমার জুলেখা মনে হয় আসমানে চইলা গেছে!"

নিয়ামত, আরিফা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। নাইম ভ্যাবাচেকা হয়ে তাকিয়ে থাকে বাপ-মায়ের দিকে। জুলেখা আপাকে সেও মনে-মনে খুঁজতে থাকে। তাদের কান্না কে শুনবে? পুরো চরবাসী বিপদের মুখে রয়েছে। কিন্তু ভাঙ্গনের পর তাদের মেয়েটার জন্য বসে একটু কাঁদারও সময় নেই। যাদের ঘর তলিয়ে গেছে তারা সবাই বেরিয়ে পড়ছে এখন কিভাবে বাঁচবে, কোথায় থাকবে, সেই চেষ্টা তাদের করতে হবে। আরিফা কাঁদতে- কাঁদতে নাইমকে কোলে তুলে, নিয়ামতকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নূতন ঠিকানার খোঁজে! কোথায় যাবে তারা কিছুই জানে না, কিন্তু মনে বিশ্বাস আছে এত বড় পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও ঠাই হবে তাদের!"
(সমাপ্ত)


Next Bangla Story

List of all Bengali Stories


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717