Home   |   About   |   Terms   |   Library   |   Contact    
A platform for writers

মন যখন টানে

Online bangla Story

-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ আমাদের এই ওয়েবসাইট ( RiyaButu.com )-এ প্রকাশিত গল্পগুলির মধ্যে থেকে কিছু গল্প নিয়ে এবছরই প্রকাশিত হবে আমাদের 'রিয়াবুটু'র গল্প'।
--------------------------



List of all Bengali Stories

মন যখন টানে

লেখিকা: পলা ভৌমিক (রত্না দেব বিশ্বাস ভৌমিক), বাবা- জিতেন্দ্র চন্দ্র দেব বিশ্বাস, কালীতলা, রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ

( নির্বাচিত গল্প, 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার - মে, ২০২৩' )

##
রংপুরের ছবির মতো সুন্দর সেই ছোট্টো জায়গাটার নাম গাইবান্ধা। হয়তো কোনোকালে এখানে ছিল কোনও গোচারণ ভূমি। হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে রাতের বেলায় এখানেই বেঁধে রাখতে হতো গরুগুলো। এইসব হাতিবান্ধা, চ্যাংড়াবান্ধা, বগবান্ধা, মহিষবান্ধা আরও কতো নাম যে এই বেঁধে রাখার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কে জানে!

তাজহাটের রাজা গোপাল রায়বাহাদুরের ছেলের নাম ছিল সুন্দরলাল বাহাদুর। খাজনা আদায় উপলক্ষে যে সব যায়গায় তিনি যেতেন তার মধ্যে এই গ্ৰামটিকেই কেন যে মেলার জন্যে বেছে নিয়েছিলেন তা তো শুধু তিনিই জানতেন, তবে হয়তো সেই থেকেই জায়গাটির নাম হয়েছিল সুন্দরগঞ্জ। একটু দূরেই খেয়ালী তিস্তা হিমালয় থেকে বয়ে আসা জলধারা বয়ে নিয়ে চলেছে বুকে করে। ঠিক বাধা ধরা তেমন কোনও নিয়ম নেই তিস্তার, কোথা দিয়ে, কোন পথে যাবে কখন, কিংবা কোন বছরে কে জানে! ত্রি-স্রোতা আর কিছুটা পথ যাবার পরেই মিশেছে ব্রহ্মপুত্রে।

মনোরঞ্জন যে ঠিক কবে থেকে সুন্দরগঞ্জের বামনডাঙার রায় বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিল তা আজ আর মনে নেই। তবে গাইবান্ধা থানায় চাকরিটা পাবার পর, রায়বাড়ি ছেড়ে থাকা শুরু করেছিল ঐ মফস্বল শহরটায়। তিস্তা পাড়ের সুন্দরগঞ্জ থেকে মনোরঞ্জন এসেছিলো শীর্ণ এই ঘাঘট নদীর ধারে, গাইবান্ধাতে। নদীটা খুব বেশি প্রবল নয় বটে তবে কেন যেন বড় আপন বলে মনে হয় এই ঘাঘট নদীটাকে। গাইবান্ধা শহরকে যেন আদুরে এক বিনুনির মত জড়িয়ে রেখেছে। ঘাঘট নদী থেকে মানুষের তেমন কোনও ভয় নেই বলেই তো মনে হয়।

ব্রিটিশ আমলে পুলিশের লোককে অনেকেই ঘৃণার চোখে দেখলেও তার আমদানি যে মন্দ ছিল তা তো আর বলা যায় না। নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে সংসারের ভালোর চিন্তা করে রংপুর থেকে বিয়ে করে আনলো প্রজ্ঞাপারমিতাকে। সুন্দরগঞ্জের রায়বাড়িতে ওকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে এনেছিল। বড়দের আশীর্বাদ তো মাথা পেতে নিয়ে এসেছিল। পর পর দুই মেয়ের নাম রেখেছিল গায়েত্রী আর গীতা। মনোরঞ্জন যে ব্রাহ্মণ, এই তথ্যটুকু সে রায়বাড়িতেই জেনেছিল। তাই পরম্পরা মানতে গিয়েই নিজের মেয়েদের নাম এমন রেখেছিল, প্রজ্ঞা আর ও, দু'জনে মিলে। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে যদি কেউ ভগবানকে ডাকতে ভুলেও যায়, তাহলে ছেলে-মেয়েদের নাম ধরে ডাকলেও নাকি পুণ্য জমা হয়; এ ভাবেই। কিন্তু একমাত্র ছেলেটার বেলায় এ নিয়ম আর বজায় রাখেনি মনোরঞ্জন। নিজের নামের অস্তিত্ব বজায় রাখতেই ছেলের নাম রেখেছিল শুধুই রঞ্জন। শুনতে কথাটা একটু স্বার্থপরের মতন মনে হলেও চায় তো মানুষ এইটুকুই। নিজের মৃত্যুর পর যেন সকলে মনে রাখে তাকে। কিন্তু কতদিন লোকে একজনকে মনে রাখবে, তা তো নির্ভর করে মানুষটির কীর্তির ওপর।

পুলিশের চাকরিতে উন্নতি করতে-করতে দারোগার পোষ্টে বহাল তবিয়তে কাজ করতে-করতেই অবসর নিয়েছিলেন মনোরঞ্জন রায়। হ্যাঁ এই মনোরঞ্জন ব্রাহ্মণকে নিজেদের পদবীটা দান করেছিলেন রায়েরা। দুই দশক আগে দেশটা ভাগ হয়ে দুই টুকরো হয়ে গেল চোখের সামনেই। নিজের চাকরি আর পেনশনের কারণে ইন্ডিয়ায় যে যাওয়া হবে না কোনোদিন সেই কথাটা বুঝতে পেরেছিলেন ভালো করেই। ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ গড়ার আশায়, বেশ কয়েক বছর আগে তাই জলপাইগুড়ির ফালাকাটার কাছে মজনাই নদীর ধারে হেলাকদম বলে এক জায়গায় প্রায় আশি বিঘা জমি কিনে রেখেছিলেন রায়তওয়াড়ি ব্যবস্থার মাধ্যমে। নিজের পক্ষে তো আর এতদূর থেকে জমির দেখাশোনা করা সম্ভব ছিল না, কাজে কাজেই পাঁচজন স্থানীয় অধিবাসীদের আধিয়ার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া ছিল। বছরে দুই-এক বার মনোরঞ্জন খোঁজ নিতে পাঠাতেন জগৎকে। ফসল তো আর নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, যেটুকু টাকা-পয়সা পাওয়া যায় আর কি! মনোরঞ্জনে কাছে সেই টাকার সিংহভাগ পৌঁছতে পারতো না। জগৎ চাকরি না করলে কি হবে! মাথাটা ওর বড়ই পরিষ্কার। হিসেব বোঝে ষোলো আনা। অথচ দু'জনেই মানুষ হয়েছে ঐ রায় বাড়িতে। রায়দের কেমন দূরসম্পর্কের আত্মীয় এই জগৎবন্ধু গোস্বামী। শুধু যে আত্মীয় তাই নয়, কোনও এক কুলগুরুর বংশের রক্ত বইছে নাকি ওর শরীরে। কিন্তু কি ক'রে কিংবা কার হাত ধরে যে জগৎ এতো ধুরন্ধর বুদ্ধির অধিকারী হয়েছিল, তা পুরোটাই হয়েছে মনোরঞ্জনের অজ্ঞাতসারে। মনোরঞ্জনকে অবশ্য দাদার সম্মান দিয়ে এসেছে ও বরাবর। আর কি অমায়িক ব্যবহার ওর। মুগ্ধ না হয়ে উপায় কি!

জমির খাজনা দেওয়া আর ফসলের হিসেব বুঝে নেওয়ার পর কিছু টাকা পয়সা মাঝে মধ্যে অবশ্যই পাঠাতো মনোরঞ্জনদের গাইবান্ধার পুলিশ লাইনের কোয়ার্টারের ঠিকানায়। চিঠিপত্রও দিত মাঝে-মধ্যে মনে করে। কিন্তু কিছু কথা তো হাওয়ায় ভর করে ভেসে আসতো মনোরঞ্জনের কানে। আসামে নাকি বাড়ি, গাড়ি সব করে জগৎ থিতু হয়েছে। বিয়েও করেছে কলকাতার এক ধনী পরিবারের মেয়েকে। কলকাতা-গৌহাটি, সে যাতায়াত করে এখন প্লেনে। শুনে অবশ্য মনোরঞ্জনের ভালোই লাগে, তবে একটু দুঃখ হয় জগৎ নিজে কিছু জানায় না বলে।

প্রজ্ঞাপারমিতার মামার বাড়ি ছিল নেত্রকোনার গুনাই নদীর ধারের কোনও এক গ্ৰামে। মামার বাড়ির পাশেই ছিল একটি হাট। সেই হাটের যারা মালিক, তারা তালুকদার। সেই তালুকদার বাড়ির এক ছেলে রাঙা, যার ডাক নাম ছিল সন্তু। প্রজ্ঞাকে সে ছোটোবেলায় ডাকতো পিসি বলে। প্রজ্ঞার সাথে ছেলেটির ভাব হয়েছিল খেলাধুলায়, গল্পে, হঠাৎ কখনো-সখনো প্রজ্ঞা মামার বাড়িতে গেলে। ছেলেটির আগাগোড়াই চিঠি লিখতে খুব ভালো লাগতো। কাজে-কাজেই প্রজ্ঞার বিয়ের পরেও চিঠির দৌলতে ওদের যোগাযোগটা রয়েই গেল। পিসেমশাই মনোরঞ্জনের সাথে ঐ চিঠিতেই পরিচয়। হঠাৎ ইন্ডিয়ার ময়নাগুড়িতে দিদির বাড়ি যাবার পথে গাইবান্ধায় প্রজ্ঞাপিসির বাড়িতে সন্তুর উদয়। খুব আমুদে আর দিলখোলা টাইপের হয়েছে ছেলেটা বড় হয়ে। মনোরঞ্জন আর প্রজ্ঞার আন্তরিকতায় সন্তুকে তিন দিন থাকতেই হলো ওদের বাড়িতে। গায়েত্রীর আর গীতার দাদা ডাক, রঞ্জনের আধো-আধো বুলি, গিন্নি হবার পর প্রজ্ঞাপিসির হাতের সুন্দর রান্না, পিসেমশাইয়ের নানান গল্প, আজীবনের জন্যে মধুর স্মৃতি হয়ে থেকে গেল সন্তুর অন্তরে।

পিসি আর পিসেমশাই গত হয়েছেন বহুদিন, গীতা আর গায়েত্রীর বিয়ের কিছু বছর পরেই। বুদ্ধি করে রঞ্জনকে আসামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ওখানেই জগৎ কাকুর বাড়িতেই রঞ্জনের বেড়ে ওঠা। জগৎ-এর ছেলে-মেয়ে হয়নি। ব্যবসার দেখাশোনায় লাগিয়ে দিয়েছিলেন রঞ্জনকে। 'বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী' কথাটা যেমন আছে তেমনি গণেশ উল্টানোর কথাও তো আছে। প্রথমটা জগৎ-এর জীবনে সত্যি হয়েছিল, আর দ্বিতীয়টা রঞ্জনের জীবনে।

সন্তু খোঁজখবর করে গিয়েছিল রঞ্জনের শ্বশুর বাড়ি দিনহাটাতে। সেখান থেকে ঠিকানা জোগাড় করে রঞ্জনের কোচবিহারের বাড়িতে। একটা আলমারি তৈরির কারখানায় ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করে সংসার চালায় কোনও ক্রমে। আসামের পাট চুকে গেছে অনেক আগেই। বাড়ি, বাস, ট্রাক কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। ভোজবাজির মতো সব কিছুই নেই হয়ে গেছে একে-একে। তবে ছেলেটা এখন বড় হয়েছে। বি টেক পড়ছে। ফোন নম্বর নিয়ে এসেছিলেন অতনুর। মাঝে-মধ্যে কখনো মন টানলে ফোন করে খবর তো নেওয়া যাবে। যদিও রঞ্জনের ছোটোবেলায় দেখা সন্তু দাদার কথা একটুও মনে নেই, কিন্তু দিদিদের মুখে শুনেছে সন্তুর কথা। কোনোদিন যে দেখা হবে তা ছিল ভাবনার বাইরে। আর রঞ্জন কে দেখে, প্রজ্ঞাপিসির নানান কথা, দারোগা মনোরঞ্জন পিসেমশাইয়ের কথা আর তাঁর দিলখোলা হাসির কথা মনে পড়ে যায় সন্তুর। ভাবে, কেমন বাবা-মায়ের এ কেমন ছেলে! যেন মরে বেঁচে আছে রঞ্জন। দেশভাগের কারণেই বাবা-মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকা ওর ছোটোবেলা থেকেই। আর জগৎবন্ধু সম্বন্ধে যেটুকু সন্তু বুঝেছে তাতে এটুকু বোঝাই যায় যে রঞ্জনের টাকা-পয়সার কোনও অভাব হয়তো ছিল না, ছিল ভালোবাসার বারি সিঞ্চনের অভাব।

বছর দুয়েক পরে হঠাৎ খুব মন কেমন করছে সন্তুর রঞ্জনের কথা ভেবে। শেষ-মেশ অস্থির হয়ে ফোনটা করেই ফেলেন, অতনু রায় নামে রঞ্জনের একমাত্র শিবরাত্রির সলতে সেই ছেলেটাকে।

"হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো! শোনা যাচ্ছে কি আমার কথা?"

"হ্যাঁ জেঠু, শুনতে পাচ্ছি। তোমার নম্বরটা সেভ করা আছে আমার মোবাইলে।"

"তাহলে উত্তর দিচ্ছিলে না কেন?"

"আসলে তোমাকে জানানো হয়নি কথাটা ... মা বারণ করেছিল তো! তাই..."

"কি কথা?"

"তোমার শরীর ঠিক আছে তো?"

"এই বয়েসে যেমন ঠিক থাকা যায় আর কি! কিন্তু কি কথা, তা তো বললে না! তোমরা সবাই ভালো আছো তো! বৌমা, রঞ্জন ওরা কেমন আছে?"

"আসলে জেঠু, বাবা তো আর আমাদের মাঝখানে নেই ...তাও প্রায় বছর খানেক হতে চললো আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। একটা রোড এ্যাকসিডেন্টে মাথায় লেগেছিল খুব। রক্তে ভেসে লাল হয়ে গিয়েছিল পরনের সাদা জামাটা। হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। আর ফিরে আসতে পারেনি বাড়িতে। এখন মা আমার সাথে ব্যাঙ্গালোরে আছে। আমি একটা চাকরি করছি এখানে। কোচবিহারের বাড়িটা ভাড়া দেওয়া আছে। ... হ্যালো! জেঠু, তুমি শুনতে পাচ্ছো আমার কথা..."

"হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!..." একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্তু ওরফে সন্তোষ কুমার ঘোষ পাশে রাখা হাতল আর গদিওয়ালা লোহার চেয়ারটায় বসে বলে, "হ্যাঁ বাবা অতনু শুনতে পাচ্ছি...ভালো থেকো তোমরা। মায়ের খেয়াল রেখো...এখন রাখছি।"

সন্তু ভাবে, রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বড় হয় বোধ হয় কিছু-কিছু সম্পর্ক। কার যে কখন কার জন্যে মন টানে, সে কথা কি সেই মানুষটি বোঝে, নাকি জানে!! তা না হলে খবরটা এতদিন পরে শুনেও এত বেশি ফাঁকা- ফাঁকা লাগছে কেন ভেতরটা!
(সমাপ্ত)


Next Bangla Story

List of all Bengali Stories


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717