Home   |   About   |   Terms   |   Library   |   Contact    
A platform for writers

বিপন্ন শৈশব

Online bangla Story

-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ আমাদের এই ওয়েবসাইট ( RiyaButu.com )-এ প্রকাশিত গল্পগুলির মধ্যে থেকে কিছু গল্প নিয়ে এবছরই প্রকাশিত হবে আমাদের 'রিয়াবুটু'র গল্প'।
--------------------------



List of all Bengali Stories

বিপন্ন শৈশব

লেখক: রঞ্জিত দে, পিতা- প্রয়াত রমেশ দে, কাঁকুড়গাছি, কলকাতা

( নির্বাচিত গল্প, 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার - মে, ২০২৩' )

##
মেখলা সান্যাল। বিয়ের প্রায় দশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে ওর। বর ছিল নামী কর্পোরেট অফিসের উচ্চ পদস্থ ইঞ্জিনিয়ার অরিজিত সান্যাল। বর্তমানে মেখলা এক অসম সংগ্রাম করে যাচ্ছে, নিজের জন্য নয়, এক বিপন্ন শৈশবকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে।

মেখলা ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় মোটামুটি ভালো ছিল, বর্তমানে ওর শিক্ষাগত যোগ্যতা গ্রাজুয়েট। বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরীজীবী , মা ছিলেন গৃহবধূ। মেঘলা দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী এবং ফর্সা। খুব মজা হৈ- হুল্লোড় করতে ভালোবাসতো। কলেজে পড়ার সময় বন্ধু-বান্ধবরা এক সঙ্গে হলে ভীষণ আনন্দ করতো। এক-সাথে কতো জায়গায় ঘুরেছে সবাই, বন্ধু-বান্ধবরা খুব ভালোবাসতো প্রাণচঞ্চল মেখলাকে। সুন্দরী হলেও ও সব সময় সাজ-গোজ করে থাকতেই ভীষণ পছন্দ করতো। একবার এক আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়ে অরিজিতকে দেখে ওর খুব পছন্দ হয়ে যায়। আর অরিজিতেরও এক দেখায় মেখলাকে খুব পছন্দ হয়। তারপর দু'জনের আলাপ হলে আস্তে-আস্তে সেটা প্রেমের সম্পর্কে গড়ায়। তখন থেকেই ওরা দু'জনে এক-সাথে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতো। সে-সময় অরিজিত ছিল একটা নামী মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার। কর্মসূত্রে ওকে প্রায়ই নানা বিজনেস ককটেল পার্টি অ্যাটেন্ড করতে হতো। সেই সময় মেখলাকেও ও বেশ কয়েকবার ওইরকম পার্টিতে নিয়ে গেছে। এভাবে বেশ কিছুদিন চলার পর একসময় দুই পক্ষের অভিভাবকদের সম্মতিক্রমে ওদের বিয়েটাও হয়ে যায়।

বিয়ের পর অফিসের কাজে সিঙ্গাপুরে যাবার সময়ে মেখলাকেও সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল অরিজিত। সেখানে হানিমুনটাও সেরে নিয়েছিল ওরা। বিজনেস ককটেল পার্টিতে গেলে মেখলা খুব সেজে-গুজে যেতো আর অরিজিতকে সমান ভাবে সঙ্গত করতো। এভাবে আনন্দেই দিন কাটতে থাকে মেখলার। গায়ের রঙটা বিয়ের পর যেন আরও খুলে গিয়েছিল মেখলার , দেখতেও আরও সুন্দরী হয়েছিল। দেশে ফেরার পর একদিন হঠাৎ শরীর খারাপ করে মেখলার। বমি করে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে ও। সঙ্গে-সঙ্গে অরিজিত ডাক্তার কল করে নিয়ে আসে। ডাক্তার ভালো করে দেখে কয়েকটা পরীক্ষা করতে দেয়। অরিজিত উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে, ডাক্তারবাবু খারাপ কিছু হয়নি তো?"

"না তেমন কিছু নয় তবে সম্ভবত উনি কনসিভ করেছেন। পরীক্ষাগুলো করানোর পর আরও ভালো ভাবে বোঝা যাবে," মৃদু হেসে বলেন ডাক্তারবাবু। কয়েকদিন পরে পরীক্ষায় জানা যায় মেখলা সন্তানসম্ভবা। অরিজিত একটু চিন্তিত হয়ে বলে, "এত তাড়াতাড়ি এসব দরকার ছিল না... এখন আমার ক্যারিয়ারের ব্যাপার আছে।"

"সেটা তোমার আগেই মনে রাখা উচিত ছিল, এখন তো এসব বলে কিছুই হবে না," মেখলা বলে।

"কিন্তু তোমাকে তো আমার বিজনেস পার্টিতে যেতে হবে, তোমাকে অফিসের বস ভীষণ পছন্দ করে, তাই তুমি গেলে আমার সুবিধা হয়, এখন এই অবস্থায় কিভাবে যাবে?"

যতদিন যাওয়া সম্ভব হবে ততদিন যাবো। তারপর ঘরেই থাকতে হবে। অরিজিত আর কথা বাড়ায় না।

এরপর বছর দু'য়েক কেটে গেছে, মেখলার কোল আলো করে একটা ফুটফুটে ছেলে সন্তান এসেছে। তাকে নিয়েই সময় কেটে যায় মেখলার। আস্তে-আস্তে বড় হতে থাকে মেখলা-অরিজিতের একমাত্র সন্তান মনোজিত। ওকে মাঝে-মাঝে গভর্নেসের কাছে রেখে পার্টিতে যেতে হয় মেখলাকে। মনোজিতকে একটা কিন্ডারগার্ডেন স্কুলেও ভর্তি করে দিয়েছে মেখলা। ছোটো মনোজিতকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে মেখলা, মনোজিতকে নিজের মনের মতো করে গড়ে তুলবে, ওর বাবা সময় দিতে পারে না তো কি হয়েছে, মেখলা একাই ওকে মানুষ করবে। এইভাবে চলতে থাকে ওদের সংসার। অরিজিত আগের থেকে আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অফিসের কাজে, এখন ও প্রমোশন পেয়ে অ্যাসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার, প্রায়ই অফিস ট্যুরে বাইরে থাকে। আর মেখলা, ছেলে বড় হচ্ছে বলে সেভাবে আর অরিজিতকে সময় দিতে পারে না।

ইদানীং কয়েকটা দিন ধরে মেখলা লক্ষ্য করেছে মনোজিতের মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। কেমন যেন অন্যরকম আচরণ করে। ওর স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে আগে খুব মিশতো, কিন্তু ইদানীং ও আর মিশতে চায় না। আগে সুন্দর আধো-আধো স্বরে কথা বলতো এখন কোনও কথাই বলতে চায় না, অদ্ভুত রকম ভাবে চুপচাপ হয়ে গেছে। ওকে ডাকলে সাড়া দিতে চায় না, যেন শুনতে পায়নি কোনও কথা। ঘরের কোনে বসে থাকে চুপ করে। মেঘলা ওর পরিস্থিতি দেখে ভয় পেয়ে যায়। অরিজিত মাস-খানেক পর অফিস ট্যুর থেকে ফিরে এলে ওকে সব খুলে বলে।

অরিজিত বলে ডাক্তার দেখানোর জন্য, সেই মতো ওরা মনোজিতকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তার ভালো করে দেখে মুখ গম্ভীর করে ফেলে।

"কি হয়েছে ডাক্তারবাবু?"

"ওর বয়স কতো?" ডাক্তার জিজ্ঞেস করে।

"এই তিন বছর ছয় মাসের মতো বয়স," অরিজিত বলে।

"আচ্ছা বলুন তো এরকম কতদিন ধরে চলছে?"

মেখলা সব খুলে বলে ডাক্তারকে।

"ওর মধ্যে 'অটিজমের' সমস্ত রকম লক্ষণ রয়েছে, তবে সম্ভবত প্রথম স্টেজে আছে," ডাক্তার বলে।

"'অর্টিজমটা' কি রোগ ডাক্তারবাবু?" উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে মেখলা।

"'অর্টিজম' হলো স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার অর্থাৎ স্নায়ু বিকাশজনিত একটা সমস্যা। শিশুরাই এই রোগের শিকার হয়, এতে শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়, আচরণগত ভাবে অন্য বাচ্চাদের থেকে একদম আলাদা ধরনের হয়ে থাকে, ওদের খিচুনি, অতি চঞ্চলতা, উদ্বিগ্নতা, বুদ্ধির স্বল্পতা, বিষণ্ণতা, ঘুমের সমস্যা, আচরন জনিত সমস্যা এই ধরনের নানান সমস্যা হতে পারে। এই রোগে বেশ কিছুদিন চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে আর সন্তানের প্রতি বিশেষ ভাবে যত্ন নিতে হবে। আপনি তো ওর মা, আপনাকেই পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে, হয়তো অনেক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিতে হবে শিশুর জন্য আপনাদের দুজনকেই, পারবেন তো?"

সব শুনে যেন আকাশ ভেঙে পড়ে মেখলার মাথায়, কোনোদিন ভাবতে পারেনি নিজের সন্তানকে নিয়ে এইরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। সে ডাক্তারকে বলে, "আমি পারবো ডাক্তারবাবু... ও যে আমার প্রাণ, ওর জন্যে আমার সুখ-আহ্লাদ সব ছেড়ে দেবো," বলতে-বলতে কেঁদে ফেলে মেখলা।

"দেখুন ম্যাডাম, এই রোগ পুরোপুরি না সারলেও নিয়ম মতো চললে অনেকটাই সারে, আর রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপনও করতে পারে। তার জন্যে দরকার পর্যাপ্ত সাহচর্য, সহানুভূতি আর সন্তানের প্রতি বিশেষ মনোযোগ। ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে আর বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করতে হবে, বিভিন্ন ধরনের থেরাপি নিতে হবে, আর ওদের জন্য আলাদা ধরনের স্কুল আছে, আমি আপনাকে এই প্রেসক্রিপশনে সবটাই লিখে দিচ্ছি। আপনি সেই-মতো স্কুলে যোগাযোগ করে নেবেন।"

"হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, আমি সব করতে রাজি। ওর জন্য সব কিছু করতে পারি আমি। ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতেই হবে আমাকে..."

অরিজিত গম্ভীর ভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। একমাত্র ছেলের শৈশব এইভাবে বিপন্ন হয়ে যাবে স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবতে পারেনি মেখলা। মনোজিতের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেখলা আর ভাবে, এবার সত্যিকারের জীবনের লড়াই লড়তে হবে ওর সন্তানের জন্য। মনে-মনে প্রস্তুতি নিয়ে নেয় মেখলা। শুরু হয় এক অন্যরকম লড়াই।

পরের দিন ডাক্তারের কথা মতো স্কুলের ভর্তি করার ব্যাপারে অরিজিতকে বললে, ও তখন অফিসের কথা বলে বেরিয়ে চলে যায়। মেখলা তখন একলা বেরিয়ে খোঁজ করে স্কুলে ছেলেকে নিয়ে উপস্থিত হয়। স্কুলের অফিসে গিয়ে আধিকারিকদের সাথে কথা বলে —
"নমস্কার বলুন," মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক বলেন।

"আমি মেখলা সান্যাল, আর এই আমার ছেলে মনোজিত," বলেই ডাক্তারবাবুর প্রেসক্রিপশন আধিকারিকের হাতে তুলে দেয়। প্রেসক্রিপশন দেখে নিয়ে আধিকারিক বলেন, "আমরা ওকে স্কুলে ভর্তি করে নিচ্ছি তবে অভিভাবক হিসেবে আপনাকে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হবে, অনেক ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতে হবে, অনেকটা সময় ওর জন্যে দিতে হবে তবেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে আপনার সন্তান। কি পারবেন তো?"

"হ্যাঁ স্যার আমি আমার ছেলের জন্য সব কিছু করতে পারবো, আপনি শুধু বলুন আমাকে কি করতে হবে..."

"তাহলে শুনুন, আমরা কিছু পদ্ধতি আপনাকে অনুসরণ করতে বলবো সেটা আপনি সব সময় করে যাবেন। যেমন, ছেলের সাথে বেশি-বেশি করে কথা বলবেন যাতে ও মনে করে ওর প্রতি আপনি খুব মনোযোগী। আর কথা যখন বলবেন তখন ওর দৃষ্টি যেন আপনার দিকে থাকে আর আপনার কথা আর ঠোঁটের নাড়াচাড়া ও যেন অনুসরণ করতে পারে সেটা বিশেষ ভাবে নজর রাখবেন। ওকে ইশারা বা ইঙ্গিত করে মনের ভাব প্রকাশ করতে শেখাবেন। ও যদি কোনও শব্দ উচ্চারণ করে তাহলে সেটাকে অর্থ-পূর্ণ শব্দে পরিণত করার চেষ্টা করবেন। প্রথমে ছোট-ছোট শব্দ বলতে শেখাবেন যাতে ও সেটা রপ্ত করতে পারে। প্রতিদিন একইরকম ভাবে চেষ্টা করে যেতে হবে। একটু শেখা হলে আবার নতুন-নতুন শব্দ বলা শেখাবেন একইভাবে। ছবির বই দেখিয়ে ছবি চেনানো অথবা আপনার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, কোনটা কি, সেটা বোঝানো। আবার রেকর্ডারে ছড়া, গান সময় করে শোনাবেন, দেখবেন অনেক উন্নতি হবে। পরবর্তী পর্যায়ে হাসির জবাবে হাসা, হ্যান্ডশেক করা, নমস্কার করা, কেউ কিছু বললে তার জবাব কিভাবে দেবে, এগুলো সব শেখাতে হবে। সমবয়সী ছেলেদের সাথে মেলামেশা করার সেই চেষ্টা অনবরত করে যেতে হবে। ভাবের আদান-প্রদান করা শেখাতে হবে, ওকে সব জায়গায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করবেন। যেমন খেলার মাঠ, শপিং মল, আত্মীয়স্বজন বা বন্ধু বান্ধবের বাড়ি, যাতে ও সবার সাথে কথা বলতে পারে, যেন কোনোভাবেই নিজেকে ও আলাদা না ভাবতে পারে, এগুলো আজ থেকেই শুরু করে দিন, পরবর্তী পর্যায়ে আরও কিছু ব্যাপার বলে দেবো, সেগুলো ঠিক মতো পালন করলেই দেখবেন আপনি ঠিক সফল হয়েছেন।

"আমি সব করবো স্যার।"

"তাহলে আজ সব ফর্মালিটিসগুলো পূর্ণ করে দিন। আমি ভর্তি আজকেই করে নিচ্ছি। কাল থেকে ওকে স্কুলে নিয়ে চলে আসুন।"

"ঠিক আছে স্যার..."

পরের দিন থেকে শুরু হয় নতুন করে সংগ্রাম মেখলার। অরিজিত সব কিছু মেখলার থেকে শোনে, কিন্তু কিছু বলে না। স্কুলে নিয়ে যাওয়া থেকে বাড়িতে বসে সব সময় মনোজিতকে নিয়েই পড়ে থাকে মেখলা। স্কুলের কথা-মতো সবটাই পালন করে খুব মনোযোগ দিয়ে। মেট্রো-রেলে করেই ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যায় মেখলা। মনোজিতকে একেক সময় ধরে রাখা খুব মুশকিল হয়ে যায়, মেশিনে টোকেন ছুঁইয়ে ভিতরে প্রবেশ করে ট্রেন ধরতে হয়, তখন দুমদুম করে মেশিনে মারে মনোজিত, একদিন তো জঞ্জাল সাফাইয়ের বালতিতে সজোরে পা দিয়ে এমন মেরেছিল যে সে সময় বালতি উলটে সব জঞ্জাল ছড়িয়ে পড়ে প্ল্যাটফর্মে। তখন একজন কর্মী ছুটে এলে লজ্জায় পড়ে যায় মেখলা, হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে নেয়। যাতায়াত করতে-করতে এখন কর্মীরা সবাই চিনে গেছে মেখলা আর মনোজিতকে, প্রয়োজনে ওরা সাহায্য করে দেয় ওদের। একেক সময় উদভ্রান্ত হয়ে যায় মেখলা, যতদিন যাচ্ছে যেন শক্তি বাড়ছে মনোজিতের, তবু ও হাল ছাড়ে না, দাঁতে দাঁত চেপে সংগ্রাম করে চলে প্রতিনিয়ত।

এভাবেই বেশ কিছুদিন কেটে যায়। মনোজিত কিছু কথা পরিষ্কার করে বলতে পারে এখন, স্কুলের নির্দেশ মতো সবকিছু পালন করে মেখলা। এদিকে অরিজিত রাত করে বাড়ি ফেরে এখন, ইদানীং নেশা করা ধরেছে অরিজিত, ছেলের দিকে ফিরেও তাকায় না, কোনও কোনও দিন তো বাড়ির ড্রয়িং রুমেই ড্রিংক করে, কিছু বললে কোনও উত্তর দেয় না, আবার কোনও কোনও সময় মেজাজ দেখিয়ে বলে, "তুমি তোমার কাজ করো..."

"ছেলের প্রতি তোমারও কর্তব্য আছে অরিজিত, আমি একা তো আর পেরে উঠছি না, তুমি সাহায্য করলে ওকে ধরে রাখা সহজ হয়..."

"আমার এতো টাইম নেই..."

"দেখো অজুহাত দিও না... এই রাতের সময়টুকু এসব না করে ওকে একটু সময় দিলে তো ও তো তোমাকে বাবা বলে চিনতেও পারবে। এইটুকুনি একটা ছেলে, তোমার কি মায়া হয় না ওর জন্য?"

"বেশি বকবক না করে নিজের কাজ করো, সারাদিন খেটে-খেটে আমি ক্লান্ত... এসময় আমাকে একদম বিরক্ত করবে না।"

অরিজিতের চোখ-মুখ দেখে মনে-মনে ভেঙে পড়ে মেখলা। ফিরে যায় আবার ছেলের কাছে। ছেলে ওকে দেখে যেন প্রাণ ফিরে পায়। এভাবে বেশ কিছুদিন চলার পর একদিন হঠাৎ রাতের দিকে অরিজিতের কিছু কথা মেখলার কানে আসে। তখন ও দালানে দাঁড়িয়ে কারুর সাথে কথা বলছিলো। মেখলা কান পেতে শোনে অরিজিতের কথা, "তুমি কোনও চিন্তা করো না...আমাকে বিশ্বাস করো, ঠিক সময়ে তোমাকে নিয়ে আসবো আমার কাছে... এখনকার জীবন আমার কাছে অসহ্য... তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই..."

মেখলা বুঝতে পারে কেউ অগোচরে অরিজিতের জীবনে চলে এসেছে আর তার সাথেই কথা বলছে ও। কথা শেষ করে অরিজিত ঘরে ঢুকলে মেখলা জিজ্ঞেস করে, 'কার সাথে রাতে কথা বলছিলে অরিজিত?"

"ওহ, আড়ি পেতে সব শুনেছো!! বাহ দারুণ... উন্নতি হয়েছে তোমার..."

"তুমি ছেলের কাছে আসো না, অথচ বাইরের একজন মেয়ের সাথে কথা বলার জন্য তোমার কাছে সময় আছে?"

"খবরদার!! তুমি এই ব্যাপারে একটা কথাও বলবে না। তোমাদের কোনও ব্যাপারে আমি নেই, তেমনি তুমিও সব ব্যাপারে নাক গলাবে না। টাকা-পয়সা দিয়ে দিচ্ছি তাতে যেটা মনে হয় করার করবে," একটু জোরেই বলে অরিজিত। ঘর থেকে সেই সময় ছেলের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। মেখলা বুঝতে পারে অরিজিতের জোরে বলা কথা মনোজিত বোধ হয় শুনতে পেয়েছে। সঙ্গে-সঙ্গে ওখান থেকে ছেলের কাছে ছুটে যায় মেখলা। মেখলার দিন কাটতে থাকে সংগ্রাম করে। অরিজিত এখন রোজ বাড়িতে আসে না। সে-সময় ফোন করে জানতে চাইলে বলে, "ফিরছি না কাজে ব্যস্ত আছি..." বলে ফোন কেটে দেয়।

মেখলা ছেলের কথা ভেবে কিছু বলতে পারে না অরিজিতকে, নীরবে শুধু কাঁদে কষ্ট হলে, তারপর আবার ছেলের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একদিন ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যাবার পথে মোবাইলে ফোন আসে মেখলার। ছেলেকে সামলে কোনোরকমে ফোনটা দেখে যে অরিজিত ফোন করেছে, আগের রাতেও বাড়ি ফেরেনি - "হ্যালো..."

"তোমার সাথে জরুরি কথা আছে। আমি সন্ধ্যাবেলায় আসছি..." বলে ফোন কেটে দেয় অরিজিত। মেখলা ভাবে আবার কি হলো, কি দরকার ওর মেখলাকে, কিছুই বুঝতে পারে না। সন্ধ্যাবেলায় এসে উপস্থিত হয় অরিজিত, তখন মেখলা ছেলেকে নিয়ে বসেছিল। অরিজিতের আওয়াজ পেয়ে ড্রইং রুমে আসে মেখলা। অরিজিতকে বলে চা খাবে কিনা... "নাহ... জরুরি কাজে এসেছি... সেটা সেরে আবার চলে যাবো," বলে ব্যাগ খুলে একটা কাগজ বের করে মেখলার হাতে দেয়, "কি এটা?"

"ডিভোর্স পেপার... এটা সই করে দাও। আর হ্যাঁ, এই ফ্ল্যাটটা তোমার নামেই করে দিয়েছি, ব্যাঙ্কে দশ লক্ষ টাকা রয়েছে সেটা তোমার জন্য। আর মাসে-মাসে কিছু টাকাও তোমাকে পাঠিয়ে দেবো। তবে যদি এটা পছন্দ না হয় তবে মামলা হলে এগুলো সব বন্ধ হয়ে যাবে মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত। আর মামলার নিষ্পত্তি হলে যা হবে তা আমি এখনই তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি। ভেবে দেখো কি করবে..."

মেখলার মাথায় যেন পুরো আকাশ ভেঙে পড়ে, অরিজিত ওকে চিরকালের মতো ছেড়ে চলে যাবে বলে সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। যাকে একদিন ভালোবেসে বিয়ে করেছিল মেখলা, সে অসুস্থ সন্তানকে ফেলে চিরকালের জন্য চলে যেতে চাইছে। কেঁদে ফেলে মেখলা বলে, "অরিজিত তুমি অসুস্থ ছেলেকে আর আমাকে একা ফেলে পালিয়ে বাঁচতে চাইছো?"

"দেখো কথা বলার সময় আমার কাছে একদম নেই। যা বললাম সেটা করলে তোমার ভালোই হবে, এভাবে কেউ বাঁচতে পারে না। এটা জীবন নয়, আমি বাঁচতে চাই আমার মতো করে..."

"দেখো অরিজিত, এই সন্তান তোমার-আমার ভালোবাসার ফসল। এতে তো কারুর হাত নেই..."

"তোমাকে তো সবটাই বললাম, বাকিটা তোমার হাতে আর..."

ছেলের আওয়াজ কানে আসতে মেখলা বলে, "ঠিক আছে তুমি যা চাইবে তাই হবে। আমি মনোজিতকে দেখে এসেই সব করে দিচ্ছি।"

ডিভোর্স পেপারে সই করে দেয় মেখলা। অরিজিত সেটা হাতে নিয়ে ব্যাগে ভরতে-ভরতে আরও কিছু কাগজ বের করে মেখলার হাতে দিয়ে বলে এখানে ব্যাঙ্কের বই, ফ্ল্যাটের দলিল সবকিছুই আছে। আর এই ফ্ল্যাটে যা-যা আছে সব তোমার। আমি চললাম," বলেই অরিজিত ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যায়। মেখলা অরিজিতের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। ভাবে, আবার বিপন্ন হলো ওর জীবন; একদিকে বিপন্ন শৈশব আর এক দিকে বিপন্ন ওর নিজের জীবন। কালের স্রোতে সব যেন ভেসে যেতে থাকে। চোখের জলে ভেসে যায় মেখলা। হঠাৎ আবার ছেলের কান্না, তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ছেলের কাছে চলে যায় সে।

এবার শুরু হয় মেখলার অন্যরকম জীবন, একদিকে ছেলে আর একদিকে সব। মেখলা ঠিক করে ফেলেছে ছেলের জন্যেই জীবন উৎসর্গ করে দেবে, তাতে যা হয় হবে। সব বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাড়িতে ডেকে সব ঘটনা খুলে বলে মেখলা, "আমার কিছু চাই না তোদের কাছে... শুধু আমাকে কয়েকটা টিউশন ধরে দে তোরা। বাকিটা আমি করবো..."

টিউশন করে ছেলের স্কুলে বেরোনোর আগে আর ছেলেকে নিয়ে ফেরার পর। মনোজিত অনেকটাই শান্ত এখন, নিজের মনেই খেলা করে, পড়েও নিজের মনে, স্কুলে বেশ সুনাম মনোজিতের; পড়াশোনা থেকে সবকিছুতেই দারুণ মনোযোগী হবার কারণে। এরমধ্যে একটা জিনিস আবিষ্কার করে মেখলা, টেপ রেকর্ডারে গান শুনতে-শুনতে অবিকল গান গাইতে শিখেছে মনোজিত। সেই গান যেন বুকে ধাক্কা দেয়; এত প্রাণবন্ত! স্কুলেও অনুষ্ঠানে গান গেয়েছে মনোজিত। অদ্ভুত প্রশান্তি এখন মেখলার মনে। জানলার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে থাকে মেখলা।

এরমধ্যে একটা দারুণ খবর আসে মেখলার। বেশ কিছুদিন আগে মেখলা সরকারী স্কুলে চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিল — দুপুরবেলায় সেদিন আর ছেলের স্কুলে যায়নি ছেলের হালকা জ্বর থাকায়, হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজে মেখলা এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখে ডাক-পিওন। মেখলার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দেয় আর একটা কাগজে সই করিয়ে নিয়ে চলে যায় পিওন। দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকে খামটা নেড়ে-চেড়ে দেখে যে উপরে গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া লেখা রয়েছে। একটু ঘাবড়ে গিয়ে খামটা খুলে কাগজ দ্রুত পড়ে নেয় মেখলা, তারপর খুশিতে কেঁদে ফেলেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। চিঠিটা সরকারী স্কুলে চাকরির নিয়োগপত্র ছিল। আগে পরীক্ষায় পাশ করে ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছিল মেখলা, মাঝে বেশ কিছুদিন কেটে যেতেই সব ভুলে যায় ও। পরের মাসে জয়েন। আর একটা ঘটনা ঘটে, মনোজিতের স্কুলে যাবার সঙ্গে-সঙ্গে মেখলাকে স্কুলের অফিসে ডেকে পাঠান আধিকারিক। কি ব্যাপার, ভেবে উদ্বিগ্ন মনে অফিসে গিয়ে দেখা করলে আধিকারিক বলেন, দারুণ সু-খবর আছে ম্যাডাম। মেখলা ভাবে, তাহলে কি চাকরির খবর কোনোভাবে ওদের কানে পৌঁছেছে নাকি!!

"শুনুন তবে, আমাদের অ্যানুয়াল প্রোগ্রামের মনোজিতের গান শুনে একজন পরিচালক ওকে দিয়ে শিশুদের জন্য তৈরি হওয়া সিনেমাতে গান গাওয়াতে চান। উনি সেদিন আমাদের অনুষ্ঠানে ছিলেন এবং ওর গানের ভীষণ প্রশংসা করেছিলেন। আজ ফোনে এই কথা জানিয়েছেন, আপনি রাজি থাকলে বাকি কাজগুলো উনি এসে করিয়ে নেবেন। মনোজিত আমাদের স্কুলের গর্ব, আপনি কিন্তু 'না' করবেন না ম্যাডাম..."

এক-সাথে জোড়া সুখবর মা-ছেলের জীবনে; এটা ভাবতেও পারছে না মেখলা... চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে ওর।

রবিবার ছুটির দিনে খাওয়া-দাওয়ার পর ছেলের সাথে গল্প করছে মেখলা। ওর রেকর্ডিং খুব ভালো হয়েছে স্টুডিওতে; সেই নিয়েই গল্প। এখন বেশ কিছুটা স্বাভাবিক মনোজিত, অন্যান্য সাধারণ ছেলেদের মতো না হলেও মোটামুটি আস্তে-আস্তে অনেকটাই প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে মনোজিত। হঠাৎ দরজায় কলিং বেলের আওয়াজ। "আবার কে এলো এইসময়?" ভেবে দরজা খুলে দেখে অরিজিত। এ কি চেহারা হয়েছে ওর! গাল ভর্তি দাড়ি, জামা-প্যান্ট নোংরা, উদভ্রান্ত ধরনের।

"আমাকে একটু বসতে দেবে?"

"এসো ভিতরে..."

অরিজিত মেখলাকে ছেড়ে যাবার পর যার সাথে নতুন প্রেম হয়েছিল তাকে বিয়ে করেছিল, কিন্তু সেই মেয়েটি অরিজিতকে ভুলিয়ে সর্বস্বান্ত করে টাকা-পয়সা, নতুন কেনা ফ্ল্যাট, সবকিছু নিয়ে নেয়। তারপর বধূ নির্যাতনের মামলা করে জেলেও ঢুকিয়ে দেয়। সেই কারণে চাকরিটাও চলে যায় অরিজিতের। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সোজা এখানে পৌঁছে যায় অরিজিত। চুপচাপ অরিজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে সব শোনে মেখলা, কিন্তু ওর কোনও মায়া আসছে না।

"তা বলো, কি করতে হবে এখন..." মেখলা বলে।

"আমরা কি আগের মতো আবার থাকতে পারি না মেখলা? আমি অনেক ভুল করেছি... আমি তার প্রায়শ্চিত্তও করেছি এর জন্য... আমাকে কি আবার জায়গা দেবে তুমি?"

"তোমাকে আমি দিতে পারি তবে সেটা তোমার ব্যাঙ্কের সেই আমাকে দেওয়া দশ লক্ষ টাকা। আমি ছুঁয়েও দেখিনি সেটা। আমি তোমাকে সেটা দিয়ে দিচ্ছি, আর তোমার অনেক দামী জামাকাপড় এখানে আলমারিতে আছে সেগুলো তুমি নিতে পারো। ফ্ল্যাটটা আমি মনোজিতের নামে করে দিয়েছি..."

"তাহলে আমাকে থাকতে দেবে না তুমি?"

"আমি তোমাকে তো ছাড়িনি!! একদিন তুমি আমাদের জীবন বিপন্ন করে আমাকে আর আমার অসুস্থ ছেলেকে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলে নিজের ভ্রান্ত সুখের খোঁজে। সেদিন আমি কিছু বলতে পারিনি আমার ছেলের দিকে তাকিয়ে, কারণ ও তখন অসহায় ছিল। আরে আমার কথা না-ই বা ভাবতে, এইটুকু ছেলের কথা তো ভাবতে পারতে!! সেদিন হৃদয়হীনের মতো আচরণ করে চলে গিয়েছিলে। এখন একটু দাঁড়াও আমি আসছি।"

কিছুক্ষণ পর ঘর থেকে বেরিয়ে আসে মেখলা হাতে একটা বড় সুটকেস আর একটা হাত ব্যাগ নিয়ে। "এই ব্যাগে তোমার সব জামাকাপড় আছে আর এই ছোট ব্যাগে ব্যাঙ্কের সব পাশ বই। আশাকরি এতে তুমি নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে। তুমি এবার যেতে পারো..." এইসময় মনোজিত বেরিয়ে আসে ঘর থেকে, "কে মা এই লোকটা?" জিজ্ঞেস করে মনোজিত।

"কেউ না বাবা। একটা অন্য কাজে এসেছিল, এখন চলে যাবে।"

উপায় না দেখে ব্যাগগুলো নিয়ে বেরিয়ে যায় অরিজিত। মেখলার মনে কোনোরকম দুঃখ অনুভব হচ্ছে না। মৃদু হেসে দরজা বন্ধ করে ছেলেকে নিয়ে ঘরে ঢুকে যায় মেখলা।
( সমাপ্ত )


Next Bangla Story

List of all Bengali Stories


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717