-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার - মে, ২০২৪' স্বরচিত গল্প লেখার প্রতিযোগিতা, ( প্রতি বছর মে মাসে )
Result
--------------------------
List of all Bengali Stories
◕
দীপনির্বাপণ
লেখিকা - শ্রীপর্ণা দে, কলকাতা
##
দীপনির্বাপণ
লেখিকা - শ্রীপর্ণা দে, কলকাতা
'প্রতিমা, ওই মেয়েকে আমার বাড়ি থেকে আজই বিদায় দাও। ওর মতো কলঙ্কিনী মেয়ের সঙ্গে এক ছাদের তলায় আমি কিছুতেই থাকব না। সমাজে আমার মান- সম্মান আছে। সেই মান- সম্মানে কেউ কলঙ্ক লেপন করে চলে যাবে তা আমি কিছুতেই সহ্য করব না। এতদিন সে যেখানে ছিল সেখানেই থাকুক। তুমি যদি ওকে এই বাড়িতে আশ্রয় দাও তাহলে আমিই এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাব। আমি সাফ বলে দিচ্ছি তোমায়।'— দুপুরের খাওয়া শেষ করে বিকাশবাবু বিস্ফারিত চোখে অগ্নি-গর্জন করে স্ত্রী প্রতিমাকে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন।
প্রতিমা বিকাশবাবুর সামনে হাতজোড় করে বললেন — 'দোহাই তোমার, একটু চুপ করো। পাশের ঘরে মেয়েটা শুনলে কি ভাববে! যা ভুল হয়েছে সে তো আর ফিরবে না। তুমি এত মাথা গরম করো না। আজ এতদিন পর সুজাতা একটু আশ্রয়ের খোঁজে আমাদের কাছে এসেছে। আমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নিই তাহলে ও কোথায় যাবে! আমার কি অভিমান হচ্ছে না! কিন্তু আমি যে মা। এসময় আমার অভিমান করা চলে না। মেয়ের গোটা শরীরে চাবুকের দাগ দেখে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। তার উপর মেয়েটা পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এই অবস্থায় কি করে মেয়েটাকে বার করে দিই বাড়ি থেকে! তুমিই বলো!'
বিকাশবাবু তাচ্ছিল্যের সুরে প্রতিমাকে বললেন — 'অন্তঃসত্ত্বা! ওর আর ওই বেজন্মাটার সন্তান। ওই সন্তান ওদের দুজনের মতোই বেহায়া, নির্লজ্জ হবে। আমার কয়েক জন্মের পাপ নাহলে সুজাতার মতো মেয়ের জন্ম দিই!! অকৃতজ্ঞ, বেইমান মেয়ে কোথাকার... আমরা ওর কাছে চার বছর আগেই মারা গেছি। আমি বাড়ি না থাকার সুযোগে সাত সকালে ওকে তুমি ঘরে তুলছো, তুমিই ওকে দূর করবে।'
প্রতিমা অস্ফুট কণ্ঠে বললেন — 'রক্তের টান কি বাইরে থেকে দূর করা যায়! কত সহজে বলে দিলে কথাটা। তোমার কি কষ্ট হচ্ছে না মেয়ের এই অবস্থা দেখে! তুমি তো বুকের রক্ত দিয়ে ওই মেয়েকে ভালবেসেছো একদিন।'
বিকাশবাবু আর্দ্র গলায় বললেন — 'ভালোবাসার কি প্রতিদান পেলাম! প্রতিমা, আমি আমার বাইশ বছর শিক্ষকতা জীবন, পঞ্চাশ বছরের ব্যক্তিগত জীবনে কোনো কালির দাগ লাগতে দিইনি। কত ছাত্রছাত্রীকে মানুষের মতো মানুষ করেছি। অথচ নিজের মেয়েকেই মানুষ করতে পারিনি। যাকে এত স্নেহ- ভালোবাসায় বড়ো করেছি, সেই-ই আমার মুখে চুনকালি দিয়ে, আমার উঁচু মাথাটা মাটিতে মিশিয়ে দিলো। আমার গর্বের আনন্দের মিথ্যা ফানুসটা ছিঁড়ে দিলো। কখনো মেয়েটাকে জীবনের চাওয়া- পাওয়া নিয়ে অভিযোগ করতে দিইনি। কোনো দিন কাঁদতে দিইনি। আজ এই অবস্থা দেখে সত্যিই কষ্ট হচ্ছে। বড়ো কষ্ট।'বিকাশবাবুর চোখে জল এসেছে। স্ত্রী প্রতিমার কাছ থেকে নিজেকে লোকানোর জন্য ঘরে চলে গেলেন।
প্রতিমাও চোখের জল নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেন না। আক্ষেপের সুরে প্রতিমা বললেন — 'সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল... হায় ঈশ্বর! এত কিছু সহ্য করার ক্ষমতা দিও মানুষটাকে।'
সুজাতা, বিকাশবাবু ও প্রতিমার একমাত্র সন্তান। বিকাশবাবু- প্রতিমা দুজনেই স্বপ্ন দেখতেন সুজাতাকে তাঁদের মনের মতো করে গড়ে তুলবেন। বিকাশবাবু নিজে স্কুল শিক্ষক হয়েও চাইতেন, তাঁর মেয়ে সুজাতা যেন তাঁর চেয়েও অনেক বড় হয়। সুজাতাও বাবা- মা'র স্বপ্ন-পূরণ করতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। স্কুলে বরাবর প্রথম হয়ে সুজাতা যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে বাবা- মা'র কাছে। সুজাতা শুধু পড়াশোনাতেই নয়, গান, নাচ, ছবি আঁকাতেও যথেষ্ট পারদর্শী। স্কুলের পাঠ শেষ হলে বিকাশবাবু সুজাতাকে দিল্লীর এক নামী কলেজে ভর্তি করে দেন। কলেজে দুটো বছরেই সুজাতা ফার্স্ট ক্লাস হয়ে অধ্যাপকদের নজর কেড়েছিল। বিকাশবাবু- প্রতিমা সুজাতার সাফল্যে মনে মনে বেশ গর্বিত ছিলেন।
সুজাতার জীবন বেশ নিজের ছন্দেই চলছিল। পড়াশোনা ছাড়া কোনোকিছু নিয়ে ভাববার অবকাশ সুজাতার ছিল না। কিন্তু সুজাতার একটা ভুল সিদ্ধান্ত তার সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতন ঘটিয়ে দিল। বি.এ. সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হওয়ার কিছুদিন পর ফেসবুকের দৌলতে সুজাতার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় সাহেব সরকার নামে একটি ছেলের। সাহেবের সঙ্গে ফেসবুকে বন্ধুত্বের সুবাদে সুজাতা জানতে পারে বেশ কয়েকটি কথা। সাহেবের আদি বাড়ি কলকাতায়। দিল্লীতে একটা মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে সাহেব কর্মরত। তার বাবা- মা মারা গেছেন বছর তিন আগে। চাকরি-সূত্রে সে দিল্লীতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে। সাহেবের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট-প্রোফাইলে আপলোড করা ছবিতে সুজাতা তাকে দেখেছে। দেখতে মন্দ নয় সাহেব। ফর্সা, সুঠাম শরীর, মাঝারি উচ্চতা, মুখে চাপ-দাঁড়ি। বয়স ত্রিশের ঘরে।
সাত মাস ফেসবুকেই সুজাতার সঙ্গে সাহেবের কথা চলতে থাকে। সাহেবের কথাবার্তা, আচার- ব্যবহার সুজাতাকে আকৃষ্ট করে। জল জমে বরফ হওয়ার মতো সাহেব- সুজাতার বন্ধুত্ব জমে প্রেমে পরিণত হতেও বেশি সময় লাগেনি। সাত মাস পর সুজাতা সাহেবর সঙ্গে মুখোমুখি দেখাও করে। সম্পর্কের বন্ধন আরও দৃঢ় হয়। দেখতে দেখতে সুজাতার থার্ড ইয়ারের পরীক্ষাও শেষ হয়। পরীক্ষা মিটে গেলে কলেজের মাস-খানেক ছুটিতে সুজাতা বাড়ি ফেরে। বাড়ি ফেরার পর সুজাতার আচার- আচরণ বিকাশবাবুর চোখে সন্দেহজনক লাগে। বিকাশবাবু, স্ত্রী প্রতিমাকে বলেন — 'সুজাতা, কেমন যেন বদলে গেছে। ওকে একটু নজর দিও। ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোন বন্ধুর সঙ্গে যে সময় কাঁটায় কে জানে!'
প্রতিমা বিকাশবাবুকে আশ্বাস দিয়ে বললেন — 'তুমি চিন্তা করো না। আমি মেয়ের সঙ্গে কথা বলে নেবো।'
স্বামীকে দুশ্চিন্তা মুক্ত করতে একদিন কথায়-কথায় প্রতিমা সুজাতার কাছে জানতে চাইলেন যে, সে এত সময় ধরে ফোনে কার সঙ্গে কথা বলে। সুজাতার কাছে এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পেলেন না। শুধু সুজাতাকে বললেন — 'আর যাই করো কোনো খারাপ পথে পা বাড়িও না... আমাদের থেকে দূরে থাকো, চিন্তা তো হয়। তোমাকে নিয়ে তোমার বাবার কত স্বপ্ন। সে স্বপ্ন পূরণ করার চেষ্টা করো।'
সেইদিন সুজাতা তার মায়ের কথায় বিরক্তি ভরে বলেছিল- 'মা, তোমরা সব সময় আমার পিছনে খিটখিট করা বন্ধ করো। আর এভাবে গোয়েন্দাগিরি করলে তো এখন বাড়ি আসা যাবে না! আমি বাচ্চা নই এখন।'
প্রতিমা মেয়ের এই কথায় চরম দুঃখ পেয়েছিলেন। তবু বিকাশবাবুকে কিছু জানাতে পারেননি পাছে মানুষটা কষ্ট পায়। সুজাতা বাড়িতে থাকাকালীন সাহেবও অধৈর্য হয়ে পড়ে। সে সুজাতাকে কাছে পাবার জন্য উন্মাদ হয়ে ওঠে। সে ফোনে সুজাতাকে বলে — 'যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তুমি যদি আমাকে বিয়ে না করো তাহলে আমি আত্মহত্যা করব। আমি তোমাকে ছেড়ে একটা মুহূর্ত থাকতে পারছি না।'
সুজাতা কিছুটা ভয়ে, বিভ্রান্তিতে বলল — 'না, তুমি এসব কিছু করো না। আমি তোমাকেই বিয়ে করব। আমি বাড়িতে এসেছি এখন। তুমি একটু বোঝার চেষ্টা করো।'
তারপর কি ঘটেছিল তা অন্তর্যামী জানেন। হঠাৎ একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে এক বৃষ্টি-মুখরিত সন্ধ্যায় সুজাতা সাহেবের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। বিকাশবাবুরা চার বছর ধরে থানা- পুলিশ করেও সুজাতার কোনো খোঁজ পাননি। এদিকে সাহেব সুজাতাকে বিয়ে করে কাশ্মীরে নিয়ে যায়। সেখানে তারা নতুন সংসার পাতে। নতুন সবকিছু সুজাতার ভালোই লাগে। কিন্তু বিয়ের কয়েক মাস যেতে-না যেতেই সুজাতা বুঝতে পারে যে সাহেব তাকে প্রতারণা করেছে। তার সরল বিশ্বাসকে সে অমর্যাদা করেছে। ফেসবুকের সব পরিচয়টাই চরম মিথ্যা। সুজাতার মনে জমা হয় সাহেবের প্রতি ঘৃণার পাহাড়। সহজ দাম্পত্যের মধ্যে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়াতে তাদের সম্পর্কে তিক্ততা বাড়তে থাকে।
কাশ্মীরে এসে এক-এক করে সাহেবের সব অজানা দিকগুলো সুজাতার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। সাহেবের আসল নাম সহিদুল মোল্লা। কাশ্মীরে এক ভাড়া বাড়িতে দুই বিবি ও এক ছেলে আছে। পাঁচ বছর দিল্লীতে একটা সোনার দোকানে সে কাজ করত। দশ বছর হলো তার মা মারা গেছে। তার বাবা একটা কিডন্যাপিং কেসে ধরা পড়ে হাজত বাস করছে। সুজাতা এসব ঘটনা জানতে পারার পর সহিদুলকে হুমকি দেয় যে, সে থানায় তার নামে অভিযোগ করবে। সুজাতা এত বড় প্রতারণা কিছুতেই সহ্য করবে না। এই কথা সহিদুলকে বলার পর সুজাতার উপর শুরু হয় চরম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
সহিদুল তার দুই বিবির উপর সুজাতাকে নজরবন্দী করে রাখার দায়িত্ব দেয়। সুজাতা প্রতিবাদ করলে এক আধ-বেলা খাবার বন্ধ করে মারধর করে সহিদুল ও তার দুই বিবি। সহিদুল সুজাতার ইচ্ছা- অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে কাছে আসে। ডানাকাটা পাখির মতো প্রতি রাতে যন্ত্রণায় ছটপট করতে থাকে সুজাতা। তিন বছর অমানুষিক অত্যাচার চলল সুজাতার উপর। তারপর একদিন সুজাতা জানতে পারল যে সহিদুল তাকে বিক্রির জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। সে ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে বাঁচার প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকল। সহিদুলের বারো বছরের ছেলের সাহায্যে রাতের অন্ধকারে সুজাতা পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে বাঁচাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। অসহায় সুজাতা মুক্তির খোঁজে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। আজ নিজের বাবা মা'র মুখটা ভীষণ মনে পড়তে লাগল ওর।
চার বছর পর সুজাতা আজ বাড়ি ফিরেছে। তার মা প্রতিমা মেয়েকে ফেলতে পারেননি। তার বাবা বিকাশবাবু মেয়ের এই অন্যায়কে ক্ষমা করতে পারছেন না। সুজাতার ঘরে ফেরাকে কেন্দ্র করে স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে প্রবল অশান্তি বেধেছে। সুজাতাও নিরুপায় হয়ে বাবা মার কাছে আশ্রয় চাইছে। তর্ক-বিতর্ক করে বিকাশবাবু ঘরে গেলে প্রতিমা সুজাতাকে থালা সাজিয়ে খেতে দিলেন। খাবার দেখে সুজাতার চোখ জলে ভরে এলো। সে বলল — 'কতদিন ভালো করে খাইনি। ওরা খেতে দিত না। খাবারের বদলে মার দিত।'
— 'খেয়ে নে। খাবার সময় চোখের জল ফেলতে নেই।'
সুজাতা খাবার মুখে তুলতে গিয়ে বলল — 'বাবা আমার উপর খুব অভিমান করে আছে না! আমার ভুলের জন্য তোমরা এত অশান্তি ভোগ করছ। ভেবেছিলাম আত্মহত্যা করব। কিন্তু পারিনি আমার পেটে নিষ্পাপ বাচ্চার জন্য। তার তো কোনো দোষ নেই। আমার জীবনটা আমারই। কিন্তু আমার পেটে যে তিলে-তিলে বেড়ে উঠছে তার জীবন শেষ করার আমার কোনো অধিকার নেই।'
প্রতিমা সুজাতার চোখের জল মুছিয়ে বললেন — 'তোর উপর বাবার অভিমানটা স্বাভাবিক। দেখবি আস্তে আস্তে সব রাগ পড়ে যাবে।'
প্রতিমার কথা শেষ হওয়া মাত্র বিকাশবাবু ঘর থেকে অযাচিতভাবে বেরিয়ে এসে বললেন — 'আমি ওই মেয়েকে কোনোদিন ক্ষমা করব না। ওর কাছে আমি মৃত। আর আমার মেয়েও চার বছর আগে মারা গেছে।'
প্রতিমা বিকাশবাবুকে বললেন — 'চুপ করো। ওসব কথা বলো না। মেয়েটা একটা ভুল করেছে বলে তুমিও করবে!'
বিকাশবাবু গর্জে উঠে বলেন — 'ভুল!! কিসের ভুল! আমি অন্যায় কিছুতেই মেনে নেব না। নিজে তো সব খুইয়েছে। আমি তো ওর মতো অকৃতজ্ঞ মেয়ের জন্য সব খোয়াতে পারি না।'
সুজাতা ডুকরে কেঁদে বলল — 'বাবা, তোমার কাছে আমি মৃত!'
বিকাশবাবু চোখ মুখ লাল করে বললেন — 'হ্যাঁ মৃত। আমাদের মুখে কলঙ্ক লেপে তোর শান্তি হয়নি। কেন আবার ফিরে এলি! আমাদের কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছিস? আমরা তো তোর কাছে কিচ্ছু চাইনি। রেহাই দে আমাদের।'
সুজাতা বিকাশবাবুর কথায় হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে চলে গেল। প্রতিমা বিকাশবাবুকে মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন — 'দিলে তো মেয়েটার খাওয়াটা নষ্ট করে।'
বিকাশবাবু বললেন — 'খাওয়া নষ্ট! ওর কি একটু লজ্জা আছে! লজ্জা থাকলে ও এই বাড়িতে ঢুকত না। একদিন যে পথে বাবা-মা'র মুখে চুনকালি লেপে ও বেরিয়ে গিয়েছিল সে পথেই পড়ে থাকুক। আমার বাড়িতে আসার তো কোনো প্রয়োজন ছিল না।'বিকাশবাবু গজগজ করতে করতে ঘরে চলে গেলেন।
সুজাতা বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছিল। হঠাৎ প্রতিমার স্পর্শে কান্না কিছুটা স্তিমিত হয়ে এলো। প্রতিমা সুজাতাকে পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন — 'চল খেয়ে নে।'
সুজাতা বলল — 'মা, খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি খাবার নিয়ে যাও।'প্রতিমা মেয়ের কথা শুনলেন না। খানিকটা জোর করেই প্রতিমা সুজাতাকে খাইয়ে দিলেন।
সারাদিনের ক্লান্তিতে খাওয়ার পর চোখের জল ফেলতে ফেলতে সুজাতা কখন ঘুমিয়ে গেছে মনে নেই। প্রতিমা সন্ধ্যাদীপ জ্বালছেন। খুট-খাট শব্দে সুজাতার ঘুম ভেঙে গেল। সুজাতা ধড়পড় করে উঠে বলল — 'সন্ধ্যে হয়ে গেছে?'
প্রতিমা সুজাতার মুখে তাপ দিয়ে বললেন — 'ঈশ্বর, মঙ্গল করো।'
অবসন্ন দিনটা কেটে গেল কোনোরকমে। বিকাশবাবু গোটা সন্ধ্যেটাই বাড়ির বাইরে কাটালেন। প্রতিমাও সাংসারিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। জানালার বাইরের নিশ্চল অন্ধকারটাকে সুজাতা বড়ই ভয় পাচ্ছিল। অন্ধকার যেন তার সমস্ত সত্তায় কালিমা ঢেলে দিচ্ছে। বিকাশবাবু বাড়ি নেই। তাই বাড়িটাও নিস্তব্ধ। আর বড় বাড়িতে বোধ হয় নিস্তব্ধতা একটু বেশিই থাকে। যার ফলে নিঃশ্বাস- প্রশ্বাসের শব্দটা সহজেই শোনা যায়। সুজাতাও শুনতে পেল প্রতিমার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। সুজাতা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মাকে বলল — 'মা, আমার জন্য চিন্তা করো না।'
প্রতিমা সুজাতাকে বললেন — 'চিন্তা করব না ভাবলেই কি চিন্তা দূর হয়ে যায়!'
সুজাতা বলল — 'দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।'
প্রতিমা আক্ষেপের সুরে বললেন — 'ঈশ্বরকে ডাকছি, উনি যেন সব ঠিক করে দেন।'
ঘড়িতে বোধ হয় রাত দশটা। বিকাশবাবু বাড়ি ফিরলেন। বিকাশবাবুর মুখটা কেমন যেন বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। প্রতিমা জিজ্ঞাসা করলেন — 'কি হয়েছে তোমার ? সারা সন্ধ্যেটা কোথায় ছিলে?'
বিকাশবাবু বিরক্তি ভরে বললেন — 'আমার কি হয়েছে তা জানার দরকার নেই। আগে বলো, ওই আপদটাকে বিদায় করেছো। আমি ওর মুখ দেখতে চাই না। বাড়িতে থাকলেই ওর মুখ দেখতে হবে।'
প্রতিমা বিকাশবাবুকে গম্ভীর গলায় বললেন — 'চুপ করো। সুজাতা ঘরে আছে। ও শুনতে পেলে কত কষ্ট পাবে।'
বিকাশবাবু চোখ লাল করে বললেন — 'প্রতিমা, শাক দিয়ে মাছ ঢেকো না। হয় ওই মেয়ে বাড়িতে থাকবে কাল থেকে, না হয় আমি। তোমাকে দুজনের মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নিতে হবে।' বিকাশবাবু নিজেই নিজের খাবার নিয়ে খেতে বসলেন।
সুজাতা ঘর থেকে বাবা-মা'র তর্ক-বিতর্ক শুনতে পেল। পেটে সন্তানের ভারে শরীরটা সুজাতার বড়ই ক্লান্ত লাগে। বিকাশবাবু খেয়ে উঠে যাবার পর প্রতিমা সুজাতাকে খাইয়ে দিলেন। প্রতিমা সুজাতাকে বিছানা করে শুইয়ে দিলেন। বিছানায় শুয়ে সুজাতার নিশ্চিন্তে ঘুম এলো না। এপাশ-ওপাশ করেই কেটে গেল বেশ কিছু সময়। বাবার বলা কথাগুলো সুজাতার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। সুজাতা বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। দেওয়াল ঘড়িটার ভিতর দিয়ে বেহিসেবি সময় বয়ে চলেছে। ঘড়িটার কাঁটা বারো ঘর ছুঁয়েছে। সারা পৃথিবী ঘুমে আচ্ছন্ন। বিবশ অন্ধকার মুড়ে আছে পৃথিবীকে। সুজাতা একটা ভ্যানিটি ব্যাগে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস ভরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সে কি যেন ভেবে একটু এগিয়ে গিয়ে বাবা-মা'র ঘরের দিকে উদাসীন ভাবে তাকাল। রাতের নিস্তব্ধতার ছন্দপতন হল তার পায়ে নূপুরের শব্দে। সুজাতা সচেতন হয়ে নূপুর খুলে ভ্যানিটি ব্যাগে ভরল। তারপর পা টিপে-টিপে সদর দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার সাগরে যেন সুজাতা ডুবে গেল।
সকালে প্রতিমা উঠে সুজাতাকে ডাকতে গিয়ে দেখে যে সুজাতা ঘরে নেই। ঘরে সমস্ত জিনিসপত্র যে অবস্থায় ছিল সেখানেই পড়ে রয়েছে। গোটা বাড়িতে সুজাতাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। মেয়েকে না পেয়ে প্রতিমা কাঁদতে কাঁদতে বিকাশবাবুকে বললেন — 'সর্বনাশ হয়ে গেছে গো। বাড়িতে কোথাও সুজাতা নেই। এই চিঠিটা লিখে সে চলে গেছে।'
বিকাশবাবুর ঘুমের রেশ তখনো কাটেনি। বিছানার পাশে টেবিলে রাখা চশমাটা পড়ে বললেন — 'কি বলছো তুমি!'
প্রতিমা বিকাশবাবুকে দোষারোপ করে বললেন — 'যা হয়েছে সব তোমার জন্য। তুমি যদি মেয়েটাকে ওইভাবে অপমান না করতে তাহলে ও বাড়ি ছেড়ে যেত না।'
বিকাশবাবু মুখ নিচু করে আর্দ্র গলায় বললেন — 'দাও চিঠিটা।'
প্রতিমার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে বিকাশবাবু দেখলেন তাতে লেখা, 'সমস্ত চিন্তার হাত থেকে তোমাদের মুক্তি দিলাম। যে তোমাদের কাছে মৃত তার আর এই বাড়িতে থাকা চলে না। একটা দিন তোমরা আমাকে আশ্রয় দিয়েছ সেটাই আমার কাছে যথেষ্ট। বাবাকে বলো তার মৃত মেয়েটাকে ক্ষমা করে দিতে। তোমরা ভালো থেকো। আমার প্রণাম নিও।'
বিকাশবাবু চিঠিটা পড়ে ভেঙে পড়া গাছের মতো ভেঙে পড়লেন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে প্রতিমাকে বললেন — 'আমি নয় আমার মেয়েকে অপমান করেছি, হাজারটা কথা শুনিয়েছি। প্রতিমা, তুমি তো কোনো কথা শোনাওনি। তোমার ভালোবাসার কোনো দাম নেই!'
প্রতিমা বললেন — 'মেয়েটা বোকার মতো চলে গেল। কি করবে! কোথায় যাবে! ঈশ্বর, মেয়েটা যেখানেই থাক, রক্ষা করো।'
সকালের সূর্যের আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে। কাল এরকম একটা সময় সুজাতা এসেছিল। আজও যদি সেই দিনটা একবার ফিরে আসে। কলিং বেলটা যদি আবারও বেজে ওঠে। বিকাশবাবুর কাছ থেকে উঠে গিয়ে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে সদর দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন প্রতিমা।
( সমাপ্ত )
Next Bangla Story
List of all Bengali Stories
## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers.
The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation.
Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##
◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717