Home   |   About   |   Terms   |   Library   |   Contact    
A platform for writers

পরিতৃপ্তি

Online bangla Story

-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার - মে, ২০২৪' স্বরচিত গল্প লেখার প্রতিযোগিতা, ( প্রতি বছর মে মাসে ) Result
--------------------------



List of all Bengali Stories

পরিতৃপ্তি

লেখিকা: জয়ন্তী চক্রবর্তী, পিতা- উমাপদ চক্রবর্তী, দক্ষিণ ২৪ পরগণা

##
পরিতৃপ্তি

লেখিকা: জয়ন্তী চক্রবর্তী, পিতা- উমাপদ চক্রবর্তী, দক্ষিণ ২৪ পরগণা

সামনে ট্রে-র ওপর সাজানো আটটা কাপ ভর্তি কালো লিকার চা। মাথা নিচু করে একমনে চিনি গুলছিল প্রণব। এমন সময় ঠিক পিছন থেকে কেউ বলল, "এই... চারটে ফ্রেঞ্চ-টোস্ট আর চারটে চা দে তো। জলদি দে... চায়ে দুধ-চিনি বেশি করে দিয়ে বেশ মোটা করে বানাবি," বলেই চারজন ছেলে-মেয়ে ক্যান্টিনের এককোণে চারটে চেয়ার দখল করে একটা টেবিলে বসে পড়ল। প্রণব তাকিয়ে দেখেই নিজের কাজে মন দিল। এখনি এই আটটা চা আগে স্টাফ-রুমে পৌঁছে দিতে হবে। দয়াতে এই কলেজ-ক্যান্টিনের কাজটা পেয়েছে প্রণব; প্রণব সামন্ত। কোভিডে হঠাৎ করেই মারা গেলেন বাবা। আগে বাবাই চালাত ক্যান্টিনটা। দুই ভাই-বোন আর বাবা-মা, এই চারজনের সংসারটা কোনোরকমে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে চলত এই ক্যানটিনের আয় থেকে। সেই সঙ্গে প্রণবও টিউশানি পড়াত তিনটে বাড়িতে বিকেল বেলা। তাতেই তার কলেজের খরচ চলে যেত। সায়েন্স নিয়ে পড়বার ইচ্ছা থাকলেও নেয় নি, বইপত্র কেনার বা টিউশানি নেবার সঙ্গতি নেই বলে। ইংরেজি-অনার্স নিয়ে এই কলেজেই পড়ত সে। হঠাৎ বাবা মারা যাওয়ায় চালু ক্যান্টিনটাতেই বসতে হল তাকে। কলেজে-পড়া মাথায় উঠল। ক্যান্টিনে বসবার পর থেকেই প্রণব লক্ষ্য করেছে সহপাঠী-সহপাঠিনীরা তাকে অন্য চোখে দেখতে শুরু করেছে। কেউ কেউ ইচ্ছে করেই হুকুমের সুরে কথা বলে, ইচ্ছে করেই তাড়া দেয়। ইচ্ছে করেই তার খাবারের বদনাম করে। সব গা-সওয়া হয়ে গেছে প্রণবের। নিজের মার্কা-মারা মুচকি হাসিটি মুখে ঝুলিয়ে নিজের মনে কাজ করে যায় প্রণব। একা হাতেই ধোয়া-মাজা সব করে। একা হাতেই সামলায় খদ্দেরদের।

দ্রুত পায়ে প্রণব স্টাফ রুম থেকে ফিরে এসে দাঁড়াতে-না দাঁড়াতেই কোনের টেবিলে বসে থাকা দলটা খেঁকিয়ে উঠল, "কি-রে, কখন অর্ডার দিয়েছি? পারবি না তো বল, চলে যাচ্ছি।"

প্রণবের রাগ হলেও সে পাল্টা রাগ দেখায় না। বরং হাসতে হাসতে বলে, "খাওয়া হয়ে গেলেই তো চলে যাবি তোরা। তার চেয়ে বেশ তো গল্প করছিস। আমি শুনছি, দেখছি। এমনি দেখা তো আর হয় না।"

ওর কথার মধ্যে লুকিয়ে থাকা কষ্টটা হয়তো ওদের অল্প হলেও স্পর্শ করে। ওরা আর রাগারাগি করে না। প্রণব যত তাড়াতাড়ি পারে ওদের অর্ডারি খাবার ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে আসে। হাসি মুখে নামিয়ে দেয় ওদের সামনের টেবিলে। ওরা খেয়ে টাকা মিটিয়ে চলে যাবার পর আসে সেই মেয়েটা। একাই আসে ও। রোজ একই খাবার নেয়। দু-পিস পাউরুটি আর ছোট্ট বাটিতে ঘুগনি। অল্প কিছুদিন হল আসছে মেয়েটা। বোধহয় বাইরের কোনও কলেজ থেকে এসে নতুন ভর্তি হয়েছে । প্রণবের খুব ইচ্ছা করে শান্ত নিরীহ স্বভাবের মেয়েটার সঙ্গে আলাপ করতে; সাহস হয় না। মেয়েটা আহামরি কিছু সুন্দরী নয়। তবে চোখদুটি ভারি মায়াবী, টানাটানা, আর গভীর কালো দুটি চোখের তারা। প্রণবের আরও ভালো লাগে, কারণ একেবারেই সাজে না মেয়েটা। মাথায় মোটা একটা বেণী আর চোখে সরু একটু কাজল, ব্যাস! এটুকুই তার সাজ। রোজ যে একই সময় সে আসে তা নয়। ক্লাসের ফাঁকে সময় পেলেই চলে আসে ক্যান্টিনে। প্রণব আজকাল বুঝতে পারে, রোজ দশটায় দোকান খোলা থেকে তার মধ্যে একটা উদগ্রীব অপেক্ষা চলতে থাকে, কখন মেয়েটি আসবে, এই জন্য। মেয়েটি কোনও বন্ধুর সঙ্গে আসে না। তাই তার নামটাও জানা হয়নি এখনও।

আজও সে এলো। চোখাচোখি হতেই প্রণব মুচকি হেসে বলল, " দু-পিস রুটি আর ঘুগনি তো?"

মেয়েটা ঘাড় নেড়ে 'না' বলল। কেমন যেন শান্ত বিষাদময় হাসিটুকু তার। প্রণব বলল, "সে-কি? খাবে না আজ?

মেয়েটা বলল, " না...আজ শুধু ঘুগনি আর চা দাও; রুটি থাক।"

এমন কিছু দাম নয় রুটির। মাত্র দশ টাকা, দু-পিস রুটির দাম। তাও নেই মেয়েটার কাছে? অবশ্য ওর সাজ পোশাক দেখলেই বোঝা যায় গরীব ঘরের মেয়ে। অন্যরা যখন রঙ বে-রঙের সালোয়ার-কামিজ, লম্বা ঝুলের স্কার্ট, কিংবা জিনস টি-শার্ট, কত কি পরে; এই মেয়েটা তখন শুধুই শাড়ি পরে আসে, তাও বয়স্কদের মতো হাল্কা এক-রঙা শাড়ি। হয়তো মায়ের শাড়ি। ভাবতে ভাবতে টেবিলের ওপর এক-প্লেট ঘুগনি আর দু-পিস রুটি রেখে দিল প্রণব। মেয়েটা চমকে উঠে বলল, "আমি তো রুটি নেব না বললাম..."

প্রণব হেসে বলল, "দাম নয় কাল দিও..."

- কাল যদি না আসি?

- পরশু দিও...

- পরশুও যদি না আসি?

- তাহলে দিও না।

- বাঃ!! তোমার তো ব্যবসার জিনিস। সব কেনা। ফ্রিতে দিলে চলবে কেন?

প্রণব ঠোঁট উল্টে বলল, "ভারি তো দু-পিস রুটি!! তুমি প্রায়ই আসছ। ছাড় তো। তোমার কোন ডিপার্টমেন্ট?"

- ইংলিশ।

- বাঃ! আমারও... আগে কোথায় পড়তে? হঠাৎ এই মিড সেশনে এসে ভর্তি হলে?" ভাব জমায় প্রণব টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে।

- আগে তো দুর্গাপুর গভর্নমেন্ট কলেজে পড়তাম। এম. এ. এম. সি তে থাকতাম। বাবার কারখানাটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। তখন এখানে মামার বাড়ি চলে এলাম আমরা। তুমিও তো এই কলেজেই পড়তে; তাই না?"

লাজুক মুখে চায়ে চুমুক দিতে দিতে মেয়েটি প্রশ্ন করে। প্রণব বলে, "হ্যাঁ। আমার বাবা হঠাৎ মারা গেলেন। চালু ক্যান্টিনটায় বসে গেলাম তাই। আফটার অল কলেজটা তো আর ছাড়তে হল না।"

দু'জনেই হেসে উঠল। অন্যরকমের একটা বোঝাপড়া যেন তৈরি হয়ে গেল দু'জনের মধ্যে। খাবার পর মেয়েটি নিজের কাপ-প্লেট নিজেই বেসিনে গিয়ে ধুয়ে দিচ্ছে দেখে প্রণব 'হাঁ হাঁ' করে উঠল। মেয়েটা বলল, "আমি তৃপ্তি। তুমি তো প্রণব?"

- কি করে জানলে?

- কেন? সবাই তো বলে প্রণবের ক্যান্টিন... চলি আজ। আবার কাল আসব।"

পরদিন থেকে রোজই আসত তৃপ্তি। আর সঙ্গে করে আনত মোটা-মোটা নোটের খাতা। কোনও-কোনও সময় লাইব্রেরি থেকে ধার নেওয়া কয়েকখানা বইও। নিজের ঝোলার ভেতর থেকে আর একটা ব্যাগে বইপত্রগুলো ভরে রেখে দিয়ে আসত ক্যান্টিনের ভেতর এক কোনায়, পেরেকে ঝুলিয়ে। কোনও কোনও দিন ক্যান্টিন ফাঁকা থাকলে টেবিলে বই-খাতাপত্র নিয়ে মুখোমুখি বসে গল্প করত দু'জন। আলোচনা চলত বিভিন্ন সাবজেক্টের ওপর। এখন আর শুধু রুটি ঘুগনি নয়, কোনও-কোনও দিন ভেজিটেবল-চপ বানিয়ে রাখে প্রণব তৃপ্তির জন্য। ওকে ঢুকতে দেখলেই গ্যাসের একদিকে ফ্রাইংপ্যান বসিয়ে দিত প্রণব। ইশারায় বলত, "একটু বসো... ভাজতে দিয়েছি..."

মুচকি হেসে তৃপ্তি বসে পড়ত কোনের দিকে একটা নির্জন টেবিলে। বইপত্র খুলে মন দিত পড়ায়।

মাস ছয়েক পর পার্ট-ওয়ান পরীক্ষা এসে গেল। প্রণবের নাম কাটা যায়নি কলেজের খাতায়। পরীক্ষায় তাই বসে গেল 'জয় মা..' বলে। বসত না; নেহাত তৃপ্তি ভীষণ জোরাজুরি করল তাই বসতে হল। আর পাশও করে গেল এবাভ ফিফটি পার্সেন্ট নাম্বার নিয়ে। কিন্তু তৃপ্তি কোথায় গেল? যে সবচেয়ে বেশি খুশি হতো প্রণবের এই সাফল্যে, সে যে কোথায় ডুব মারল পরীক্ষার পর! তৃপ্তি আসে না; তাই বই-পত্র কিম্বা নোটসও আর পায় না প্রণব। তার মানে লেখাপড়াটা এবার সত্যি সত্যিই ঘুচলো। মনে মনে সেটা সে সহজ ভাবেই মেনে নিল, কিন্তু মেয়েটা যে কেন আসে না আর, তার কোনও কারণ খুঁজে পেল না প্রণব। মনের মধ্যে কাঁটার মত খচখচ করেই যেতে লাগল ক্রমাগত। তৃপ্তির ঠিকানাটাও তেমন করে জানা হয়নি যে খোঁজ খবর নেবে। শুধু বলেছিল স্টেশনের কাছে থাকে। কিন্তু পরের বাড়িতে মাথা নিচু করে থাকে বলে কখনো বাড়িতে যেতে বলেনি। তাই প্রণব ধরেই নিয়েছিল নিশ্চই বিয়ে হয়ে গেছে তৃপ্তির। ওর সহপাঠীদের কাছে জানতেও চেয়েছে। কিন্তু কেউ কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি। আসলে তেমন কোনও ঘনিষ্ঠ বন্ধু তো ছিল না ওর। খুব চাপা আর অন্তর্মুখী স্বভাবের মেয়ে ছিল ঐ তৃপ্তি।

জীবন থমকে থাকে না। তারপর পেরিয়ে গেছে কত দিন, মাস, বছর। প্রণব বোনের বিয়ে দিয়েছে। ব্যাঙ্ক থেকে কিছু লোন নিয়ে একটা বড়-সড় হোটেল খুলেছে রিভার সাইড রোডের গায়ে। সকালের রুটি-ঘুগনি, লুচি, অমলেট ইত্যাদি টিফিন আর দুপুরে ভাত, মাছ, চিকেন, মাটন, চাটনি সবই পাওয়া যায় এখন প্রণবের হোটেলে। দু'জন রাঁধুনি-কাম হেল্পার রেখে দিয়েছে। নিজে বসে ক্যাশ কাউন্টারে, বেশ নরম গদি আঁটা একখানা চেয়ারে, ঝকঝকে কাঁচের টেবিলের সামনে বসে খাতায় জমা-খরচ মেলায় প্রণব একমনে। কলেজের ক্যান্টিনটা বছর পাঁচেকের জন্যে লিজ দিয়ে দিয়েছে পিসতুতো ভাইকে। চেহারায় খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি প্রণবের। কেবল মাথার সামনের দিকের চুল গুলোয় রুপোলী রঙ ধরেছে সামান্য। সারাদিনই প্রায় খদ্দেরদের ভিড় লেগে থাকে। হিমসিম খায় ছেলে দুটো। একেক দিন ভিড় সামলাতে ক্যাশ বাক্স ফেলে উঠে আসতে হয় প্রণবকে। কিচেন থেকে মাছ-মাংসের বাটি ট্রেতে সাজিয়ে ঘুরতে হয় খদ্দেরদের টেবিলে-টেবিলে। কখনো ক্যাশে বসে বসেই হাঁক মারে, "কৈ-রে পানু, ঊনিশ নম্বর টেবিলে ভাত চাইছে কখন থেকে, শুনতে পাস নি? ছ নম্বরে চিকেনটা দিয়ে যাও শৈলদা।" প্রৌঢ় শৈলেন রায় পৈতে প্রলম্বিত খালি গায়ে 'এই তো যাচ্ছি' বলে তাড়াতাড়ি চিকেনের বাটিগুলো গুছিয়ে নেন ট্রের ওপর। খাটো গলায় মন্তব্য করেন, "শালারা খাচ্ছে দেখ রাক্ষসের মত! যেন ফাঁসির খাওয়া খেয়ে নিচ্ছে।"

সেদিন দুপুরের পর একটু ঝিমুনি মত এসেছিল প্রণবের। বেলা তিনটে বাজে। এই সময়টা ফাঁকাই থাকে হোটেল। ক্যাশবাক্সে চাবি দিয়ে নিজের ছোট্ট রুমটায় এসে বসে থাকে প্রণব বালিশে হেলান দিয়ে। ছোট্ট জানলাটা দিয়ে দেখা যায় দুপুরের উদাস নদী। অনেক দূরে ওপারে মানিকগঞ্জের চরে ইট-ভাটার চিমনি থেকে ধোঁয়া উড়ে যায়। অলস মন্থর গতিতে হেলে দুলে ভেসে-ভেসে আসে দু -একটা ডিঙি নৌকা। উড়ে যায় গাঙচিল। মাথার ওপরের সূর্য হেলে পড়ে পশ্চিমে। মল্লারের চোখ বন্ধ হয়ে আসে। ভাবে, বেলা পড়ে এলো। আর একটু পরেই আরও একটা দিন টুপ করে ডুবে যাবে নদীর ঘোলাটে জলে। আরও একটা দিন। হঠাৎ তন্দ্রাটা ভেঙে যায় মল্লারের পানুর হেঁড়ে গলার তর্কা-তর্কীর শব্দে, "বলছি তো তখন থেকে, কিছু নেই। এতো অবেলায় আর থাকে কিছু?"

- দেখ না ভাই, দুটো ভাত আর একটু ডাল হলেই চলবে। আর কিচ্ছু চাই না।

প্রণব রুম থেকে ঘুম ধরা জড়ান গলায় চেঁচিয়ে বলল, "কি হয়েছে রে পানু?"

- দ্যাখ-না দাদা, বলছি খাবার শেষ, শুনছে না। এই অবেলায় হাঁড়ি-কুঁড়ি মাজার সময় আর কিছু থাকে?

- আহা! তাই বলে খদ্দের ফিরিয়ে দিবি? দাঁড়া দেখছি।

কোমরে দু'হাত চেপে 'উঃ! আঃ!' করতে করতে বাইরে বেরিয়ে আসে প্রণব। সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক মহিলা। কপালে গোল সিঁদুরের টিপ। হাতে শাঁখা। প্রণব কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো অবাক চোখে। তারপর গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বলল, "আপনি একটু বসুন। সব আছে। গরম করে দিতে দু-মিনিট সময় লাগবে।"

সব হোটেলেই সকালের আধ-সেদ্ধ ভাত কিছুটা তুলে রাখা হয়। দরকার মতো বাড়তি এক-ফুট দিয়ে পরিবেশন করে খদ্দের সামলানোর এটাই নিয়ম। পানুরা দিতেই পারত। আসলে বিশ্রামের সময় উটকো ঝামেলা বলে কাটাতে চাইছিল ওরা। প্রেশার কুকারে একজনের মতো ভাত বসিয়ে দিয়ে প্রণব পানুকে ডেকে বলল, "সকালের ভাজা মাছ দু-পিস দিয়ে একটু ঝোল করে দে পানু। ওবেলার আমড়ার চাটনি আছে না খানিকটা...পাঁচ মিনিটের মধ্যে টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে যা। শৈলদা, একটু স্যালাড বানিয়ে ফেল চটপট।"

কিচেন থেকে বেরিয়ে প্রণব দেখল নদীর দিকের কোনের টেবিলখানার একধারে জড়সড় হয়ে বসে আছে মেয়েটি। প্রণব সামনে এসে দাঁড়াল। গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বলল, "তারপর? কেমন আছ তৃপ্তি?"

চমকে উঠে তাকাল মেয়েটি। বলল, "তুমি চিনতে পেরেছ আমায়? আমি তো ভাবলুম...! কী আশ্চর্য দেখো... একযুগ পর এলাম। তোমার কথাই ভাবছিলাম। যাক, দেখা হয়ে গেল। কেমন আছ প্রণব?"

- এইতো। যা দেখছ। তা তোমার বিয়ে হলো কোথায়? কর্তা কি করে? ছেলে-মেয়ে? এতদিন পর এলে, একা কেন?"

তৃপ্তি ম্লান হেসে বলল, "এত প্রশ্নের উত্তর একসঙ্গে দিতে হবে? আমার শ্বশুর বাড়ি মানিকগঞ্জে। মায়ের শ্রাদ্ধে এসেছিলাম। বাবা তো আগেই গেছেন হকারি করতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে। এবার মাও চলে গেলেন।"

প্রণব অবাক হয়ে বলল, "তোমার বর? ছেলেমেয়ে?"

- হয়নি। তাই বরও অন্য জায়গায় বিয়ে করেছে। একটা ছোটো কে.জি. স্কুলে পড়াই আর টুকটাক সেলায়ের কাজ করি। একা মানুষ তো, চলে যায়।"

তৃপ্তি বারবার কিচেনের দিকে তাকাচ্ছে দেখে প্রণব তাড়া দিয়ে বলল, " কিরে পানু, তোদের এখনো হলো না? তো তৃপ্তি, তুমি মামার বাড়ি থেকে এলে, এতো বেলায়। দেখে তো মনে হচ্ছে কিছু খাওনি। তারা কেমন মানুষ? এত বেলায় ছেড়ে দিল?"

- দেবে না? আমি যে অপয়া মেয়ে। মামা স্পষ্ট বলে দিলেন, 'অনেক করেছি তোদের জন্যে। খাইয়ে-পরিয়ে মানুষ করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। নিজের কপাল গুণে ঘর করতে পারলি নি। এখন বোন চলে গেছে। আর কারো কোনও দায় নিতে পারব না।' এ কথার পর আর কেউ তাদের বাড়ি দুটো ভাতের জন্যে বসে থাকে? তুমিই বলো..."

শৈলদা থালা সাজিয়ে ধরে দিল টেবিলে। নুন, লেবু, মাছের ঝোল, আর চাটনি। পানু জলের গ্লাস রেখে দিয়ে বলল, "পাঁপর ভেজে দিই দিদি?"

তৃপ্তি মাথা নেড়ে বলল, "না থাক।"

প্রণব বলল, " থাকবে কেন? পানু দে, দুটো পাঁপর ভেজে দে চট করে। তুমি ধীরে সুস্থে খাও তৃপ্তি। আমি পাখাটা বরং বাড়িয়ে দিচ্ছি।"

তৃপ্তি খেতে খেতে বলল, "খুব সুন্দর হোটেলটা করেছ কিন্তু প্রণব, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।"

- তোমার পছন্দ হয়?

- হবে না? কত বড়! কি সুন্দর সাজানো। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কেমন!"

তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে ধুতে তৃপ্তি বলল, "আজ চলি তবে। দেরি হয়ে গেলে ওপারে আবার ফিরতে রাত হয়ে যাবে। একা মানুষ! মাইল তিনেক পথ যেতে হবে হেঁটে!"

প্রণব একটু ইতস্তত করে, দু-বার কেশে, পিছন ফিরে, নদীর ওপারে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেই ফেলল, "তোমাকে কি ফিরতেই হবে ওপারে?"

তৃপ্তি আঁচলে হাত মুছতে মুছতে অবাক হয়ে বলল, "বারে! তোমায় বললাম না, মামার বাড়ি—"

- এ শহরে আমারও যে একটা বাড়ি আছে তুমি জানো না?

"মা.. মা.. মানে?" তৃপ্তি কাঁধের ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে করতে থমকে গিয়ে প্রশ্ন করল অবাক হয়ে।

প্রণব তৃপ্তির কাছে এগিয়ে এসে ওর হাত থেকে টাকাটা নিয়ে আবার ওর ব্যাগেই ঢুকিয়ে দিল। ওর চোখে-চোখ রেখে বলল, "কত কাল ধরে বসে আছি, তুমি জান? আমার মন বলত ঠিক আসবে তুমি একদিন। সেই যখন এলে আবার চলে যাবে কেন তৃপ্তি?"

তৃপ্তি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো প্রণবের মুখের দিকে। বলল, "তুমি...তুমি আমাকে এখনো মনে রেখেছ? সেই মাত্র ছ-মাসের স্মৃতি ভোলোনি?"

প্রণব লাজুক মুখে হেসে বলল, "কেন? দেখলে না হোটেলের নামটা? 'পরিতৃপ্তি'... তোমার নামে নাম রেখেছি। যাতে কখনো এখানে এলে পথ চলতে চোখে পড়ে তোমার, তাইতো এই 'পরিতৃপ্তি' সাজিয়ে বসে আছি এতকাল। তুমি নামটা দেখেও বুঝতে পারলে না?"

- কিন্তু এত বছর বাদে! এ কি হয়? এ কি সম্ভব প্রণব? কি বলছ তুমি?

- কেন? অসম্ভব হবে কেন? তুমি সেদিনও যা ছিলে, আজও তাই আছ। মাঝ থেকে দু'জনের বয়সটা একটু বেড়ে গেল, এই যা। চলো, তোমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে যাই।"

লজ্জায় মুখ নামিয়ে ফেলে তৃপ্তি। কোনও উত্তর দিতে পারে না। প্রণব জিনিস পত্র গুছিয়ে, ক্যাশ বাক্সে তালা লাগাতে লাগাতে ভাবে, দুনিয়ায় কত অসম্ভব সম্ভব হয়। হঠাৎ হঠাৎ কত আশ্চর্য ঘটনা যে ঘটে যায় ! এক যুগ ধরে চেপে বসে থাকা পাথর এক মুহূর্তে ঘাম হয়ে গড়িয়ে পড়ে যায় বুক থেকে। যেমন আজও সূর্যটা অন্য দিনের মতোই টুপ করে ডুবে গেল ঘোলাটে নদীর জলে। তবুও কিন্তু ডুবলো না। ভুস করে আবার ভেসে উঠলো পূবদিকের আকাশে। তবে পুরো নয়। আধখানা। তা হোক। তাই বা কম কি? কেমন জ্যোছনায় ভরে গেছে কালো নদীর বুকখানা!
( সমাপ্ত )


Next Bangla Story

List of all Bengali Stories


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717