Home   |   About   |   Terms   |   Library   |   Contact    
A platform for writers

দেবগড়ের দেবদূত

Online bangla Story

-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ আমাদের এই ওয়েবসাইট ( RiyaButu.com )-এ প্রকাশিত গল্পগুলির মধ্যে থেকে কিছু গল্প নিয়ে এবছরই প্রকাশিত হবে আমাদের 'রিয়াবুটু'র গল্প'।
--------------------------



List of all Bengali Stories

দেবগড়ের দেবদূত

লেখক - সমরেশ মুখার্জী

##
দেবগড়ের দেবদূত

লেখক - সমরেশ মুখার্জী

চান্দেরী থেকে বাসে দুটোয় ললিতপুর পৌছে বাসস্ট‍্যান্ডের চা-ওয়ালাকে শুধোই, দেবগড়ের বাস কোথায় আসবে? তর্জনী নির্দেশে বুঝি - ওখানেই। কখন আসবে? জড়ো করা পাঁচ আঙুলে বুঝি - এলো বলে। চায়ের দাম? পাঁচ আঙ্গুল ছড়িয়ে সে বোঝায় - পাঁচ টাকা। বুঝি, মুখে গুটখা ঠোসা বলে কথা কইছে আঙ্গুল। সবে চায়ে চুমুক দি‌য়েছি একটা বাস ওখানেই এসে দাঁড়ায়। খর্বকায় চালক লাফিয়ে নেমে 'জাখলোন', 'জাখলোন' বলে চ‍্যাঁচাতে থাকে। বুঝি, স্ট‍্যান্ডে এলে তার ভূমিকা হয়ে যায় সারথী‌ থেকে সংগ্ৰাহকের।

কিছু যাত্রী ছোটে সেদিকে। আমার চুমুক চালু চায়ে। এক‌‌‌‌‌ জায়গায় অন‍্য বাস‌‌ও তো আসে‌। মুখে ঠোসা গুটখা ফেলে চা-ওয়ালা বলে, বাবুজী আপনি এতেই জাখলোন চলে যান। সেখান থেকে দেবগড়ের শেয়ার ট‍্যাক্সি পাবেন। দেবগড়ে‌র সরকারি বাস আসবে চারটেয়। অতক্ষণ খামোখা অপেক্ষা করবেন কেন। পরোপকার করতে গিয়ে বেচারা‌র আধ খাওয়া গুঠখা নষ্ট হয়। বুকে পিঠে স‍্যাক, হাতে কাপ নিয়ে এগোই। কিন্তু একটা হ‍্যান্ডেল ধরে উঠতে পারি না। পাদানি বেশ উঁচুতে‌। অবস্থা দেখে চালক কাপটা নেয়। দু -হাতে হ‍্যান্ডেল ধরে উঠে সীটে বসে বাইরে হাত বাড়াই। লক্ষ্মীট‍্যারা চোখে সরল হেসে এঁঠো কাপ ফেরৎ দেয় সে। তার 'এ‌ক‌ই অঙ্গে এতো রূপে' বিমুগ্ধ হয়ে শুধোই, ভাই, জাখলোনে দেবগড়ের শেয়ার ট‍্যাক্সি পাবো তো? কয়েকবার ধোঁকা খেয়ে ইদানিং কিছু তথ‍্য দু'বার যাচাই করি। সে বলে, অবশ্যই। আমার বাড়ি‌ও দেবগড়ে‌। 'লাশ টিপ' মেরে আমি‌‌ও ওতেই যাই। এবার নিশ্চিন্তি।

ললিতপুরে শিক্ষা হতে জাখলোনে নেমেই দাঁড়িয়ে থাকা অটোয় উঠতে যাই। কলকাতার অটোই ওখানে 'ট‍্যাক্সি'। পরদেশী বুঝে চালক বলে, দেবগড়? সায় পেয়ে বলে, 'তো উস ট‍্যাক্সিমে যাইয়ে'। 'উস ট‍্যাক্সি' দাঁড়িয়ে দুশো মিটার দুরে। স্থানীয়রা নেমেই ছুটেছে। আবার‌ও ধোঁকা। হাঁকপাঁকিয়ে গিয়ে 'ট‍্যাক্সি' চালকের ডাইনে অন্তিম সীট পাই। এখানে সীটে চারজন! চলন্ত ট‍্যাক্সিতে দুই প্রান্তযাত্রী‌র পঞ্চাশভাগ প্রেক্ষাপট ঝোলে শূন‍্যে। তৃতীয় চিমসে যাত্রী বুককেসে অভিধানে‌র মাঝে ঠেসে ঢোকানো ওয়ার্ড‌বুক হয়ে চললো। বার্থডে কেকের স্লাইস সদৃশ সীটে‌র চিলতে অংশে ঠেকনো দিয়ে‌ দিব‍্যি চালাচ্ছে ছিপছিপে চালক রামু। আমার বড় স‍্যাক ছাদে। বুকের স‍্যাক‌‌টা পিছলে পড়ে যেতে চাইছে। সেটা সামলাতে গিয়ে আমার পড়ে যাওয়ার দশা।

রামুকে ট‍্যাক্সি থামাতে বলে দড়ি বেঁধে সেটা ঝুলিয়ে দিই ছাদের রডে। চলন্ত ট‍্যাক্সিতে সেটা ঝুমকো দুলের মতো দোলে কানের পাশে। আমি দু'হাতে দু'পাশের রড ধরে নিশ্চিন্ত। পিছনে মুরগি-ঠাসা হয়ে বসা ছ'জন যাত্রী‌ নির্বিকার। এমন দৃশ‍্য স্থৈর্যবর্ধক। মসৃণ রাস্তায় নয়টি মানুষ, পিছনে দুশো লিটারের ড্রাম, ছাদে তিনটে বস্তা ও আমার গোব্দা স‍্যাক নিয়ে‌ ইতালিয়ান পিয়াজ্জিও 'ট‍্যাক্সি' চলছে। বিমুগ্ধ হয়ে বলি, এতো কিছু নিয়ে বেশ যাচ্ছে তো! ওর 'ট‍্যাক্সি‌র' তারিফে শোলের ধন্নু-গরবিনী বসন্তীর মতো‌ তৃপ্ত হাসে রামু‌।

চলন্ত অটোয় স্বল্প গল্পের ফাঁকে রামু মিনমিনিয়ে বলে, বাবুজী, ছাদের ব‍্যাগটা বেশ বড়। ওটার জন‍্য পাঁচ টাকা 'এসট্রা' লাগবে কিন্তু। জাখলোন থেকে বারো কিমি দেবগড়ের পনেরো টাকা ভাড়া‌‌ কমই লেগেছিল। 'এসট্রা' গায়ে লাগে না বরং ওর বলার ভঙ্গিতে মায়া‌ লাগে। দাবি কত সীমিত! হেসে নিশ্চিন্ত করি ওকে। হয়তো ঐ পাঁচ নিয়েও পঞ্চায়েতি করে স্থানীয়‌রা।

দেবগড়ে জৈন ধর্মশালাই গন্তব্য। ওখানেই নামে ডিজেলের ড্রাম। দেবগড় উত্তরপ্রদেশের ললিতপুর জেলার ছোট্ট একটি গ্ৰাম। ওখানে পেট্রলপাম্প নেই। তাই ধর্মশালার ম‍্যানেজার সুনীল জৈনই পেট্রল, ডিজেল ও কিরানা (মুদী) সামান‌ বেচেন। ছাদের বস্তাগুলো‌‌ দোকানের মাল। ধর্মশালা‌য় গোটা ত্রিশেক ঘর, বেবাক খালি। দোতলায় দ্বিশয‍্যার বাথরুম সমেত পরিচ্ছন্ন ঘর পাই। পিছনের জানলা খুলতে‌ আদিগন্ত সবুজ প্রশান্তির চামর বোলায় মনে। পড়ন্ত সূর্যের সোনালী রোদে সবুজ ক্ষেতের পাশ দিয়ে দৌড়ে আসছে লাল ফ্রক পড়া একটি বালিকা। খিলখিলিয়ে হাসছে। হাওয়ায় উড়ছে চুল। ওকে তাড়া করে আসছে এক ক্ষুদে। হয়তো ওর‌‌ ভাই। দৃশ‍্যটি মনের পর্দায় ফ্রীজ হয়ে যায়।

দেবগড় পর্যটক‌-বিরল জায়গা। তাই শাপে বর হিসেবে আধুনিক‌তার উৎকট অনুষঙ্গ অনুপস্থিত। শান্ত গ্ৰামীণ পরিবেশ। খাবার হোটেলও নেই। ধর্মশালার এক কর্মী সপরিবারে থাকেন। বললে তাঁরাই খাবার বানিয়ে দেন। পঞ্চাশ টাকা থালি। ফ্রেশ হয়ে বাইরে গাছতলায় ছোট্ট চায়ের দোকানে এসে বসি। দুরে কয়েকটি শিশু ধুলো উড়িয়ে খেলছে। একটা মোষ চোখ বুঁজে জাবর কাটছে। কান নাড়িয়ে মাছি তাড়ানোয় গলায় বাঁধা ঘন্টার মৃদু ডুংডুং ঘুমপাড়ানি আওয়াজে শৈশবে পিসিমার অজগাঁয়ের বাড়িতে কাটানো কিছু বাল‍্যস্মৃতি উসকে ওঠে।

আজ চান্দেরিতে দশ কিমি হেঁটে ঘুরেছি। তার‌পর এতোটা এসেছি। বাড়ি থেকে বেরিয়েছি বিশ দিন আগে। বয়সও উনষাট হতে চললো। একটু ক্লান্তই লাগছিল। তবু নির্জন পরিবেশে চায়ে কয়েক চুমুক দিয়ে মন প্রসন্ন হয়ে যায়। সামনে বসা স্থানীয় লোকটি আলাপ করেন। ইউ.পি. ট‍্যূরিজমের রাহি ট‍্যূরিস্ট লজের কেয়ারটেকার। সংস্কার চলছে বলে লজ বন্ধ। নাম বললেন, মালখান সিং। বলি, ঐ নামের একজন তো এককালে পুলিশকে ঘোল খাইয়ে চম্বলের বেহড় কাঁপিয়ে বেড়াতো! মালখান হাসেন, চম্বলের বাগীদের সেই জমানা খতম।

আমার হেঁটে ঘোরা পছন্দ শুনে মালখান কাগজে লাইন স্কেচ করে পথ বাতলে দেন। ললিত‌পুর থেকে আসা পিচ-রাস্তা‌টা ধরমশালাতেই শেষ। আগে চাষের ক্ষেত। দুরে বেতয়া নদী মধ‍্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশের সীমানা হয়ে বয়ে চলেছে। ধরমশালা থেকে বাঁদিকে দেবগড় পাহাড়ে উঠেছে সরু পিচ-রাস্তা। দু'কিমি গিয়ে জৈনমন্দিরে শেষ হয়েছে সেটা। ইতস্ততঃ কিছু ভাঙা দেওয়াল ছাড়া দেবগড় কেল্লার আর কিছু‌‌ অবশিষ্ট নেই। স্কেচ অনুযায়ী পুরাতাত্ত্বিক স্থান‌গুলি দেখতে হাতিগেটের কাছে রাস্তা ছেড়ে বনপথে যেতে হবে। সেটাও গিয়ে ঠেকেছে জৈনমন্দিরে। নীচে ধর্মশালা থেকে মন্দির পরিক্রমা পথ পাঁচ কিমি। তবে বৌধগুফা গেলে দশ কিমি। বলি, এই জঙ্গল তো মহাবীরস্বামী অভয়ারণ‍্যের অন্তর্গত। শুনেছি এখানে নেকড়ে, হায়েনা, লেপার্ড আছে। একা ঘোরা নিরাপদ তো? উনি বলেন, ১২৪১ হেক্টরের অভয়ারণ‍্যের ৫৪১ হেক্টর কোর এরিয়া। পাঁচ কিমি পরিক্রমা পথ বাফার এলাকায়। বিগত ত্রিশ বছরে এদিকে লেপার্ড দেখা যায় নি। তাই ভয়ের কিছু নেই। তবে বৌধগুফা জঙ্গলে‌র গভীরে। ওখানে একা না যাওয়াই ভালো।

মালখানের সাথে আলাপকালে লক্ষ্মীট‍্যারা বাসচালক এসে বসে। মানে ওর আজকের 'লাশ টিপ' হয়ে গেছে। নাম বলে শিশুপাল। দোকানীকে বলি ওকেও চা দিতে। সে জোড়হস্তে বারণ করে। কিঞ্চিৎ টলমলো অবস্থা দেখে বুঝি তার আপত্তি‌র কারণ - সে তখন মজে আছে সোমরসে। শিশু বলে, বলেছিলাম না ঠিক পৌঁছে যাবেন। বলি, সুক্রিয়া শিশুভাই, এক বাত পুছুঁ? শিশু বলে, বেঝিঝক পুছিয়ে। বুড়ো আঙুলে গলায় ঢালার ইশারা করে বলি, চালানো‌র সময়ও চলে নাকি? জিভ কেটে শিশু বলে, না, বাবুজী, গুরুর বারণ আছে। তখন পাবলিকের জান আমার হাতে। শুধু ডিউটি শেষে, সারাদিন ধকলের পর একটু...। বুঝি আমি, এটুকু ওর লাশ টিপে‌র পর রিক্রিয়েশন। ট‍্যারা চোখের অনাবিল হাসিতে শিশুকে প্রথম দর্শনে‌ই ভালো লেগেছিল, অকপট স্বীকারোক্তিতে সেটা গাঢ় হয়।

পরদিন সকালে কিছুটা উঠে ডানদিকে একটা হালকা পায়ে চলা পথের চিহ্ন চোখে পড়ে। কিন্তু হাতিগেট তো ছার, একটা ভাঙা পিলারও অবধি নেই! একটি স্থানীয় লোক আসছিলেন। বলেন, ওটাই পরিক্রমা পথ। বিমূঢ় হয়ে বলি, আর হাতি গেট? রাস্তা ছেড়ে একটু ভেতরে জঙ্গলাকীর্ণ একটা তোরণের ভগ্নাবশেষ দেখিয়ে বলেন, এটাই হাতি গেট। উহ‍্য বক্তব্য, পিচরাস্তায় দাঁড়িয়ে মাথা চুলকোলে হবে কত্তা! একটু আশপাশে নজর করে দেখতে হবেনি? বোকা হেসে বনপথে এগোই।

একে একে আসে বারাহী মন্দির, সিদ্ধগুফা, রাজঘাট, নাহারঘাট। অরণ‍্যের নিস্তব্ধ‌তা স্থান-মাহাত্ম‍্যের মাধুর্যে যোগ করেছে অপরূপ মাত্রা। বেতয়া‌র পাথুরে ঘাটে বসে থাকি। উড়ে যায় ময়ুর। বিরল দৃশ‍্য। অচেনা কাকলীর মাঝে ময়ুরের কর্কশ - ক্রেয়া, ক্রেয়া - ধ্বনি ছড়িয়ে যায় দূরে। অনেক নীচে বেতয়া‌র পেলব শরীরে মেদুর বাঁক। নদী মাতৃত্বের প্রতীক। আসন্ন চৈত্রে‌র তৃষ্ণার্ত বুকে‌‌‌‌ জেগেছে চর, চলছে সাময়িক চাষ। ঘাটের পাথরে বেশ ওপর অবধি জলের দাগে বোঝা যায় বর্ষায় বেতয়া‌‌ হয়ে যায় বেগবতী উগ্ৰচণ্ডিকা। তখন মিলিয়ে যায় তার বুকে স্নেহের চর, তার রোষে প্লাবিত হয় চরাচর। নদীর ওপারে আদিগন্ত শষ‍্যখেত। ওপারে তীরের কাছে একটি নৌকায় রাখা পাম্পসেট থেকে আসছে মৃদু, ঘুমপাড়ানি আওয়াজ - ডিব্‌-ডিব্ - ডিব্-ডিব্…। এছাড়া কাছে দুরে মনূষ‍্য অস্তিত্বের আর কোনো শ্রাব‍্য লক্ষণ নেই।

বনপথ ধরে এগোতে আসে কংক্রিটের ওয়াচ টাওয়ার। সূর্য মধ‍্য গগনে। টাওয়ারের তিন তলায় উঠে প্লাস্টিক বিছিয়ে শুয়ে পড়ি। অরণ‍্যে‌র ঝিমঝিমে আবেশে ঘুমিয়েই পড়ি ঘন্টা দেড়েক। নির্জন প্রকৃতি‌র কোলে সামান্য বিশ্রামেই তরতাজা লাগে। নেমে কিছুটা হাঁটতেই চোখে পড়ে বেশ বড় জৈনমন্দির‌ চত্বরের পিছনে‌র গেট। এখানে রয়েছে অষ্টম থেকে সপ্তদশ শতকে তৈরি ৪১টি মন্দির ও একটি গোলাকার মানস্তম্ভ। পার্শ্বনাথ মন্দির‌টি বড়। পাথরের কাজ সুন্দর। এসব ভারতীয় পূরাতত্ব বিভাগের অধীনে। তবে জৈন সম্প্রদায়ের পূজারী নিয়মিত পূজার্চনাও করেন। জৈন উৎসবে বহু ভক্ত সমাগম হয়। ঘন্টাখানেক ধরে ঘুরে ঘুরে দেখি। ততক্ষণ আর কেউ আসে না সেখানে।

দেবগড় অতীতে গুপ্ত, প্রতিহার, চান্দেলা, গোণ্ড রাজত্বের সাক্ষী। সব পূরাকীর্তি‌র সময়কাল জানা যায়নি। দেবগড়ের উল্লেখযোগ্য পূরাকীর্তি পাহাড়ের নীচে ৫০০ খ্রীষ্টাব্দের গুপ্তকালীন দশাবতার মন্দির‌। হিন্দু মন্দির‌ স্থাপত‍্যকলায় প্রচলিত 'নাগর' শৈলী‌তে নির্মিত মন্দিরে অর্ধমন্ডপ, মন্ডপ, মহামন্ডপ, অন্তরাল পেরিয়ে তবে গর্ভগৃহে বিগ্ৰহ দর্শন করতে হয়। গর্ভগৃহের উপর উচ্চ শিখর, তার ওপর ছাতার মতো অমালক, তারপর খাপুরি ও শিরে কলস। দূরত্বের ব‍্যবধান সত্ত্বেও পূরীর জগন্নাথ‌দেব ও গুজরাটের দ্বারকাধীশ মন্দিরে‌ এই শৈলী সুস্পষ্ট। পঞ্চায়তন শৈলীতে মূল মন্দিরের চার কোনে চারটি ছোট মন্দির থাকতো। খাজুরাহো‌র কান্ডারিয়া মহাদেব মন্দির‌ নাগর ও পঞ্চায়তন শৈলী‌র সংমিশ্রণে‌র নিদর্শন। দেবগড়ে‌র দশাবতার মন্দির উত্তর-মধ‍্য ভারতের প্রাচীন‌তম পঞ্চায়তন শৈলী‌র টিকে থাকা নিদর্শন। এখানে মূল মন্দিরের শিখরের সামান্য অবশেষ ছাড়া নাগরশৈলী‌র বাকি লক্ষণ‌ লুপ্ত। তবে চারপাশে‌ চারটি ছোট মন্দিরবেদী দৃশ‍্যমান।

নীচে এসে দেখি মালখান বসে চায়ের দোকানে। বলে, চলুন আপনাকে দশাবতার মন্দির দেখিয়ে আনি। চারদিকে চারটি সিঁড়ি দিয়ে বেদীতে উঠে পশ্চিম দিকের উন্মুক্ত প্রবেশদ্বার দিয়ে সরাসরি গর্ভগৃহে প্রবেশ করা যায়। তবে গর্ভগৃহে এখন কোনো বিগ্ৰহ নেই। মন্দিরে‌র তিন বহিরঙ্গে রয়েছে বাস রিলিফের কাজ। উত্তরে গজেন্দ্র‌মোক্ষ, পূবে নর-নারায়ন ও দক্ষিণে শেষনাগ বা অনন্ত‌নাগের পাকানো দেহশয‍্যা‌য়, সপ্তফনার ছত্রছায়ায় এলায়িত ভঙ্গিতে শায়িত বিষ্ণু। এই বিভঙ্গ শেষাশায়ী বিষ্ণু, অনন্তশায়ী বিষ্ণু বা Reclining Vishnu হিসেবে সুপরিচিত। বিষ্ণুর মুকুটে পাথরের কাজের সুক্ষতা বিষ্ময়কর। যেন দারুশিল্প। পশ্চিমে বেদীতে ওঠার সিঁড়ির পাশে নন্দপত্নী যশোদা কৃষ্ণকে কোলে তুলে তাঁর সদ‍্যোজাত কন‍্যা যোগমায়াকে বাসুদেবের হাতে তুলে দিয়েছেন। তিনি জানেন কংসের কারাগারে নিয়ে গেলেই তাকে হত‍্যা করা হবে। সেই বিষাদ তাঁর মুখে সুস্পষ্ট। যেন পাথরের ক‍্যানভাসে ছেনি হাতুড়িতে আঁকা ছবি! তবে মালখান খুঁটিয়ে না দেখা‌লে এসব আমার অজানাই রয়ে যেতো।

রাতে ধর্মশালা‌য় সেই কর্মী‌র ঘরে খেতে যাই। গৃহিণী বারান্দায় আসন পেতে দেন। ননদ উঠোনে কাঠের আঁচে রুটি সেঁকছেন। ঘরোয়া রান্না। একটি কিশোরী পড়া ছেড়ে এসে আমলকী‌র আচার দেয়। বলি, যদি বড় দল আসে? গৃহিণী বলেন, তিরিশ জনের বাসপার্টিকেও একঘন্টার নোটিশে খাইয়েছি। বুঝি, ওনার স্বামী‌র চাকরি‌তে মাইনে কম। তাই এমন সুযোগে বাড়ি‌র সবাই লেগে পড়ে কিছু অতিরিক্ত আয়ের আশায়। যেমন ম‍্যানেজার চালান মুদী দোকান। গৃহিণী‌র কণ্ঠে - 'ভাইসাব, আর একটা রুটি দিই? তরকারি নেবেন না?' - শুনে অর্থের বিনিময়ে আহারেও মেলে আত্মীয়‌তার স্বাদ। রেস্টুরেন্টে এসব অমিল।

আমার সাথে আর একজন অতিথি নৈশাহার করলে‌ন। আলাপ হোলো বছর পঞ্চান্নর রমেশ শর্মার সাথে। পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। চাকরি করেন রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা TCIL (Telecommunications Consultants India Ltd), পোস্টিং হায়দ্রাবাদ। পরিবার আছে গোয়ালিয়রে। সংস্থা‌র কাজকর্ম কমে এসেছে। অনেককে এখানে ওখানে ডেপুটেশনে পাঠিয়ে দিয়ছে। কয়েক‌জনকে VRS ধরিয়েছে। স্বচ্ছ ভারত মিশনের আওতায় ভারতীয় পূরাতত্ব বিভাগের কিছু পুরাতাত্ত্বিক সাইটে শৌচাগার নির্মাণ চলছে। পরে ২০১৯এর মে মাসে উত্তরাখণ্ড ভ্রমণে গোপেশ্বরে গোপীনাথ মহাদেব মন্দিরেও দেখেছি‌লাম শৌচাগার, RO Water Plant তৈরী হচ্ছে। দেবগড় পর্যটক-বিরল জায়গা। তবে দশাবতার মন্দির ও পাহাড়ের ওপর প্রাচীন জৈন মন্দিরের বেশ মান‍্যতা আছে। জৈন সমাজের উৎসবের সময় বহু মানুষ আসেন। তাই এখানেও চলছে শৌচাগার নির্মাণের কাজ। রমেশবাবু এখানে তিনমাসের ডেপুটেশনে এসেছেন সেই কাজ পরিদর্শনে। চাকরি বাঁচাতে মানুষ‌কে কত কী করতে হয়, শৌচাগার নির্মাণ পরিদর্শন সে তুলনায় এমন কিছু নয়।

পরদিন সকালে ললিতপুর যাওয়ার সরকারি বাস বাতিল। বাইরে দুটো অটো দাঁড়িয়ে। ছাড়া‌র কোনো ঠিকানা নেই। অন্ততঃ ছজন যাত্রী হলে যাবে। জীবন মনে হয় এখানে ঘড়ির তালে চলে না। শক্তি‌র কাব‍্যে মেঘ আকাশে অলস গাভীর মতো চরে। এখানে সময়ের‌ সেই দশা। তাড়া থাকলে দেড়শো টাকায় রিজার্ভে যাও। আমার একাকী ভ্রমণে শিডিউল মানার তাড়না নেই। অটো চালককে ফোন-নম্বর দিয়ে যাই শীতের সকালে বেতয়ার তীরে। ছাড়া‌র সময় হলে ডাকবে আমায়। গতকাল বেতয়া‌কে দেখেছি পাহাড়ের ওপর থেকে। এখন দেখবো কাছে গিয়ে। মোড় ঘুরতেই দেখি একটা মামূলী ঘরের সামনে গোবর নিকানো উঠোনে দাঁড়িয়ে রামুর ট‍্যাক্সি। রামু অবাক হয়ে বলে, আপনি এদিকে? বলি, আজ সাতটার বাস বাতিল। শেয়ার ট‍্যাক্সি কখন ছাড়বে ঠিক নেই। তাই যাচ্ছি একটু বেতয়া‌র পারে হাওয়া খেতে।

রামু বলে, একটু দাঁড়ান, আমি আপনাকে জাখলোন ছেড়ে দেবো। অটোর সামনে জোড়হস্তে চোখ বুঁজে দাঁড়ায় রামু। নীরবে হয়তো ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে ওর বাহনের সামনে কয়েকবার ধূপকাঠি ঘুরিয়ে নমস্কার করে হ‍্যান্ডেলের সামনে ধূপকাঠিটা‌ গুঁজে দেয়। ওটাই হয়তো ওর পুজো বা অন্নদাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা‌ জ্ঞাপন! রামুর অটোপূজো দেখে মনে পড়ে 'অযান্ত্রিক'-এ কালী ব‍্যানার্জীর অভিনয়। বিমলও জগদ্দলের সাথে কথা বলতো বন্ধু‌র মতো। রেডিয়টরে জল ঢাললে জগদ্দল‌ মানুষের মতো‌ই ঢকঢক আওয়াজ করে জল খেতো। তবে জগদ্দল ছিল ১৯২০ মডেলের এক ঢ‍্যাকারাম শেভ্রোলে। রামুর পিয়াজ্জিও নতুন ঝকঝকে তন্বী।

রামু বলে, চলুন। বলি, ট‍্যাক্সিতে সীট রাখলাম যে? ও বলে, ধুস, ওরা নটার আগে নড়বে না। বলি, রিজার্ভে কত লাগবে? রামু দেশোয়ালী বুলি‌তে বলে, কছু রিজাভ সিজাভ নেহি বাবুজী, আপ এক হি সওয়ারিকা কিরায়া দেনা। রাস্তেমে কোই মিলে তো মেরা নসীব। আমি হতবাক। যে রামু পরশু বড় স‍্যাকের জন‍্য পাঁচ টাকা 'এসট্রা' চায় সে‌‌ আজ কুড়ি টাকায় 'ট‍্যাক্সি' ছোটাবে শুধু আমার জন‍্য! তেলের দামও তো উঠবে না! পরশু সামান‍্য আলাপ হয়েছে ওর সাথে, একটা ছবি তুলেছি ওর, ব‍্যস, এটুকুই। আজ যে চলে যাবো, আর হয়তো কখোনো আসবো না এখানে। তবু রামুর মতো নিম্নবিত্ত মানুষ এমন ঔদার্য দেখায় কীভাবে!

একটু যেতে দেখি শিশুপাল যাচ্ছে হেঁটে। রামু গতি কমায়। শিশু লাফিয়ে চড়ে। বাস না আসায় সেও বারো কিমি হেঁটে জাখলোন গিয়ে 'ফাস টিপের' স্টিয়ারিং ধরবে। বলি, এতোটা হেঁটে যাবে? শিশু নির্বিকারচিত্তে বলে - 'এমনটা তো হয়েই থাকে'। শিশু জানে না এই সংলাপ বাংলায় ঐতিহাসিক। আমি ভোপাল যাবো শুনে ও রামুকে বলে, তু বাবুজীকো 'টেশন' লেকে যা। অমৃতসর-মুম্বাই হামেশা লেট আতি হ‍্যায়। শায়দ মিল যায়েগি। তব বাবুজি‌কো ললিতপুর যানে কা জরুরত‌ নেহি পড়েগা। রামু সায় দিয়ে ধাতব ধন্নুর কান মুচড়োয়। আসার দিন মালের ভারে বেচারি ছিল গজগামিনী। এখন ঝকঝকে সকালে তকতকে রাস্তায় চঞ্চলা হরিণীর মতো ছোটে সে। এক পরদেশীর কাছে মনিবের মান রাখতে হবে যে!

বাসস্ট্যান্ড থেকে স্টেশন আরো দু-কিমি। মোড় ঘুরতে এক স্থানীয় মহিলা ওঠেন। স্টেশনে পাঁচ টাকা দিয়ে নেমে যান। এটুকুই জুটলো রামুর নসীবে। শিশুর থেকে পয়সা নেয়নি। আমি দৌড়ে যাই টিকিট কাউন্টারে। রামু দাঁড়িয়ে থাকে। ট্রেন চলে গেলে ফেরত নিয়ে যাবে বাসস্ট্যান্ডে। ট্রেন আসতে মিনিট দশেক দেরী। টিকিট কেটে এসে রামুর হাতে দেড়শো টাকা‌ই দিই। ওর উদারতার নায‍্য প্রতিদান। গ্ৰাম‍্য রামুর মুখে সরল হাসি বিষ্ময়াবিষ্ট খুশিতে মাখামাখি। তবে দেবগড়ে ওর প্রস্তাবে আমার বিষ্ময়ের নাগাল রামু পায়নি। শহুরে মুখের মলাটের আড়ালে থাকা মনোভাবের নাগাল পাওয়া গেঁয়ো রামুর কম্ম নয়। আমি এগোই। স্টেশনে ঢোকার আগে শেষবারের মতো পিছন ফিরে তাকাই। রামু দাঁড়িয়ে তখনও হাত নাড়ছে। মনের ফ্রেমে বন্দী হয়ে যায় এক দেবদূতসম মানুষের ছবি।
( সমাপ্ত )


লেখকের নিজের কথা: আমি ভ্রমণপিপাসু। ব‍্যাকপ‍্যাকার শৈলী‌তে অপ্রচলিত, পর্যটকবিরল স্থানে একাকী ভ্রমণ আমার সবিশেষ পছন্দ। তাই উত্তরাখন্ড, মধ‍্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থানের অনেক জায়গায় এক-দুমাসের জন‍্য একাকী ভ্রমণে গেছি। বেড়ানোর জায়গার বিশদ হদিশ এখন নেটে, Trip Advisor, Holiday IQ এর মতো ট্র‍্যাভেল সাইটে, YT VDOতে পাওয়া যায়... আমার মনে হয় কিছু মনে রাখার মতো ঘটনা বা মানুষের সাথে আলাপচারিতা যদি গুছিয়ে লেখা যায় তাহলে তা ভ্রমণকাহিনী ও কথাসাহিত্যের যৌথ আঙিনায় ভ্রমণসাহিত‍্য গোছের লাগে। এমন লেখা পড়তে এবং লিখতে আমার ভালো লাগে। তাই এযাবৎ অনেক জায়গায় গেলেও লিখেছি তেমন কিছু জায়গা নিয়ে‌...


Next Bangla Story

List of all Bengali Stories


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717