Home   |   About   |   Terms   |   Library   |   Contact    
A platform for writers

স্বপ্নের সমাধি

Online bangla Story

-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার - মে, ২০২৪' স্বরচিত গল্প লেখার প্রতিযোগিতা, ( প্রতি বছর মে মাসে ) Result
--------------------------



List of all Bengali Stories

স্বপ্নের সমাধি

লেখিকা - জয়ন্তী চক্রবর্তী, দ. ২৪ পরগণা

##
"বাবু, ও বাবু, উঠে পড় বাবা। কত বেলা হয়ে গেলো! এক্ষুনি উঠেই তো আবার এক-পাহাড় বই লিয়ে বসবি। ক'টা দিনের জন্যে বাড়িতে এলি, ক'টা কতা যে কইব তোর সঙ্গে সে সময়টুকুও তোর নেই। নে বাবা ওঠ। মুখে-হাতে টুকুন জল দে। ভোরের বেলা মুড়ি ভেজেছি গরম গরম খেইয়ে নে জিরেন-কাটের গুড় দে। ‌ তোর বাবা হাটে গেল আজ গুড় নে। আমি তোর জন্যে এক ভাঁড় তুলে রেখেছি। তুই ভালবাসিস..." মা মশারির দড়িগুলো খুলতে খুলতে আপন মনে বকে যাচ্ছে কত কথা। প্রদীপ শুনতে পাচ্ছে সবই কিন্তু ঘুমের ভান করে পড়ে আছে। সে জানে এরপর মা বকা দেবে আর তারপর মাথার চুল মুঠি করে ধরে অনেক আদর করবে। অনেক অনেক... বয়স আঠারো পেরিয়ে গেছে তবু মায়ের এই সাত সকালের আদর টুকুবড় ভালো লাগে প্রদীপের। একেবারে সেই ছোট্টবেলা থেকে এই অভ্যাস প্রদীপের। মা ডেকে হেঁকে আদর করে, বকা দিয়ে না তুললে তার কিছুতেই বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না। আর তাছাড়া আজই তো শেষ দিন। ও-বেলাই ফিরতে হবে হোষ্টেলে। বেলা সাড়ে তিনটের ট্রেন; ধরতে গেলে বাড়ি থেকে বাবার সাইকেলের পেছনে চেপে চার-মাইল দূরের বাস-স্ট্যাণ্ড; সেখান থেকে বাস কিংবা অটো ধরে আরো পাঁচ মাইল দূরে স্টেশন। তারপর পৌনে দু'ঘণ্টা বাদুড়-ঝোলা হয়ে কলকাতা। ভাবতেই যেন জ্বর আসে স্বপ্নিলের। সে আবার কুণ্ডুলি পাকিয়ে পাশ-বালিস আঁকড়ে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে। এবার মা মাথার চুল ধরে ঝাঁকাতে থাকে। প্রদীপ মায়ের কোলের মধ্যে মাথাটা গুঁজে দেয়। মায়ের বকুনি শুরু হয়ে যায় আবার।

"হ্যাঁরে বাবু, কত বড় হইয়ে গেলি তুই, এখনো সেই দুষ্টুমি! ওঠ, উঠে পড়। জামা কাপড় যা গোছানোর আমি গুইচে থুয়েচি। বই-টই গুলান তুই গুইচে নে। ও-বেলা দুটো খেয়েই তো আবার বেরতে হবে।"

হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে জীর্ণ তক্তাপোশের মলিন বিছানায় উঠে বসে স্বপ্নিল। ততক্ষণে বাড়ির বাইরে থেকে হাঁক শোনা যায় সুদাম মণ্ডলের, "কৈ গো, কোতায় গেলে? এদিকে এসো। দেকে যাও কত বড় মাছ এনেছি! তাড়াতাড়ি কেটেকুটে রান্না বসিয়ে দাও। খোকা খেয়ে বেরবে।" প্রদীপের মা যশোদার মাছ দেখে তো মাথায় হাত! "ইত্তো বড় মাছখান আনলে? গুড় বেচার সব টাকাগুলান দিয়ে এলে বুজি মাছউলির দোকানে? মনে নাই, বাবুর লতুন জামা প্যান্ট কিনার লেগে উর হাতে লগদ টাকা দিতে হবেক।"

সুদাম মণ্ডল ট্যাঁক থেকে একটা বিড়ি বের করে সুখ টান দিতে দিতে হেসে বলল, "সি টাকার ব্যবস্তা আমি করে রেখেছি। তোমার অত ভাবতে হবেক নাই। আলের বাওলা গাছ কটা বেচে দিচি হালদার বাবুর কাচে। হাজার দুই ট্যাকা পেয়েচি।"

"আর আমার বাবুর কলোজের টাকা? তার ব্যবস্তা হলো?" যশোদা মণ্ডল মাথায় ঘোমটা টেনে বড় রুই মাছখানা নিয়ে আঁশ বঁটিতে গুছিয়ে বসতে বসতে স্বামীকে প্রশ্ন করল। ‌ সুদাম মণ্ডল বলল, "ধলা গাইটা বেচে দুবো ঠিক কইরলাম। সেই ঝ্যাকন আমাদের বাবু ঘরে থাইকবেক লাই। দুধ কে খাবেক! তার চে বরং..." যশোদা একবার ফাঁকা গোয়াল ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখল। একটু আগে ধলা গাইটাকে বাছুর সমেত বাইরে ঘাসের মাঠে বেঁধে রেখে এসেছে। বড্ড গা ঘেঁষা তার গাইটা। মাঠ থেকে তুলতে একটু দেরি হলেই হাম্বা হাম্বা করে পাড়া মাথায় করে তোলে। কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই লম্বা খড়খড়ে জিভ দিয়ে গা চাটতে শুরু করে দেয়। বাছুরটাও ভারি সুন্দর আর তেমনি দুরন্ত। কপালে কেমন সুন্দর একখান লাল টিপ। "আহা! বকনা বাছুরটা। ভারি পয়মন্ত। ও যেদিন হলো সেইদিনই বাবুর ইনজিনিয়ারের খপর বেরলো । এখন তারি কলোজের খরচ দিতি অমন নক্ষী মেয়ে ধলারে বেচে দিতি হবে! কি আর করা যাবে! অদেষ্ট!"

মাছ কেটে পুকুর ঘাট থেকে ধুয়ে এনে যশোদা উঁচু দাওয়ার একধারে দরমা ঘেরা রান্নাশালে গিয়ে ঢুকলো। "আহা! ছেলেটা এবার থেকে কোথায় থাকবে, কি খাবে ভগমানই জানে। গতকাল রাত জেগে এক কৌটো মুড়ির নাড়ু আর নারকেল ছাপা তোয়ের করে রেখেছে। বড় ব্যাগ খানায় ভরে দিয়েছে চুপি চুপি। খুলে যখন দেখতে পাবে কত আনন্দ না-জানি হবে ছেলেটার। আহা!" দশটা নয়, পাঁচটা নয়, একটা মোটে ছেলে তার। তারেই কি ভালো করে দুধটা ঘিটা মাছটা ডিমটা খাওয়াতে পেরেছে কুনোদিন! দিন মজুর বাপের যেখান থেকে যেটুকু আয় সবই তো চলে গেছে ছেলের টিপিশানি আর বই খাতাপত্তর কেনার পেছনে। রেশনের চাল আর উঠোনের বোনা শাকপাতা, কচু ঘেঁচু আর লাউ কুমড়ো খেয়ে বড় হয়েছে ছেলেটা। ভগবান যদি মুখ তুলে চায় একদিন ছেলেটা পাশ-দেবে। বড় চাকরি পাবে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দুটো ভালো মন্দ খেতে পাবে। তেমন দিন কি আর চোখে দেকে যেতে পারবে যশোদা? যা দুকচেটে কপাল তার!" ভাবতে ভাবতে উনুনের ওপর হাঁড়িতে ভাত ফুটে ওঠে। রান্নাশালের সামনে এসে প্রদীপ ডাকে, " ওমা, খেতে দাও। জোর খিদা লেগেচে।"

"এই যে বাপ, দুধটা গরম করি।"

যশোদা হাঁড়ি নামিয়ে তাড়াতাড়ি দুধের কড়া বসায়। কৌটে থেকে মুড়ি বার করে দ্রুত-হাতে। প্রদীপ হঠাৎ বলে, "মা, তোমার বুড়ো আঙুলটা অমন ফুলে আছে কেন গো? ফুলে লাল হয়ে আচে। ব্যথা করে খুব নিশ্চই। কি হয়েছে মা?"

"ইই.. ও কিচু নয় বাপ। আঙুলহাড়া হয়েচে। ও এমনি এমনি সেরে যাবে। তুই খা দিকি। আর দুমুঠো মুড়ি দুব?"

প্রদীপ মায়ের ডান হাতটা টেনে নিয়ে বলে, " ইস! এতটা ফুলেছে! ডাক্তার দেখাওনি কেন?"

"হুঁঃ! ডাক্তার দিখাচ্ছে! আঙুলহাড়ার লেগে কে কবে ডাক্তার দেখায়চে আমাদের পারা গরিব ঘরে? তু নে তো, খেইয়ে নে।"

প্রদীপ গম্ভীর হয়ে যায়। আর কত দিন? আরো অত পথ পাড়ি দিলে তবে গা থেকে এই গরিব গন্ধটা মুছে যাবে? মলিন ছেঁড়া শাড়ির আঁচলে ঘাম মুছতে থাকা মায়ের মুখের দিকে একবার অসহায় ভাবে তাকায় প্রদীপ। গায়ে থাকতে এতদিন বাড়ি বাড়ি টিউশানি করে তবু শ-পাঁচ ছয় টাকা মায়ের হাতে তুলে দিতে পারত সে। এখন জয়েন্ট পেয়ে শহরের নামকরা বড় ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। কপাল নেহাত ভাল। তাই, হস্টেলটা পেয়ে গেছে। তা না হলে যে কী হতো! কলকাতায় তাদের চেনা জানা কেউ নেই যে, তার বাড়ি থাকবে। তাছাড়া জীবনে কখনো এই চাঁপাডাঙা গ্রামের বাইরে যায়ও নি প্রদীপ। সেই একবার মাধ্যমিকের সিট পড়েছিল মানিকগঞ্জ স্কুলে। হেডস্যার ভ্যান-ভাড়া করে সবাইকে নিয়ে ক'দিন আসা যাওয়া করেছেন। তবে ফর্ম তোলা, ভর্তি হওয়া, এসবের জন্যে বেশ ক'দিন একা একা যাওয়া আসা করতে করতে কিছুটা সাহস হয়েছে মনে।

"ও খোকা, ইদিকে আয় বাইরে। দ্যাক কারা এয়েচেন!!" হঠাৎ উঠোন থেকে বাবার গলা শুনতে পেয়ে দুধ মুড়ির বাটি ফেলে বাইরে বেরিয়ে আসে প্রদীপ। দেখে হেড স্যার আর অঙ্ক স্যার এসেছেন। প্রদীপ দৌড়ে গিয়ে স্যারদের পা ছুঁইয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই তারা মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন, "বেঁচে থাক বাবা। স্কুলের মুখ উজ্জ্বল কর। গ্রামের মুখ উজ্জ্বল কর। বাপ মায়ের মুখ উজ্জ্বল কর।" হেডস্যার বলতে লাগলেন, "তোকে নিয়ে আমাদের সবার অনেক স্বপ্ন প্রদীপ। এর আগে এই স্কুল থেকে কেউ জয়েন্ট পায়নি।"

অঙ্ক স্যার বলে উঠলেন, "সে দোষ আমাদের; ছাত্রদের নয় স্যার। বাংলা মিডিয়াম ইস্কুল দেখলেই পরীক্ষকরা খাতা ভালো করে দেখেই না। একে তাকে দিয়ে খাতা দেখায়। নম্বর দেয় গড় পড়তা।" হেড স্যার হাসতে হাসতে বললেন, "তাহলে আমাদের প্রদীপ বেরিয়ে এল কি করে?"

অঙ্ক স্যার বললেন, "সেটা কিছুটা ওর কপাল বলতে পারেন। তা যাকগে, যাই হোক বাবা, তুই আমাদের স্কুলের গর্ব। আমাদের অহঙ্কার! তা আজই বেরচ্ছিস তো?"

প্রদীপ বিনম্র ভাবে বলল, " হ্যাঁ, স্যার! আজ বিকেলে সাড়ে তিনটের ট্রেনে । বাবা তুলে দিয়ে আসবে।"

হেডস্যার বললেন, "হোস্টেলও পেয়ে গেছিস শুনলাম। খুব ভালো। সাবধানে থাকবি বাবা। কলকাতা ভারি গোলমেলে জায়গা। তুই গ্রামের সাদাসিদে ছেলে। ওখানকার সব চালবাজ পাজি ছেলেদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করতে হবে না। নিজের মত থাকবি আর মন দিয়ে পড়াশোনা করবি। এই নে বাবা, ক'টা টাকা রাখ। বই-টই কিনতে হলে কিনে নিস। আর পরে আরো টাকা পয়সা লাগলে বলিস। যা যতোটা পারি আমরা টিচাররা চাঁদা তুলে পাঠিয়ে দেব..."

অঙ্ক স্যার বললেন, "হ্যাঁ প্রদীপ, বেশ করে কোমর বেঁধে পড়াশোনা করে দেখিয়ে দে তো বাপ, আমাদের এই চাঁপাডাঙা শচীরানী উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের মতো অজ পাড়াগাঁ'র বাংলা ইস্কুল থেকে পড়েও কেউ বড় কিছু করে দেখাতে পারে।"

প্রদীপের দুই চোখের পাতা ভিজে উঠেছিল। সে নিচু হয়ে স্যারদের প্রণাম করতে করতে মনে মনে বলল, "আশীর্বাদ করুণ স্যার, আপনাদের এতো ভালবাসার সম্মান যেন রাখতে পারি। হে মা কালী, হে মা শীতলা, হে বাবা পঞ্চানন, তোমরা আমার সহায় হয়ো।"

সেদিন সন্ধ্যায় প্রদীপ যখন হোস্টেলে এসে পৌঁছুল তখন উজ্জ্বল আলোকমালায় সেজে উঠেছে তিলোত্তমা কলকাতা। দোতলার বারান্দা থেকে তাকে দেখেই কতকগুলো ছেলে প্রায় সমস্বরে বলে উঠলো, "ঐ তো, ঐ তো আসছে শচী-রানী। আসুন আসুন আসুন।"

প্রদীপ হঠাৎ এহেন উদ্ভট সম্ভাষণে কুঁকড়ে গেল। একতলায় ওর ঘর। দুজনের সিট। আগের জন আগেই এসে ছিল। প্রদীপ দরজায় নক করতেই খুলে গেল। ঢুকেই বিছানায় বসতে যাবে এমন সময় হুড়মুড় করে সেই দোতলার ছেলেগুলো দলবেঁধে ঢুকে পড়ল ঘরে। একজন ওর ব্যাগের চেন টেনে খুলে ফেলে বলল, "এই, কি এনেছিস বাড়ি থেকে শিগগীর বের কর।"

প্রদীপ রেগে গিয়ে ব্যাগটা ওর হাত থেকে টেনে ছিনিয়ে নিয়ে বলল, "ওকি করছ তোমরা? ওতে কিচ্ছু নেই। ছাড়ো... সরো, সরে যাও..."

ছেলেগুলো হৈহৈ করে হাসতে হাসতে বলল, "কি! সরে যেতে বলছিস? ওরে শচী-রানী সরে যেতে বলছে। তার মানে নির্ঘাত রাজভোগ-টাজভোগ আছে। নে খোল... খুলে ফ্যাল।"

ছেলেগুলো জোর করে প্রদীপের হাত থেকে ওর সস্তা কিটস ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে সব কিছু উপুড় করে ঢেলে ছড়িয়ে ফলল। প্রদীপ অবাক হয়ে দেখল পুরনো গামছা ছেঁড়ার পুটুলিতে বাঁধা মুড়ির নাড়ু। তার বড় প্রিয় খাবার। আর একটা পুটুলিতে বাঁধা কটা কালো কালো গুড়ের তৈরি নারকেল নাড়ু। প্রদীপ জানেও না, মা লুকিয়ে কখন দিয়ে দিয়েছে। ছেলেগুলো মায়ের পাঠানো ঐ খাবার জিনিসগুলো নিয়ে ছোঁড়া ছুঁড়ি করছে, ঠাট্টা বিদ্রূপ করছে, অশ্লীল ব্যাঙ্গ করছে। প্রদীপ আর সহ্য করতে পারল না। কেঁদে ফেলে বলল, " কেন তোমরা আমার মা বাবাকে নিয়ে এমন নোংরা নোংরা কথা বলছ? কী দোষ করেছেন তারা? কেন ফেলে দিলে আমার মায়ের পাঠানো খাবার গুলো?"

"ওরে আমার মায়ের খোকন রে! আবার কাঁদছে দেখো কেমন ফুলে ফুলে! আহাহাহাহাহা। এই তোরা ওকে নিয়ে ওরকম করছিস কেন রে! বেচারা কান্নাকাটি করছে! ছেড়ে দে।" একজন ছুটে এসে ওর গালে চকাস চকাস করে দুটো চুমু খেয়ে বলল, "কী মিষ্টি দেখতে গো তুমি ছচীরানী। আমার সঙ্গে কিন্তু তোমার ফাইনাল হয়ে গেল..." একটা অশ্লীল ভঙ্গী করল ছেলেটা। অন্য ছেলেগুলো ফেটে পড়ল অট্ট হাসিতে। আর একজন হাসতে হাসতে বলল, "তা শচী রানী... চলো ছাতে যাই..."

প্রদীপ চিৎকার করে উঠলো আতঙ্কে, " ছাড়ো... ছেড়ে দাও আমায়। পায়ে পড়ি তোমাদের‌। আমার মা বাবা ... " কথা শেষ করতে পারল না প্রদীপ। ধাঁই করে একটা রাম ঘুঁষি ছুটে এসে প্রদীপের নাকের ওপর পড়ল। দরদর করে রক্ত বের হচ্ছে। প্রদীপ তখনো হাত পা ছুড়ে যাচ্ছে সমানে, "ছেড়ে দাও আমায়... ছেড়ে দাও। আমি কি করেছি তোমাদের?"

ও যতো ছটফট করছে আর চেঁচাচ্ছে, ছেলে গুলো তত উল্লাসে ফেটে পড়ছে। কে একজন বলল, "নানুদা এটাকে চলো চ্যাঙদোলা করে ছাতে নিয়ে যাই।"

নানুদা বলল, " ইঃ! কত শখ! পালকি চড়ে যাবেন! হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চল। বেটা গাঁইয়া ভূত কোথাকার! নানু নাথ কে বলে কিনা সরে যাও। দাঁড়া আজ তোর বাপের বিয়ে দেখিয়ে ছাড়ব। চল, নিয়ে চল টানতে টানতে। শালা আট বছর আছি। এত বড় কথা বলতে কেউ সাহস করেনি। দাঁড়া তোর ভালো রকম টিউনিঙ করা দরকার। নে চল তোরা। দাঁড়িয়ে রইলি কেন? ওকে বুঝিয়ে দিতে হবে নানুর দলবলের কথা না শুনলে কি হয়।"

ওরা প্রদীপের ব্যাগ থেকে গেঞ্জী বের করে তাই দিয়ে ওর মুখটা ভালো করে বেঁধে হিড়হিড় অরে টানতে টানতে ছাতের ওপর নিয়ে চলল। প্রদীপের গোঙানির শব্দ আর শোনা যাচ্ছিল না। কেবল তার দুটি চোখের কোল দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল বিন্দু বিন্দু অশ্রু কণা।

সেদিন গভীর রাতে, ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে যশোদার হঠাৎ মনে হলো তার বাবু যেন তাকে ডাকছে, " মা, ওমা, খেতে দাও না। বড্ড খিদে পেয়েছে।" চমকে বিছানায় উঠে বসল যশোদা। মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। বাকি রাতটুকু আর ঘুম এলো না দু চোখের পাতায়। কে জানে কি করচে ছেলেটা। হে ঠাকুর, হে মা শেতলা, হে মা মঙ্গলচণ্ডী, তোমার থানে আড়াইশো বাতাসার হরির নুট দেব মা। ছেলেটার ভালো খবর এনে দিও। বাছাকে আমার ভাল রেখো মা, বাঁচিয়ে রেখো।"

সেদিন সকালে বেড়া চাঁপা গ্রামের একমাত্র চায়ের দোকানে লোকে লোকারণ্য। হেডমাস্টার মশাই পঞ্চাননবাবু বাজার করতে যাচ্ছিলেন। লোকজনের ভীড় দেখে থমকে গিয়ে কাকে যেন জিজ্ঞেস করলেন, " কি হয়েছে হে? ওখানে অত ভীড় কিসের?"

কয়েকজন এগিয়ে এল হেডমাস্টার মশাই কে দেখে। এক জন হাতে ধরা খবরের কাগজটা স্যারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "এই যে মাসটার মশাই, দেখুন না... কী সব যে হচ্ছে আজকাল! দেখুন তো ভাল করে, ছেলেটাকে চিনতে পারছেন?"

পঞ্চানন বাবু দেখলেন সামনের পাতায় বড় বড় হেডলাইনে বেরিয়েছে খবরটা। হস্টেলের ছাত থেকে পড়ে ইঞ্জিনীয়ারিং ছাত্রের আত্মহত্যা! উপুড় হয়ে পড়ে আছে ছেলেটা। কিন্তু ইনসেটে ও কার মুখ। চশমা খুলে ফেললেন হেডস্যার! থর থর কাঁপছে দুটো পা, "প্রবীর! এতো আমাদের প্রবীর!" কয়েকজন চেঁচামেচি করে উঠল, "ধর ধর স্যারকে ধর। পড়ে যাবে এক্ষুনি... " ধরতে হল না। রাস্তার ওপর মাটিতে বসে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন বেড়াচাঁপা শচী-রানী উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পঞ্চানন বাবু। "পারলিনি বাবা,! হেরে গেলি! তোকে জোর করে হারিয়ে দিল ওরা!"
( সমাপ্ত )


Next Bangla Story

List of all Bengali Stories


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717