Home   |   About   |   Terms   |   Library   |   Contact    
A platform for writers

ওপারের কণ্ঠস্বর

Online bangla Story

-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ 'নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার - মে, ২০২৪' স্বরচিত গল্প লেখার প্রতিযোগিতা, ( প্রতি বছর মে মাসে ) Result
--------------------------



List of all Bengali Stories

ওপারের কণ্ঠস্বর

লেখক: অগ্রদীপ দত্ত, জলপাইগুড়ি

##

||এক||
একটা মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে অনেকক্ষণ ধরে। পাশের দুটো রুমেই পর্দা নামানো। সামনের সোফায় বসা ভদ্রমহিলা বললেন, তুমি একাই থাকবে তো? না আর কেউ আছে? বন্ধু- বান্ধব?

- একাই। চুমুক মেরে টেবিলে কাপটা নামিয়ে রাখল সায়ন্তন। ঠিক তখনই নজর পড়ল ভদ্রমহিলার পেছনের ওয়াল পেন্টিং- এ। ছবিটা যে হাতে আঁকা বুঝতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। দক্ষিণের দেওয়ালে অজস্র মেডেল ঝোলানো। ছোট বড়ো বিভিন্ন ধরণের ট্রফি, কাপ, সার্টিফিকেট ভর্তি একটা শো- কেস। তার ঠিক উপরেই টাঙানো পোট্রের্টটা। গ্রিল-হীন জানালার ভেতর থেকে মেয়েটা সোজাসুজি সায়ন্তনের দিকে তাকিয়ে আছে বলে মনে হচ্ছে।

- ছবিটা আমার মেয়ের। এবার কলেজে উঠল।

পাশের ঘর থেকে আচমকা এক ভদ্রলোক বেড়িয়ে এসে কথাটা বলল। স্যান্ডো গেঞ্জি আর ঢিলেঢালা একখানা পায়জামা পরে আছেন, মাথায় উসকো- খুসকো চুল। মুখে হাসি ঝুলিয়েই ছবিটার থেকে চোখ সরিয়ে সায়ন্তনের দিকে তাকালো লোকটা। মেয়ের ছবি আড়চোখে দেখছিল, সেটা লক্ষ্য করেই বোধ হয় ভদ্রলোক এই ঘরে এলেন। অপ্রস্তুত হয়ে চোখ নামালো সায়ন্তন। ভাড়া বাড়ি দেখতে এসে বাড়িওয়ালার মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা কাঙালপনা ছাড়া আর কিছু না। ছিঃ কী ভাবল এরা। সায়ন্তন লজ্জিত-বোধ করল। একটু হেসে বলল, না মানে ছবিটা এত জীবন্ত। তাই আর কি...

- শুধু তুমি নও। যারাই আসে মুগ্ধ হয়। আমিও হই। নামকরা শিল্পীর আঁকা। প্রত্যয়ভাস্বর জানা। বলে ভদ্রলোক একচোট হাসলেন। সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল সায়ন্তন। নিজের মেয়ের রূপে প্রত্যেক বাবাই মুগ্ধ হয়। সেটা বড়াই করে বলার কিছু নেই।

- একটু বসো, আসছি। বলে ভদ্রমহিলা তার স্বামীকে গিয়ে কিছু একটা বললেন। তারপর দু'জনেই পাশের রুমে চলে গেলেন। এই ফাঁকে সায়ন্তন পেন্টিংটার কাছে গিয়ে একটা ছবি তুলে নিল মোবাইলে। মেয়েটা বাড়াবাড়ি রকমের সুন্দরী। হাতে আঁকা ছবিতেই যদি এই রূপ হয়, তাহলে সামনা-সামনি কেমন হবে কথাটা ভাবতেই অস্পষ্ট একটা অবয়ব ফুটে উঠল চোখের সামনে। মিহি কণ্ঠস্বরটা আবার ভেসে আসছে সাথে হারমোনিয়ামের ছন্দবদ্ধ সুর। মেয়েটা গানও করে!! যেমন দেখতে, তেমনই গলা। চোখ দুটোর মধ্যেও আশ্চর্য এক মায়া আছে। অদ্ভুত একটা ঘোর লেগে গেল সায়ন্তনের। 'পারত্রিকা' চলে যাওয়ার পরে সুযোগ পেলেও অন্য কারোর সাথে আর সম্পর্কে জড়াতে পারেনি; হয়ত চায়ওনি। কিন্তু আজ অনেকদিন পর ভেতর ভেতর একটা অস্বস্তি টের পেল। চাবির গোছা হাতে নিয়ে ভদ্রমহিলা আসলেন, চলো তোমাকে রুমগুলো দেখিয়ে আনি।

এক-ঝলক চোখ বুলিয়ে সায়ন্তন পোট্রের্টের আশ-পাশে মেয়েটার নাম খোঁজার চেষ্টা করল; পেল না।

খুব যে পছন্দ হল তা নয়। দু'কামরার রুম। ঘরের ভেতর ভ্যাপসা একটা গন্ধ। অনেকদিন দরজা জানালা বন্ধ থাকলে যেমন হয়। চার দেওয়ালের মধ্যে তিন দেওয়ালেই নোনা ধরা। বাথরুম- পায়াখানাও অ্যাটাচড নয়। ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনের কোণার দিকে যেতে হয়। একতলা বাড়িটার দু'দিকেই এক-ফালি করে উঠোন। নানারকম ফুলের গাছ লাগানো। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা চারিদিক। ফ্ল্যাটে ঢেকে যাওয়া পাড়ায় বোধহয় এই বাড়িটাই কেবল একতলা; পুরনো ধাঁচের। রুমগুলো দেখে সায়ন্তন ভেবেছিল না করে দেবে। এর চেয়ে চৌধুরী মোড়ের আগের মেসই ঢের ভালো। আর এখানে টাকাটাও বেশি। এতসব ভাবার পরেও সায়ন্তন দুম করে অ্যাডভান্স পে করে বেরিয়ে আসল। মনের ভেতর তখনও বেজে চলছে সেই হারমোনিয়ামের সুর, স্বল্প চেনা কণ্ঠস্বর।

||দুই||
মেয়েটা কোনও কারণে সামনে আসতে চায় না। এখানে শিফট হওয়ার দিন চারেক পর সায়ন্তন জিনিসটা খেয়াল করল। সকাল সাড়ে ন'টার মধ্যে বেরিয়ে যেতে হয়। অফিস থেকে ফিরতে সাড়ে সাত- আট। মঙ্গলবার অফিস ক্যান্টিনে শমীকের পিঠে একটা চাপড় মেরে বলেছিলো, কী বাড়ির খোঁজ দিলি রে ভাই! বাড়ি তো নয় হিরের খনি মাইরি...

কথাটায় ব্যঙ্গ আছে কি না শমীক ধরতে না পেরে বলল, পোষায়নি, না?

পকেট থেকে ফোন বের করে সেদিনের ছবিটা দেখালো সায়ন্ত, এই জিনিস বাড়িতে থাকলে কার পোষাবে না ভাই?

- ওরেহ... শালা! বাড়িওয়ালার মেয়ে? কী দেখতে রে। একে দেখার জন্যই তো মাসে সাড়ে তিন হাজার দেওয়া যায়। এক্সট্রা রুমটুম হবে? আমিও গিয়ে থাকবো তাহলে, বলে সায়ন্তনকে খোঁচা মারল শমীক।

- মনের রুমে তো শুধু একজনকেই জায়গা দেওয়া যায়...

ওই দ্যাখো চোখ টিপে হাসল শমীক, ছেলে তো পুরো কবি হয়ে গেল। অবশ্য বাঙালি ছেলেরা প্রেমে পড়লে, কবিতা আসা কম্পালসারি...

ওদের কথা শুনে সামনে বসা সুচরিতা, বিদিশাদের হাসির রোল উঠল। রাইমা পাশেই ছিল। মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বলল। আমরা বৌদি পাচ্ছি তবে। কথাবার্তা কতদূর এগোলো?

- ওই আর কি.. প্রাইমারি স্টেজে রয়েছে। টুকটাক হাসি, কথা। ওর লজ্জা এখনও পুরোপুরি কাটেনি। রোজ সকালে রেওয়াজে বসে। অপূর্ব গান গায়। একদিন দেখা করাবো তোদের সাথে...ঢপটা মেরে সায়ন্তন বুঝল একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। চারদিনে একবারও মেয়েটার সাথে দেখা হয়নি তার।

রোজকার মতো আজকেও ভোরবেলায় ঘুমটা ভেঙে গেল সায়ন্তনের। হারমোনিয়ামের অস্পষ্ট সুরটা ভেসে ভেসে আসছে। ঘুম জড়ানো চোখে মোবাইল হাতড়ে দেখলো সাড়ে পাঁচটা বাজে। কনকনে শীতের সকাল। চারপাশ নিস্তব্ধ। গায়ের থেকে লেপ সরিয়ে বিছানায় কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকল। তারপর অভ্যাসবশত শাল জড়িয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো। সুরটা আরও কিছুটা স্পষ্ট হল। আলোকেরই ঝর্ণা ধারায় গানটা হচ্ছে। গানের প্রতি কোনও-কালেই বিশেষ আকর্ষণ ছিল না। ছোটবেলায় মা যখন সকাল- সন্ধে রেওয়াজে বসতো হারমোনিয়ামের রিডগুলো এলোমেলো ভাবে টিপে দিয়ে হাসত মায়ের কোলে বসা ছোট্ট সায়ন্তন। বড় হয়ে বুঝতে পারল আকর্ষণ না থাকলেও মায়া আছে। একদিন সমস্ত মায়া ত্যাগ করে মা চলে গেল।
পুরো উঠোন জুড়ে কুয়াশা মেঘ হয়ে জমে আছে। সায়ন্তন খালি পায়ে ঘাসের উপর হাটতে শুরু করল। সারারাত ধরে জমে থাকা শিশিরের কণাগুলো আঙুল ছুঁয়ে যাচ্ছে। শিউলি ফুলের গন্ধ এল নাকে। প্রাণ ভরে শ্বাস নিল সায়ন্তন। যন্ত্রের মতো দৌড়াতে গিয়ে এই সূক্ষ্ম অনুভবগুলো হারিয়ে ফেলে মানুষ। এই বাড়িটায় আসার পর থেকে সব এক-এক করে ফিরে আসছে। একটা সুর সকালগুলো এত অন্যরকম করে দেবে, ভাবেনি। সত্যিই মেয়েটার মধ্যে জাদু আছে। আচ্ছা, ওর গলাটা কি মায়ের চেয়েও সুন্দর? মা শুনলে কী বলতো? নিশ্চয় প্রশংসাই করত। আদ্যোপান্ত ভালো মানুষ মা; মনের মতো একখানা বৌমা পেলাম, বলে মুখ টিপে হাসত। ধুসস! এসব কী আবোলতাবোল ভাবছে। আলাপই হল না এখনও, আর বৌমা! সায়ন্তন লজ্জা পেয়ে ঘরে ঢুকলো। ততক্ষণে গান বন্ধ হয়ে গেছে।

||তিন||
সকালের শান্ত বাড়িটা সন্ধ্যায় কেমন অশান্ত ওঠে। সায়ন্তন বেশ কয়েকদিন লক্ষ করল ব্যাপারটা। অফিস থেকে ফিরে যখন ইনডাকশনে কফি বানায়, পাশের ঘর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি প্রায়-দিনই কানে আসে। মেয়েটা আর বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের মধ্যে ঝামেলা। এক নাগাড়ে চিল চিৎকার ছুড়ে মেয়েটা থামলে ভদ্রলোকও পালটা ঝাঁজ দেখানো শুরু করে। বাপ- মেয়ের এত অশান্তি কী নিয়ে সায়ন্তন বুঝতে পারে না। কথাগুলো স্পষ্ট শোনা না গেলেও বোঝা যায় অশান্তি কোনও ছেলেকে ঘিরে। মাঝে মধ্যে ভদ্রমহিলাও খেঁকিয়ে ওঠেন, পাগল করে ছাড়বে আমাকে। কোনদিন গলায় বিষ ঢেলে মরে পড়ে থাকবো, কথাগুলো শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে। এদের পারিবারিক সমস্যা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই ওর। তবুও কৌতূহলটা টেক্কা দিয়ে বাড়তে থাকে।

রোববার একটু দেরিতে ঘুম ভাঙল। সকালে রেওয়াজের শব্দ কানে আসেনি। বিছানায় শুয়ে মোবাইলে নিউজ-ফিড স্ক্রল করছিলো সায়ন্তন। দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে বিছানা ছাড়ল। সেই মালকিন ভদ্রমহিলা। আড়ষ্ট গলায় বললেন, একটু বিরক্ত করলাম। তোমায় একটা কাজ করে দিতে হবে ভাই...ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হল উনি কোনও সমস্যায় রয়েছেন। শাড়িটাও এলোমেলো ভাবে পরা।

- না না বিরক্ত কিসের? আসুন না ভেতরে। কী কাজ করতে হবে বলুন?

ভদ্রমহিলা একটা ব্যাগ এগিয়ে দিল। মাছ আর সবজির একটা লিস্ট করে দিয়েছি। ভেতরে লিস্ট আর টাকাটা দিলাম। একটু বাজারটা করে দিতে পারবে?

এ তো মেঘ না চাইতেই বন্যা। এই সুযোগ ছাড়া যায়? বাজার দিয়ে আসার নাম করে মেয়েটার সাথে দেখা করে কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে আসা যাবে। একগাল হেসে সাগ্রহে ব্যাগটা নিল সায়ন্তন। কেমন যেন একটা জামাই জামাই ফিল আসছে। মুখে বলল, এ আবার কোনও কাজ হল নাকি? আপনাদের বাজার তো আমিই করে দিতে পারি; উত্তেজিত হয়ে মুখ ফস্কে বাড়তি কথাটা বেরিয়েই গেল।

ভদ্রমহিলা একটু ম্লান হেসে বললেন, আসলে তোমার কাকুর শরীরটা একটু খারাপ করেছে। আর মিনতিও কয়েকদিন ধরে কাজে আসছে না। তাই আর কি...

- এমা! ডাক্তার দেখিয়েছেন?

ভদ্রমহিলা উত্তর দিতে যাবেন তখনই তার নাম ধরে ডাকাডাকির আওয়াজ পেলেন। যাওয়ার আগে বললেন, ব্যাগটা ঘরে দিয়ে এসো।

#
ব্যাগ ভর্তি বাজার হাতে কলিংবেল টিপল সায়ন্তন। ভদ্রমহিলা এসে দরজা খুললেন। বসার জন্য বললেন ভেতরে। চান্স পেলেই মেয়েটার রুমে ঢুকে পড়বে, ভেবে রেখেছে। প্রথমদিন খুব বেশি ঘনিষ্ঠ হওয়া ঠিক না। উত্তেজিত হলে মুখ ফস্কে ফালতু কথা বেরিয়ে যায় সায়ন্তনের। এটায় ইম্প্রেশন খারাপ হতে পারে। জুতো খুলতে গিয়ে দেখল কেউ একজন ড্রয়িং রুম থেকে পাশের ঘরে চলে গেল। দুলে ওঠা পর্দা দেখে মনে হল হয়ত মেয়েটাই। সায়ন্তন ঘরে ঢুকল। বাজারের ব্যাগটা মেঝেয় নামিয়ে রেখে ভদ্রমহিলা তড়িঘড়ি সোফার থেকে কিছু একটা দলা পাকিয়ে পাশের ঘরে নিয়ে যেতে গেলেন। হাত ফস্কে কতগুলো পুতুল মেঝেতে পড়ল। সায়ন্তনের মনে হল এগুলো আগে কোথায় যেন দেখেছে। ভদ্রমহিলা একটু হেসে বললেন, দাঁড়াও চা বানাচ্ছি।

সায়ন্তন হাসি মুখে টেবিল থেকে পেপার তুলে কথা সাজাতে শুরু করল। কী করে প্রসঙ্গটা আনা যায়। চায়ে দু'চুমুক মেরে কথাটা বলেই ফেলল সায়ন্তন, আপনার মেয়ের সাথে আলাপটা এখনও হয়ে ওঠেনি কাকিমা।

মহিলা যেন একটু থতমত খেলেন। ম্লান হেসে বললেন আসলে ও কারো সাথে দেখা করতে পছন্দ করে না।

দেখা না করতে চাওয়ার কী কী কারণ হতে পারে সায়ন্তন ভাবছিল। পাশের ঘর থেকে রোজকার মতো আবার মেয়ে- বাবার অশান্তি শুরুর আওয়াজ পাওয়া গেল। তবে অন্যান্য-দিনের মতো উঁচু স্কেলে নয়। মহিলা উঠে সেই ঘরে গেলেন। তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় ভদ্রলোকের মুখে বার কয়েক অ্যাসিড কথাটা স্পষ্ট শুনতে পেল সায়ন্তন। অজানা আতঙ্কে বুক মুচড়ে উঠল।

||চার||
শমীক ঠিকই আন্দাজ করল। ওই বাড়িটায় যাওয়ার পর থেকে সায়ন্তনকে ডিস্টার্বড দেখাচ্ছে। কাজে ভুল করছে। আজকেও নিজের ডেস্কে চুপচাপ বসে জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল সায়ন্তন। মোবাইলের ওয়াল-পেপারে সেই মেয়েটার ছবি। - তোর কী হয়েছে বলতো?

সায়ন্তন না বলে থাকতে পারল না। শুনে, শমীককে চিন্তিত দেখাল...

- অ্যাসিড ভিক্টিম? তার জন্য সামনে আসতে চাইছে না?

সায়ন্তন চুপ করে থাকল। শমীক বলল, তাই তো মনে হচ্ছে। দাঁড়া, আমি খোঁজ লাগাচ্ছি। সত্যিটা জানা দরকার। মেয়েটার নাম ম্যানেজ করতে পারবি কোনও ভাবে? কায়দা করে শোন ভদ্রমহিলার কাছে, বা পাড়ার কাউকে পেলে ধর। ম্যানেজ করার অনেক চেষ্টাই করেছে সায়ন্তন; পারেনি। আর পাড়ার লোকের যা ছিরি, বাড়িতে আগুন লাগলেও খোঁজ নিতে আসবে না। মাঝের কিছুদিন রেওয়াজ, ঝগড়া কোনও কিছুই শোনা গেল না। কিন্তু সায়ন্তনের ঘুম ভাঙত সাড়ে পাঁচটাতেই। অস্থির পায়ে পায়চারি করত পুরো উঠোন জুড়ে। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে কান পেতে থাকত। মানুষ যেই জিনিস কম ভাবার চেষ্টা করে, সেটাই আরও তীব্র ভাবে চলে আসে ভাবনায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গুগলে অ্যাসিডে ঝলসে যাওয়া মুখের ছবি দেখে, আঁতকে উঠত।

ভেতরের ছটছটানিটা বেড়ে যাচ্ছিল প্রতিদিন। সায়ন্তন বুঝল এক অদৃশ্য মাকড়সার জালে আটকে যাচ্ছে সে। এই বাড়ি ছেড়ে না বেরোলে বিপদ আছে। শমীককে বলে বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল শেষ-মেশ। কাল বিকেলে বাড়ি ছেড়ে দেবে। শমীক অন্য একটা মেস ঠিক করে দিয়েছে। ভদ্রমহিলাকে বাড়ি ছাড়ার কথা বলাতে তিনি কোনও আপত্তি তোলেননি। কারণও জানতে চাননি। যেন এটাই স্বাভাবিক। সত্যিই অদ্ভুত এরা। এক মাসের টাকা অ্যাডভান্স করলেও চোদ্দোদিনেই ঘর ফাঁকা করে দেবে সায়ন্তন। এখানে থাকা সম্ভব না।

পরের দিন ঘরে তালা মেরে বেরোতে পাঁচটা পেরিয়ে গেল। চাবি দিয়ে আসল ভদ্রমহিলার হাতে। ব্যাগ নিয়ে শেষবারের মতো উঠোনে এসে দাঁড়াতেই এক মহিলাকে দেখলো কাপড় উঠাতে। কাজের মেয়ে মিনতি হয়ত এ- ই। এতদিন এই সময়ে অফিসে থাকার জন্য দেখা হয়নি। এর থেকে যদি কিছু জানা যায়। সায়ন্তন কৌতূহল গোপন করতে পারল না। মিনতি প্রথমে কিছুই বলতে চাচ্ছিলো না। সায়ন্তন চলে যাচ্ছে শুনে কী যেন ভাবল। আশপাশে চোখ বুলিয়ে নীচু স্বরে বলল, আমি জানতাম আপনিও থাকতে পারবেন না। এসব পাগলের কারবার দেখে কে থাকবে এখানে? যে আসে, পালিয়ে যায়।

সায়ন্তন কথাটা ধরতে পারল না। - পাগল মানে? কে পাগল? মেয়েটা?

আশ্চর্য চোখে তাকালো সায়ন্তন। বৌটা কেমন যেন ফ্যাকাসে হাসল।

- মেয়ে পাগল হয়ে বেঁচে থাকলেও তো বাপের মাথাটা এরকম পচতো না। আপনি কি কিছুই জানেন না?

সায়ন্তন কোনও উত্তর দিল, না...

- এই বাড়িতে কাজ করি পাঁচ বৎসর। খুকুর কতই বা বয়স তখন। আঠারো,উন্নিশ। আমার মেয়ের সমান। গানের মাস্টারের সাথে যেন লটঘট ছিল, দাদাবাবু জানতে পেরে আটকালো। ব্যাস, অ্যাসিড গিলে পড়ে থাকলো বেসিনের কোণায়।

বিদ্যুৎ-পৃষ্ট গাছের মতো স্থির; সায়ন্তনের কথাটা বোধগম্য হতে কিছুক্ষণ সময় লাগল, অস্ফুটে বলল, কিন্তু এটা কী করে...

মহিলা যেন এক মনেই বলে গেল, সে কী চিৎকার! নিজে চোখে দেখেছি তো। দাদাকে আটকে রাখা যায় না, পাঁঠা-কাটার মতো কাতরানো। ওটার পর থেকে দাদাও নিজে যে কতবার মরার চেষ্টা করল... যাবি তো যা, বাপটাকে পাগল করেই গেলি! কম তো ডাক্তার দেখানো হল না। কীসের কী। সারাদিন কতরকম যে আওয়াজ করে গলা দিয়ে। লোকে ভাবে মেয়ের সাথে ক্যাচাল। ভাববে না কেন। নিজেই যে মেয়ের গলা নকল করে, সেটা বাইরের লোক জানবে কীভাবে? ভাড়াটে এসব জানতে পারলে পালিয়ে যায়। কেউ থাকে না এখানে। আপনি চলে যাচ্ছেন দেখেই কথাগুলো বললাম। মহিলা থামলেন।

কিছু যে একটা গণ্ডগোল আছে এ বাড়িতে, সায়ন্তন আগেই আন্দাজ করেছিল। কিন্তু এখনও পুরো ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য লাগছে। মহিলার থেকে ভদ্রলোকের নামটা শুনে কী যেন মনে হল। স্তম্ভিত হয়ে ফোনটা বের করে ফেসবুকে সার্চ মারল - তমাল মুখার্জি। বেশ কয়েকটা অ্যাকাউন্ট আসল। শেষেরটায় ক্লিক করতে দেখলো সেই ভদ্রলোকের ছবি দেওয়া। লাস্ট পোস্ট বছর সাতেক আগের। তারপর থেকে আর কোনও আপডেট নেই। কিছুটা স্ক্রল করতেই একটা পোস্ট নজরে এল। ওয়ার্কড অ্যাট প্রফেশনাল ভেন্ট্রিলোকুইস্ট অ্যান্ড ইম্প্রেশনিস্ট। অনেক কিছুই পরিষ্কার হল এবার। মনে পড়ল, বহুদিন আগে কেউ একজন এরকমই একটা ভিডিও ক্লিপ শেয়ার করেছিল ফেসবুকে। অত গুরুত্ব দিয়ে না দেখলেও আবছা মনে আছে। সেদিন মহিলাটার হাত থেকে পড়ে যাওয়া ডামি পুতুলগুলো ওই ভিডিওতে দেখেছিলো সায়ন্তন। যেখানে একটা লোক অবিকল অন্যের গলার আওয়াজ নকল করতে পারে, ঠোঁট না নড়িয়ে পুতুলকে দিয়ে কথা বলাতে পারে। তাছাড়া এই লোক প্রফেশনাল মিমিক্রি আর্টিস্টও ছিলো। অন্যের গলা হুবহু অনুকরণই এদের পেশা! মৃত মেয়ের আওয়াজ নকল করে মেয়েকে বাঁচিয়ে রেখেছে লোকটা। বা হয়ত এই অসহায় বাবার অবচেতনে মেয়ে আজও জীবিত। দৃশ্যটা ভাবা-মাত্রই বুক ছ্যাঁত করে উঠল।

সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণ হল। আশপাশের বাড়ি থেকে শঙ্খের আওয়াজ ভেসে আসছে। কাপড়গুলো বালতিতে ভরে মহিলা এগিয়ে গেল দরজার দিকে। ঘুরে বলল, বৌটাও কোনদিন পাগল হয়ে যাবে দেখবেন। জমানো টাকা ভাঙিয়ে আর কয়দিন খাবে। গলার স্বর বুজে এল মহিলার। তারপর হয়ত চোখের জল আড়াল করতেই ঢুকে গেল ভেতরে। গেটের বাইরে পা রাখতে সেই অস্পষ্ট হারমোনিয়ামের সুরটা কানে এল সায়ন্তনের; এটা এখন বাজার কথা নয়; ও ভালো করেই জানে। তবুও অন্ধকার কুয়াশায় পিছন ফিরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সে।
( সমাপ্ত )


Next Bangla Story

List of all Bengali Stories


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717