Home   |   About   |   Terms   |   Library   |   Contact    
A platform for writers

যেদিন ভেসে গেছে

Bengali Story

All Bengali Stories    70    71    72    73    74    75    76    77    (78)     79   

-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ আমাদের এই ওয়েবসাইট ( RiyaButu.com )-এ প্রকাশিত গল্পগুলির মধ্যে থেকে কিছু গল্প নিয়ে এবছরই প্রকাশিত হবে আমাদের 'রিয়াবুটু'র গল্প'।
--------------------------



◕ যেদিন ভেসে গেছে

লেখক - শান্তনু চ্যাটার্জী, ন্যাশানাল পার্ক, নৈহাটি, উত্তর ২৪ পরগণা

Part 2

✿ ৩

আমার বিয়ের ব্যাপারটা প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর আমাদের বাড়িতে এক সন্ধেবেলায় এল ভণ্ডুলজেঠু। সম্পর্কে বাবার জ্যাঠতুতো দাদা। দুর্গাপুরে থাকে। মামন অর্থাৎ ভণ্ডুলজেঠুর মেয়ের পরীক্ষা চলছিল বলে বিয়ের কথাবার্তার সময় ওরা আসতে পারেনি। ভণ্ডুলজেঠুর নাম কিভাবে "ভণ্ডুল" হল, তা আমার ভালোভাবে মনে নেই। কিন্তু এটুকু মনে আছে আমার পিসতুতো দাদা বাচ্চু ওকে এই নামে ডাকতো। ওর দেখাদেখি আমরা অন্যান্য ভাই-বোনেরাও এই নামে ডাকতে শুরু করেছিলাম। তাতে অবশ্য কেউই আপত্তি করেনি। তবে এর পিছনে বিভূতিভূষণ যে বাচ্চুদার ওপরে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলেন সেটা সহজেই অনুমেয়।

সে যাই হোক, নামটা শুনতে মজাদার হলেও মানুষটা কিন্তু মোটেই মজাদার নন। ছোটবেলায় তো আমরা একে যমের মতো ভয় পেতাম। গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, মিশকালো গায়ের রং। ওর বপু দেখলে এমনিতেই ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। তবে আমরা ওকে যেমন ভয় করতাম, তার চেয়েও সে বেশি ভয় করত লোকসমাজ আর লোকধর্মকে। সমাজের হেন নিয়ম নেই যা সে মেনে চলত না। নিজেই যে সেটা শুধু মানতো তাই নয়, আমাদেরকেও মানিয়ে ছাড়ত। তাই ছোটবেলা থেকেই ওর কাছে ঘেঁষতে বিশেষ একটা ভরসা হতো না। সকালে ঘর না ধুয়ে বাসি ঘর থেকে বেরোনো যাবে না, কোথায় কোন এঁটো-ছুঁয়ে ফেললে আবার গঙ্গাজলে হাত ধুতে হবে। কোনটা শুভ কোনটা অশুভ ইত্যাকার নানান ঝামেলার জন্য পারতপক্ষে আমরা ওর সঙ্গ এড়িয়েই চলতাম।

এখন যমের ভয়টা গেলেও ওর প্রতি আড়ষ্টভাবটা যথেষ্ট আছে। তবে আমাদের পরিবারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজই জেঠুর হস্তক্ষেপ ছাড়া হয় না। বাবা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে জেঠুর মতামতের খুব গুরুত্ব দেয়। তাই আমার বিয়ের কথা শুনে জেঠু বলেই ফেলেছিল, "জিতুর বিয়ে হবে, আর তোরা নিজেরাই সব ঠিক করে ফেললি? তোরা বুঝিস কি?" কথাটার মধ্যে একটু হলেও অভিমানের সুর ছিল। বাবা তাই বলল, "আরে সবে তো প্রাথমিক কথাটা হয়েছে। তুমি এসো, তারপর ফাইনাল হবে"খন।" তাই জেঠু এসেছিলো এবারে সপরিবারে। শুভদিন ঠিক করে আমি বাদে ওরা সবাই বিয়ের শেষ পর্বের কথাবার্তা সারতে গেল সুলগ্নাদের বাড়িতে। বড়োদের সিদ্ধান্তে মাথা গলানোর কোনো অধিকারই আমার ছিল না তখন। আর ভণ্ডুলজেঠুর সামনে তো একেবারেই নয়। তাই নিজের সিদ্ধান্তটুকু জানিয়েই নিজেকে সবটুকু থেকে সরিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম আমি। এটাই ছিল আমাদের পারিবারিক শিক্ষার নমুনা।

সেদিন সন্ধেবেলায় ওরা যখন বাড়ি ফিরল, বাবা আর মায়ের মুখটা কেমন থমথমে মনে হল। আমি সেদিন আঁচ করেছিলাম, কিন্তু বুঝতে পারিনি। পরেরদিন আমার অফিস। আর অফিসের খুব কাছেই সুলগ্নাদের বাড়ি। তাই ওকে বলেছিলাম অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়বো, তারপর দুজনে ঘুরতে যাবো। আমাদের এই বেড়াতে যাবার ব্যাপারটা অনেক আগেই ঠিক করা হয়ে গেছিলো। সেদিন অফিসে যাবার আগে বাবা আমাকে ডাকল, তারপর কোনোরকম ভূমিকা ছাড়াই বলতে শুরু করলো, "সুলগ্নার সঙ্গে মেলামেশাটা এখন আর বেশি একটা করিস না। এখনও তো বিয়ে ঢের দেরী। আরো কয়েকটা মাস যাক, তারপর কথাবার্তা বলিস।" কথাগুলোর মধ্যে একটা আদেশোচিত ভঙ্গী ছিল যেটা বাবার কাছ থেকে খুব একটা আশা করা যায় না। বাবা তো সাধারণত এমন বলে না, বরং সে তো নিজেই সুলগ্নার সাথে কথা বলার ব্যাপারে আমাকে উৎসাহিত করেছিলো। যে ঘরে দাঁড়িয়েছিলাম, তার পাশেই রান্নাঘর। সেখান থেকে মায়ের গলা ভেসে এলো, "আজ তোদের কোথায় বেড়াতে যাবার প্ল্যান আছে না? একদম যেন যাবি না। ওকে বলে দিস তোর শরীর খারাপ হয়েছে। তুই যেতে পারবি না।" মায়ের কথার তীব্র প্রতিবাদ করে আমি বলে উঠলাম, "কিন্তু কেন?" ওরা তখনই কিছু বলল না। আর আমারও অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছিলো, তাই এই নিয়ে কথা আর বিশেষ এগোল না।

সেদিন অফিসে বসে কোনো কাজেই মন লাগলো না। বারবার বাবার কথাগুলো মনে হচ্ছিলো। বাবা কেন এমনটা বলল? বাবা কি তাহলে চায় না আমার সাথে সুলগ্নার সম্পর্কটা থাকুক? ভণ্ডুলজেঠুর সাথে ওদের বাড়িতে যাওয়ার পর থেকেই বাবা কেমন যেন একটা অস্বস্তিতে ভুগছে, অথচ স্পষ্ট করে কিছু বলছেও না। তাহলে ওদের বাড়িতে কি সেদিন কিছু অশান্তি বেঁধেছিল? কিন্তু তেমনটা হলে সুলগ্না তো আমাকে জানাতো। গতকাল রাত্তিরে ওর সাথে যখন কথা বললাম, তখন তো কিছু শুনলাম না।

যাই হোক, সেদিন দুজনে মিলে একটু গঙ্গার ধারে গেছিলাম। ঘাটটা খুব সুন্দর করে বাঁধানো। একটা পার্কও আছে। কিন্তু আমরা সেদিকে গেলাম না। তারই অনতিদূরে একটা সুবিশাল বট গাছ। তার ছায়ায় নরম ঘাসের ওপর আমরা বসে পড়লাম। সামনে গঙ্গা বয়ে চলেছে। সুলগ্নার খেয়ালগুলো বড়ই অদ্ভুত। একটা বটপাতা নিয়ে সে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিল। আমি বললাম, "তুমি তো এখানে ভাসিয়ে দিলে। এবার এটা ভাসতে-ভাসতে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশবে।"

আমার বলার সঙ্গে সঙ্গে পাতাটা ভাসতে-ভাসতে এক ধারে চলে এসে পাড়ের বড়ো-বড়ো ঘাসের মধ্যে আটকে গেলো। সুলগ্না সেটা দেখে ফিচ করে হেসে ফেললো। আমি একটু কবিত্ব করে বলতে শুরু করলাম, "কার যে কোথায় গন্তব্য আগে থেকে কিছুই বলা যায় না।" আমার কথা শুনে সুলগ্না ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে বলে, "কি মশাই, খুব কবিত্ব হচ্ছে, না?" তারপরেই আমাকে একটা কবিতা শোনাবার অনুরোধ করলো। আমি বললাম, "আমি তো কবিতা ঠিক মনে রাখতে পারি না। পড়ি, ভালো লাগে, ব্যস এই পর্যন্তই।" ও আমার কথা শুনে চুপ করে যায়। তারপর একটু উদাসভাবে একটা কবিতা শুরু করে –
"হাতের ওপর হাত রাখা খুব সহজ নয়
সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়
এ কথা খুব সহজ, কিন্তু কে না জানে
সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়।"
(কবিতা – সঙ্গিনী, কবি – শঙ্খ ঘোষ)

"কার লেখা বল তো?" প্রশ্নটা আমার দিকে ছুঁড়ে দেয় ও। নামটা ঠিকমতো মনে আনতে না পেরে আমি বলি, "বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত বিখ্যাত এক কবি।" ও কিছু উত্তর দেয় না। বলে, "আমি একটা গল্প লিখেছি। তোমাকে মেইলে পাঠিয়ে দেবো। পড়ে বোলো তো, কেমন লাগলো? ভালো হলে একটা ম্যাগাজিনে পাঠাবো।"

"আমার বুদ্ধির ওপর তোমার ভরসা আছে? আমার কিন্তু নেই।" এই বলে সশব্দে হেসে উঠি আমি।

মৃদু বাতাস বইছে। সুলগ্নার চুলগুলো চোখের সামনে এসে পড়ছে বার-বার। সাদা শালোয়ারে ওকে মানিয়েছে বেশ। বাঁ গালে একটা ছোট্ট আঁচিল, চোখে রিমলেস চশমা। ওর দিকে তাকিয়ে আমি ভাবছিলাম, ও ঠিক আমার বৌ নয়। ও আমার প্রেমিকা। হঠাৎ আমার দিকে ফিরে মৃদু হেসে ও জিগ্যেস করে, "কি দেখছ?"

এমনভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকাটা উচিত হয়নি। মনে-মনে লজ্জিত হয়ে আমি কথা ঘোরাবার জন্যে বললাম, "অফিসে আজ আমাকে এক সিনিয়র দাদা জিগ্যেস করছিল, কবে বিয়ে করছি। আমি এখনও কিছু জানাইনি। পাকা কথা হোক।"

ও বলতে লাগলো, "জিতু, বিয়ের পরেও আমি কিন্তু লেখালিখিটা ছাড়বো না। তুমি আমাকে লেখার সময় দেবে তো?"

আমি বলি, "নিশ্চয়ই দেবো।"

সারাদিন কি করলাম, কি খেলাম, কোথায় গেলাম এইসব কথা কত সাধারণ। না করলেই বা কি এমন এসে যেতো? কিচ্ছু না। তবু এইসব কথাতেই কখন যে সন্ধে নেমে গেলো, সে খেয়ালই আমরা কেউ করলাম না। আমি ওকে অফিসের কোনো একটা কাজের ব্যাপারে ভালো করে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম এবং এটা বলার চেষ্টা করছিলাম যে, কাজটা কত কঠিন এবং আমি একার চেষ্টায় কিভাবে সেটা উদ্ধার করেছি। এমন সময় ও একপ্রকার চেঁচিয়ে বলে উঠলো, "সাতটা বাজে।"

ফেরবার পথে কথাপ্রসঙ্গে ওকে জিগ্যেস করলাম, "আচ্ছা, গতকাল আমাদের বাড়ি থেকে তোমাদের বাড়িতে যাওয়ার পরে কী কথাবার্তা হয়েছিলো?" ও মাথা নেড়ে বলল, এ ব্যাপারে ও কিছুই জানে না।

অফিসে কঠিন কাজের দোহাই দিয়ে বাড়িতেও বাঁচলাম, এবং আরো এক কাঠি ওপরে উঠে এটাও বললাম যে, আমাকে ছাড়া আর কারুর দ্বারাই কাজটা সম্ভব হত না। অনেক জটিল কাজ। না হলে কি আর বাড়ি ফিরতে এতো দেরী হয়। মা-বাবা দেখলাম আমার কথার কোনো প্রতিবাদ করলো না। শুধু রাতের বেলার খাবার সময় এমন একটা কথা বলল যা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

টেবিলে খেতে বসেছিলাম তখন আমি, বাবা আর ভণ্ডুলজেঠু। মা আর জেঠিমা পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের খাবার পরিবেশন করছিল। অনেক ভূমিকা-টুমিকা করে বাবা বলে উঠলো, "দেখ, অনেক কিছুই তো আমাদের হাতে নেই। ইচ্ছার বিরুদ্ধেও অনেক কাজই করতে হয়।" তারপর আবার একটু থেমে বাবা বলল, "দাদা গতকাল ওদের বাড়ি গিয়ে সব দেখেশুনে কোনো আপত্তি করেনি। এই বিয়েতে ওরও মত আছে। তবে একটা ব্যাপার। এটা আমার মাথাতেই ছিল না। দাদাই বলল, একবার দুজনের রাশিটা মিলিয়ে নিতে হবে। আমাদের পরিবারের সকলের বিয়ের সময়েই রাশি মেলানো হয়। ব্যাপারটা আমার মাথাতেই ছিল না।" বাবা এইটুকু বলেই থেমে গেল।

জেঠু মুখে ভাত নিয়েই বাবার কথার জের টেনে বলতে শুরু করলো, "আরে বাবা, তার থেকেও বড়ো কথা, জাতিতে ওরা নীচু। আর আমাদের শরীরে বইছে ব্রাহ্মণের রক্ত। কিভাবে এই বিয়েতে তুই সম্মতি দিতে পারিস বিমল? 'মেয়েটা ভালো' এইটুকুই কি তোদের যথেষ্ট মনে হল? তোর বংশের প্রতি তোর কি এতোটুকুও সম্মান নেই?" কথাগুলো বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেও ঘা-টা পেলাম আমি। তারপর আবার শুরু করলো, "আর মেয়েটার আছেটাই বা কী? না আছে রূপ, না কিছু।"

জেঠুর কথা শুনে আমার খাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো। অন্য কেউ হলে রাগে ফেটে পড়তাম। কিন্তু ভণ্ডুলজেঠুর কাছে সেই রাগ দেখানোর সাহস আমার ছিল না। আমি মাথা নিচু করে রইলাম। বুঝতে পারছিলাম, মা আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কি একটা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল মা। আমার বুঝতে অসুবিধা হল না, এ বিয়েতে ওদের মত নেই। রাশি মিললেও নেই, না মিললেও নেই।

তবে রাশি মেলেনি। জ্যোতিষমশাই বললেন, দুজনের বৈবাহিক জীবনে যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিতে পারে। বাবা কলকাতায় অন্য এক বড়ো জ্যোতিষের কাছে গেলো। তারও একই বক্তব্য। আজন্ম সংস্কারের চাপে বাবার পক্ষে এরপর এই বিয়ের ক্ষেত্রে এগোনোর ইচ্ছা বা ক্ষমতা কোনোটাই রইল না। সেইমতো বাবা আমাকে বোঝাল। মাও অনেক বোঝাল। ভণ্ডুলজেঠুও আমাকে অনেক জ্ঞান দিলো। কিন্তু আমি তখন নাছোড়বান্দা। আমি এই সময় সুলগ্নার সাথে কথা বলতে চাইলাম। আর কার সাথেই বা বলবো আমি কথা? কিন্তু যখন ওর সাথে কথা বললাম, সেটা আমাকে আরো হতাশ করল। ও বলল, "দেখো, ওরাই তো আমাদের বিয়েটা ঠিক করেছে। আজ ওরা যখন চাইছে না তখন…"।

আমি রাগে ফেটে পড়লাম, "মানে? তুমি কী বলতে চাও? ওরা যখন খুশি আমাদের সম্পর্কটা গড়ে তুলতে বলবে। আবার যখন খুশি তাকে ভেঙে দিতে বলবে? এটা কখনো হয়? ভণ্ডুলজেঠু এভাবে তোমাকে আর তোমার পরিবারকে অপমান করলো, আর তুমিও কিভাবে এগুলো সহ্য করে রয়েছ?" আমি রেগে ওকে অনেকক্ষণ ধরে বকাঝকা করলাম। ও আমার কথার কোন প্রতিবাদই করলো না। আমার বলা শেষ হয়ে গেলে ও মৃদুস্বরে বলে উঠলো, "মেয়েদের অনেককিছুই মেনে নিতে হয় গো। তুমি দেখো, তুমি ভালো বৌ পাবে। অনেক সুখী হবে। মা-বাবা যা করে তা ভালোর জন্যেই করে। আমার কথা আর নাই-বা ভাবলে। কারুর তাতে এসে-যাবে না।"

সেদিন বড্ড অভিমান হয়েছিলো। ওর ওপর অভিমান হয়েছিলো, আমার মা-বাবার ওপর অভিমান হয়েছিলো, গোটা পৃথিবীটার ওপর অভিমান হয়েছিলো। আমার সামনের রঙিন পৃথিবীটা এভাবে হঠাৎ ধূসর হয়ে যাবে? এটা আমি কীভাবে মেনে নেবো? আমার শত প্রতিরোধের পরেও একসময় বুঝতে পারলাম, সুলগ্নাকে ভুলে যেতেই হবে। ওকে পাবার ক্ষমতা আমার নেই। তখন আমার সমস্ত জমানো অভিমান গোটা দুনিয়াটার প্রতি আমাকে নিঃস্পৃহ করে তুলল। পরিস্থিতিকে মেনে নিতে বলে বাবা আমাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলো। মা তো বলেই দিলো, তার কাছে সুলগ্নার চেয়ে ঢের ভালো পাত্রীর খোঁজ আছে। কিন্তু ওরা দেখল, আমি এখন সবকিছুতেই অত্যন্ত বীতস্পৃহ। গোটা দুনিয়াটার ওপর থেকেই আমার সব আগ্রহ দূর হয়ে গেছে। ঠিক এই সময়েই আমার প্রোমোশনের খবর এলো আর প্রোমোশনের পর আমার নতুন পোস্টিং হল জলপাইগুড়ি। আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

কেউ জানে না, কিন্তু জলপাইগুড়িতে আমি ফি-বছর আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আবেদন করে গেছি যাতে সেখান থেকে বাড়ির কাছে আমার বদলী না হয়। এইসময়ের মধ্যে বাড়িতে আমি আর প্রায় যাইনি বললেই চলে। এর বছর তিনেক বাদে আমার বাবা মারা যায়। মা'কে দেখাশোনা করার কেউ নেই। সে একা হয়ে পড়েছে। তার ওপর তিন বছরের পুরনো ঘটনার ক্ষতটা পুরো না সারলেও এখন অনেকখানি শুকিয়ে এসেছে। তাই আমি এবার বদলির জন্য আবেদন করলাম। বছর দুই বাদে আমার আবার বদলী হল। আমি আবার আমার পুরনো জায়গায় ফিরে এলাম। কিন্তু এ জায়গা আমার বেশিদিন ভালো লাগলো না। এই বাড়ি, এই ঘরগুলো, এই টেবিল চেয়ার – সব কিছুতেই একটা পুরনো অসুখের গন্ধ। ঠিক করলাম, এই বাড়ি ছাড়বো। নতুন ফ্ল্যাটের সন্ধানে রইলাম। গত মাসে এখানকার এই ফ্ল্যাটে উঠেছি। কলকাতার কাছেই।

✿ ৪

বৃষ্টিটা ধরে এসেছে। আমার সামনের উঠোনটা জলে থৈ-থৈ করছে। আকাশ এখন অনেকখানি পরিষ্কার। হাল্কা মেঘের পাশে উঁকি দিচ্ছে শ্রাবণের চাঁদ। এবার আর এখানে থাকা চলে না।

মোড়া থেকে উঠে সুলগ্নাকে ডাকলাম। ও বোধহয় ভেতরের ঘরে ছিল। কোনো সাড়া এলো না। আরো দু'বার ডাকার পরও যখন সাড়া পেলাম না, তখন বিনা অনুমতিতেই ঘরে ঢুকে পড়লাম। প্রথমে একটা ছোট বৈঠকখানা। সেটা পার করে একটা অন্ধকার ঘর। তার ওপাশের একটা ঘরে আলো জ্বলছে। ঘরটার কাছে যেতে দেখলাম, ঘরটা ছোট। ঘরের প্রায় অর্ধেক অংশ জুড়ে একটা খাট পাতা। তার সামনে একটা চেয়ার। না, ভুল বললাম, চেয়ার নয়, হুইলচেয়ার। সেই হুইলচেয়ারে বসা একটা লোককে বাটি আর চামচে করে কি একটা পানীয় খাইয়ে দিচ্ছে সুলগ্না। লোকটা যেন আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। স্থির মাছের মত দৃষ্টি তার। আমি বুঝতে পারলাম না, সে আমাকে দেখছে নাকি অন্য কিছু দেখছে।

কিছু বলবেন?"সুলগ্না আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত ভাবে বলে ওঠে।

আমি মাথা নাড়িয়ে বলে উঠি, "হ্যাঁ, বলছি, বৃষ্টি কমে গেছে। আমি আসছি।" এই বলে আমি দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি। এমন সময় একটা মৃদু পদশব্দ পেলাম। সুলগ্না দেখি আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি ওর দিকে ফিরলাম। বললাম, "উনি কে? তোমার স্বামী?"

সুলগ্না মাথা নাড়িয়ে বলে, "হ্যাঁ। একটা কলেজের প্রফেসর ছিলেন। গত বছর একটা গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে…" কিছুক্ষণ থেমে সে আবার বলে, "এখন পুরো অথর্ব। নিজে থেকে কিছুই করতে পারে না।" তারপরে একটা নিস্তব্ধতা। আমি বললাম, "তুমি আর গল্প লেখো সুলগ্না?" ও মাথা নাড়ায়। লেখে না। আমি বললাম, "ছাড়লে কেন লেখাটা?" ও কোনো উত্তর করলো না। বেরিয়ে আসার আগে ওকে একবার বলে এলাম, "ভালো থেকো।" তারপর ধীরে-ধীরে পথ চলতে লাগলাম আমি। যেতে-যেতে মনে হল, ওকে আমার বাড়ির ঠিকানাটা দিয়ে এলে হতো। তারপর ভাবলাম, থাক, কী হবে আর পিছনে ফিরে? ওসব আর না ভাবাই ভালো। আমি এগোতে লাগলাম, আর আমার পেছনে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগলো একটা পুরনো অতীত।
( সমাপ্ত )

Previous Part


All Bengali Stories    70    71    72    73    74    75    76    77    (78)     79   


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717