Home   |   About   |   Terms   |   Library   |   Contact    
A platform for writers

বীর সিংহ

Bangla Article

-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ আমাদের এই ওয়েবসাইট ( RiyaButu.com )-এ প্রকাশিত গল্পগুলির মধ্যে থেকে কিছু গল্প নিয়ে এবছরই প্রকাশিত হবে আমাদের 'রিয়াবুটু'র গল্প'।
--------------------------

All Bangla Articles    1    2    3    4    5    ( 6 )     7    8    9   

বীর সিংহ
প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা, সেপ্টেম্বর, ২০২১-এর একটি নির্বাচিত প্রবন্ধ
লেখিকা: রিয়াঙ্কা সাহা, পিতা: রবীন্দ্রনাথ সাহা, ব্যারাকপুর, উত্তর চব্বিশ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ


## বীর সিংহ
লেখিকা: রিয়াঙ্কা সাহা, পিতা: রবীন্দ্রনাথ সাহা, ব্যারাকপুর, উত্তর চব্বিশ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ

পাত্রীর বয়স চোদ্দ, পাত্র অশীতিপর কুলীন ব্রাহ্মণ। উনবিংশ শতকের বাংলার এ এক অতি পরিচিত দৃশ্য। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার পক্ষে এ নাকি বড় সৌভাগ্যের। শীঘ্রই সেই চোদ্দ বছরের বালিকা বিধবা হয়। তারই সমবয়সী বাল্যবন্ধু বালকটির মনে দাগ কেটে গিয়েছিল ঘটনাটা। বালকটির বিদ্রোহী মনে সেদিনই অঙ্কুরিত হয়েছিল প্রকৃত পৌরুষ ও মনুষ্যত্বের বীজ। বালকটিকে পরবর্তীকালে সমগ্র বিশ্ব চিনবে বিদ্যাসাগর নামে।

১৮২০ সালে মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম হয়। পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা ভগবতী দেবী। বিদ্যাসাগরের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও ব্যক্তিত্বের উৎস সন্ধান করতে হলে ফিরে দেখতে হবে তাঁর পারিবারিক অতীত। তাঁর পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ একাধারে ছিলেন অতিশয় বলবান, নিরতিশয় সাহসী, স্পষ্টবাদী; অন্যদিকে তিনি কারও আনুগত্য করতে পারতেন না। পিতামহের এই চারিত্রিক গুণাবলী তাঁর পিতার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। ঠাকুরদাস ছিলেন বুদ্ধিমান, পরিশ্রমী এবং সৎ। কপর্দকশূন্য ঠাকুরদাস যখন কর্মসংস্থানের খোঁজে কলকাতায় আসেন, তখন একবার এক অপরিচিত ভদ্রমহিলা ক্ষুধায় কাতর ঠাকুরদাসের ক্ষুধা নিবারণ করেছিলেন। বাবার মুখে এই ঘটনা শুনে বিদ্যাসাগর 'বিদ্যাসাগর চরিত'-এ লিখেছেন,"পিতৃদেবের মুখে এই হৃদয়বিদারক উপাখ্যান শুনি, আমার অন্তঃকরণে যেমন দুঃসহ দুঃখানল প্রজ্বলিত হইয়াছিল, স্ত্রীজাতির উপর তেমনই প্রগাঢ় ভক্তি জন্মিয়াছিল।"

বাংলায় বারো মাসে তেরো পার্বণ। যে দেশে ক্ষুধার তাড়নায় মরছে লক্ষ লক্ষ মানুষ, সে দেশে উৎসবে-পার্বণে কোটি-কোটি টাকা ব্যয়ের বিলাসিতা আশ্চর্য বৈকি। কিন্তু সেকালেও ভগবতী দেবী বলতে পেরেছিলেন, একদিনের পুজোয় এত খরচ না করে সেই অর্থ গাঁয়ের গরীবদের জন্য খরচ করার কথা। ভগবতী দেবী সেযুগের মানুষ হয়েও কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিঁড়ে বেরোতে পেরেছিলেন। 'দ্যার সাগর' ও সংস্কারব্ৰতী ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন সেই মায়েরই যথার্থ উত্তরসূরী।

বিদ্যাসাগরের প্রথম চাকরি হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে। সেকালে বিদেশী সিভিলিয়ানদের এদেশে কর্মক্ষেত্রে উঁচু পদে আসীন হতে হলে দেশী ভাষার পরীক্ষায় পাশ করতে হত। বিদ্যাসাগরকে এই পরীক্ষার পরীক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করার পর থেকেই এই পরীক্ষায় অকৃতকার্যের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে লাগল। কর্তৃপক্ষ তাঁকে পরীক্ষার নিয়ম একটু শিথিল করতে বললে তিনি অনমনীয় ভাবে উত্তর দেন, প্রয়োজনে চাকরি ছেড়ে দেবেন, কিন্তু অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে পারবেন না। এই ছিলেন বিদ্যাসাগর। অন্যায়ের সাথে কথনও আপোষ করেন নি৷ এমন তেজোদ্দীপ্ত ব্যক্তিত্ব এই বঙ্গদেশে প্রকৃতই বিরল।

এরপর তিনি সংস্কৃত কলেজে চলে এলেন। তিনি দেখলেন শিক্ষায় চরম বৈষম্য সেখানে। ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কারোর সংস্কৃত শিক্ষার অধিকার নেই। এই জঘন্য রীতি পরিবর্তন করে শিক্ষায় সমানাধিকার চালু করলেন তিনি। এখন থেকে শুধু ব্রাহ্মণ নয়, বৈশ্য-শূদ্ররাও পড়তে পারবে সংস্কৃত। শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতেরা ছেড়ে কথা বলল না; প্রতিবাদ করল তারা। এখানেও বিদ্যাসাগর মশাই নিজের সিদ্ধান্তে অটল। প্রশ্ন তুললেন, যদি রাধাকান্ত দেব সংস্কৃত পড়তে পারেন, ম্লেচ্ছ সাহেবরা সংস্কৃত পড়তে পারে, তাহলে শূদ্রদের সংস্কৃত পড়তে বাধা কোথায়? সবাই তখন চুপ। প্রকৃত মানুষ যিনি তিনিই পারেন জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠতে, মানুষকে মানুষের চোখে দেখতে, মানুষের মতো ভালবাসতে। বিদ্যাসাগর ছিলেন সেই প্রকৃত মানুষ। এই সংস্কৃত কলেজেই বিদ্যাসাগর শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারে ব্রতী হয়েছিলেন। ছাত্রদের শারীরিক শাস্তির বিরোধী ছিলেন তিনি। এ প্রসঙ্গে একটা ছোট্ট ঘটনা উল্লেখ করা যায় শঙ্খ ঘোষের 'বিদ্যাসাগর' থেকে, "একজন অধ্যাপক ছেলেদের শাস্তি দিয়েছিলেন দাঁড় করিয়ে রেখে। এ-রকম শারীরিক কষ্ট দেওয়া মোটেই দেখতে পারতেন না বিদ্যাসাগর। ছেলেবেলার সনাতন পণ্ডিতের পাঠশালা মনে পড়ে যায়। অধ্যাপক মশাইকে আড়ালে ডেকে বললেন, কী হে, তুমি যাত্রার দল খুলেছ নাকি? ছোকরাদের তাই তালিম দিচ্ছ? তুমি বুঝি দূতী সাজবে? ভারি লজ্জায় পড়ে গেলেন ভদ্রলোক।"

ছোটবেলায় বর্ণপরিচয় পড়েনি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বাংলা ভাষাকে ভাষার অকারণ কাঠিন্য থেকে বর্জিত করে তাকে সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন বিদ্যাসাগর। বাংলা বর্ণমালা থেকে দীর্ঘ 'ঋ' এবং দীর্ঘ '৯' বর্জন, বাংলা গদ্য সাহিত্যে যতি চিহ্নের প্রচলন ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যকে প্রাঞ্জল রূপ দিয়েছেন। তখন যে সাহিত্যিক বাংলা ভাষা প্রচলিত ছিল তা ছিল সংস্কৃতের প্রভাবে নীরস, দুর্বোধ্য এবং কাঠিন্যে পরিপূর্ণ। বিদ্যাসাগর প্রথম এমন এক গদ্যরীতির প্রবর্তন করেন যা সুমধুর, ছন্দবদ্ধ ও সুসংগঠিত। অনুবাদ সাহিত্যের পাশাপাশি আছে তাঁর মৌলিক রচনা- প্রভাবতী সম্ভাষণ।

বেতাল পঞ্চবিংশতি, সীতার বনবাস- এর মতো অনুবাদ সাহিত্যই হোক বা মৌলিক সাহিত্য- তাঁর রচনার পরতে-পরতে রয়েছে মানবতাবাদের জয়গান। তিনি সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন, ছাত্রদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হলে তাদের কুসংস্কারমুক্ত শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। সেই কারণেই 'সাংখ্য-বেদান্ত' এসব ভুল দর্শন বাদ দিতে হবে। 'আখ্যানমঞ্জরী'-তে শিশুদের চরিত্র গঠনের জন্য তিনি মাতৃভক্তি, পিতৃবৎসলতা, ন্যায়পরায়ণতা, দয়াশীলতা, অকুতোভয়তা, প্রত্যুপকার প্রভৃতি গুণাবলীসম্পন্ন ছোট-ছোট গল্প অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আখ্যানমঞ্জরীর প্রতিটি গল্পই বিদেশী গল্পের অনুবাদ। আসলে সেকালে জন্মেও তিনি সেকালের গোঁড়া ব্রাহ্মণদের মতো পাশ্চাত্য শিক্ষার বিরোধী ছিলেন না। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধনেই যে শিক্ষার সর্বোত্তম বিকাশ এবং প্রকাশ; তা বুঝেছিলেন তিনি।

একবার হিন্দু কলেজের প্রিন্সিপাল 'কার' সাহেবের সাথে দেখা করতে গেলেন বিদ্যাসাগর। তিনি দেখলেন সাহেব টেবিলে জুতো সুদ্ধ পা তুলে দিয়ে পাইপ টানতে-টানতেই চূড়ান্ত অভদ্র ভাবে কথা বললেন তাঁর সাথে। তিনি বুঝলেন এটা দেশীয় মানুষদের ইচ্ছে করে অপমান করা। বেশ কিছুদিন পর 'কার' সাহেবকে কোনও এক দরকারে আসতে হল বিদ্যাসাগরের কাছে। ঠিক একইভাবে বিদ্যাসাগর অভ্যর্থনা জানালেন তাকে, টেবিলের ওপর পা তুলে, হাতে হুঁকো নিয়ে। বিদ্যাসাগর সারাজীবন সসম্মানে মাথা উঁচু করে চলেছেন। ক্ষমতার কাছে মাথা নত করবেন এমন কাপুরুষ তিনি ছিলেন না।

ছোটলাট হ্যালিডে সাহেবের বাড়িতে মাঝে-মধ্যেই তাঁকে যেতে হতো নানা কাজে। উচ্চপদস্থ কর্তাদের অভ্যর্থনার জন্য তাঁকে বিদেশি পোশাক পরতে হত। এটাই ছিল দস্তুর। একদিন বিদ্যাসাগর সরাসরি জানিয়ে দিলেন হ্যালিডে সাহেবকে যে তাঁর পক্ষে আর বিদেশী পোশাক পরা সম্ভব হচ্ছে না। যে পোশাকে তিনি অভ্যস্ত এবং স্বচ্ছন্দ সেই পোশাক পরেই তিনি আসতে চান। হ্যালিডে সাহেবও সানন্দে তাঁর প্রস্তাবে সম্মতি দেন। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি গ্রহণ করার অর্থ যে স্বদেশী সংস্কৃতিকে বর্জন নয় তা তিনি দেখিয়েছেন। আজকের যুগে বিশ্বায়নের চাপে বাংলা ভাষা ও বহু ভারতীয় সংস্কৃতি লুপ্তপ্রায়। আমরা আজকাল ইংরেজি শিক্ষিত এমন বহু 'বাঙরেজ' দেখি যাদের বাংলা ভাষায় কথা বলতে লজ্জা করে। আসলে আমরা আজও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়েছি।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায় "বিদ্যাসাগরের কারুণ্য বলিষ্ঠ- পুরুষোচিত।" সেকালে মনে করা হত দয়া, করুণা এসব শুধুমাত্র স্ত্রীজাতির ভূষণ। পৌরুষের পক্ষে এসব দুর্বলতা। বিদ্যাসাগর শুধু স্ত্রীজাতির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন তাই নয়, তিনি সহমর্মীও ছিলেন। তাঁর নিজের কথায়,"আমি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী বলিয়া অনেকে নির্দেশ করিয়া থাকেন। আমার বোধ হয়, সে নির্দেশ অসঙ্গত নহে।... আমি পিতামহীদেবীর একান্ত প্রিয় ও নিতান্ত অনুগত ছিলাম। কলিকাতায় আসি, প্রথমত কিছু দিন, তাঁহার জন্য যার পর নাই উৎকণ্ঠিত হইয়াছিলাম। সময়ে-সময়ে তাঁহাকে মনে করিয়া কাঁদিয়া ফেলিতাম।" আসলে প্রকৃত পুরুষ তিনিই যার মধ্যে একদিকে যেমন থাকবে চারিত্রিক দৃঢ়তা, ন্যায়পরায়ণতা; অন্যদিকে তেমনই থাকবে কোমল হৃদয়, দরদী মন।

তখন উনবিংশ শতকের বঙ্গসমাজ বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহের মত কুপ্রথার নেশায় আচ্ছন্ন। সমাজের পঙ্কিলতা থেকে নারীদের উদ্ধার করার জন্য ইতিমধ্যেই ত্রাণকর্তা হিসাবে এগিয়ে এসেছিলেন এক সমাজসংস্কারক, রাজা রামমোহন রায়। তিনিই প্রথম সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলেন, যার ফলস্বরূপ ১৮২৯ সালে ব্রিটিশ সরকার সতীদাহ প্রথা রদ করার উদ্দেশ্যে আইন পাশ করে। তাঁরই পথ অনুসরণ করে-করে বিদ্যাসাগর বিধবা-বিবাহ প্রবর্তনে সচেষ্ট হন। দেখা গেল বিদ্যাসাগর রচিত বিধবা-বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না; সে বিষয়ক গ্রন্থ মুদ্রিত হতেই বাজারে হু হু করে তার বিক্রি বাড়তে লাগল। এর চাহিদা এতটাই ছিল যে চতুর্থ বার পর্যন্ত মুদ্রণের প্রয়োজন হয়েছিল। বহু সাধারণ মানুষ সেসময় চিঠি লিখে বিদ্যাসাগরের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, শাস্ত্রমতে তারা তাদের বিধবা কন্যাদের পুনরায় বিবাহ দিতে পারেন কি না। সমর্থন যেমন পেয়েছেন, তেমনই নিজেদের শাস্ত্রজ্ঞ বলে দাবি করেন এমন বহু ব্যক্তি বিদ্যাসাগরকে চোখ রাঙিয়েছে, বিধবা-বিবাহ চালু হলে সমাজ রসাতলে যাবে। শাস্ত্র থেকেই বিদ্যাসাগর উদাহরণ খুঁজে দেখিয়েছেন যে শাস্ত্রে বিধবা-বিবাহের অনুমোদন আছে। অবশেষে ইংরেজ সরকার বিধবা-বিবাহ সংক্রান্ত আইন পাশ করে ১৮৫৬ সালে। কিন্তু সংস্কার শুধু খাতায় কলমে সীমাবদ্ধ থাকলেই তো চলবে না, তাকে কার্যক্ষেত্রে রূপায়িত করার ব্যবস্থা করতে হবে। দেখা গেল, এতকালের গোঁড়ামি, সংস্কার ভেঙে বেরিয়ে আসার মতো সাহস কারোর নেই। চারিদিকে তখন বিদ্যাসাগরের শত্রু সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও আসছে। এমন অবস্থায় যারা তার পাশে ছিল তাদের অনেকেই ভয়ে পিছিয়ে গেল। শেষমেশ পাওয়া গেল এক পাত্র। তার নাম শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। মহা ধুমধাম করে সম্পন্ন হল প্রথম বিধবা-বিবাহ।

কিন্তু নিন্দুকেরা তাঁকে ভণ্ড বলতে লাগল। এতই যদি সংস্কার-ব্রতী হবেন, তবে নিজের ছেলের সাথে বিধবার বিয়ে দিচ্ছেন না কেন বিদ্যাসাগর? নিন্দুকদের মুখ বন্ধ হয়ে যায় ১৮৭০ সালে যখন তিনি তাঁর একমাত্র পুত্র নারায়ণ চন্দ্রের সাথে বিধবা ভবসুন্দরী দেবীর বিবাহ সম্পন্ন করেন।

একসময় বিদ্যাসাগর দক্ষিণবঙ্গের বিদ্যালয়গুলোর সহকারী ইন্সপেক্টর পদে নিযুক্ত হন। অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য তিনি নারীশিক্ষার প্রসারে ব্রতী হন। ১৮৪৯ সালে বেথুন সাহেব একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেন। বিদ্যাসাগর তার সেক্রেটারি পদে নিযুক্ত হন। বিদ্যাসাগর বেশ কিছু মডেল স্কুল গড়ে তোলেন। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিনি হুগলী, বর্ধমান, নদীয়া ও মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় পঁয়ত্রিশটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এইসব বিদ্যালয়ে ছাত্রী সংখ্যা ছিল প্রায় তেরোশো।

শেষ বয়সে তিনি সরকারী চাকরি থেকে স্বেচ্ছাবসর গ্রহণ করে সাঁওতাল পরগণায় সাঁওতালদের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করেন। শোনা যায়, সিপাহী বিদ্রোহের সময় অধ্যক্ষের বিনা অনুমতিতে সংস্কৃত কলেজকে সেনানিবাস হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এর প্রতিবাদে তিনি পদত্যাগ করেন। শেষ জীবনে তথাকথিত 'সভ্য জাতির' ভণ্ডামির চেয়ে তিনি সমাজের চোখে 'অসভ্য জাতি' সাঁওতালদের সহজ সরল জীবনযাপনের সাথে একাত্মবোধ করেছিলেন। আমরা তাঁর 'বর্বর-জাতির সৌজন্য' রচনার মধ্য দিয়ে তাঁর সেই একইরকম মানবতাবোধের পরিচয় পাই। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর সম্পর্কে যথার্থই বলেছিলেন,"The genius and wisdom of an ancient sage, the energy of an Englishman and the heart of a Bengalee mother."

তিনি ছিলেন নির্ভীক, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী। রবীন্দ্রনাথ 'বিদ্যাসাগর চরিত'-এ তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, "তিনি আপনার মধ্যে সত্যের তেজ, কর্তব্যের সাহস অনুভব করে ধর্মবুদ্ধিকে জয়ী করবার জন্যে দাঁড়িয়েছিলেন। এখানেই তাঁর যথার্থ মহত্ব।"

বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি। তা না হলে আজ বিদ্যাসাগরের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করার মত এ দেশে একজনও প্রকৃত মানুষ থাকবে না কেন? যে দেশে আজও জাতপাত নিয়ে দলাদলি, সে দেশে প্রায় এক শতাব্দী আগে সংস্কৃত শিক্ষায় ব্রাহ্মণদের একাধিপত্য দেখে এক দৃঢ়চেতা পুরুষ প্রশ্ন তুলেছিলেন, শিক্ষায় সকলের সমানাধিকার থাকবে না কেন? আজকের এই ক্রমক্ষয়িষ্ণু সমাজকে সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্য বিদ্যাসাগরেরই প্রয়োজন।
( সমাপ্ত )

তথ্যসূত্র :
বিদ্যাসাগর চরিত- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিদ্যাসাগর রচনাবলী: প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় খণ্ড
বিদ্যাসাগর: শঙ্খ ঘোষ

Next Bangla Article

All Bangla Articles    1    2    3    4    5    ( 6 )     7    8    9   


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717