Home   |   About   |   Terms   |   Contact    
RiyaButu
A platform for writers

কানামাছি


বাংলা উপন্যাস


All Bengali Stories    18    19    20    21    22    23    24    25    (26)     27      

শ্যামল বৈদ্য

Syamal Baidya
ত্রিপুরা সরকারের সলিলকৃষ্ণ দেববর্মণ পুরস্কারপ্রাপ্ত শ্রী শ্যামল বৈদ্য ত্রিপুরার একজন বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক। সময় সময়ে ওনার অনেকগুলি বই প্রকাশিত হয়েছে এবং পাঠকদের কাছে খুব সমাদৃত হয়েছে। ওনার লেখা দুটি উপন্যাস ক্রমপর্যায়ে আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হচ্ছে।


-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ আমাদের এই ওয়েবসাইট ( RiyaButu.com )-এ প্রকাশিত গল্পগুলির মধ্যে থেকে কিছু গল্প নিয়ে এবছরই প্রকাশিত হবে আমাদের 'রিয়াবুটু'র গল্প'।
--------------------------

কানামাছি
বাংলা উপন্যাস
লেখকঃ শ্যামল বৈদ্য, আগরতলা, ত্রিপুরা

Previous Parts: 1st Part     2nd Part     3rd Part     4th Part    



৫ম পর্ব

দুপুরের ব্যস্ত শহর। মোটরস্ট্যাণ্ডে এসে বসে রইলেন প্রকাশবাবু। লোকটা বলেছিল, আপনি এসে মোটরস্ট্যাণ্ড লক্ষীভাণ্ডার মুদি-দোকানের সামনে বসে থাকবেন, আমি এসে টাকাটা নিয়ে যাবো। লোকটা আরও বলেছিল, টাকাটা আপনি ভালো স্যুটকেস বা ভালো ব্যাগে করে আনার প্রয়োজন নেই একটা বাজারের থলেতে নিয়ে আসবেন। তার প্রতিটি নির্দেশ তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। লোকটা আরও বলেছিল, সব গুলি হাজার টাকার নোট নেবেন, - ছোটো নোট দিলে সে নেবে না। এটা কেন বলল লোকটা তা প্রকাশবাবু বুঝতে পারলেন না। হাজার টাকার নোটই হোক আর পাঁচশো টাকা তার দাবী অনুযায়ী টাকা পেলেই তো হল। সবচাইতে অবাক হয়েছিলেন প্রকাশবাবু যখন লোকটা দশ কেজি হাজার টাকার নোট চাইল! দশ কেজি মানে কত টাকা? এটা তিনি বুঝেছিলেন হাজার টাকার নোটগুলি ব্যাংক থেকে বাড়িতে এনে লুকিয়ে সেগুলি মেপে। বারবার মেপে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কেজিতে কত টাকার হাজার টাকা নোট লাগে। এতগুলি টাকা তার বউমাকে ফিরে পেতে ওদের হাতে তুলে দিতে এই ব্যবসায়ী মানুষটি বিন্দুমাত্র ঘাবড়ে যাননি। টাকা ইচ্ছে করলেই আবার তিনি ফিরে পেতে পারেন; কিন্তু ঘরের সন্মান, ঘরের লক্ষীকে এমন বিপদে ফেলে রাখতে পারেন না।

যে লোকটা প্রতিদিন সময় করে মাঝরাতে ফোন করতো তার উপর কেমন একটু ভরসা জন্মে গিয়েছিল প্রকাশবাবুর। তার কথাবার্তা যথেষ্ট ভদ্র এবং ভরসা করার মতো। সে সবসময় বলেছে, দেখুন বিপদে পড়ে এই খারাপ কথাটা আপনাকে আমার বলতে হচ্ছে। যারা আপনার বউমাকে তুলে নিয়ে গেছে তারা অত্যন্ত খারাপ লোক। আমাকে বাধ্য করছে তাদের হয়ে টাকাটা আপনার কাছ থেকে নিতে। আমি বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা এখন কেমন।

যে মানুষ এতটা বুঝে সে নিশ্চিত টাকা পেয়ে বেইমানী করবে না। তাছাড়া ক্রিমিনালদের নাকি কথার দাম থাকে। তারা কথা দিলে কিছুতেই অন্যের অনিষ্ট করে না। কথা মতো টাকাটা পেলেই ওরা মাধবীকে আজ ছেড়ে দেবে। কন্যাসম ছেলেবউয়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই প্রকাশবাবুর চোখটা ছলছল করে উঠল। কী নির্যাতনটাই না জানি তাকে সইতে হচ্ছে। তিনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন, হে ঠাকুর ওকে তুমি রক্ষা করো।

চায়ের ছেলেটাকে ডেকে এক কাপ চা নিলেন প্রকাশবাবু। এ-দিক ও-দিক তাকিয়ে তিনি নানান লোকের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করতে লাগলেন। কিন্তু কাউকেই তার সেই লোকটা বলে মনে হচ্ছে না। যাকে দেখছেন তাকেই ভাবছেন এই বোধ হয় সেই লোকটা। টাকাটা পাশে রেখে আর কতক্ষণ তিনি বসে থাকবেন এই দুপুরবেলা সেটাই ভাবছিলেন। এক এক সময় এক এক জন লোক আসছিল তার পাশে বসে চা খেয়ে আবার চলেও যাচ্ছে। তিনি আপন মনে নানান কথা ভাবতে ভাবতে সময় কাটাচ্ছিলেন। অনিরুদ্ধ এখন কথা বলছে, ডাক্তাররা বলেছে আর ভয়ের কিছু নেই। গত এক মাস ধরে উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগের নিরসন হল বটে কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিন্ত তিনি হতে পারছেন না। যে আঘাতগুলি তার শরীরে রয়ে গেছে তা সেরে উঠতে কতদিন লাগবে? আদৌ এই আঘাত সে মানসিকভাবে সম্পূর্ণরূপে কাটিয়ে উঠতে পারবে তো? শরীর ও মন দুটোই তার আজ তার বিপর্যস্ত। যে আশায় মানুষ ঘর বাঁধে তার কোনওটাই ছেলেটা এখনও পেল না। কী করে তিনি ফিরিয়ে দিতে পারবেন তার ছেলের জীবনে সুখ? প্রকাশবাবু মনে মনে ভাবলেন এবার তিনি নিজেই বউমা-র সাথে এ-ব্যাপারে কথা বলবেন, এর একটা শেষ হওয়া দরকার। ভাবনার মাঝেই প্রকাশবাবু হঠাৎ চমকে উঠলেন! তার পাশেই রাখা বাজারের থলেটা এখান থেকে উধাও। কে নিয়ে গেল এই থলেটা? বুড়ো মানুষটা আঁতকে উঠলেন! অন্য কেউ তার থলেটা নিয়ে পালিয়ে যায়নি তো? এখানে চীৎকার চেঁচামেচি করে কোনও লাভ নেই তাতে আরও সমস্যা বাড়তে পারে। তাই চুপচাপ রিকশা ধরে তিনি বাড়িতে ফিরে এলেন।

কে করল এমন কাজটা? সেই লোকটা টাকা নিয়ে যায়নি তো? হে ঠাকুর এ তো মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে গেল। কেন যে তিনি আবোল তাবোল ভাবতে লাগলেন বসে বসে? একটু খেয়াল রাখলে টাকাটা এমন হুট করে বেহাত হয়ে যেত না। রক্ষা স্ত্রী বাড়িতে নেই তাহলে তার সব উদ্বেগ স্ত্রী-র সামনে ধরা পড়ে যেত। তিনি যেন এখন সুতোর উপর দিয়ে টলমল পায়ে হাঁটছেন। যেকোনো সময় ওই সুতো ছিঁড়ে ধরমর করে পড়ে যেতে পারেন তিনি।

যাই হোক বিকেলে সেই লোকটা আবার ফোন করল। সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ করে তিনি টেলিফোন রিসিভার কানে তুললেন। ওপার থেকে যে ক-টা শব্দ ভেসে এল তা শুনে তিনি কেঁপে উঠলেন, আপনার টাকাটা আমরা পেয়েছি কাকু। আর এই একটা বাক্য শুনে প্রকাশবাবু যেন পরম শান্তি ফিরে পেলেন। যাক তাহলে টাকাটা সঠিক জায়গাতেই গিয়ে পৌঁছেছে। ক্রিমিনালদের অন্যায় ভাবে টাকা দিয়েও যে আনন্দ পাওয়া যায় সেটা তিনি আজ উপলব্ধি করতে পারলেন। সমস্ত বিপদ তাহলে কেটে গেলে, আজই তার বউমা তার বাড়িতে ফিরে আসবে। এমন ভালো দিন আর জীবনে আসবে বলে তার মনে হলো না। তার স্ত্রী বাড়িতে ফিরে আসতেই তিনি সংযত হয়ে গেলেন। সোজা বারান্দায় গিয়ে একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড়লেন। অপেক্ষা করতে লাগলেন, কখন ফিরে আসবে তার বউমা? বসে থাকতে থাকতে তিনি যেন অধৈর্য হয়ে উঠলেন। আবার আপন মনে ভাবতে লাগলেন এটা একটা কাজের কাজ করেছেন তিনি। কত ভেবেছিলেন এই নিয়ে, যে কী করে তাদের কাছে টাকাটা নিয়ে পৌঁছানো যায়? অথচ কত সহজভাবেই না টাকাটা ওরা নিয়ে গেল।

সবটা কাজ একা করে তিনি নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে এসেছেন, কাকপক্ষীতেও কিছু টের পায়নি। পেছনে কী হবে, কী হতে পারে এসব নিয়ে ভাবতে তার মন চাইছে না। জীবনে সবসময় পজিটিভ ভেবে এগোতে হয়, না হলে মানুষ সামনে যেতে পারে না। তবে সহদেববাবুর কথাগুলি তার কানে এখনও তেতো হয়ে লেগে রয়েছে। একটা মানুষ তার মেয়ে সম্বন্ধে এমন কথা বললেন কী করে? আজ বউমা ফিরে এলে তিনি তার বেয়াইকেও ছাড়বেন না। সবাই মিলে একটা মেয়ের পিছনে লেগে থাকার কোনও মানেই তিনি খোঁজে পাচ্ছেন না। যা হয় হবে পরে দেখা যাবে, এখন তিনি বারান্দায় ফুরফুরে মেজাজে বসে রইলেন। কারণ ওরা বলেছে টাকা পেলেই তারা তার বউমাকে ছেড়ে দেবে। এই কৃতিত্বটা তিনি আর কাউকে দিতে চান না, বউমা এলেই তাকে নিয়ে ছুটবেন নার্সিংহোমে। সমস্ত ভুল বোঝাবুঝি শেষ করে ফেলতে হবে তাড়াতাড়ি। মাধবী আর অনিরুদ্ধকে একটা সুখের সংসার যে করেই হোক তার ফিরিয়ে দিতে হবে। ফালতু অভিমান করে দুটোতে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। এসব ছেলেমানুষি এখনও কি তাদের সাজে? সময় চলে যাচ্ছে, একেকটা গাড়ি আসছে আর তিনি চমকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছেন! কিন্তু কোথায় কী, তার বউমা তো এখনও কোনও গাড়ি করে বাড়ি ফিরে এলো না! কোথায় মাধবী? সে তো ঘরে ফিরে আসছে না এখনও? রাত যত বাড়ছে ততই তার চঞ্চলতা বাড়তে লাগল। বারবার রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখেন আর নিজেই বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, কই বউমা তো ফিরে এলো না!

তিনি অস্থিরভাবে ঘর-বার করতে লাগলেন। তাহলে কি তিনি কিছু ভুল করে ফেরলেন? ওই ক্রিমিনালদের কথা বিশ্বাস করা তার ঠিক হয়নি? এমন একটা কাজ তিনি আবেগের বশে করে ফেললেন এখন কাউকে বলতেও পারছেন না। এই খবরটা যে জানবে সেই তাকে চেপে ধরবে। তাই তিনি অস্থিরভাবে পায়চারি করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলেন না। নীরবে তার স্ত্রী জয়া এসে দাঁড়ালেন পাশে।

কী হয়েছে তোমার?

চমকে ফিরে তাকালেন প্রকাশবাবু! যেন তিনি ধরা পড়ে গেছেন। কই কিছু নাতো?

ঘরবার করছো - গেটে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কারো অপেক্ষা করছো?

না না ভাবছিলাম, হঠাৎ বউমা যদি ফিরে আসে।

বউমা তো ফিরবে না। তোমার মাথায় এই সাধারণ বুদ্ধিটুকু নেই। সে তো তার প্রেমিকের সাথে পালিয়েছে। তুমি যে কী করে এত বড়ো ব্যবসা সামলেছো আমি সত্যি বুঝতে পারি না। এই মেয়েটা একটা দুঃশ্চরিত্রা, সে আর ফিরবে কেন? সে তার নাগরের সাথে পালিয়েছে।

সংযত শব্দের ব্যবহার করো জয়া। মাধবী তোমার পুত্রবধূ। আর এসব তোমার মিছে কথা, হিংসে, তুমি ওকে সহ্য করতে পারো না তাই বলো।

তোমার কাছে মুক্তিপণের টাকা চেয়েছে তো? দিয়েছো? দেখবে সেই টাকা যদি পায় তাহলে তারা এখান থেকে আরও দূরে কোথাও পালিয়ে যাবে। তোমার নায়িকা বউমাটি আর ফিরবে না কোনওদিন।

না না তা হবে না। আমার বউমা ফিরে আসবে।

এই আনন্দেই থাকো। তুমি ভাবছ আমি টাকা দেব এই মেয়ের মুক্তির জন্য? ওকে আমি পুলিসে দেব। ওর ফাঁসি হওয়া উচিত বাজে মেয়েছেলে কোথাকার। রাজরানি বানিয়েছিলাম আমরা ওকে আর সে কিনা এই প্রতিদান দিল? ছিঃ ছিঃ মেয়ে নামের কলঙ্ক এই মেয়ে।

তার স্ত্রী আরো অনেক কিছুই বকবক করে চলে গেছেন। কিন্তু তিনি আর সামনে এগোতে পারছেন না। তার সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে। রাত বাড়ছে আর তার আশঙ্কাও ক্রমশ বাড়ছে। তাহলে কি তার বউমা সত্যিই তাকে ঠকিয়েছে? প্রকাশবাবু ধপাস করে বসে পড়লেন। নিজের কাছে যা কিছু জমানো ছিল সব তুলে ওদের হাতে দিয়েছেন তিনি। ভেবেছিলেন যে, ঘরের আব্রু এই যাত্রায় হয়তো বেঁচে যাবে। কিন্তু এর ফল যে এত নিষ্ঠুরভাবে তার কাছে ফিরে আসবে তা তিনি ভাবতেই পারেননি।



৬ষ্ঠ পর্ব

বাঁচার জন্য মনটা ছটফট করে উঠল। সমস্ত খুশি তার মন থেকে উড়ে গেছে কর্পূরের মতো। এখন মৃত্যুভয় তাড়া করছে মাধবীকে। প্রতিটি রাত মানুষের চলাফেরা শেষ হয়ে গেলে তার বুকে জমে যায় বরফের মতো কিছু ভয়। আগে রাত হলেই ভাবতো তরুণ যদি আজ আসে খুব ভালো লাগবে আর এখন ভাবে তরুণ অন্তত আজ যেনো না আসে। আরও একটা দিন বেঁচে থাকতে তার ভালো লাগছে। ইচ্ছে করলে এই বাড়িটার সব মানুষকে চেঁচিয়ে জানিয়ে মুক্তি পাবার উপায় সে বের করতে পারবে। কিন্তু এখানেই সমস্যা হচ্ছে তার, নিজের সাথে যুদ্ধ করে কিছুতেই স্থির সিদ্ধান্তে যেতে পারছে না। এত কাণ্ডের পর সেই আবার ফিরে যেতে হবে অনিরুদ্ধ ও তার মা-র কাছেই। আর তারাই বা ওকে গ্রহণ করবে কেন? অনিরুদ্ধকে যখন মেরে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল তখন সে তো পাশেই দাঁড়িয়ে দেখছিল। অনিরুদ্ধকে বাঁচানোর কোনও চেষ্টা সে একবারও করেনি। অনিরুদ্ধ তো সে ঘটনা ভুলে যাবে না। এই যে অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে তার মনে তা কোনওদিন কোনও চেষ্টাতেই ঘোচানো যাবে না। সব কিছুই কেমন যেন ভুল হয়ে গেল। তবে যাইই হোক না কেন তাকে বাঁচতেই হবে, কিছুতেই তরুণের হাতে সে মরতে পারে না। তাকে মারতে পারে একমাত্র অনিরুদ্ধ কারণ যে পাপ সে করেছে তা তার স্বামীর বিরুদ্ধেই করেছে। স্বামীর যে কোনো অত্যাচার সে সহ্য করতে পারবে। কিন্তু তরুণ টাকার লোভে, বাঁচার লোভে কেন মারবে তাকে? যার জন্য মাধবী ঘরবাড়ি সব ছেড়ে বেরিয়ে এল তার হাতেই কিনা মরতে হবে তাকে? না না এটা সে কিছুতেই মনে নিতে পারছে না।

সিঁড়ি বেয়ে সেই শান্ত পায়ের শব্দটি নিচে নেমে আসছে। তার সাথে চঞ্চল আরও এক জোড়া ছোটো ছোটো পায়ের শব্দ। এটাই তার অদেখা অনামী বন্ধু অনামিকা। মাধবী আচমকা ডাকল সে পায়ের শব্দ অনুসরণ করে, অনামিকা -। সাথে সাথেই চারটে পায়ের শব্দ যেন থেমে গেল। ওরা কিছু বলাবলি করছে তখন। অবিকল একটা মানুষের ডাক শুনে তার হয়তো থমকে গিয়েছিল! কে ডাকল? দেয়াল তো কথা বলতে পারে না? থমকে গেল মাধবীও। এ কি করতে যাচ্ছিল সে? এত তাড়াতাড়ি তরুণের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলল? তরুণ কী বলেছে সে কথাগুলি আবার সে শোনার চেষ্টা করল নিজের মনে। এদিকে পায়ের শব্দ আবার চলতে শুরু করেছে। ওই অনামিকা তার সন্তানের হাত ধরে নিচে নেমে যাচ্ছে, সামনে এগিয়ে চলেছে। মাধবী ওই মানুষটাকে না দেখে না জেনে অনামিকা ডাকার কারণ রয়েছে অনেকগুলি। প্রথমত তার পা ফেলার তাল আর শব্দ একদম তার বন্ধু অনামিকার মতো। দুই, অনামিকা মানেই তো নামহীন কেউ তাই এর নাম অনামিকা। এখানে একা থাকতে থামতে এই অচেনা পদশব্দকেই সে যেন সারাদিন প্রত্যাশা করে। সকালে আর বিকালে দু-বার এই শব্দ সিঁড়িতে উঠানামা করে। তখন মাধবী নিজের মনেই নানান কথা বলতে থাকে ওই অচেনা নারীর উদ্দেশে। সারাদিন একা থাকতে গেলে এই উদ্ভট আচরণই যেন তাকে কিছুটা রিলিফ দেয়।

মাধবী হাঁপিয়ে উঠলেও তার মাথা এখনও ঠিক ঠাক কাজ করছে। সে এখনও একটা আশায় এখানে দিনরাত এক করে দিচ্ছে। তবে কতদিন এভাবে কাটাতে পারবে নিজেই জানে না। তার এখুনি ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। আর কতদিন নিজের সাথে লড়াই করে সে টিকে থাকতে পারবে সে জানে না। সারাটা দিন সে রাতের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে। রাত এলে মনে আতঙ্ক যেমন আসে তেমনি একটু শান্তিও আসে রাতের অন্ধকারে পেছনের জানালাটা সে খুলে রাখতে পারে। বড়ো বড়ো বাড়িগুলির আলো দেখে তার মনটা ভরে ওঠে। ওখানে কত বিচিত্র মানুষ তাদের সুখ, দুঃখ, ভালোবাসা আর কাজ নিয়ে বেঁচে আছে। মাধবী-র বাবা সবসময় বাচ্চাদের খেলতে দেখলে দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখতেন। মাধবী জিজ্ঞাস করলে বলতেন, বাচ্চাদের সংস্পর্শে থাকলে নাকি বয়সটা কমে যায়, অনেকদিন বেঁচে থাকা যায়। মাধবীও ওই বেঁচে থাকা মানুষগুলিকে দেখতে না পেলেও একেকটা অ্যাপার্টমেন্টের আলোর নিভে যাওয়া আর জ্বলে থাকা দেখে নিজেকে উজ্জীবিত করে। দূর থেকে ফেরিওয়ালাদের ক্ষীণ চিৎকার শুনে নিজেকে অনুভব করে।

এই জীবনটা তাকে উপহার দেবে বলে সে তো তরুণকে আপন করতে চায়নি। শুধু কী এই ক-টা দিনের অন্ধকার জীবন? তরুণ হয়তো তাকে লোহার গারদের ভেতরেও পাঠিয়ে দিতে পারে। সে নিজে বাঁচতে বা শাস্তি কম করতে তাকে ফাঁসিয়েও দিতে পারে। কেন যে সে আর কিছুতেই তরুণকে বিশ্বাস করতে পারছে না বরং মনে হয় এত অত্যাচার অসম্মানের পরও অনিরুদ্ধ তার কাছে থেকে দূরে সরে যায়নি। সব সময় মাধবী-র মন পেতে সে পাগলের মতো চেষ্টা করে যেত। মাধবী কি তাহলে জীবনে বড়ো বেশি ভুল করে ফেলল?

দরজায় নিচু খটখট শব্দ হতেই সে আবার চমকে উঠল! বাইরে তালা খোলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে তরুণ এসেছে। মুহূর্তে ছুড়িটা আবার কোমরে গুঁজে নিল মাধবী। না এখন আর কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। আস্তে দরজাটা খোলতেই তরুণ ভিতরে ঢুকে গেল। তরুণকে আজ এত বিধ্বস্ত লাগছে না। সে বেশ হাসি খুশি এবং রিলাক্স মেজাজে ঘরে এসে ঢুকল। ঘরে এসেই সে মাধবীকে বুকে জড়িয়ে ধরল। মাধবীর শরীরের মধ্যে ডুবে যেতেই যেন সে আজ উন্মাদ হয়ে আছে। সে মাধবীকে আদর করে বলল, ওহ মাধু তুমি কত ভালো! আর একটা কাজ করে দাও তাহলেই আমি হব পৃথিবীর সবচাইতে খুশি মানুষ।

কাজ! চমকে ফিরে তাকাল মাধবী। কী কাজ তরুণ?

কাজ! আমি কাজ বলছি তোমাকে? ওহ্, অবভিয়াসলি বিয়েটাও তো একটা কাজ।

হুঁ। তুমি কী আমাকে কিছু লুকোচ্ছ তরুণ?

সেকি তোমাকে লুকাবো কেন? তুমিই তো আমার সব।

মাধবী ওকে সরিয়ে দিয়ে বলল, এই ছাড়ো দেখি। কী ব্যাপার খুব মুডে আছো মনে হচ্ছে? গতদিন তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল তোমার উপর বোমা পড়েছে। আর আজ মনে হচ্ছে - কী ব্যাপার তরুণ কিছু ভালো খরব আছে?

এই তুমি আমাকে সন্দেহ করছো মাধু?

কেন তোমার এমন মনে হল?

না কথাগুলি একটু তেরছা লাগছে। এই মাধু শোনো না, অনেকদিন তোমার সাথে ভালো করে সময় কাটাইনি। আজ আমার তোমাকে চাই ডিয়ার।

কী হয়েছে সেটা আগে বল?

আরে না না তেমন কিছুই ঘটেনি সব আগের মতই আছে। তবে আমি ভেবে দেখেছি টেনশান করে আমাদের লাইফটা হেল্ করে লাভ নেই।

মাধবী হাসল! আচ্ছা অনিরুদ্ধ কেমন আছে এখন? সে কি মুখ খুলেছে পুলিসের কাছে?

হঠাৎ তরুণের চেহারাটা চেঞ্জ্ হয়ে গেল। অন্ধকারেও মাধবী বুঝতে পারল, এই অনিরুদ্ধ নামটা তরুণের কাছে সবসময়ই যন্ত্রণার। সে একটু সময় অস্থিরভাবে পায়চারি করে বলল, এই শালার কলজেটা সাংঘাতিক শক্ত বুঝলে, মরবে না। এত বড়ো ঘটনার পরও সে মরল না!

তরুণ একটু সময় চিন্তা করে আবার অস্থির হয়ে পড়ল। হঠাৎ সে লাফিয়ে উঠে বলল, এই মাধু তুমি রেডি হয়ে যাও তো আমরা বেরুব। গেট্ রেডি।

কোথায় যাবো?

তোমাকে একটা সিক্রেট্ জায়গায় নিয়ে যাবো।

কেন?

সারপ্রাইজ! তোমাকে ওখানে নিয়ে গিয়ে একটা সারপ্রাইজ দেব।

মাধবী সরে গিয়ে বলল, প্লীজ তরুণ আমার সাথে হেঁয়ালি করো না। এমনিই আমার মন-মেজাজ ভালো নেই। আজ প্রায় দু-মাস ধরে এই অন্ধকার ঘরে ফেলে রেখে দিয়ে গেছ। আমি এইরকম জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছি। মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলে ঘুরতাম আমি। একমাত্র আমার শাশুড়ি ছাড়া কেউ আমার লাগাম টেনে ধরতে পারেনি। শাশুড়ি অনেক লড়াই করেছে তারপরও আমি স্বাধীন ছিলাম। কিন্তু এ কী জীবন কাটাচ্ছি আমি? আমার একদম ভালো লাগছে না। আমি পাগল হয়ে যাবো। তুমি আর তালা দিয়ে যেও না আমাকে। তোমার হয়ে বাঁচব বলেই তো ঘর ছেড়েছি। তাহলে আমাকে ঘরে আটকে রাখছো কেন? আমাকে আটকে না রাখলে আমার মনটা ভালো থাকবে, আমি তাহলে মাঝে মাঝে লুকিয়ে ঘুরেও আসতে পারব।

তোমার কী হয়েছে বলতো মাধু? আজ একটু উল্টা সুরে গান ধরেছ। আমি কি এমনিই তোমাকে এখানে তালা দিয়ে যাই বলো? ফ্ল্যাটটা খোলা থাকলে সবাই ভাববে ভেতরে কেউ আছে। লক্ থাকলে সেটা ভাবার কোনও সম্ভাবনা থাকে না। সহজ কথাগুলিকে কেন জটিল করে তুলছো তুমি?

আমার মত অন্ধকার ঘরে পরে থাকো দু-মাস দেখবে পাগল হয়ে যাবে। আমরা কবে বেরুচ্ছি এখান থেকে? না তোমাকে আজ বলতেই হবে, আর কোনও বাহানা আমি শুনতে চাই না।

এখনও কিছু পরিষ্কার হয়নি। আরে ডার্লিং এসব নিয়ে তুমি এত উতলা হচ্ছ কেন? এই তো একদিন বেরিয়ে পড়ব।

মাধবী-র ভিতরটা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। তবু তরুণকে সে কিছুই বুঝতে দিল না। তরুণ তাকে বিছানায় ফেলে তার শরীর নিয়ে আবার মগ্ন হয়ে গেল। মাধবী-র যে খারাপ লাগছে তাও নয়, অনেকদিন পর একটা পুরুষের ছোঁয়া তার ভালো লাগছে। এই যে যৌবন তা কারও অপেক্ষায়ই তো দিন গুনছে অবিরাম। মনের মানুষটাকে খুঁজতে খুঁজতেই যে মাধবী ক্লান্ত হয়ে গেল। এই তরুণকেই তো চেয়েছিল সে তার মনের রাজা করতে। কিন্তু আজ কেন যেন মনে হচ্ছে সেই যোগ্যতা তরুণের নেই। ভালোবেসে মরে যাওয়ার মতো ছেলে তরুণ নয়। তার আচরণ আজ মোটেই ভালো লাগছে না। মাধবী যেন আর আগের মত সাড়া দিতে পারছে না, বাঁধনটাই কেমন আলগা হয়ে গেছে।

ফিরে যাবার সময় জিনিসপত্তর যা কিছু এনেছিল তা বুঝিয়ে দিল তরুণ। তারপর বলল, এই মাধু শোনো একটা ইমপোর্টেন্ট কথা আছে তোমার সাথে।

বলো।

আমি সিরিয়াস। আগামীকাল কিন্তু তোমাকে অন্য একটা জায়গায় শিফট্ করতে হবে। আর কোথাও যেতে হবে না তোমাকে প্রোমিজ। দিস ইজ দা এণ্ড। এই বাড়িটা পুলিসের নজরে এসে গেছে, যেকোনো সময় পুলিস এই বাড়িতে রেড্ করতে পারে।

ভয়ে মাধবী-র মুখটা কালো হয়ে গেল। দিস ইজ দা এণ্ড। তার মানে ফ্ল্যাটে মানুষের আনাগোনায় তার অসুবিধে হচ্ছে, তাই ওকে শেষ করতে নির্জনে নিয়ে যেতে চাইছে ? এই ছেলেটার প্রতিটি কথা তার কাছে দুর্বোধ্য আর ছলনা মনে হয় এখন। কেন তরুণ আজ এত খুশি? গতদিন তো তার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল হতাশার চূড়ান্ত স্তরে সে পৌঁছে গেছে। আর আজ? অবস্থার তো তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি? তাহলে কেন? তার মনে নিশ্চিত কোনও মতলব আছে। না আর পারা যাচ্ছে না, এবার একটা কিছু করতেই হবে।

দূরের ওই অ্যাপার্টমেন্টগুলির আলো এখন নিভে গেছে। জানালা দিয়ে হিমেল হাওয়া আর তাজা বাতাস ছুটে আসছে। মাধবীর চোখ বেয়ে টলটল করে জল পড়তে লাগল। মানুষ তার আবেগের কাছে হেরে যায় বটে, কিন্তু আবেগ আর বাস্তব এক নয়। যে স্বপ্ন মাধবী তরুণকে নিয়ে দেখেছিল তা কাল্পনিক ছিল। তার বাবা আর অনিরুদ্ধ-র বিরুদ্ধে জেদ মেটাতেই সে এত বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বাস্তবে তরুণ মুখে অনেক মিঠে মিঠে কথা বললেও কল্পনার মত এত সুন্দর নয়। তার চাইতে অনেক অনেক ভালোছেলে অনিরুদ্ধ। বিয়ের পর একটা পুরুষকে এতটা অবহেলা করলে কোনও পুরুষ কি মেনে নিত? অথচ অনিরুদ্ধ তার ইচ্ছের এক ফোটা অমর্যাদা করেনি। তাকে পুরো সম্মান দিয়েছে, তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে একটি পা-ও এগোয়নি। এমনকি এত বড়ো ঘটনার পরও সে তার স্ত্রী-র বিরুদ্ধে কোনও স্টেটমেন্ট দেয়নি।

দূর আকাশে আর কোনও চাঁদ দেখা যাচ্ছে না আজ। তবুও তারাদের আলো ছড়িয়ে আছে আকাশ জুড়ে। সে আকাশ থেকে যেন এক প্রতিধ্বনি তার দিকে ছুটে আসছে হু হু করে, তোমার ডেস্টিনি কোথায় মাধবী? তোমার ডেস্টিনি কোথায়? নিজের কান দু-হাতে চেপে ধরল সে। এই তীব্র তীক্ষ্ণ আকাশবাণী সে আর সহ্য করতে পারছে না। না অনিরুদ্ধের কাছে আর ফিরে যাওয়ার কোনও উপায় নেই। অনিরুদ্ধ তাকে ক্ষমা করে দিলেও আর কোনওদিন আপন করে নেবে না। তার মনের মধ্যে এক অপরিসীম ঘৃণা সঞ্চিত হয়ে আছে। সে আর কোনওদিন বসু বাড়ির বউ হয়ে ফিরে যেতে পারবে না। বুক ভরা কান্নায় রাতের তারারা নীরব সাক্ষী হয়ে অবাক হয়ে তাকিয় রইল, তাহলে জীবনে এত ভুল কেন করল মাধবী? কিসের আশায় কিসের ভরসায় সে সবকিছু হেলায় ছেড়ে নিজেকে এমন নিঃস্ব করে দিল?

তরুণ কাছে এসে দাঁড়াল। অন্ধকারেও তাকে অনুভব করতে পারছে মাধবী।

শোনো মাধু, আমি সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করে ফেলেছি। আমরা এখান থেকে অনেক দূরে কোথায়ও পালিয়ে যাবো।

তুমি আর স্বপ্ন দেখিও না আমাকে। এই বিপদ থেকে কী করে রক্ষা পাবে তাই বলো?

তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছো না?

না। এই অন্ধকার ঘরে পরে থেকে থেকে আমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে।

আমি বুঝতে পারছি মাধু।

তুমি বরং আমাকে ছেড়ে দাও, দেখবে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

কী করে?

আমি যদি এখন ফিরে গিয়ে বলি, অনিরুদ্ধকে মেরে আমাকে জোর করে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল কিছু দুষ্কৃতকারী, দেখবে সবাই বিশ্বাস করবে।

যদি জানতে চায় কারা নিয়ে গিয়েছিল তোমাকে? কোথায় নিয়ে রেখেছিল ?

আমি বলবো ওই লোকগুলিকে আমি চিনিনা। তাছাড়া হাত বেঁধে কোথায় এক অন্ধকার ঘরে ফেলে রেখেছে আমি বুঝতে পারিনি।

আর আমাদের বিয়ে-সংসার?

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল মাধবী। এবার কী বলবে সে নিজেই ভাবতে লাগল। যে লোভে সে এত সব কাণ্ড করল সে কাজেই তার অনীহা দেখে তরুণও অবাক হয়ে গেল।

তরুণ বলল, যদি ফিরেই যাবে ভেবেছিলে তাহলে এসবের কোনও মেনে আছে কী? যেতে চাইলে তুমি যেতে পারো আমি আটকাবো না। তুমি আরও ক-টা দিন ভেবে বলো। আমি ক-দিন পরেই আবার ফিরছি।


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717
Next part

Previous Parts: 1st Part     2nd Part     3rd Part     4th Part    

All Bengali Stories    18    19    20    21    22    23    24    25    (26)     27