Home   |   About   |   Terms   |   Library   |   Contact    
A platform for writers

শচীনকর্তার সংগ্রামের ফসল

Bangla Article

-------- বিজ্ঞপ্তি ----------
■ আমাদের এই ওয়েবসাইট ( RiyaButu.com )-এ প্রকাশিত গল্পগুলির মধ্যে থেকে কিছু গল্প নিয়ে এবছরই প্রকাশিত হবে আমাদের 'রিয়াবুটু'র গল্প'।
--------------------------

All Bangla Articles    1    2    3    4    5    6    7    8    9    ( 10 )     11   

শচীনকর্তার সংগ্রামের ফসল
( 31 October 1975; শচীনকর্তার মৃত্যুবার্ষিকীতে উনার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য )
লেখক - শিলাজিৎ কর ভৌমিক, ধলেশ্বর, আগরতলা


sachin devbarman
## শচীনকর্তার সংগ্রামের ফসল:

লেখক - শিলাজিৎ কর ভৌমিক, ধলেশ্বর, আগরতলা

১৯২৪ সালে শচীনকর্তার জীবনে শুরু হল এক নতুন পর্ব। বাবা নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মণ উচ্চশিক্ষার জন্যে পুত্রকে কলকাতায় নিয়ে এলেন। ইচ্ছে ছিল, পুত্র ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর হবে। প্রথমদিকে, শচীনকর্তার মন কেমন করত ত্রিপুরার জন্যে। কেননা, তখন তিনি ত্রিপুরার নদ-নদী, জল-জলা, পাহাড়-জঙ্গল থেকে বিচ্ছিন্ন। এতদিন ত্রিপুরার এই সুন্দর প্রকৃতির সঙ্গেই নিজের জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই, ইংরেজ আমলের জমকালো কলকাতা শহরে তিনি এক আগন্তুক হয়ে উঠেছিলেন।

সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করা, অধ্যাপকদের গুরুগম্ভীর তত্ত্ব আলোচনা, বিকেলে লাইব্রেরি যাওয়া – সব মিলিয়ে মানসিকভাবে ক্লান্ত শচীনকর্তা ঠিক করলেন গান শিখবেন। গেলেন অন্ধ-গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কাছে। গুরুর যত্ন ও শিষ্যর নিষ্ঠা – কোনোটারই অভাব নেই। শিষ্য আবার টেনিস অনুরাগী। প্রত্যেকদিন ওয়াই.এম.সি.এ-তে প্র্যাকটিস করতে যেতেন। ফলত, ঘেমে গরম-ঠাণ্ডা লেগে গলা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। গুরু নির্দেশ দিলেন, টেনিস ছাড়তে হবে। শিষ্যও এক কথায় খেলা ছাড়লেন।

একবছর পরে এম.এ পড়া ছাড়লেন। ছেলে কৃষ্ণচন্দ্র দে ও ওস্তাদের কাছে গান শিখছে, শহরের সব নামী জলসায় উপস্থিত হচ্ছে – এসবে নবদ্বীপকর্তার আপত্তি ছিল না। কিন্তু ছেলে পড়াশোনা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে, সেটা বাবার মনঃপুত ছিল না। কলকাতায় এসে ছেলেকে অনেক বুঝিয়ে আইন কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলেন। কিন্তু গানের নেশা শচীনকর্তার মস্তিষ্ককে এমনভাবে গ্রাস করেছিলে যে কিছুদিন পর তিনি আইন কলেজও ছেড়ে দিলেন। বেছে নিলেন সঙ্গীত জগতের এক অনিশ্চিত জীবনকে।

১৯৩১ সালে শচীনকর্তার জীবনে নেমে এল অন্ধকার। তাঁর বাবা প্রয়াত হলেন। বাবাই ছিলেন তাঁর বন্ধু, আদর্শ, পৃষ্ঠপোষক, পথপ্রদর্শক। মাথার উপর এক বটবৃক্ষ চলে গেল। শুরু হল জীবন সংগ্রামের এক নতুন অধ্যায়। বাড়ির সবার পরামর্শ অগ্রাহ্য করে কলকাতায় থেকে যাওয়ার পরিণাম ভোগ করতে হল। ত্রিপুরা প্যালেস ছেড়ে তিনি আশ্রয় নিলেন ভবানীপুরে চিত্রশিল্পী রসময় ভট্টাচার্যের বাড়িতে। সেখানে তিনি সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তাঁর এই 'simple living, high thinking' মনোভাবকে মেনে নিতে পারেন নি ত্রিপুরা রাজপরিবারের আত্মীয়স্বজন। বরং, তাঁরা এটিকে রাজপরিবারের আত্মসম্মানের উপর অপমান বলে গণ্য করলেন। বন্ধ হল ত্রিপুরা রাজকুমারদের প্রদেয় মাসিক ভাতা 'দরমাহা'। অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে তিনি গানের টিউশনি শুরু করলেন।

কিছুদিনের মধ্যেই রেডিওতে ১৫ মিনিটের প্রোগ্রাম করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেখানে নিজের সুর সংযোজনায় দুটি গান গেয়ে দশ টাকা পেয়েছিলেন পারিশ্রমিক হিসেবে। এ ছিল তাঁর কাছে পরম তৃপ্তি। এরপর তিনি বুঝেছিলেন যে কলকাতার বিদগ্ধ সঙ্গীতমহলে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে, তাঁকে নিজস্ব একটা ঘরানা তৈরী করতে হবে। সে কারণে, বন্ধু হেমেন্দ্রকুমার রায়কে বললেন, সেই ধরনের কিছু গান লিখতে। নিজেই সেসব গানে সুর দিলেন। প্রথমে সেসব গান হিজ মাস্টার্জ ভয়েজে গাওয়ার চেষ্টা করলেন। রিহার্সাল শুনে বাতিল করা হল তাঁকে। বলা হল, অনুনাসিক মেয়েলি কণ্ঠ বলে শ্রোতারা তাঁকে গ্রহণ করবে না।

এরপর হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টসের দরজায় কড়া নাড়লেন। মালিক চন্ডিচরণ সাহা রাজি হলেন। ১৯৩২ সাল। 'ডাকলে কোকিল' ও 'এ পথে আজ'-এই দুই নিজস্ব সুরারোপিত গানের দ্বারা আত্মপ্রকাশ করলেন সুরকার ও গায়ক শচীন দেববর্মণ।

এরপর বন্ধু হেমেন্দ্রকুমার রায় কলকাতার বিখ্যাত থিয়েটার জগতের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিলেন। সেই কারণে, শচীনকর্তা 'সতীতীর্থ' ও 'জননী' নাটকে সুর দিয়ে জয় করে নিলেন বহু জ্ঞানী গুণী নাট্য-ব্যক্তিত্বের মন। নরেশ মিত্র, অহীন্দ্র চৌধুরী, শিশির ভাদুড়ী সহ নাট্য জগতের অনেক বিদগ্ধ ব্যক্তির মন তিনি জয় করেছিলেন। ছবি বিশ্বাস, জহর গাঙ্গুলী, মধু বসু প্রমুখ চলচ্চিত্র তাঁর বন্ধু হলেন। মধু বসুর অনুরোধে 'সেলিমা' ছায়াছবিতে একটি ছোট ভূমিকায় তিনি অভিনয়ও করে ফেলেছিলেন।

তারপর একের পর এক রেকর্ড। প্রতি মাসেই। অজয় ভট্টাচার্য, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শৈলেন রায় প্রমুখের লেখা গানে তিনি খ্যাতির শিখরে উঠতে লাগলেন। যখন আস্তে-আস্তে তিনি নিজেকে গুছিয়ে নিলেন, তখন পালিত স্ট্রীটের এক কামরার বাড়ি ছেড়ে তিনি ১এ বসন্ত রায় রোডে দুই কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নিলেন। একটা ঘরে থাকা খাওয়া, অন্য ঘরে সঙ্গীত শিক্ষার বিদ্যালয় – 'সুর মন্দির'। প্রচুর ছাত্রছাত্রীর সমাগম।

তবে সবকিছুর মধ্যে একটা ব্যাপারে শূণ্যতা রয়েই গেল। বাংলা আধুনিক গানের এক একটা রেকর্ড বেরোলেই শচীনকর্তা সাফল্য পেতেন ঠিকই। কিন্তু বাংলা ছায়াছবিতে সুর দিয়ে সেই সাফল্য পেলেন না। সেকালের প্রখ্যাত গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, "বাংলা 'ছদ্মবেশী', 'জজ সাহেবের নাতনি' এমন দু-একটি ছবি ছাড়া কোনও ছবির গানই তেমন হিট করেনি।"

১৯৪২ সালে শচীনকর্তা মুম্বাই থেকে রঞ্জিত স্টুডিওর মালিক চন্ডুলাল শা-র আমন্ত্রণ পেলেন সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে। কিন্তু ততদিনে বাংলা মায়ের সঙ্গে তাঁর এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাই সেই আমন্ত্রণ তিনি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু পরিস্থিতি পরিবর্তন হওয়ার পর ১৯৪৪ সালে মুম্বাই থেকে দ্বিতীয়বার আমন্ত্রণ এলে তিনি গঙ্গা থেকে আরবসাগরে চলে গেলেন। এবং সেই আমন্ত্রণটি ছিল 'ফিল্মিস্তান'-এর কর্ণধার শশধর মুখার্জি এবং অবশ্যই চন্ডুলাল শা-র তরফ থেকে।

শচীনকর্তার সর্বপ্রথম সুরারোপিত হিন্দি ছায়াছবি ছিল 'শিকারী'। নায়ক সবার প্রিয় দাদামণি অশোককুমার। ছবির সুর আর গান ভালোই প্রশংসিত হয়েছিল পত্রপত্রিকায়। এরপর ফিল্মিস্তানের আরও পাঁচটি ছবিতে সুর দিয়েছিলেন শচীনকর্তা। এর মধ্যে 'শবনম' ছবির সবকটি গান হিট হয়ে গেল। কিন্তু তাতে ভিন্ন মনোভাবের পরিচালক শচীনকর্তা সন্তুষ্ট নন। চলচ্চিত্র জগতের বোদ্ধারা প্রশংসা করলে কি হবে? তাঁর মতে, সাধারণ মানুষ তাঁর সুরারোপিত গান গুণগুণ করে গাইলেই তিনি বুঝবেন যে তিনি সুরকার হিসেবে সফল। এ বিষয়ে বিস্তারিত ভাবে বলতে গেলে, তখন মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্র জগতে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে রাজত্ব করছিলেন নৌসাদ, শ্রীরামচন্দ্র, অনিল বিশ্বাস ও সাজ্জাদ হোসেন প্রমুখ। ভারতীয় সঙ্গীতের প্রধান ধারা 'মেলোডি' ছিল তাঁদের সুরসৃষ্টির প্রেরণা। শচীনকর্তা বুঝেছিলেন যে ছায়াছবির গান আমজনতার বিনোদনের স্বার্থের জন্যে হওয়া উচিত। সাধারণ মানুষের গান ভালো লাগলেই গান জনপ্রিয় হয়, এবং তাতেই এক সঙ্গীত পরিচালক জাতে উঠে। কাজেই মুম্বাই চলচ্চিত্রের সুরের ধারা থেকে সরে এলেন ত্রিপুরার সন্তান শচীন দেববর্মণ।

১৯৪৮ সালে কর্তার পরিচয় হয় দেব আনন্দের সঙ্গে। কর্তার গানের রীতিমতো ফ্যান ছিলেন দেব সাহেব। তিন ভাই – বড় চেতন আনন্দ, মেজো দেব আনন্দ, ছোট বিজয় আনন্দ। সন্ধ্যাবেলায় কর্তা এঁদের বাড়িতে নিয়মিত আড্ডা মারতে যেতেন। সেখানে আসতেন গুরু দত্তও। দেব আনন্দের উদ্যোগে এক নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরী হল – নাম 'নবকেতন'। প্রথম ছবির নাম 'অফসর'। পরিচালক চেতন আনন্দ। ১৯৪৯ সালে তৈরী ছায়াছবিটি ভালো চলল না। এরপর নবকেতনের ব্যানারে তৈরী হল দ্বিতীয় ছবি 'বাজি'। পরিচালক গুরু দত্ত। সেই ছবির সব গান হিট। একটি গান সুপারহিট। সেই গানটি কর্তা গজল ও পাশ্চাত্যের সুর মিশিয়ে তৈরী করেছিলেন। গানটি ছিল 'তদবির সে বিগড়ি হুয়ি তকদির বনালে'। গানটি গেয়েছিলেন গীতা রায়। সেই গান লোকের মুখে-মুখে ঘুরছিল। এরপর থেকে কর্তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি একের পর এক ছবিতে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে বাজিমাত করা শুরু করেছিলেন। এদিকে, 'বাজি' ছায়াছবির জন্যে গুরু দত্ত এক নামী পরিচালক হয়ে গেলেন। গীতা রায় হয়ে গেলেন নামী গায়িকা, এবং পরিচালককে বিয়ে করে তিনি হয়ে গেলেন 'গীতা দত্ত'। ছবির নায়ক-নায়িকা দেব আনন্দ ও গীতাবালি খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে গেলেন।

এ হল কর্তার জীবনসংগ্রামের কাহিনী। তিনি রাতারাতি 'সুরসম্রাট' হননি। অনেক ত্যাগ, অধ্যবসায় ও সাহস সঞ্চয় করে লড়াই করার পর তিনি সাফল্যের শ্রেষ্ঠ আসনটি পেয়েছিলেন। 'বাজি' ছবিতে সুর দিয়ে তিনি কার্যত জীবনের প্রথম বাজিমাত করেছিলেন, এবং কাকতালীয় ভাবে, 'তদবির সে বিগড়ি হুয়ি তকদির বানালে' গানটি তাঁর জীবনদর্শনের সঙ্গে মিলে গেছে। কেননা, গানটির অন্তর্নিহিত অর্থ হল, 'কৌশল দিয়ে নিজের পোড়া কপালকে জয় কর'। তাই তো, শচীনকর্তা মুম্বাই সঙ্গীত জগতের প্রথাসিদ্ধ সুরের ধারা থেকে বেরিয়ে এসে নিজস্ব ঘরানা তৈরী করে সেটিকে আমজনতার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার কৌশল অবলম্বন করে নিজের পোড়া কপালকে জয় করলেন।
( সমাপ্ত )

(তথ্যসূত্র: কুমার শচীন দেববর্মণ – জন্মশতবার্ষিকী স্বারক গ্রন্থ – সম্পাদনা: ত্রিপুরা সরকার)


Next Bangla Article

All Bangla Articles    1    2    3    4    5    6    7    8    ( 10 )     11   


## Disclaimer: RiyaButu.com is not responsible for any wrong facts presented in the Stories / Poems / Essay / Articles / Audios by the Writers. The opinion, facts, issues etc are fully personal to the respective Writers. RiyaButu.com is not responsibe for that. We are strongly against copyright violation. Also we do not support any kind of superstition / child marriage / violence / animal torture or any kind of addiction like smoking, alcohol etc. ##


◕ RiyaButu.com, এই Website টি সম্পর্কে আপনার কোনও মতামত কিংবা পরামর্শ, কিংবা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় আমাদের বলুন। যোগাযোগ:
E-mail: riyabutu.com@gmail.com / riyabutu5@gmail.com
Phone No: +91 8974870845
Whatsapp No: +91 6009890717